মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৭
নুজাইফা নূন
” সারজিস এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে হালিমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।দশটার আগে হসপিটালে পৌঁছেতে হবে তাকে।দশ টা থেকে চেম্বারে বসতে হবে।সারজিস গাড়িতে উঠে হাত ঘড়িতে দেখলো দশ টা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই।হালিমা বেগমের জন্য অনেক টা লেট হয়ে গিয়েছে তার।সারজিস দ্রুত হসপিটালে পৌঁছানোর জন্য শর্টকাট রাস্তা বেছে নিলো।গাড়ি চলছে আপন গতিতে।সাইফানের ব্যাপার টা অনেক ভাবাচ্ছে সারজিস কে ।সাইফান কে যে সারজিস অপছন্দ করে সেটা নয়।
সাইফান তার দ্বিতীয় মা শান্তা মির্জার প্রথম স্বামীর সন্তান।সারজিস সাইফান দুজনেই সমবয়সী। ফারুক মির্জার সাথে যখন শান্তা মির্জার বিয়ে হয়।তখন শান্তা মির্জা সাইফান কে হালিমা মঞ্জিলে নিয়ে আসে। হালিমা বেগম তাদের বিয়েটা মানতে পারেন না। ফারুক মির্জা হাতে পায়ে ধরে বিয়েটা মানাতে সক্ষম হলেও সাইফান কে কোনো মতেই মেনে নেন নি হালিমা বেগম।সাইফান নিজের নানি বাড়িতে বড় হতে থাকে।তবে সারজিসের থেকে সাইফান কোনো অংশে কম নয়।সাইফান একজন আর্মি অফিসার ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার লম্বাটে দেহ,শ্যাম বর্ণ , খাঁড়া নাক, মায়া ভরা চোখ, মাথার চুলগুলো একদম ছোট ছোট।সাইফান দেখতে যেমন সুদর্শন।তেমনি অমায়িক তার ব্যবহার।তার যখন আর্মি তে জব হয় তখন হালিমা মঞ্জিলের সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে এসেছিস। কিন্তু হালিমা বেগম তাকে অপমান অপদস্থ করে। বিনিময়ে সাইফান মুচকি হাসি উপহার দিয়ে হালিমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। কিন্তু সাইফান আর হালিমা মঞ্জিলে আসে নি। এতো গুলো বছর পর সাইফানের কথা শুনে একটু আবেগ প্রবন হয়ে পড়েছিলো সারজিস।
সারজিস পুরোনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ড্রাইভ করছিলো অকষ্মাৎ সারজিসের মনে হলো একটা মেয়ে কে চার পাঁচ টা ছেলে মিলে এক গাড়ি থেকে টেনে হেঁচড়ে অন্য গাড়িতে তুলছে।সারজিস দেখার ভুল বলে চালিয়ে দিয়ে ড্রাইভে মন দেয়। কিন্তু লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই একটা মেয়ে কে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছেলেগুলো কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে।সারজিস এটা দেখা মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে ছেলেগুলোর কাছে এসে বললো,
-” কি হচ্ছে এখানে ?”
-” তুই কোন ক্ষেতের মুলা রে ? হিরো গিরি দেখাতে আইছিস? আমাদের সাথে কোনো হিরোগিরি চলবে না। একদম মেরে পুঁতে দিবো।”
-” মেয়েটা কে ? আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তাকে ? “
-”তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি আমাদের? তুই যে কাজে যাচ্ছিস ।সেই কাজে যা।তোর সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। শুধু শুধু ঝামেলা করে নিজের বিপদ ডেকে আনিস না।”
-”আমি একজন ডক্টর। হার্টের ডক্টর।তবে ছোটবেলা থেকেই আমার একটা খারাপ রেকর্ড আছে।আমি যাকে ধরি যতোক্ষণ না পর্যন্ত তার হার্ট চলাচল বন্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ তাকে ছাড়ি না।আদর যত্ন করতেই থাকি করতেই থাকি।ইচ্ছে ছিলো সিআইডি অফিসার হবার। কিন্তু হয়ে গেলাম ডক্টর। অনেক দিন কাউকে আদর যত্ন করা হয় নি।হাত দুটো কেমন যেন নিশপিস করছে।
কে আগে আদর খেতে আসবি আয় বলতেই সব কয়টা গুন্ডা সারজিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে মারামারি চলতে থাকে। মারামারির এক পর্যায়ে একটা গুন্ডা পেছন থেকে সারজিসের বাহুতে ছুরি চালিয়ে দেয়।যার দরুন সারজিসের শার্ট ভেদ করে রক্ত বের হতে থাকে।সারজিস ক্ষতস্থান ধরে রাস্তায় বসে পড়ে।আর তখনি পুলিশ চলে আসে।সারজিস বিপদ সংকেত টের পেয়ে গাড়ি থেকে নামার আগে পুলিশ কে ইনফর্ম করে এসেছিলো। পুলিশ এসে গুন্ডাদের নিয়ে যেতেই সারজিস দৌড়ে গাড়ির কাছে চলে এলো।সিজদা কে গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।সারজিস এসে সিজদার কাঁধে হাত দিতেই সিজদা সারজিসের বুকে ঢলে পড়লো।
