মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৯
নুজাইফা নূন
” সিজদা চোখের পানি মুছে সাইফানের জন্য পরোটা ডিম ভাজি, ফলের জুস করে রুমে নিয়ে আসে। কিন্তু সাইফান কে রুমে পায় না।সিজদা সাইফানের খোঁজে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কর্কশ শব্দে সাইফানের ফোন বেজে উঠে।সিজদা ব্যাপার টা আমলে নেয় না। কিন্তু বারবার কল আসছে দেখে সিজদা ভাবে হয়তো হালিমা মঞ্জিল থেকে কল করা হয়েছে।সিজদা এগিয়ে এসে কল রিসিভ করতেই বুক ধুক করে উঠে তার।কেউ তার হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোন কেড়ে নেয়।যার দরুন ভয় পেয়ে যায় সিজদা।সিজদা তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে দেখে তার হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নেওয়া ব্যক্তিটা আর কেউ নয়।তার বিয়ে করা বর সাইফান।সিজদা বিষ্ময় নয়নে সাইফান কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।সে সাইফান কে সন্দেহ করতে চায় না। কিন্তু সাইফানের কর্মকান্ডে সিজদার মনে সন্দেহের দানা বাঁধে।সাইফান কথা বলা শেষ করে রুমে প্রবেশ করতেই সিজদা তেজি কণ্ঠে বললো,
-” কে ফোন করেছিলো? যার জন্য আপনি আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন?আমাকে কথা বলতে দিলেন না।আমি কথা বললে আপনার খুব বেশি সমস্যা হয়ে যেতো বুঝি?”
-” তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো? তোমার কি মনে হয় আমার ওয়াইফ বা গার্লফ্রেন্ড ফোন করেছিলো?”
-” এ বাবা! আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম কে ফোন করেছে?আপনি আমার স্বামী।আপনার সব কিছুর উপর অধিকার আছে আমার।যদিও আমি আপনার ফোন ধরতে চায় নি। কিন্তু বারবার কল আসছিলো দেখে রিসিভ করেছিলাম।আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি আর কখনোই আপনার কোনো জিনিসে হাত দিবো না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” সাইফানের বুঝতে বাকি রইলো না যে সিজদার মনে ধীরে ধীরে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।সাইফান পেছন থেকে সিজদা কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-” আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার বউয়ের অভিমান হয়েছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না।আমার খুবই ক্লোজ ফ্রেন্ড রবিন কল করেছিলো।প্রথমত রবিন জানে না আমি বিয়ে করেছি। তুমি কথা বললে রবিন আমার বিয়ের ব্যাপারে জেনে যেতো।ওকে না বলে বিয়ে করেছি জানলে রবিন খুব কষ্ট পেতো। দ্বিতীয়ত আমি চাই নি আমার বউয়ের এমন মিষ্টি কণ্ঠ অন্য কোন পুরুষ কর্ণকুহরে প্রবেশ করুক।আমি একাই আমার বউয়ের মিষ্টি কণ্ঠ শুনবো।অন্য কোন পুরুষ আমার বউয়ের মিষ্টি কণ্ঠ শুনে যদি তার প্রেমে পড়ে যায়? সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না তাই না?”
-” সাইফান এমন মিষ্টি আলিঙ্গন, মধু মিশ্রিত কথা শুনে সিজদার সমস্ত রাগ অভিমান যেন মূর্ছা যায়।সিজদা ও পেছন ঘুরে সাইফান কে জড়িয়ে ধরে।।
-” যমুনা মির্জার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
ব্লাডের জন্য কোথাও দৌড়াদৌড়ি করতে হয় নি।
আরাফাত, আব্দুলা, সাকিব নামের
তিন জন ছেলে স্বেচ্ছায় তিন ব্যাগ ব্লাড ডোনেট করেছে।তারা যখন ব্লাড দেওয়ার কথা বলে তখন সারজিস একটু অবাক হয়েছিলো । কিন্তু পরে ছেলেগুলো জানায় ,
তাদের মা বাবা কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই তারা এতিমখানায় বড় হয়েছে।যমুনা মির্জা কে তারা ছোট থেকেই মা ডেকে এসেছে।আজ থেকে কয়েক বছর আগে যমুনা মির্জা কে তারা রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হসপিটালে এডমিট করেছিলো। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর তার পূর্বের কোনো কথায় মনে ছিলো না। এমনকি তার নিজের নাম টা পর্যন্ত মনে ছিলো না।ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেগুলো কি করবে বুঝতে না পেরে যমুনা মির্জা কে এতিম খানায় নিয়ে যায়। যমুনা মির্জাকে এতিম খানার রান্না বান্নার কাজে নিযুক্ত করা হয়। এতিম খানার সব বাচ্চারাই যমুনা মির্জা কে মা বলে সম্বোধন করে।তিনি ও নতুন পরিচয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়। এভাবেই কেটে যায় কয়েক বছর। এতিমখানার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো বড় হয়ে যায়।
