মন দিয়েছি তোমাকে শেষ পর্ব 

মন দিয়েছি তোমাকে শেষ পর্ব 
নুজাইফা নূন

” সারজিস যাওয়ার পর মির্জা পরিবারের সদস্যরা হালিমা মজ্জিলে ফিরে আসে।সামিরা তখনো নিচে আসে নি দেখে শান্তা মির্জার মনে খটকা লাগে।শান্তা মির্জা দৌড়ে সামিরার রুমের সামনে এসে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে যায়।তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেই চিৎকার দিয়ে উঠেন।তার চিৎকার শুনে সবাই সামিরার রুমে ছুটে আসে।সামিরার রুমের অবস্থা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় সকলের। রুমের আলমারি খোলা রয়েছে।কাপড় চোপড় ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে।এমনকি সামিরার বিয়ের জন্য যে গহনা বানানো হয়েছিলো,সেগুলোও নেই।সামিরার নিজের জমানো বেশ কিছু টাকা ছিলো।সেই টাকাগুলো ও নেই।শান্তা মির্জা সামিরার রুমের প্রত্যেক টা কোণা থেকে শুরু করে ছাদেও দেখে আসে। কিন্তু কোথাও সামিরা কে না পেয়ে আবারো সামিরাও রুমে আসে।তখনি টেবিলের উপর একটা চিরকুট দেখতে পায়।শান্তা মির্জা চিরকুট খানায় সামিরার হাতের লেখা দেখে হাত কাঁপে তার।সামিরা সবার মুখে চুনকালি দিয়ে পালিয়ে যাবে।এটা সবারই ধারণার বাইরে ছিলো। শান্তা মির্জা কোনো কথা না চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। মূহুর্তের মধ্যেই যেন পুরো বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়।।”

-” গত হয় কয়েকটা মাস।হালিমা মঞ্জিলে আজ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।আজকে বাড়িতে নতুন মেয়ে জামাই আসবে। ফারুক মির্জা সামিরা কে অনেক বেশি ভালোবাসেন।মেয়েকে ছাড়া তিনি অচল হয়ে পড়েছিলেন।মেয়ের সাথে কথা বলতে না পারলে যেন তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।তিনি অনেক ভেবে দেখলেন একমাত্র মেয়েকে ছাড়া তিনি ভালো নেই। কতো গুলো মাস তিনি ঠিক মতো খেতে পারেন না।খেতে গেলেই সামিরার কথা মনে পড়ে।মেয়েটা কি খাচ্ছে না খাচ্ছে ভাবতেই খাবারের প্লেটে পানি ঢেলে খাবার ছেড়ে উঠে আসেন। ঘুমোতে গেলে মনে হয় সে নরম তুলতুলে বিছানায় ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তার আদরের মেয়েটা কি আদৌ ঠিক মতো ঘুমোতে পারছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এসব চিন্তা ভাবনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো।তাই তো তিনি সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে মেয়ে জামাই কে বাড়িতে ডেকেছেন। শুধু তাই নয়। নিজের মেয়ের সুখের কথা ভেবে তিনি রামিম কে নিজের কোম্পানির CEO পদে নিযুক্ত করেবেন বলে জানিয়েছেন। তাদের হালিমা মঞ্জিলে আসা উপলক্ষে সকাল থেকে বাড়িতে রান্না বান্না চলছে। ।রান্না শেষ হতেই শান্তা মির্জা সিজদা কে রেডি হ‌ওয়ার জন্য উপরে পাঠিয়ে দেয়।সকাল থেকে কিচেনে থাকার দরুন ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে মেয়েটা। গায়ের জামাটা শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। সিজদা উপরে এসে কাবার্ড থেকে একটা হালকা গোলাপি শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সিজদা ভেজা কাপড় গুলো বেলকনিতে মেলে দিয়ে এসে মাথার টাওয়াল খুলে চুলগুলো ঝেড়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে হালকা প্রসাধনী ব্যবহার করে চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে সাজগোজ করে নেয়।

সাজ কমপ্লিট হলে সিজদা নিচে এসে কিচেন থেকে খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখে।শান্তা মির্জার ও সবটা অ্যারেঞ্জ করা হয়ে গিয়েছে।তিনি ও গোসল সেরে রেডি হয়ে নিচে এসেছেন।এর‌ই মধ্যে তার ফোন বেজে উঠে।তিনি কল রিসিভ করতেই তার চোখের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে যায়।তার হাত থেকে ফোন ফ্লোরে পড়ে গিয়ে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়।তিনি ঠাস করে ফ্লোরে বসে পড়েন। ফারুক মির্জা নিজের স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে তার নিকট ছুটে এসে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন,

