মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪০+৪১
ফাবিয়াহ্ মমো
ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। বাতিহীন রুমের ভেতর অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে গেলো তখন, সেটা নিয়ে চিন্তাও করতে পারলো না সে। একজোড়া অশ্রুপূর্ণ চাহনির মাঝে বাক্য হারিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো, এই প্রথম নিজের উপর জোর খাটানো অধিকার দেখে চুপ হয়ে গেছে মাহতিম।
খুবই কাছে, খুবই নিকটে থাকা মুখটার স্নিগ্ধ চোখজোড়া আজ বন্ধ, সেই বন্ধ চোখ থেকে পাপড়ি চুয়ে চুয়ে পানি পরছে, মোটা মোটা অশ্রু ফোঁটাগুলো নির্বিকারে চোয়াল বেয়ে নিচে পরছে, পুরো মুখটা যেনো লালচে আভায় আচ্ছন্ন, নিচের ঠোঁটটা এমনভাবে দাঁতে চেপে রেখেছে যেনো অসহ্য যন্ত্রনাটা কঠিনভাবে গলাধঃকরণের চেষ্টায় আছে। মাহতিম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলো না, মুখ দিয়ে কথাও বলতে পারছিলো না, পরিস্থিতিটা কেমন করে স্বাভাবিক হবে সেটাও যেনো জানা নেই তার। ওই পাপড়ি চুয়ে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ঝরার দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে যেনো উত্তপ্ত ছুড়ির আঘাতের মতো বিঁধছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাহতিম তার হাতের ফোনটা বিছানায় ছেড়ে মেহনূরের গালের কাছে হাত আনলো, কিন্তু হাতটা গালের উপর রাখলো না। অবহেলার অভিমানটুকু এখনো সতেজ হয়ে মনের কোঠায় জেঁকে আছে, বারবার অন্তরের কোমল জায়গায় কেউ কড়াঘাত করে বলছে ‘ থেমে যা, তুই পুরুষ মানুষ, তুই অবলার কাছে ধরা দিবি না। নত স্বীকার করবি না। থাম! ‘ মাহতিম কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই স্থির হয়ে রইলো, বিবেকের দোরগোড়ায় নানা অজুহাত এসে তাকে দূঃসহ যন্ত্রনার ভেতর ফেলে দিচ্ছে। খানিকটা সময় তিরতির করে পেরিয়ে গেলো, গভীর নিশুতি রাত্রিকালীন প্রহর যেনো আরো নিঃশব্দতার ভুবনে তলিয়ে যাচ্ছে।
যেখানে মাহতিমের ভেতরে অভিমান-অপেক্ষা-অবজ্ঞার সুরগুলো হিংস্রতার দুনিয়ায় ধাবমান, অন্যদিকে তখন অব্যক্ত-অপ্রকাশ্য-অবসন্ন হৃদয়ের ব্যকুলতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে মেহনূরের। সচল মস্তিষ্কের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিচেতনার মাহতিম প্রিয়তমার একটা ইশারার জন্য অপেক্ষমাণ, সামান্যতম ইঙ্গিতপূর্ণ অবস্থা দেখলে বুকের মধ্যে টেনে নিতে দেরি সহ্য করবে না। আজ কোনো বিধি-নিষেধ, ন্যায়নীতি, আদেশ-আজ্ঞাদেশ কিচ্ছু মান্য করবে না মাহতিম। চার মাসের যেই অসহ্য দহনের অন্তঃক্রীয়ায় সে দগ্ধ ছিলো, সেটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে উদ্দীপিত হয়ে আশান্বিত চাহনিতে মুখিয়ে আছে। অনেক চিন্তাভাবনার হিসাব কষে শেষমেশ নিজেকে চূড়ান্তরূপে খোলাশা করার উদ্দেশ্যে ঠোঁট থেকে হাত সরালো মাহতিম। হাত সরানোর অনুকম্পন টের পেয়ে অশ্রুসিক্ত ফোঁপানো মুখায়বটা তার দিকে চক্ষু কপাট খুলে তাকালো। নিস্তব্ধ রুমটার শব্দহীন অবস্থার ভেতর দৃঢ় কন্ঠে বললো মাহতিম,
– তোমাকে নতুন করে কিছুই বলার নেই মেহনূর। জেনেশুনে যেহেতু তোমার মতো ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে বিয়ে করেছি, এতে দোষটা আমারই। আমারই দোষ যে, তোমার উপর নিজের সমস্ত কিছুর ভার রাখতে চেয়েছিলাম। আমার প্রোফেশনাল লাইফের সব ট্রার্মে সাকসেস এ্যাচিভ করতে পারলেও তোমার কাছ থেকে নূন্যতম যোগ্যতাটুকুও জুটলো না মেহনূর। হয়তো তোমাকে ফোর্স করেছি দেখে তুমিও ভয়ের চোটে আমাকে অনুভূতির আশ্বাস দিয়ে ফেলেছো। তোমাকে দোষ না দিলেও তোমার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছে। রাগ লাগছে, অসহ্য লাগছে।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো ঝেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করলো মাহতিম। বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, দৃষ্টিদুটো বিছানার উপর মলিন ভাবে স্থির হয়ে গেছে। ছোট ছোট টুকরোর মতো তার মনটা আজ চূর্ণবিচূর্ণ, চোখ বন্ধ করে যাতনার প্রতিটি দং’শিত নিশ্বাস ঠোঁট খুলে ছাড়ছে মাহতিম। অনবরত নিশ্বাস ছাড়তেই ব্যথার গ্লানিটুকু ভেতরে চেপে অতি কষ্টে ধীরভাবে বলতে লাগলো,
– আমাকে ছেড়ে যেতে পারো মেহনূর। তোমাকে বাধা দিবো না।
