মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪১

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪১
নুজাইফা নূন

-” সকাল দশটায় সারজিসের ফ্লাইট।মির্জা পরিবারের সদস্যরা এয়ার পোর্টে এসেছেন সারজিস কে বিদায় দিতে।সকাল থেকে সারজিস কে নিয়ে সবাই এতো ব্যস্ত ছিলো যে সামিরার কথা তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছে।রামিম রাতেই কল করে জানিয়েছে তারা নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছে।আপাতত রামিমের কাজিনের বাসায় উঠেছে তারা।খুব শীঘ্রই দুজনে বিয়ে করে নিবে।
সামিরা কে তার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরে সারজিসের ও ভালো লাগছে। নিজের ভালোবাসা পূর্ণতা না পেলেও বোনের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে।এটাই তার কাছে অনেক বড় পাওয়া।”
-”সামিরার রুমের দরজা বন্ধ দেখে সবাই ভেবেছে গতরাতের ঘটনায় সামিরা অনেক ভেঙ্গে পড়েছে।হয়তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। তাই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছে। শান্তা মির্জা সামিরা কে ডাকতে গিয়েও রুমে প্রবেশ করেন না।

ঘুমের মধ্যে সামিরা কে ডেকে তুললে সামিরার মাথায় প্রচন্ড পেইন হয়। এজন্য
সবাই সামিরা কে না ডেকে এয়ার পোর্টে চলে আসে।হালিমা বেগমের চোখ যেন বাঁধ মানতে চাইছে না। যমুনা মির্জা ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি সারজিস কে তিনি মায়ের মতো আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন।সেই আদরের সারজিস তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হচ্ছে তার।তিনি সারজিস কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আমি তোমার সাজানো গোছানো জীবন টা এলোমেলো করে দিলাম দাদুভাই।আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”
-” তুমি কিছু করো নি দাদু।যা ভুল করার আমি করেছি। এজন্যই তো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তুমি কেঁদো না।আমার সৌন্দর্যময়ীর খেয়াল রেখো।তার চোখে পানি আসতে দিও না।তাকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করো।আমি চাই সৌন্দর্যময়ী যেন সবসময় ভালো থাকে , সুস্থ্য থাকে।মেয়েটা ছোট বেলা থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে।এখন তার সুখের দিন ফিরেছে।তার মুখে যেন সারাজীবন তৃপ্তির হাসি লেগে থাকে।”
-” প্রতিত্তরে হালিমা বেগম কিছু না বলে সারজিসের বুক থেকে সরে গিয়ে নিজের চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।সারজিস হালিমা বেগমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

-” এভাবে কেঁদে আমাকে দূর্বল করে দিয়ো না দাদু।”
-” তুমি কানাডা যেয়ো না দাদুভাই।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”
-” ফেরার কোনো পথ খোলা নেই দাদু। কিছুদিন বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমি প্রতিদিন ভিডিও কলে তোমার সাথে কথা বলবো। তোমাকে বুঝতেই দিবো না আমি তোমার থেকে দূরে আছি।দেখো তোমার মনে হবে আমি সবসময় তোমার আশেপাশে আছি।ঠিক আগে যেমন টা থাকতাম।”
-”দেশ ছাড়ছো যখন নিজের ইচ্ছায়।তখন আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবে কি রাখবে না সেটাও একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে হালিমা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে অন্যত্র চলে যান।তিনি যেতেই সাইফান এসে সারজিসের কাঁধে হাত রেখে বললো,

-” তোর এভাবে চলে যাওয়া টা মানতে পারছি না ভাই।মনে হচ্ছে তোর এভাবে চলে যাওয়ার পেছনে কোথাও ও না কোথাও আমি দায়ী।আমার জন্যে তোর সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারতি।আমি আমার ব‌উকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম। তুই কেন তোর সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? এখনো সময় আছে ভাই। তুই যাস না।আমার জন্য তোর সমস্যা হলে বল।আমি এক্ষুনি এই মুহূর্তে চলে‌ যাচ্ছি। তবু ও প্লিজ তুই তোর সব ছেড়ে যাস না।”
-” তুমি যেমনটা ভাবছো সেরকম কিছু নয় ব্রো।কানাডার একটা বড় হসপিটাল থেকে আমার জন্য একটা অফার এসেছে।তারা চাইছে আমি তাদের হসপিটালে কার্ডিওলজিষ্ট হিসেবে জয়েন করি।আমার ক্যারিয়ার গড়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।আমি সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই নি।তাই তো কানাডা যাওয়া।তোমার প্রতি কোনো রাগ অভিমান নেই আমার। তুমি শুধু শুধু নিজেকে দায়ী মনে করছো। তুমি আমার কথা বাদ দাও। তুমি নতুন বিয়ে করেছো। নিজের সংসারে মনোযোগ দাও। তোমাদের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা র‌ইলো।”