-” হুট করে কি হলো?কে কল করেছিলো ? কি বললো?”
-” শান্তা মির্জা ফারুক মির্জা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন।তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন কেউ তার কলিজা টেনে বের করে নিয়ে আসছে।নিজের স্ত্রীর চোখের পানি সহ্য করতে পারলেন না ফারুক মির্জা‌।তিনি বিচলিত হয়ে বললেন,
-” আরে কি হয়েছে টা কি? তুমি যদি না বলো তাহলে আমারা কিভাবে বুঝবো?”
-” আমার ছেলেটা।”
-” হ্যাঁ বলো।সাইফানের কি হয়েছে?”
-” আ আমার ছেলেটা আর নেই ফারুক।”
-” নেই মানে? কি সব আবোল তাবোল বকছো?”

-” আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন আর এই পৃথিবীতে নেই ফারুক।নেই।যার জন্য এতো স্ট্রাগল করলাম, নিজের কাছে নিজে অপরাধী হলাম‌।আমার সেই বুকের মানিক আর কখনোই আমাকে মা বলে ডাকবে না।আর কখনোই হালিমা মঞ্জিলে নিজের অধিকার চাইতে আসবে না ফারুক।আমার ছেলেটা মিশনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে ফারুক মারা গিয়েছে।কতো কষ্টের ছেলে আমার। ছোটবেলা থেকে কতো কষ্ট করে বড় হয়েছে।আজ যখন একটু সুখের মুখ দেখলো।তখনি আমার কলিজা টা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সব কিছু ছেড়ে চলে গেলো ।আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো ফারুক বলতে বলতে সেন্সলেস হয়ে গেলেন শান্তা মির্জা।”

-” সিজদার হাতে গরুর গোশতের গরম তরকারির বাটি ছিলো।সাইফান মিশনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে ‌।এটা শোনা মাত্রই সিজদার হাত থেকে তরকারির বাটি তার পায়ের উপর পড়লো।গরম তরকারি পায়ে পড়ার কষ্টের থেকে মনের কষ্ট বেশি পীড়া দিলো তাকে‌।সিজদা সেখানেই থ হয়ে বসে পড়লো।তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। যেন সে একটা পাথরে পরিণত হয়েছে।এর‌ই মধ্যে সামিরা রামিম হালিমা মঞ্জিলে প্রবেশ করে।সামিরা ঢুকেই সাইফানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মূহুর্তের মধ্যেই যেন উৎসবমুখর পরিবেশ শোকে আচ্ছন্ন হয়ে উঠে। স্বজন হারানোয় বেদনার আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চারিপাশ।”

-” সাইফানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে সারজিস তৎক্ষণাৎ দেশে ফিরতে পারে না।সাইফানের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে দেশে ফিরে সারজিস।সারজিস এয়ার পোর্ট থেকে সোজা হালিমা মঞ্জিলে চলে আসে।সারজিস কে দেখেই শান্তা মির্জা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। শান্তা মির্জার চোখের পানি দেখে চোখ ভিজে যায় সারজিসের।সারজিস শান্তা মির্জার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-” প্লিজ আম্মি।কান্না করবেন না।এই দুনিয়ায় আমরা কেউ‌ই চিরদিন থাকার জন্য আসি নি আম্মি। একদিন না একদিন আপনাকে আমাকে আমাদের সবাই কে এই পৃথিবীর ছেড়ে চলে যেতে হবে।সাইফান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে‌। কয়জন পারে দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে? আপনার তো গর্ব হওয়ার কথা আম্মি।আপনি গর্বের সাথে বলতে পারবেন আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে‌।আমার ছেলে একজন বীর সৈনিক। আমি একজন বীর সৈনিকের মা।”

-” আমার একটা ছেলে তো আমার বুক খালি করে দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলো। তুই ও আমাকে ছেড়ে চলে না বাবা।তোর মা হবার জন্য ফারুক আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু আমি কখনোই তোর মা হয়ে উঠতে পারি নি।তোকে আদর করে কাছে টেনে নেই নি।আদর করে খাইয়ে দেই নি।ঘুমোনোর পর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানি গান গাই নি।আমি কখনোই তোর মা হয়ে উঠার চেষ্টা করি নি। কিন্তু আমার বুকের মানিক কে হারানোর পর আমি বুঝতে পারছি সন্তান হারানোর বেদনা।আমি আর তোকে দূরে সরে থাকতে দিবো না।আমি এক ছেলে হারিয়েছি।তোকে আর হারাতে পারবো না আমি। তুই আর কানাডা ফিরবি না সারজিস। তুই আমার সাথে আমাদের সকলের সাথে থাকবি।”