হাতের উলটোপিঠে কেবল চোখ মুছতে যাচ্ছিলো মেহনূর, কর্ণধারে বিষাক্ত কিছু শোনার পর মূর্ছার মতো স্থির হয়ে গেলো সে। চোখ মোছার হাতটা ধপ করে কোলের উপর পরে গেলে শরীর নিংড়ে যেনো শেষ শক্তিটুকু কেউ শুষে নিচ্ছে। অবশ-অচল-অকেজো অবস্থার মতো দেহটা যেনো যেকোনো সময় টলে পরবে, মাথাটা মা’রাত্মক ঝিমঝিম করছে। অনেক চেষ্টা শেষে শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলালো মেহনূর, আস্তে-আস্তে ঢোক গিলে গলদেশটা ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। অ’সভ্য উপাধি পাওয়া মানুষটা এখনো তার নিচু মাথাটা তুলেনি, কি সুন্দর নিঃসঙ্কোচে বলে দিলো ‘ ছেড়ে যাও ‘। মেহনূর হতবিহ্বল অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা এগিয়ে মুঠোবন্দি করা হাতটা ধরলো, শক্ত হাতটা কুড়িয়ে নিতেই হঠাৎ মাথা তুলে কপালে ভাঁজ ফেলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো,
– কি করছো মেহ —
কথাটুকু অর্ধপূর্ণ হয়ে গলায় আঁটকে গেলো মাহতিমের, সে আর কথাটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেলো না। শীতের শিশির ফোঁটা যেমন পাতার বুকে আশ্রয় পেয়ে সেখানেই জ্বলজ্বল করে নিজের দীপ্ত মহিমা ছড়িয়ে দেয়, তেমনি মাহতিমের শক্ত-প্রশস্ত বুকটার উপর নিজের চাপা অনুভূতি উন্মুক্ত করে মনের কিষ্টে-দহনে হু হু করে কেঁদে উঠে মেহনূর। সাদা শার্টের বেশে ঢেকে যাকা মাহতিমের দেহটা আজ নিজের কাছে রাখার চেতনায় খামচে ধরেছে। ওই দীর্ঘাটে মানুষটার পেশিবহুল পিঠটাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো মেহনূর, তার বুকটার মধ্যে নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে মুখ গুঁজে দিলো সে।
পিঠের উপর সাদা শার্টটাকে মুঠোর মধ্যে খামচে ধরতেই নখের আকস্মিক ব্যথায় তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। ওমনেই দুপাটি দাঁত শক্ত করে ব্যথাটা হজম করে চোখ খুলে তাকালো। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে নিজের বুকের দিকে তাকাতেই কান্নায় ফুলে-ফুলে উঠা মেদহীন পিঠটার দিকে চোখ পরলো তার। গাঢ় বেগুনী রঙের ব্লাউজটা যথেষ্ট পাতলা, সেই সঙ্গে শীত নিবারণের জন্যও যথেষ্ট অনুপযুক্ত পোশাক। চুলের খোপাটা খুলে ঘাড়ের নিচে ঝুলে আছে, ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী অংশটুকু উন্মুক্ত হয়ে কোমরের টানটান চামড়াটা পরিদৃষ্ট। রুমে থাকা মৃদ্যু মাত্রায় সচল এসির হিমে স্বল্প উন্মুক্ত পিঠের সমস্ত পশম কাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরটাও ভয়াবহ ঠান্ডা মেহনূরের। মাহতিম দ্রুত তার খুলে রাখা জ্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে ডানপাশ থেকে নিতে গেলে বাধা দিলো মেহনূর। অস্ফুট সুরে ফুঁপিয়ে উঠলে আঁটকে আসা গলাতেই বলতে লাগলো,
– আমার হাতে কালি লেগে গিয়েছিলো, আমি কালি পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ছিলাম। আমার ভাগ্য খারাপ, আমার জানতাম না আপনি আমায় ডেকেছেন। আমি সত্যিই পানির আওয়াজের জন্য আপনার ডাক শুনতে পাইনি। যদি একবার বুঝতাম, যদি একবার জানতাম আপনি চলে এসেছেন, আমি কখনোই ওই ভুলগুলো করতাম না। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না। দোহাই, আমাকে মাফ করুন। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্যটুকু আমার নেই। আমি নিজেই স্বাভাবিক থাকবো না। আমার অবস্থা আপনি ছাড়া কে বোঝে বলুন? কেউতো আপনার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরের অবস্থা বুঝে না।
আমি কিচ্ছু পারিনা, কিচ্ছু পারিনা, ঠিকঠাক মতো কিছু বলতেও পারিনা। আমার কথাও এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কোথায় যাই বলুন? আম্মা, বড়মা, বুবু, দাদাভাই কেউ এখানে নেই। প্রতিদিন দেখতাম, আপনি সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, আমি পাগলের মতো অপেক্ষায় থাকতাম। অথচ দেখতাম, আপনি কল কেটে দিতেন। আপনার সাথে একটু কথা বলার জন্য কত অপেক্ষায় থাকতাম আপনি জানেন না। যাওয়ার দিন যখন ভুলবশত কিছু বলে ফেললাম, সেটার জন্যও আপনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।
আপনি বিয়ের আগে ভালো ছিলেন, বিয়ের পর আপনি আমাকে আর মূল্য দেন না। আপনি আমাকে ছাদের রুমে একা-একা থাকতে বলছেন, আমি শত ভয় পাওয়া সত্ত্বেও দ্বিমত করিনি। একা একাই ওই রুমটার ভেতর থেকেছি। যতো বারই দুঃস্বপ্ন দেখতাম, মনে মনে ওই অন্ধকার ঝুপড়িতে আপনাকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতাম, আপনাকে আমি পেতাম না। আপনাকে ছাড়া আমার এই শহরের মধ্যে থাকার সাহস নেই, আমি গেঁয়ো, অচল, গাধা।