মূহুর্তের মধ্যেই যেন সারজিসের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেলো।সারজিস সিজদার পালস চেক করে দেখলো পালস চলছে। তৎক্ষণাৎ সারজিস সিজদার চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে সিজদার মুখে হালকা চাপড় মেরে বললো,
-” হে ইউ ! ওপেন ইউর আইজ।প্লিজ টক টু মি।সারজিস সিজদা কে কয়েকবার ডাকার পরেও সিজদার থেকে রেসপন্স পেলো না।
সে সিজদা কে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁজা কোলে তুলে নিতেই সিজদা চোখ খুলে তাকালো।সিজদার চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল সারজিসের পা। বেড়ে গেল হার্টবিট।সারজিস সিজদার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।মনে হলো যেন এই চোখের দিকে তাকিয়ে জনম জনম পার করে দেওয়া যাবে। চোখে এতো মায়া।সারজিসের মনে হলো হলুদের সাজে কোনো হলুদ পরীর সাক্ষাৎ পেয়েছে সে।তার যে হসপিটালে যেতে দেরি হচ্ছে।সে কথা বেমালুম ভুলে গেলো সারজিস।সারজিসের ধ্যান ভেঙ্গে গেলো সিজদার চিৎকারে।সিজদা চিৎকার করে বলছে,
-” আপনার তো হাত কাইটা রক্ত বের হইতাছে। কেমনে হাত কাটলো আপনার?”
-” ও কিছু না।সামান্য একটু কেটেছে। তোমার সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোনো বিয়ের কনে। তুমি কি বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছো বা তোমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে ?”
-” না স্যার।আমি তো আপামণির লগে তার বান্ধবীর হলুদের অনুষ্ঠানে যাইতেছিলাম।হুট করে আপামণি কইলো তার পানির পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু গাড়িতে পানি ছিলো না।তাই তো আপামণি পানি আনতে গেছিলো।আর তখনি কয়েক বাজে লোক এসে আমার শরীরে হাত দিতে লাগলো।আমার খুব খারাপ লাগতেছিলো তখন।
আমি চিৎকার করে আপামণি রে ডাকতে গেলেই তারা আমার নাকে কিছু একটা চাইপা ধরলো।এরপর আর কিছু মনে নাই আমার।আমি তো ভাবছিলাম আমি বোধহয় মইয়া যামু। খারাপ লোকগুলান আমারে হয়তো মাইরা ফেলবো।”
-” তোমার নাম কি ? বাসা কোথায়?”
-” প্রতিত্তরে সিজদা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সারজিসের ফোন বেজে উঠলো। হসপিটাল থেকে কল এসেছে।সারজিস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশ টা ত্রিশ বেজে গেছে।সারজিস কল রিসিভ না করে সিজদা কে বললো,
-” গাড়িতে বসো?”
-” কোথায় যাবো ?”
-” হসপিটালে ।”
-” হাসপাতালে ক্যান যামু ? হাসপাতালে লইয়া আমারে কি ইনজেকশন দিবেন?আমি হাসপাতালে যামু না।আমারে বাড়ি লইয়া যান।”
-”না না।তোমাকে কোন ইনজেকশনের দিবো না। চিন্তা করো না।তোমাকে আমি তোমার বাসায় পৌঁছে দিবো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে হসপিটালে যেতে হবে।তোমাকে একাও ছাড়তে পারছি না।তোমার লাইফ রিষ্ক আছে।যে গুন্ডা গুলো তোমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছিলো। এদের নিশ্চয় বড় গ্যাং আছে। এতোক্ষণে হয়তো তাদের কাছে খবর ও পৌঁছে গিয়েছে।এতো সহজে তারা তোমাকে ছাড়বে না।আবারো তোমার উপর অ্যাটাক হতে পারে। তুমি আমার কথা শোন। তুমি এখন আমার সাথে হসপিটালে চলো।আমি হসপিটালের কাজ শেষ করে তোমাকে তোমার বাসায় নিরাপদে পৌঁছে দিবো।”
-” আচ্ছা বলে সিজদা গাড়িতে বসতে যাবে তার আগেই সারজিসের ক্ষতস্থানের দিকে নজর পড়ে তার। সিজদা কি করবে বুঝতে পারে না।এই মানুষ টার কাছে ঋণী সে।আজ তার জন্যই সে বাঁচতে পেরেছে।না হলে এতোক্ষণে সে নরপশুদের খাবারে পরিণত হতো ভাবতেই সিজদার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।সিজদার কাছে একটা রুমাল ছিলো।সিজদা রুমাল দিয়ে সারজিসের ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়।সারজিস মুগ্ধ দৃষ্টিতে সিজদার দিকে তাকিয়ে রইলো ।তার কানে অনবরত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সেই লাইন বাজতে লাগলো,
মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৬
-”প্রহর শেষে আলোয় রাঙা,সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”