মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৬

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৬
ফাবিয়াহ্ মমো

অবাকে-বিষ্ময়ে চূর্ণ হলো তানভীর। চোখদুটো দরজার দিকে স্থির। একজোড়া ক্ষুরধার দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। দুটো বলপূর্ণ হাত বুকের কাছে ভাঁজ করা। কালো শার্টের নিচে প্রশস্ত দেহের অস্তিত্ব। সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের উপর দাম্ভিকতার ছাপ স্পষ্ট। আচার-চলনে পরিপাট্যের ছোঁয়া। লোকটা কেনো শিষ বাজালো তানভীর জানে না। সেটার রেশ ধরে একদফা প্রশ্ন ছুঁড়লো তানভীর,

– আপনি কে?
এবার দৃষ্টি ঘুরালো মেহনূরের দিকে। বড়-বড় চোখদুটোতে অনিমেষ নেত্রে তাকালো। দূর থেকে ভ্রুঁ নাচিয়ে ছোট্ট ইশারা করলো। অর্থ হলো, ‘ আমি কে বলে দাও ‘। শীতের শিরশির অনুভূতির মতো ঢোক গিললো মেহনূর, চোখের চাহনি এখনো অটল। আকস্মিক ধাক্কার মতো শরীর ঝিমঝিম করছে। বক্ষস্থল শুকিয়ে খরার মতো চৌঁচির। উত্তর না পেয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো তানভীর। জোর দিয়ে উত্তেজিত গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– কে এই লোক ? এখানে বাগড়া দিচ্ছে কেন?
বজ্রাহতের মতো কেঁপে উঠলো মেহনূর। ধীরগতিতে চোখ তুলে তানভীরের পানে তাকালো। ঠোঁটদুটো নাড়িয়ে ভীতু গলায় বললো,
– আন-আনসারী,
কথার আগাগোড়া বুঝতে পারলো না তানভীর। দুই ভ্রুঁ কুঁচকে ক্ষেপাটে গলায় বললো,
– কিসের আনসারী? এই লোক শিষ —

চেঁচাতে গিয়ে আচমকা থেমে গেলো তানভীর। ভয়ংকর কিছু মনে পড়ায় থেমে গেলো সে। চোখদুটো তৎক্ষণাৎ বড়-বড় করে মাথা পিছু ঘুরালো। দরজার দিকে অবাক দৃষ্টি রেখে কাঁপা গলায় বললো,
– মা-মা-মা-মাহতিম?
তোতলানো অবস্থা দেখে বাঁকা হাসলো মাহতিম। হেলানো অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গলাটা একটু দাম্ভিকতার স্টাইলে খাঁকাড়ি দিয়ে সংযত গলায় বললো,
– তাইতো মনে হচ্ছে।

বিপদের আশঙ্কায় ভীত হলো তানভীর। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার! মেহনূরকে শায়েস্তা করার চিন্তা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। এখন যদি অঘটন কিছু ঘটে যায়, তাহলে একবিন্দু রক্ষে নেই! তানভীরের জব্দ অবস্থাটা অগ্রাহ্য করলো মাহতিম। তার ব্যকুল দৃষ্টি স্রেফ মেহনূরের দিকে আবদ্ধ। দুটো স্বচ্ছ চোখের চাহনি চুপচাপ দেখছে সে। কতদিন পর চোখদুটোর কাছে হাজির হয়েছে। একটু কাছে গিয়ে চিবুক ছোঁয়ার বাসনা বড্ড পাগল করে তুলছে। আজও প্রথমদিনের মতো নিজেকে কাঙ্গাল-কাঙ্গাল লাগছে। নিরবতার ক্ষণটুকু চলতে থাকলে দ্রুত চোখ নামালো মাহতিম। বুকভর্তি দম নিয়ে শব্দ করে ছাড়লো। বাহ্যিক রূপটা এক লহমায় পরিবর্তন করে তানভীরের দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে দাম্ভিকতার সাথে আস্তে-আস্তে বললো,