আমি কারোর সাথে সখ্যতা করতে পারিনা, আমি কিচ্ছু করতে পারিনা, কাউকে মন খুলে দুটো কথা বলতে পারি না, আমার চুপচাপ আচরণ দেখে সবাই আমাকে অহংকারী ভাবে। আমি কি করবো বলুন? আমি নিজেও জানিনা কিভাবে কি করবো, আমি কখনো মানুষের সাথে মিশিনি। আপনি শাস্তি দিতে চাইলে কঠোর কঠোর শাস্তি দিন, আমাকে মে:রে ফেললেও আমি কিচ্ছু বলবো না, কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবেন না। গ্রামের গেঁয়োদের মতোই রেখে দিন, উপন্যাসের ওই অবলাদের মতোই ফেলে রাখুন, আমি ওই অবলাদের মতোই ঘরের এককোণে থেকে যাবো। তবুও ছেড়ে যাবো না।
জমাটবদ্ধ কথাগুলো ব্যক্ত করে প্রচণ্ড ক্লান্ত অনুভব করছে মেহনূর, নাক টেনে একটু সুস্থির অনুভব করলে চোখের ফোলাভাবের জন্য এখন চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে ফিসফিসিয়ে মুখ দিয়ে নিশ্বাস টানছে, মাথা ভারী হয়ে প্রচণ্ড টনটন করে ব্যথা করছে। পিঠের উপর হাতদুটো শিথিল করতেই মুঠো থেকে সাদা শার্টটা মুক্ত হয়ে গেলো, নিস্তেজ পরিবেশটা সুনশান শব্দে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পরিণত হলো। দূর থেকে হুটহাট ট্রাক চলার গমগম শব্দ ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে দু-একটা বেতাল সুরের হর্ণও শোনা যাচ্ছে। মেহনূর অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বুক থেকে মাথা উঠাতে গেলো, কিন্তু ক্লান্তির জন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, সে কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারলো না। প্রথমে ভেবেছিলো, মাথা ভারী হওয়ার কারণে এমন সমস্যাটা হচ্ছে কিন্তু সেই চিন্তাকে ফাঁকা করে আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলো মেহনূর। অনুমানটা ঠিকঠাক ধরতেই হঠাৎ কানের কাছে মৃদ্যু সুরের কন্ঠ শুনতে পেলো,
– রাতটুকু থেকে যাও। আমি কিচ্ছু করবো না।
চোখ খুলেও অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না মেহনূর, হাতটাও ছাড়াতে পারছে না সে। মাহতিমের বাহু বেষ্টনের মাঝে বন্দি হয়ে ছটফট করারও সুযোগ নেই আজ। যদি মাহদি এই রুমে ভুলবশত ‘ ভাই,ভাই ‘ করতে-করতে ঢুকে যায় তাহলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যাবে। মেহনূর আগাম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মাহতিমের পিঠে হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলতে থাকে,
– মাহদি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আমি ওকে মোবাইল ধরিয়ে বুঁদ করে চলে এসেছি। ওকে একটু দেখে আসি, ছাড়ুন।
মেহনূর বহু চেষ্টা চালিয়ে হাতদুটো টেনে এনে মাহতিমের বুক বরাবর ধাক্কা দিলো, লাভের-লাভ কিছুই হলো না, উলটো বাহুযুগলের মাঝে চাপ খেয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মেহনূর বারবার অনুনয় বিনয় করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য, মাহদি যদি দেখে ফেলে তাহলে মারজার কানে যেতে এবার কেউ বাধা দিতে পারবে না। এদিকে মাহতিম এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছে, অন্য কান দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো সুড়সুড় বের করে দিচ্ছে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সত্যি সত্যিই রুমের বাইরে থেকে ‘ ভাইয়া, ও ভাইয়া ‘ বলে ডাক শোনা গেলো।
কন্ঠটা চিনতে পারলো দুজনই, দুজনই মারাত্মক চমকে উঠে হাতজোড়া শিখিল করে দরজার দিকে তাকালো। মাহতিমের তো ইচ্ছে করছে ফাজিলটাকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে, এদিকে মেহনূর তো ভয়েই জব্দ। দরজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুজনই একে-অন্যের মুখের পানে তাকালো, মেহনূরের অবস্থা দেখে মাহতিমের বড্ড হাসি পাচ্ছে। প্রেম করার সময় যেমন বাবার ভয়ে মেয়ে লুকিয়ে থাকে, তেমনি একটা ভাবভঙ্গী ধরে ভীতু বনে আছে মেহনূর। মেহনূরের কপালের উপর থেকে ছোট ছোট চুলগুলো ডানহাতের তর্জনী দিয়ে সরিয়ে দিতেই হাসতে-হাসতে বললো মাহতিম,
– ঘরে স্বামী রেখে দেবরের সাথে লুটোপুটি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমার মান-সম্মান, ইজ্জত, অর্জন সব শেষ করলে?
মেহনূর কপট রাগ দেখিয়ে ভ্রুদুটো কুঁচকালো। ক্ষীণ রাগের রেশে বলে উঠলো,
– আপনি কার সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছেন?