-” এটা হয় না আম্মি‌।আমি কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছি।অতি শীঘ্রই আমাকে ফিরতে হবে।”
-” না। তুই কানাডা ফিরবি না। তুই কানাডা ফিরে গেলে আমি পুত্র শোকে পাগল হয়ে যাবো। তুই দেশে ফিরে আর আমার মুখ দেখতে পারবি না।”
-” ঠিক আছে আম্মি।আমি দেখছি কি করা যায়।”
-” গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।আমি তোর নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”

-” ঠিক আছে আম্মি বলে সারজিস সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে।তখনি সিজদার সাথে দেখা হয়।সিজদা কে দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো সারজিসের।সিজদার এতো পরিবর্তন দেখে বুকে যন্ত্রনার সৃষ্টি হলো সারজিসের। পুরোনো ক্ষত টা যেন মূহুর্তের মধ্যেই তাজা হয়ে গেলো।সিজদার পরণে ছাই রঙের একটা সুতি থ্রি পিস রয়েছে।আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। অনেক কালো হয়ে গিয়েছে।চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গিয়েছে।হাসি খুশি চেহারায় অসহায়ত্ব, মলিনতার ছাপ ফুটে উঠেছে।মাত্র কয়েক টা দিনের ব্যবধানে মেয়েটার আমূল পরিবর্তন এসেছে।সারজিস সিজদা কে দেখে শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-” কেমন আছো সৌন্দর্যময়ী?”
-” সিজদা ছলছলে চোখে বললো,
-” ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন ডাক্তারবাবু?”
-” ভালো । নিজের এ কি হাল করেছো সৌন্দর্যময়ী? নিজেকে শক্ত করো।এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।”
-” সিজদা প্রতিত্তরে কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিচে নেমে আসে।সে কিভাবে নিজেকে শক্ত করবে? মানুষ টার সাথে যে তার অনেক পথ চলা বাকি ছিলো।অনেক অনেক না বলা কথা বাকি ছিলো।মাত্র কয়েকটা দিন মানুষ টার সঙ্গ পেয়েছে সে।নিজেকে তার রঙ্গে রাঙ্গাতেও পারে নি।তার আগেই সে তাকে একা করে দিয়ে চলে গেল।সিজদা কেন তার জায়গায় যেকোনো মেয়ে থাকলেই নিজেকে শক্ত করা দায় হয়ে পড়তো।সাইফানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে সিজদা পাথর হয়ে গিয়েছে।চাইলেও কান্না করতে পারছিলো না।সবাই সিজদা কে বলছিলো কান্না কর।কান্না করে নিজের কষ্ট টা কমা।

কিন্তু সিজদা চাইলেও তার চোখ থেকে পানি পড়ে নি। কিন্তু যখনি সাইফানের লাশ আসে সিজদার বুক ভার হতে শুরু করে।সিজদা ছুটে গিয়ে সাইফানের লাশের উপর পড়ে।সাইফান কে একটা নজর দেখেই চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ২৪ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।তখন সাইফানের দাফন কাফন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। সিজদা কারো সাথে কোন কথা না বলে চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মন মরা হয়ে রুমে বসে থাকে। পাঁচ দিন পর সিজদা রুম থেকে বের হয়।আর বের হয়েই সারসিস কে দেখতে পায়। সিজদা নিচে এসে সোফায় বসতেই পাড়া প্রতিবেশীরা এসে সিজদা কে দেখে বললো,

-” আহারে।ছেলেটা তো মারা গেলো।এখন কি‌ হবে মেয়েটার ?মেয়েটার গোটা জীবন পড়ে রয়েছে।ভালো করে সংসার টাও গুছিয়ে নিতে পারলো না।এর‌ই মধ্যে বিধবা হয়ে গেলো?ভালোই হয়েছে এখনো‌‌ বাচ্চাকাচ্চা হয় নি।তাহলে আবার বিয়ে‌ করতে গেলে সমস্যা হতো। শুনেছি মেয়েটা এতিম।তার উপর আবার বিধবা হয়ে গেলো।এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে? মেয়েটার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো।”