-” খুব ইচ্ছে ছিলো তোর সাথে পুরো শহর ঘুরে দেখার। কিন্তু সেই চাওয়া অপূর্ণ থেকে গেলো।তোর সাথে ভালো করে পরিচয় হবার আগেই তুই চলে যাচ্ছিস।কানাডা গিয়ে আমাদের কে ভুলে যাস না ভাই।তোকে অনেক বেশি মিস করবো আমি।আর হ্যাঁ খুব শ্রীঘ্রই দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করবি। দেশে ফিরলে তোকে লাল টুকটুকে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো।আবার আমাদের হক মেয়ে কোনো বিদেশীনী বিয়ে করে নিয়ে আসিস না ভাই।”
-”চিন্তা করো না। কোনো বিদেশীনী মনে জায়গা পাবে না।মন টা যে অন্য কারো দখলে রয়েছে।বাই দ্যা ওয়ে এবার ফিরে এসে যেন তোমাদের দুই জন থেকে তিন জন দেখতে পাই।চাচ্চু ডাক শুনতে পাই যেন বলতে বলতে গলা ধরে এলো সারজিসের। কথাগুলো বলতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। তবু ও সে চায় না সাইফান‌ তাকে কোন প্রকার সন্দেহ করুক।তার জন্য সিজদার কোন সমস্যা হোক।”

-” সাইফান কথা ঘুরিয়ে বললো, সাবধানে যাবি।আর পৌঁছে কল করবি কিন্তু।”
-” সারজিস কিছু বলার আগেই তাথৈ এসে সারজিস কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।কান্না করতে করতে মেয়েটার চোখ মুখ ফুলে উঠেছে।নাকের পাটা লাল টুকটুকে আকার ধারণ করেছে।
সারজিস এক ঝটকায় তাথৈ কে নিজের বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
-” এসব কোন ধরনের অসভ‌্যতা তাথৈ? তোকে কতোবার বলেছি আমাকে এভাবে হুট হাট জড়িয়ে ধরবি না। এরপর ও কথা কানে যায় না তোর?এক কথা আর কতোবার বললে শুনবি তুই?”
-” না যায় না। তুমি কেন বোঝ না আমি তোমাকে ভালোবাসি? তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। তুমি আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছো।আমি কি নিয়ে বাঁচবো সারজিস? তুমি প্লিজ যেয়ো না।”

-” তুই আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস? “
-” এনি ডাউট?”
-”আমার ফেরার অপেক্ষা করতে পারবি ? সেটা হোক পাঁচ বছর,দশ বছর বা সারাজীবন? তুই যদি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসিস।তাহলে আমার জন্য অপেক্ষা করবি।আই প্রমিস ইউ তুই যদি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারিস।আমি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে আপন করে নিবো।
বিয়ে করবো তোকে। কিন্তু তার জন্য তোর অপেক্ষা করতে হবে।এটা তোর একটা পরীক্ষা।ভালোবাসার পরীক্ষা।এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই উপহারস্বরূপ এই‌ সারজিস মির্জা কে পাবি তুই।।”

-”সারজিসের এভাবে চলে যাওয়া টা মেনে নিতে পারছে না সিজদা।তার কেন জানি কষ্ট লাগছে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।মনে হচ্ছে যেন তার জীবন থেকে অনেক দামি কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।সারজিস চলে যাওয়ায় এতো খারাপ লাগার কারণ বুঝে উঠতে পারছে না সিজদা।হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে এমন হচ্ছে।
সিজদা গুটি গুটি পায়ে সারজিসের দিকে এগিয়ে আসে।সিজদার চোখে চোখ পড়তেই‌ বুক ধুক করে উঠে সারজিসের।সিজদার চোখ ছলছল করছে।চোখের পাপড়ি ভেজা।সারজিস তড়িৎ গতিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে।তখনি সিজদা পেছন থেকে ডাক্তারবাবু বলে ডাক দেয়।সিজদার ডাক কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই পা থেমে যায় সারজিসের।সারজিস পেছন ফিরে তাকাতেই সিজদা জোর কদমে সারজিসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-” সবার সাথে কথা বললেন।আমার সাথে কথা বললেন না‌ ডাক্তারবাবু?আমাকে কি আপনার চোখে পড়ছে না।নাকি আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন না?বিয়ের পর থেকে দেখছি আপনি কেমন যেন পাল্টে গেছেন।যেন আমাকে চিনেন‌‌ ই না।এমন কেন করছেন ডাক্তার বাবু? কি করেছি আমি??”
-”সিজদার এমন দরদমাখা কথা শুনে চোখ ভিজে উঠলো সারজিসের।গলা ধরে এলো।সারজিস জড়ানো কণ্ঠে বললো,
-” দাদু তোমার জন্য বাড়িতে টিচার নিয়ে আসবেন।মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। নিজের পরিচয় গড়ে তুলবে।”
-” শুধু এই টুকুই?”
-” সারজিস কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে শুরু করলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার।সে সন্তপর্ণে চোখের পানি মুছে মনে মনে বললো,

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪০

-” তোমাকে বলার অনেক কিছুই ছিলো সৌন্দর্যময়ী। কিন্তু সেই কথাগুলো বলার কোনো অধিকার যে আমার নেই।
ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর প্রেম ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস উঠে গিয়েছিলো আমার। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আবারো প্রেমের বীজ বপন করেছিলে।মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিলাম তোমাকে। কিন্তু ভাগ্য তোমাকে আমার হতে দিলো না সৌন্দর্যময়ী। তুমি সাইফানের সাথে ভালো থেকো।আমি না হয় দূর থেকে তোমাকে ভালো থাকতে দেখে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিবো।।।”

মন দিয়েছি তোমাকে শেষ পর্ব