মাহতিম হাসি থামিয়ে চোখ স্বাভাবিক করলো। আপাতত উত্তর না দিয়ে মেহনূরকে কম্বলের নিচে আপাদমস্তক ঢেকে শুতে বললো। মেহনূর কথার পিঠে প্রশ্ন ছোঁড়ার সাহস পেলো না, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া প্রশ্ন ছোঁড়ার নিয়ম স্বামীর সাথে খাটানো ঠিক না। বড়মার কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে সেই মতেই কাজ করলো মেহনূর। এদিকে দরজা খুলে হুলস্থুল ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলো মাহদি, রুমে ঢুকতেই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর সুরে বললো,
– ভাইয়া, এই তুমি আমার বউকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? ও নিজের রুমে নেই, মায়ের রুমেও নেই, কিচেনও নেই। কোথায় ও!
মাহতিমও পালটা উত্তর ছুঁড়ে দাম্ভিকতার সাথে বললো,
– রাতে কি টাটকা চড় খেতে এলি? লাগাবো? লাগালে কিন্তু ওই সাইড দিয়ে ভাত চিবাতে পারবিনা।
আলমারির ডান দ্বারটা খুলে কাঠের ড্রয়ারটা টান দিলো মাহতিম। মাহদির কথাটা স্পষ্ট ভাবে কানে শুনেছে সে। ফা’জিলের ‘ বউগিরি ‘ স্বভাব আজ কেমন করে ছুটিয়ে ছাড়বে সেটার জন্য জম্পেশ একটা শিক্ষা রেডি করছে। কম্বলের নিচে ভয়ে কাহিল অবস্থা মেহনূরের, যদি কম্বলটা খপ করে টান মারে তাহলেই খেলা শেষ। মাহদি নিজের উত্তর না পেয়ে মুখ কাঠিন্য করে কোমরে দুহাত রাখলো, ভাইয়ের কাছে কয়েক কদম এগিয়ে এলে মাহতিম ঠাস করে ড্রয়ার লাগিয়ে আলমারির দ্বার বন্ধ করলো। মাহতিম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে থাকলে পেছন থেকে মাহদি ফের বলে উঠলো,
– তুমি আলমারীতে ওকে লুকিয়ে রেখেছো তাইনা?
চোখ দুটো খিঁচুনি দিয়ে হাসি আঁটকালো মাহতিম, ভুলেও পিছু ফিরে তাকালো না। পেছন থেকে ভাইয়ের অবস্থাটা ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে হঠাৎ কম্বলের দিকে নজর চলে গেলো। কম্বলের ওমন ভূতুড়ে কাঁপুনির নড়াচড়া দেখে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিউরে উঠলো মাহদির। হরর সিরিজের দৃশ্যপট মনে পরতেই ‘ ও মাগো, ভাইয়া ‘ বলে চিৎকার দিয়ে তৎক্ষণাৎ মাহতিমকে পেছন থেকে জাপটে ধলো। হুট করে চিৎকারের কারণ বুঝতে পারলো না মাহতিম, সাথে-সাথে মাহদির দিকে ঘুরে দাঁড়ালে মাহদিকে কারণ দর্শাতে বললো।
মাহদি ঢোকের-পর-ঢোক গিলতেই চোখমুখ খিঁচে তর্জনী তুলে বিছানার দিকে ইশারা করলো। ইশারা করতে দেরি ওমনেই ঘরের বাইরে পা চালিয়ে ভোদৌঁড়ে ছুঁটে পালালো। দুহাতে কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহনূর, হাসতে-হাসতে মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না তার। মাহতিমও সেই অবস্থা নিজের হাসি সামলাতে না পেরে হো-হো হেসে দিয়েছে। আচমকা হাসি থামাতে-থামাতে মাহতিমের দিকে মুগ্ধনেত্রে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। অস’ভ্য, নি’ষ্ঠুর, বে’পরোয়া মানুষটার হাসিটা হেসে আজ মেহনূর উপন্যাসের চরণযুগল মনের ভুবনে আওড়াতে লাগলো,
মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন।
মলিন বসন ছাড়ো সখা, পরো আভরণ।
( সংগৃহীত চরণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
সোল্লাসে মেতে উঠলো আনসারী নিবাস। কেউ বুঝতে পারেনি, ভাবতে পারেনি, মাহতিম হুট করে সকলের মাঝে ফিরে আসবে। যেখানে আসার কথা ছিলো ছয়টা মাসের ব্যস্ত জীবন কাটিয়ে, সেখানে চারটা মাসের হাড়ভাঙ্গা ক্লান্তি শেষে আচমকা সে ফিরে এসেছে। মাহতিমের আগমনে পুরো বাড়ির আবহাওয়া আনন্দমেলায় রমরমা, তবুও দুটি মানুষের মন যেনো ভার হয়ে আছে। রজনী ও অনামিকা এবার যেনো সুযোগের অবস্থা দেখে রসালো ঠোঁটে হাসলো। এদিকে মাহতিম আসতে-না-আসতেই দলবলকে খবর দেওয়ার মতো মহৎ কাজটা করে ফেলেছে। এবারও সে বাড়ির বাইরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করে রেখেছে।