-” সারজিস রুমে এসে স্থির থাকতে পারছিলো না।সিজদার মলিন চেহারা টা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো।সারজিস রুমে এসে ফ্রেশ না হয়েই নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।সিঁড়ি বেয়ে নামতেই মহিলাদের কটু কথা সারজিসের কানে আসে।এসব কথা শুনে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে সারজিসের।চোখ মুখের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে যায়।সারজিস আর চুপ থাকতে না পেরে বললো,
-” আপনাদের কি কোনো কাজ নেই? কাজ না থাকলে ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করুন। তবুও অন্যের সংসারে নাক গলাতে আসবেন না। প্লিজ মেয়েটার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিবেন না।”

-” ও আল্লাহ! মেয়েটার জন্য তোমার খুব পুড়ছে দেখছি।এতোই যখন মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে তাহলে মেয়েটা কে বিয়ে করে নাও। তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেন।জানি এটা কখনোই করবে না। কিন্তু তলে তলে ঠিকই টেম্পু চালাবে।ঘরে এতো সুন্দরী মেয়ে থাকলে কোনো পুরুষ ই নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না।তার উপর আবার সুন্দরী মেয়েটা তোমার সম্পর্কে ভাবী হয়।তোমার দেবর ভাবীর সম্পর্ক। রসিকতার সম্পর্ক।এ যুগের মেয়েরা দেবর কে আধা বর মনে করে।”
-” মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ। অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছেন আপনারা। কিন্তু আর না।
আপনারা এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যান।”

-” উচিত কথা বললে‌ খালাজি বেজার ই হয়‌ বাপু। তোমাদের পারিবারিক ব্যাপার। তোমাদের যা খুশি তাই করো। আমাদের কি। আমাদের শুধু কান আছে শুনবো‌ আর চোখ আছে দেখবো বলে তারা রাগে গজগজ করতে করতে হালিমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে গেলেন।”
-” সিজদা তখনো নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।সারজিস সিজদার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-” ওদের কথায় কিছু মনে করো না সৌন্দর্যময়ী।”
-” আমি যে বিধবা হয়েছি এটা কি আমার দোষ ডাক্তারবাবু?সবাই আমাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।সে তো বর ছিলো।তার সাথে সারাজীবন সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম।সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।এতে কি আমার কষ্ট হচ্ছে না?আল্লাহ তায়ালা কেন যে মানুষ টার মরণ না দিয়ে আমার মরণ দিলেন না।আমি আগেই থেকেই জানতাম আমার মতো অভাগীর কপালে এতো সুখ স‌ইবে না।”

-” সিজদার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে রেগে যায় সারজিস।সে রাগান্বিত হয়ে বললো,
-” আর একবার ও মৃত্যুর কথা মুখে আনবে না সৌন্দর্যময়ী।তোমাকে বাঁচাতে হবে।আমাকে বাঁচানোর জন্য হলেও তোমাকে বাঁচাতে হবে।কথাটা শুনে চমকে উঠে সিজদা।সিজদা অবাক হয়ে বললো,
-” কি বললেন ডাক্তারবাবু?আপনাকে বাচানোর জন্য বাঁচতে হবে মানে?কি হয়েছে আপনার।”
-”সিজদার প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সারজিস।সারজিস আমতা আমতা করে বললো,
-” কিছু না।তুমি কি শুনতে কি শুনেছো হয়তো।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি বলে সারজিস নিজের রুমে চলে আসে।”

-” গত হয় কয়েক টা দিন।সারজিস সিজদার এই অবস্থা দেখে আর কানাডা ফেরে নি। চেম্বারে থাকলেও সারজিসের মন যেন বাড়িতে সিজদার কাছে‌‌ পড়ে থাকে।সিজদা কি করছে না করছে? কি খাচ্ছে না খাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতেই দিন পার হয় তার।সারজিস সিজদা কে যথাসম্ভব হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে।সিজদা কে কেউ কথা শোনাতে গেলে সারজিস ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। শুক্রবার সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট শেষ হলে সিজদা প্লেট গুলো গুছিয়ে রাখছিলো।তখনি সিজদার মামা আসে।রাদেশ চৌধুরী কে দেখে সিজদা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।তার কান্নার আওয়াজ শুনে শান্তা মির্জা ড্রয়িং রুমে ছুটে আসে। রাশেদ চৌধুরী সিজদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-” কাঁদিস না মা।যা হবার হয়ে গিয়েছে।এখন আর হাজার চোখের পানি ফেললেও সাইফান ফিরে আসবে না।যার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছিলি সেই মানুষ টাই তো আর নেই।এখন কিসের আশায় এই বাড়িতে পড়ে থাকবি?তোকে লোকে নানান রকমের কথা শুনাচ্ছে।এটা আমার কানে এসেছে।তাই তো আমি ছুটে এসেছি।
তোর কাপড় চোপড় গুছিয়ে নে।আমি তোকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাবো।”