– নোটিশ ছাড়াই বিদায় হন ব্রাদার। স্পেশাল ট্রিট পেলে বাঁচবেন না।
বাক্যদুটোর ভেতর কি ছিলো, তানভীর জানে না। সে চোখ তুলে একবার মেহনূরের দিকে তাকালো, এরপর তাকালো মাহতিমের দিকে। মাহতিম এখনো ঝাঁজালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টির অর্থ একটাই, ‘ শরীরের চামড়া যদি বাঁচাতে চাস, শা:লা এক্ষুণি বের হ ‘। তানভীর ক্ষীণ একটা ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত রাখলো। পরাস্ত সৈন্যের মতো নতশির অবস্থায় পা চালিয়ে দিলো। দরজার কাছাকাছি এসে বাইরে বেরুতে নিবে, তখনই মাহতিম ঠান্ডা স্বরে বললো,
– ব্রাদার, একটু দাঁড়াবেন?

কোমল কন্ঠের আদেশ শুনে পা থামালো তানভীর। বুঝতে পারলো না মাহতিম কেনো ডাকলো। ডানে তাকিয়ে মাহতিমের দিকে মনোযোগ দিলো সে। মাহতিম তখন মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তানভীর কিছুটা ভড়কে গেলেও আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলো না। বোকার মতো সেও পালটা হাসিটা দিয়ে ফেললে বুকের হাতদুটো খুললো মাহতিম। হাসি-হাসি ঠোঁটে ওর দিকে এক-পা এগিয়ে গেলো। দূর থেকে সব দেখতে পেয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে মেহনূর। ভয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপা অবস্থা।

রেসোর্টের ভেতর তরুণের দৃশ্যটা এখনো ভুলেনি মেহনূর, এই লোকের হাব-ভাব আজও খারাপ রূপ নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি যদি না থামায়, তাহলে গ্রামের ভেতর আরেকটা কুৎসা রটে যাবে। মেহনূর দ্রুত শুকনো গলাটা ভিজিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে, তখনই নিরবতাকে টুকরো-টুকরো করে বিকট শব্দ হলো। নিঃশব্দ পাঠাগারের দেয়ালে-দেয়ালে ভীতিকর শব্দ বেজে উঠলো। প্রচণ্ড ভয়ের আক্রোশে মুখে দুহাত চাপলো মেহনূর, নিষ্প্রাণ-নিষ্পলক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলো। গালে মারাত্মক ঘুষি খেয়েছে তানভীর, মুখের বাঁপাশটা একদম অনুভূতিহীন লাগছে। যেনো প্যারালাইসিস রোগের মতো বাঁ-দিকটা হারিয়ে গেছে। ব্যথায় খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটো খুললো সে, শক্ত চেহারাটা দেখতে পেলো চোখের সামনে। যেই চেহারাটা একটু আগে সদ্ভাব মুখে তাকিয়েছিলো, এখন সেটা বিলীন! সেই মুখ, সেই চোখ, সেই হাসির পরিবর্তে নিষ্ঠুরতার মূর্তি ফুটে আছে। চোখের চাহনি মারমুখো পাষাণের মতো আস্ফালন সুরে বললো,

– তোর সাহস, তোর কারেন্ট দুটোই নামিয়ে দিতাম। নামালাম না। শর্ট ডোজ দিলাম। চুপচাপ এখান থেকে বেরিয়ে যা। ভুলেও যদি এদিক-ওদিক তাকাস, সিধা তোর কলকবজা নাড়িয়ে দেবো। যা ফোট্!
সমস্ত দাপট চুরমার করে চলে গেলো তানভীর। গাল ধরে চলে যেতেই সিঁড়ির শেষ দিকটায় থামলো। মাথা পিছু ঘুরাতেই পিছু সেই ক্ষোভিত দৃষ্টিটা দেখতে পেলো। মাহতিম এখনো তাকিয়ে আছে। একনজর সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই নিরস্ত ভঙ্গিতে নিচু চাহনিতে চলে গেলো তানভীর। একবারও পিছু ফিরে তাকালো না। পাঠাগারের রুদ্ধশ্বাস অবস্থা শান্ত করলো মাহতিম, মেহনূরের পায়ের কাছে দৃষ্টি দিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললো,
– চশমাটা তুলো।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। একটুও বদলায়নি। একটুখানিও না। দুটো বছর আগে যেভাবে ফেলে এসেছিলো, আজও মানুষটা সেরকম আছে। বিচক্ষণ মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, শক্তপোক্ত দেহ, উদ্যমী চেতনা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বভাব, কিচ্ছু বদলায়নি। মাহতিম আনসারী নিজের বাহ্যিক কাঠামোতে কিছুই বদল করেনি। নিজের অবিশ্বাস্য মন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। আকস্মিক আগমনটা মানতে পারছে না।