মারজা এ নিয়ে কোনো দ্বিধা প্রকাশ করলেন না। তিনি জানেন, ছেলে এবারও তার কোনো কথা শুনবে না। মাহতিম যেহেতু বেড়ানোর এহলান করেই দিয়েছে, তার মানে যতো ঝড়বৃষ্টি হোক না কেনো, সে যথাসময়ে সবকিছু রেডি করে ফেলবে, একইসাথে বন্ধুদল এবং ভাইবোনেরা ঠিকই যথাসময়ে হাজির হয়ে যাবে। পরদিন ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই সকলের আসার খবর আসতে লাগলো। মেহনূর একের-পর-এক খবর শুনে আশ্চর্যে হতবাক! বাড়িতে আসতে দেরি, অথচ বাড়ির হুল্লোড় ফিরতে দেরি হলো না। মারজাকে ঔষুধ খাইয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নামলো মেহনূর, রাতে মাহতিমের সাথে থাকা সম্ভব হয়নি। সে নিজেই মেহনূরকে মারজার রুমে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে, কেনো দিয়েছে মেহনূর সেটা জিজ্ঞেস করেনি। সকালের নাস্তার আয়োজনটা সিরাজ কাকা ও সাবু খালা সামলাচ্ছে। রান্নাঘরের সবকিছু কতদূর এগিয়েছে সেটা দেখার জন্য সেখানে উপস্থিত হলো মেহনূর, পরোটার তলায় একটুখানি তেল ঢেলে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো খালা,
– ও বউ তুমি উইঠা গেছো? যাক ভালা হইলো। তুমি এট্টু এইনে খাড়াও তো দেহি, আমি যাইয়া এট্টু কফিডা দিয়া আহি। রজনী ভাবী হেই কহন চাইছে, এট্টু খাড়াও এইহানে। আইতাছি।
ট্রে-তে চটপট কফির মগটা রেখে চুলাটা মৃদ্যু আঁচে কমিয়ে সাবু খালা চলে গেলো। বৃদ্ধ সিরাজ একে-একে সব নাস্তা প্রস্তুত করে অন্য কাজের জন্যে বেরিয়ে পরলো। মেহনূর সবকিছু ঠিকঠাক দেখে অন্য চুলায় চায়ের পানি বসালো, সকাল-সকাল মারজাকে এক কাপ আগুন গরম চা না দিলে তিনি মুখ ফুলিয়ে বসে থাকেন। মেহনূর বাদে অন্য কারোর হাতে চা খেতে তিনি যথেষ্ট নারাজ। সারি সারি তাক থেকে চাপাতার বয়াম নিয়ে গোল ঢাকনাটা ঘুরাতে-ঘুরাতে খুলতে লাগলো মেহনূর, চুলার কাছে চায়ের দুটো কাপ এবং দুধ-চিনি রেখে দিলো।
পরিষ্কার ছাঁকনি দিয়ে চায়ের কালচে লিকারটা কাপে ঢেলে নিতেই চামচ দিয়ে দুধ মিশিয়ে নিলো, চিনির পরিবর্তে মারজার কাপে জিরো সুগারের ছোট্ট ট্যাবলেট ছেড়ে দিলো। পুনরায় যখন চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে ব্যস্ত হলো, তখনই দমকার হাওয়ার ন্যায় পিঠের উপর উষ্ণসূচকের লহমায় চমকে উঠলো মেহনূর। সমস্ত শরীরের সাথে-সাথে হাতটা শিউরে উঠতেই আঙ্গুলের ডোর থেকে ফসকে গেলো চামচটা, তখনই টস করে চামচটা কাপের গায়ে শব্দ করে উঠলো। চোখদুটো আচ্ছন্নের মতো তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে এলে পেছন থেকে একজোড়া হাতের আগমন টের পেলো মেহনূর।
হাতদুটো ধীরগতিতে কোমরের দুধার থেকে ধেয়ে এসে পেটের উপর বেষ্টন করে ধরলো। দফায়-দফায় অধরযুগলের ছোট্ট-ছোট্ট পরশ যেনো পিঠের পরিখায় ছাপিয়ে দিতে উন্মত্ত ছিলো। ক্রমে মেহনূরের হাতদুটো মুঠো হয়ে গেলো। জানালার গ্লাস গলে সোনালী সূর্যের আলোটা পাতার ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করছিলো, স্নিগ্ধ সকালের মনোহর পরিবেশ যেনো নিরব সাক্ষী হয়ে সব দেখতে লাগলো। রুদ্ধপ্রায় নিশ্বাসে চোখদুটো খুললো না মেহনূর, মনের উপর বশীভুত অবস্থার জন্য দেহের উপরও চন্ঞ্চলতার উচ্ছাস এসে ভর করছে। শক্ত করা মুঠোদুটোর আঙ্গুল আস্তে-আস্তে আলগা করলো মেহনূর, কাপের কাছ থেকে হাত নামিয়ে পেটের উপর থাকা হাতযুগলের উপর আস্তে করে রেখে দিলো। কোনোমতে আধো-আধো গলায় স্বর নামিয়ে ঘোরাক্রান্ত মানুষটার উদ্দেশ্যে বললো,
– এটা রান্নাঘর, ছেড়ে দিন না।
পিঠের উপর কার্যসাধন করা মাহতিম নিঃশব্দে হেসে ফেললো তখন। মেহনূরের কন্ঠ যে ভীতু বনে গেছে সেটা আন্দাজ করে ঠোঁটে প্রগাঢ় হাসি ফুটিয়ে তুললো। নিশ্বাসের অবস্থা প্রখর হয়ে গেছে, বারবার পেটের উঠা-নামার জন্য নিজের হাতদুটোও সমান তালে উঠা-নামা করছে। মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে যদি নিজের দিকে ঘুরানো হয়, তাহলে সে কি লজ্জায় মাহতিমের দিকে তাকাতে পারবে? অতি লজ্জায় তার ছোটোখাটো মুখটা কি রক্তজবার মতো লাল হয়ে যাবে না?