-” এসব কি বলছো মামু? আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
-” কার অপেক্ষায় এই বাড়িতে থাকবি? দেখ মা
মাত্র কয়েক বছর বয়স হয়েছে তোর।এখনো তোর গোটা জীবন পড়ে রয়েছে।আমি আবারো তোর বিয়ে দিবো। তুই নতুন করে সবটা শুরু করবি।রাদেশ চৌধুরীর কথা শুনে শান্তা মির্জা এগিয়ে এসে বললো,
-” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আম্মা এখন বাড়িতে নেই।এই সুযোগে এই অপয়া, অলক্ষী মেয়েকে নিয়ে বিদায় হন আমার বাড়ি থেকে।বিয়ের পর পরই আমার ছেলেটা কে খেয়ে নিলো এই অপয়া অলক্ষী মেয়েটা।আমার‌ই ভুল হয়েছিল ওকে এই বাড়ির বউ করে আনার।এখন আমার ছেলেটাই যখন বেঁচে নেই।তখন এই অপয়া অলক্ষী মেয়েকে দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। শুধু শুধু আমার স্বামীর অন্ন ধংস করবে।যেটা আমি হতে দিবো না।আপনি এক্ষুনি এই মুহূর্তে আপনার ভাগ্নি কে আমার বাড়ি থেকে নিয়ে যান।না হলে সবাই এসে পড়লে ঝামেলা হবে।”

-” শান্তা মির্জার কথা শুনে চোখ থেকে আপনার আপনি পানি গড়িয়ে পড়ে সিজদার।সে তো চায় নি সাইফান মারা যাক।সাইফান যেমন তার ছেলে তেমনি তার ও স্বামী।সাইফানের জন্য তার ও কষ্ট হচ্ছে।সে চেয়েছিল সাইফানের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এই বাড়িতে পড়ে থাকতে। কিন্তু শান্তা মির্জা যখন চাইছে না তখন সিজদা ও আর এই বাড়িতে থাকতে চায় না।সিজদা চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,
-” বিয়ের সময় আমি ঐ বাড়ি থেকে তো কিছুই আনি নি মামু।কি বা নেওয়ার আছে আমার। তুমি চলো বলে সিজদা রাশেদ চৌধুরীর হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই সারজিস এসে বললো,
-” তুমি কোথাও যাবে না সৌন্দর্যময়ী। তুমি এই বাড়িতে‌ই থাকবে ।”
-” সারজিসের কথা শোনা মাত্রই সিজদা তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে বললো,

-” যার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছিলাম।সেই মানুষ টাই তো আর নেই। কোন অধিকারে থাকবো আমি?আম্মা ভাবছেন সবটা আমার কাছে জন্য হয়েছে।আমি অপয়া অলক্ষী।তিনি আমার মতো অপয়া অলক্ষী মেয়েকে এই বাড়িতে রাখতে চান না।তাহলে আমি কোন অধিকারে এই থাকবো ডাক্তারবাবু?”

-” সারজিস মনে মনে বললো,ব‌উয়ের অধিকারে। হ্যাঁ তোমাকে বিয়ে করবো আমি। পূর্বে এই বাড়িতে তোমার যতোটুকু অধিকার ছিলো।তার থেকেও বেশি অধিকার ফিরে পাবে তুমি।একবার আমি যে ভুল করেছি। দ্বিতীয় বার সেই ভুল আমি কিছুতেই করবো না।তোমাকে নিজের করে পাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ যখন পেয়েছি।তখন সেই সুযোগ হাতছাড়া করছি না আমি।তোমার মায়া ভুলে থাকতে কানাডা পাড়ি জমিয়েছিলাম।

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪১

কিন্তু আমি পারি নি তোমাকে ভুলে থাকতে।আমার দেহ কানাডা পড়ে থাকলেও মন টা যে তোমার কাছে ছিলো।সেই প্রথম দেখাই মনটা চুরি করে নিয়েছিলে তুমি।আমি ভালোবেসেছি তোমাকে।মন দিয়েছি তোমাকে।বিয়েটাও তোমাকেই করবো। তুমি বিধবা হ‌ও বা চার বাচ্চার মা হ‌ও।আই ডোন্ট কেয়ার।আমার শুধু তোমাকে চাই।তোমাকে পাবার জন্য যদি পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে হয়।আমি করবো। বিনিময়ে তোমাকেই চাইবো।।।”

সমাপ্ত