কোনোভাবেই বুঝাতে পারছেনা এটা মাহতিমই! তারই মাহতিম! তারই মানুষটা বদমায়েশি করে হাজির হয়েছে। প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা অগণিত সময় এই মানুষটা মন কুঠিরে তোলপাড় করে বেড়াতো। ফেলে আসার পরও স্বস্তি পায়নি, শান্তি পায়নি, স্থির থাকেনি মেহনূর। দুটো বছর, দুটো যুগ কাঙ্গালের মতো নিঃস্ব কেটেছে। আজ কেনো এসেছে? কিসের জন্য এসেছে? কে ডেকেছে উনাকে? কিসের জন্য নিজের দামী ব্যক্তিত্ব নিয়ে এখানে আসলো? গেঁয়ো মাটিতে পা ফেললো কেনো? ভেতর থেকে অশ্রুবর্ষণের অমেয় ধারাটা উত্থানের জন্য চোখ ছলছল করছে।

নিজের কোমল আবেগ, সবটুকু অনূভূতি, দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ অভিমান সংবরণ করলো মেহনূর। পায়ের কাছ থেকে চশমা তুলে ভেজা চোখের দৃষ্টিদুটো মাটির দিকেই নুইয়ে রাখলো। যেই আত্মগরিমার বলয় নিয়ে এতকাল শক্ত ছিলো, আজও সেরূপ সংযত রয়ে পা চালালো মেহনূর। দরজার দিকে যতো নিকটবর্তী হচ্ছিলো, ততই বুকের হৃৎস্পন্দন অগণ্য চাপে কাঁপছিলো। একবারের জন্যও চোখ তুললো না মেহনূর, দরজার কাছটায় আসতেই দম আঁটকে চৌকাঠ পেরুলো। নিশ্বাসটা বহুকষ্টে চেপে রেখে পাশ কাটিয়ে চললো। একপলকের জন্যও ডানে ফিরলো না সে।

ওর দিকে যেই নির্মল দৃষ্টিটা কাতর ভাবে তাকিয়ে আছে, সেদিকে লক্ষ করলো না মেহনূর। অত্যন্ত নৃশংসভাবে অগ্রাহ্য করে চশমা নিয়ে বেরুলো। সিঁড়ির ধাপে পা ফেলতেই পিছন থেকে পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। সেই শব্দ তারই পদক্ষেপের তালে-তালে এগুচ্ছে। দুধারে সবুজ জংলী ঘাস, সুউচ্চ গাছ, মাঝখানে চিলতেখানি সরু পথ। সেই পথটুকু মাঠের দিকে অগ্রসর। মেহনূর নির্বিকার চিত্তে পা ফেলে এগুচ্ছে। কে আসছে, কেনো আসছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। একহাত দূরত্ব রেখে পিছু-পিছু হাঁটছে মাহতিম। পকেটে দু’হাত গুঁজে মনন কোঠার ছোট্ট প্রিয়কারিণীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে মেহনূর এখনো ছোটই। সেই আগের মতো অবুঝ, আগের মতো চুপ, আগের মতো শান্তসুলভ। যাকে দুহাত বাড়িয়ে বুকের মধ্যে রাখলে গুটি মেরে থাকতো। ছোট্ট ছানাটির মতো নিজেকে লুকিয়ে-গুটিয়ে ফেলতো। মাহতিমের যেই উষ্ণত্বের ভেতর সবটুকু সত্ত্বা ঢেকে নিতো, আজ সেই মেহনূর মুখ ফিরিয়ে হাঁটছে। মাহতিম শ্রান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে-হাঁটতেই অবসন্ন কন্ঠে বললো,