এইযে আদুরে ভঙ্গির আচরণগুলো করলো, ছোট ছোট স্পর্শে ছুঁইয়ে দিলো, এসবের ব্যতিরেকে সে কি লজ্জায় বুঁদ হবেনা? মুখটা নিজের দিকে ঘুরাতে নিলে, চোখদুটোয় দৃষ্টি মিলাতে নিলে, তখন কি দুহাতে লজ্জামাখা মুখটা তাড়াতাড়ি ঢাকবে না? মাহতিম মনের মধ্যে অজস্র কথা ভাবতে থাকলে পিঠের উপর থেকে ঠোঁট সরিয়ে আনলো, তার নিচু করা মাথাটা উপরে তুলতেই মেহনূরের ডানকাধে থুতনি ছেড়ে দিলো। সদ্য শেভ করা ক্লিন গালটা সন্তপর্ণে মেহনূরের ডান গালে ছুঁইয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে বললো,
– এটা যদি আমাদের রুম হতো, তখন কি আগলে রাখতে?
লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে চাইছে মেহনূর। এতো লজ্জা, এতো চাপা অবস্থা নিয়ে এই মানুষটার সামনে দ্বিতীয়বার পড়া যাবে না। তার মুখে তো কিছু আঁটকায় না, তন্মধ্যে কখন কি বলে ফেলে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মেহনূর ঢোক গিলে চোখ খুলে দরজার বাইরে দৃষ্টি দিলো, কেউ এখনো দেখেনি দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তেই পেটের উপর থেকে চাপযুক্ত বন্ধনটা ঢিলে হয়ে গেলো। কাধ থেকে ভারী থুতনিটা সরে যেতেই চুলার একটু পাশে ঠিক ডানদিকটায় উঠে বসলো মাহতিম। ঠান্ডা হয়ে আসা চা-টা ফের গরম দেওয়ার জন্য চুলায় বসালো মেহনূর, একবারের জন্যও সে মাহতিমের দিকে চোখ তুলে তাকালো না। একটু আগের চনমনে ভাবটা এখনো দেহের শিরায়-শিরায় দোল খেয়ে ঘুরছে, যদি চোখের ভাষায় সেটা ধরা খেয়ে যায় তাহলে ঘোর বিপদ আসন্ন! মাহতিম মিচকি-মিচকি হাসিতে মেহনূরের কাণ্ডকারখানা দেখতেই সরল গলায় বললো,
– ম্যাডাম, আপনার হাতের এক কাপ চাই। মেহেরবাণী করে যদি মাহতিম আনসারীর খায়েশটা পূরণ করতেন, তাহলে পুরো নেভি টিম আপনাকে কুচকাওয়াজের সংবর্ধনা দিতো।
চুলার টগবগে চায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মাথা নিচু করে হেসে দিলো মেহনূর। শব্দহীন ভঙ্গিতে হাসতে থাকলে হাসি-হাসি চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো, এক পশলা প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে বললো,
– দিচ্ছি।
ফিরতি উত্তরটা শুনে আশ্চর্য হতে গিয়ে হেসে ফেললো মাহতিম। একটু হলেও হোক, মেহনূরের বরফতুল্য জড়তা দিনকে-দিন সময়ে-সময়ে উষ্ণ সাহচর্যে গলতে শুরু করেছে। মাহতিম চুপ করে হাসিমুখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ধোয়া উঠা চা-টা দু’বার দু’দফায় গরম করে দুটো কাপে ঢেলে নিলো মেহনূর, একটা কাপের তলায় পিরিচ দিয়ে সেটা মাহতিমের দিকে এগিয়ে দিলো। বাড়িয়ে দেওয়া কাপটার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম, পরক্ষণে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে বললো,
– চিনিটা যদি চেখে দেখতেন, আমার মতো ব্যস্ত মানুষটার কষ্টটা একটু কমে যেতো।
কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে একটুও সময় লাগলো না, চট করে পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা মনে পরলো। সেই রাতেরবেলা সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে নাস্তানাবুদ, তখন একাকী রান্নাঘরে চায়ের পসরার সামনে হাজির হয়েছিলো এই অ’সভ্য খ্যাত লোকটা। সেদিনও একই কায়দায় এক কাপ চায়ের ফরমাশ করেছিলো সে, বুদ্ধির উপর ভেলকি দিয়ে মেহনূরের চুমুক বসানো কাপে সে নিজেও ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দেয়, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কৌতুহল কিশোরীর কাছে নিজের আর্দ্র অনুভূতি ব্যক্ত করে লোকটা। আজও এই লোকটা তার কাছে মনের রুদ্ধ-দ্বার খুলে আবদারের বায়না চেয়ে বসেছে।