যমুনা মির্জার ও বয়স বাড়ে।সেই সাথে বাড়ে শরীরের অসুখ। স্থানীয় ডক্টর তাকে শহরে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেন। আরাফাত, আব্দুলা ,সাকিব তারা তিন জন যমুনা মির্জা কে নিয়ে শহরে আসে।তারা গাড়ি থেকে নেমে যমুনা মির্জা কে একটা জায়গায় দাড় করিয়ে ডক্টরের চেম্বার কোথায় জানার জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু ফিরে এসে যমুনা মির্জা কে পায় না।তিনি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝখানে চলে আসেন।এ শহরের সব কিছু যেন পরিচিত মনে হয় তার। পুরোনো কিছু আবছা স্মৃতি মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে।চোখে মুখে অন্ধকার হয়ে আসে তার।মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।তখনি একটা ট্রাক এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।তিনি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যান। ভাগ্যক্রমে সারজিস সেই রাস্তা দিয়ে আসছিলো।যার দরুন এতো গুলো বছর পরেও মায়ের দেখা পেয়েছে।”
-” ৪৮ ঘন্টা পরে যমুনা মির্জার জ্ঞান ফিরেছে।তার ফিরে আসার সংবাদে হালিমা বেগম, ফারুক মির্জা ও ছুটে এসেছেন।চোখ মুখে খুশির ছাপ লেগে রয়েছে।কিন্তু তার স্ত্রীর মুখোমুখি হবার সাহস নেয় তার। যমুনা মির্জা চোখ খুলতেই তার সামনে সারজিস কে দেখতে পায়। এতো গুলো বছর পরেও নিজের নাড়ী ছেঁড়া ধন কে চিনতে অসুবিধা হয় না যমুনা মির্জার।তিনি বাবু বলে সারজিস কে জড়িয়ে ধরে চোখে মুখে অজস্র চুমু তে ভরিয়ে দেন।সারজিস ও মায়ের আদর ভালোবাসা পেয়ে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।এ কান্না যে দুঃখের কান্না নয়।এ কান্না সুখের কান্না। প্রিয়জন কে ফিরে পাবার কান্না।”
-” দেখতে দেখতে গত হয় কয়েক টা দিন। যমুনা মির্জা কে হালিমা মঞ্জিলে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু তার কন্ডিশন ভালো নয়।দুটো কিউনিই বিকল হয়ে পড়েছে তার।সারজিস তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে যমুনা মির্জা কে সুস্থ্য করে তোলার।তাকে একটা সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার। যমুনা মির্জাও ভেতরে কষ্ট চেপে রেখে সারজিসের সামনে নিজেকে সুস্থ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। অসুস্থ্য শরীর নিয়েও সারজিসের জন্য তার পছন্দের রান্না করছে।সারজিস কে খাইয়ে দিচ্ছে। ছোটবেলার মতো সারজিসের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। মায়ের এতো আদর ভালোবাসা পেয়ে সারজিসের কানাডা যাওয়ার কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।এরই মধ্যে সিজদা সাইফান তার মামা বাড়ি থেকে হালিমা মঞ্জিলে ফিরে আসে।
সিজদা কে দেখে সারজিসের একটু খারাপ লাগলেও মায়ের ভালোবাসার কাছে সেই কষ্ট চাপা পড়ে যায়। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা বেশিদিন ভোগ করতে পারে না সারজিস।তার জীবন আবারো অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যায়।”
-”রাতভর বৃষ্টি হবার দরুন ছাঁদ স্যাঁতস্যাঁতে পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। যমুনা মির্জা রুমে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গিয়েছেন।সারজিস পই পই করে দিয়েছে সে যেন অসুস্থ্য শরীর নিয়ে কোথাও বের না হয়। কিন্তু যমুনা মির্জার স্বাদ জাগে ছাঁদে গিয়ে প্রকৃতির তাজা শ্বাস প্রাণ ভরে নিতে। যমুনা মির্জা গুটি গুটি পায়ে ছাঁদে পা বাড়ায়। অদ্ভুত এক ধরণের প্রশান্তি তে ছেয়ে যায় শরীর মন।এই ছাঁদে কতোশতো স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে তার।তিনি হাত দিয়ে ছাঁদে থাকা সব গাছ ছুঁয়ে দেন।বড্ড ভালো লাগছে তার। নিজেকে যেন কিশোরী বধূ মনে হচ্ছে।
কিন্তু হুট করেই তার পিছলে যায়।তিনি তাল সামলাতে না পেরে ঠাস করে নিচে পড়ে যান।যার দরুন মাথা ফেটে রক্ত গলগল করে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে।”
মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৮
-” সারজিস তার মায়ের জন্য খাবার নিয়ে এসে যমুনা মির্জা কে নিজের রুমে না পেয়ে সারা বাড়ি তন্নতন্ন হয়ে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু
কোথাও যমুনা মির্জার দেখা মেলে না।সারজিসের যেন নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়।বুকে চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি হয়। যমুনা মির্জা কে কোথায় যেতে পারে ভাবতে থাকে।হুট করেই তার মাথায় ছাঁদের কথাটা স্বরণ হয়।সারজিস আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে ছাঁদে দৌড়ে আসে। যমুনা মির্জার এই অবস্থা দেখে তার হাত থেকে খাবারের প্লেট টা নিচে পড়ে যায় ।।”