মেহনূর ইতস্তত ভঙ্গিতে নত মাথায় কাঁচুমাচু করতে থাকলে হঠাৎ মেহনূরের পেছনে থাকা দূরবর্তী দরজায় দৃষ্টি থমকে গেলো মাহতিমের। সাবু খালা রান্নাঘরে ঢুকবে কিনা সেটা নিয়ে হাঁশফাঁশ করছিলো, তার এদিক-ওদিক করা দ্বিধাপূর্ণ দৃষ্টি যখন একজোড়া তীক্ষ্ম দৃষ্টির পানে পানে পরলো, সে ভয়ে ভূত দেখার মতো শিউরে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, তাড়াতাড়ি করে নিজেকে স্বাভাবিক করার ধান্দায় জোরপূর্বক হাসি ছুঁড়ে দিলো। কিন্তু আফসোস, লাভ হলো না। ওই তীক্ষ্ম দৃষ্টি তার ধারালো-ভয়াবহ চাহনি দিয়ে ভেতরের ক্ষেপাটে ভঙ্গিটা এমন ভাবে প্রকাশ করলো, সাবু খালা এক সেকেন্ডও দাঁড়ানোর স্থিতিতে রইলো না, ভীতিগ্রস্থ মুখ নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। এদিকে মেহনূর নিজের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থাটা কোনোমতে কাটিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট চেপে দিলো, ছোট্ট এক চুমুক দিয়ে মাহতিমের দিকে ঠেলে দিলো কাপটা। মেহনূর লজ্জাহত অবস্থার জন্য চোখ তুলেনি, যদি একবার চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকাতো, ভয়ে হয়তো সহজলভ্য আচরণটা আর কখনোই দেখাতে পারতো না মেহনূর।
দিনের আলোটা নেভার কৌশলে কমলাবর্ণের চাকাটা পশ্চিমে এখন ডুবো-ডুবো করছে। সূর্যের তেজীভাব হ্রাস পেয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঢল নেমেছে। প্রকৃতির মাঝে দেখা যাচ্ছে বেগুনি আকাশের দারুণ আদিখ্যেতা, সেই আকাশে ডান ঝাপটে নীড়ে ফিরছে পাখিদের ব্যস্ত দল। কিছু কুচকুচে কাক কুৎসিত ডাকে ‘ কা কা ‘ করছে, বাতাসের জোরালো ঝাপটা খেয়ে গাছের পাতারা কল্লোল করছে এখন। দ্বিগ্বিদিক ছেয়ে যাচ্ছে নিরবতার চাদর, শহুরের হুল্লোড় কমতে-কমতে কয়েকটা হর্ণের বাজনা শোনা যাচ্ছে। টাইলসে বাঁধাই করা পরিষ্কার ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম, তার পাপড়িভরা নয়নদুটো আকাশের উপর ন্যস্ত।
আজ বাইরে যাওয়া হয়নি বলে চুলের উপর জেলের আস্তরণ পরেনি, জেলহীন চুলগুলো বাতাসের সান্নিধ্য পেয়ে থেমে-থেমে উড়ছে। গাঢ় বাদামী রঙের শার্টটা এখন কালো হুডির নিচে ঢেকে আছে, বুকের কাছে হুডির চেইনটা লম্বালম্বি করে খোলা। ওই চেইন খোলা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের বাদামী শার্ট, শার্টটার প্রথম বোতামটা খোলা থাকার কারণে বাতাসের ঝাপটা লেগে বুকের কিন্ঞ্চিত অংশ উন্মুক্ত হয়, আবার বাতাসের ঝাপটা কমে গেলে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। পরশু দিন কক্সবাজার যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেছে মাহতিম, তার ফিল্ডের মূল ঘাঁটিটা চট্টগ্রাম শহরে। সেখান থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কতবার ঘিয়েছে সেটা অবশ্য বেহিসেব।
এবার পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে আসার চিন্তাটা পাকাপোক্ত করেছে শুধুমাত্র মেহনূরের জন্য, মেহনূর আজ পযর্ন্ত বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে প্রকৃতি দেখেনি। মাহতিম হিমেল হাওয়ার ওই সাঁঝের মায়ায় চোখ বন্ধ করলো, মানসপটের সাদা ক্যানভাসে রঙতুলি চালিয়ে বেশ রঙিন ছবি তৈরি করলো, সেখানে মেহনূর নামক হাস্যোজ্জ্বল কিশোরীর চোখে-মুখে লজ্জার ছাপ, পড়নে সোনালী পেড়ে লাল টুকটুকে শাড়ি, নাকে বিয়ের সাজের মতো সোনালী রঙের গোল নোলক, মাথাটা টিকলী সমেত অলঙ্কৃত, হাতভর্তি বধূর সাজের মতো ভারী-মোটা চুড়ি। রঙবেঙরের ফুলের মাঝে সুসজ্জিত ছোট্ট ঘরে নূপুরের পদধ্বনিতে আগমন করবে মেহনূর আফরিন।
লম্বা ঘোমটার আড়ালে যার সমস্ত রূপ আবৃত থাকবে সেদিন। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা, উৎকন্ঠা শেষে তীব্র আকাঙ্ক্ষিত দিনটায় স্বপ্নচারিনীর মেহেদি রাঙা হাতদুটো অধিকারের আবেশ খাটিয়ে নিজের হাতে পুড়ে নিবে। মেহেদির সুক্ষ সৌন্দর্যের উপর গাঢ় চুম্বনের ওষ্ঠজোড়া চেপে রাখতে দিবাক্ষণ প্রস্তুত যেনো, লজ্জায়-ভালোবাসায় দুরুদুরু করা বুকটায় একটু সাহস ভরে চোরা নজরে তার প্রাপ্তবয়স্ক সুদর্শণ পুরুষটাকে প্রাণভরে দেখবে মেহনূর, হঠাৎ দুজনের মাঝে চোখাচোখি হতেই…
– হ্যালো আনসারী, একা একা এখানে কি করছো? খারাপ লাগছে নাকি? কোম্পানি দিবো?
রঙিন কল্পচিত্রে কেউ যেনো কালো ঢেলে দিলো। সেই কালির গাঢ়তা এতোই প্রকট হলো, কোনোভাবেই পুরোনো চিত্রটা ফিরে পেলো না মাহতিম। চোখের বন্ধ কপাটটা খুলে সঙ্গে-সঙ্গে ডানে ফিরে তাকালো, ঠিক পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। মধ্যবর্তী দূরত্ব দেখে রাগে নিজেই খানিকটা দূরত্ব করে পিছিয়ে গেলো মাহতিম, রেলিং থেকে হাত সরিয়ে ধীরেসুস্থে ট্রাউজারের দু’পকেটে হাত গুঁজে ফেললো। অনামিকার পোশাকে একবার চোখ বুলিয়ে ঘেন্নায় অন্যদিকে মুখ ফেরালো। অনামিকা হাতদুটো ভাঁজ করে লাস্যময়ী হাসি ছুঁড়ে বললো,
– অনেষ্টলি স্পিকিং আনসারী, ডে-বায়-ডে ইউ আর গেটিং হ্যান্ডসাম। মাশল ফুলে তো দেখি হার্টবিট মিসের অবস্থা করে ফেলেছো। তা তোমার ফিগার দেখে তো আমারই প্রেম পাচ্ছে, ওর কি একটুও প্রেম পায় না?
অনায়াসে কথাগুলো বলে দিয়ে টসটসে চোখে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো অনামিকা। একদিন এই যুবা পুরুষের উপরই নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছিলো সে, হারাতে গিয়ে নিজের সম্রন্ত্র ব্যক্তিত্বের উপর এমন অপঘাত খেলো সেটার মাশুল এখনো মনের মধ্যে দগদগে হয়ে আছে।
অনামিকার তেরছা খোঁচায় ক্ষেপার পরিবর্তে বাঁকাহাসি দিলো মাহতিম। দৃষ্টিদুটো অনামিকার দিকে স্থির রেখে পায়ে-পায়ে একদম নিকটে এগুতে লাগলো, এমন দৃশ্য দেখে লাস্যময়ী হাসিটা উবে গিয়ে এক লহমায় আতঙ্কগ্রস্থ দৃষ্টি ধারণ করলো। আতঙ্কের আভাসটা অনামিকার চোখে-মুখে ফুটে উঠলে বাঁকা হাসিটা গাঢ় করে একদম কাছে গেলো মাহতিম, মাথাটা নিচু করে অনামিকার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলো। অনামিকা যেনো নিজের মধ্যে নেই, সে আবারও অতীতের ভুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। যেই কড়া পারফিউমের ঘ্রাণে দেহের ভেতর নিভু-নিভু কোষগুলো উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত হয়ে যেতো, যেই চাহনিতে দৃষ্টি পরলে নিজের বিবেক-আবেগ কাজ করতো না, যেই বাঁকা ঠোটের হাসি দেখলে বুকের ধুকধুকনি নিশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটাতে তটস্থ থাকতো, আজ ফের একই অবস্থা হচ্ছে। অনামিকা কন্ঠ গুলিয়ে ফের তোতলামি ভঙ্গিতে সুর ধরেছে,
– ইইইউ আআর গিভিং মি ডেডে’ন্ঞ্জা’রারাস লুলু’ক মাহতিতিম, প্লিপ্লিপ্লিজ ডোন্ট ডু দ্যাদ্যাট..
মাহতিম চওড়া করে হেসে দিলো। নিচু গলায় ক্ষো’ভ দেখিয়ে বললো,
– ইউ আর জাস্ট এ্যা ভা’লগার! আমি সেদিনও তোমায় ঘৃ’ণা করতাম, আজও তোমায় প্রচণ্ড বেশি ঘৃ’ণা করি। তুমি আমার মেহনূরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে, ওর আশেপাশেও যদি তোমার নোং’রামির ছায়া ভিড়তে দেখি, গতবার যেই হাল করেছিলাম, এবার একদম নৃ’শংস অবস্থা করে ছেড়ে দিবো। তোমার চৌদ্দগোষ্ঠীর একটাকেও আমি মাহতিম ভয় পাই না। পলিটিক্যাল পাওয়ার কতো খাটাতে পারো, খাটাও। আমিও মুখে চিড়া ভিজিয়ে তামাশা দেখবো না। চুপ আছি, তার মানে নিশ্চয়ই এটা না, আমি কিছুই করতে জানিনা।
আমার মা’কে তোমরা উলটা-সিধা যতোই বুঝাও, আমার আচরণ কোন্ পর্যায়ে জ’ঘন্য হতে পারে সেটা একবার প্রমাণ পেয়েছো। এবার যদি ধরি, খু’ন করে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিবো, সারা জনম খুঁজলেও লা’শের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেনা।
বিক্ষোভে ফেটে পরা বাক্যগুলো শশব্যস্তে ছুঁড়ে দিলো মাহতিম। নিচু করা মাথা স্বাভাবিক করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, বিদ্যুপৃষ্ঠের মতো শক্ত থাকা অনামিকা থরথর ঠোঁটে স্থির চোখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের উপর টলটলে অশ্রুর জোয়ার দেখে একই স্টাইলে আরেকদফা বললো মাহতিম,
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৮+৩৯
– তোমার রজনী ফুপিকে বিশেষ ভাবে সর্তক সংকেত দিয়ে দিও। বলে দিও, যেই হাত দিয়ে আমার বুকের উপর মোচ’ড়ানোর সাহস দেখিয়েছে, ওইহাত আমি সুস্থ রাখবো না। চললাম!
পকেট থেকে দুহাত বের করে মাথায় হুডির টুপিটা এক ঝটকায় টেনে নিলো মাহতিম। ছাদ থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পরলো, কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে শেষে মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক এবং সংযত কন্ঠে বললো,
– ট্যূরে যদি ঘাপলা করতে দেখি, একেবারে সমুদ্রের মধ্যেই অস্তিত্ব গেঁ’ড়ে দিয়ে আসবো। লাস্ট এলার্ট!