– শাড়ি পরা ভালো হয়নি। নিচে পেডিকোট দেখা যাচ্ছে।
সলজ্জ ভঙ্গিতে গুটিয়ে গেলো মেহনূর। ঠিকই দেখতে পেলো, পায়ের কাছে পেডিকোট দেখা যাচ্ছে। পিছু আগত ব্যক্তিটা অন্য কেউ হলে মোক্ষম জবাব দিতো, কিন্তু আজ ওই সাহস নেই। জবাব তো দূরে থাক, তার দিকে তাকানোর হিম্মতটুকু মিইয়ে গেছে। মেহনূর বিচলিত না হয়ে দূরবর্তী মাঠের দিকে তাকালো। আপাত ব্যাপারটা উপেক্ষা করে দ্রুত পা চালাতে থাকলো। আর দেরি নয়! সে নিশ্চিত, পিছু আগত ব্যক্তি শ্যৈনদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে, প্রতিটি পলকে-পলকে খুঁটিয়ে দেখছে। মেহনূর ব্যস্ত পায়ে ছুটতে নিলে পেছন থেকে চড়া গলায় ডাকলো,
– মেহনূর!

তড়াক করে দাঁড়িয়ে পরলো মেহনূর। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো না। থম মেরে শক্ত হয়ে রইলো। চশমাটা ডানহাতের মুঠোয় কাঁপতে লাগলো। এই আকস্মিক ভয় কোত্থেকে এলো? ভয় তো ছিলো না! সে তো ভয় পায় না! এতোদিন কোনোপ্রকার ভয় পায়নি সে। রাতের অন্ধকারে প্রচুর সাহস নিয়ে ঘুরাঘুরি পারে! মেহনূর কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ঢোক গিলতে থাকলো। দু’চোখ বন্ধ করে খিঁচ মেরে রইলো। কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। একদম ঠিক শুনতে পাচ্ছে। পেছন থেকে খসখস শব্দে এগুচ্ছে, সেই পরিচিত পদজোড়া খুব কাছে চলে আসছে। একটা ছুট দেবে? দৌঁড়ে পালাবে? কেমন-কেমন লাগছে! চাপা শিহরণ, চন্ঞ্চল নিশ্বাস, লজ্জালু অনুভূতি, একটু অভিমান, খানিকটা রাগ, কিছুটা জেদ। এ কেমন অবস্থা? নিজের সন্ধিটুকু চেপে রাখতেই পিঠে হাত পরলো। রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রতিটি সুক্ষ্মাগ্রের কাছে শিউরে উঠলো মেহনূর। অনুভব করলো, পিঠ থেকে সমান্তরাল চুলগুলো বামে ঠেলে দিচ্ছে। খুব নরম ভাবে ঘাড়ের কাছে কি যেনো করলো। আবার সেই ঠেলে দেওয়া চুলগুলো পিঠ ছড়িয়ে দিলো। চুলের যেদিকটায় ফুলে গুঁজা ছিলো, সেদিকে সুক্ষ্ম কিছুর আভাস পেলো, তখনই ফিসফিস সুরে নমন কন্ঠে বলে উঠলো,

– চোখদুটো খুলো।
পেছন থেকে সমস্ত ভার সরে যেতেই চোখ খুললো মেহনূর। সাথে-সাথে মাথা নুইয়ে গলার দিকে তাকালো। সাদা ছোট্ট পাথরের চেইনটা দেখতে পেলো সে। চেইন পরানোর মর্মটা ধরতে পারলো না মেহনূর। চেইন পরিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছে? সবকিছু ভুলে যেতে বলছে? এতোই সহজ? এতোই সোজা? মেহনূর কিছু বললো না। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে পা বাড়িয়ে মাঠের কাছে গেলো। যেখানটায় লাকী মজুমদার বসেছিলো, সেখানটায় গিয়ে পৌঁছলো। ডানহাত বাড়িয়ে মুঠো খুলতেই প্রসন্ন গলায় বললো,

– ম্যাম, আপনার চশমা। আমাকে মাফ করবেন, হাত থেকে একটু পরে গিয়েছিলো। কিন্তু ভাঙ্গেনি।
লাকী মজুমদারের গোল-গোল দৃষ্টি অন্যদিকে। মেহনূরকে উপেক্ষা করে পাশে চলে গেছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে ক্ষুদ্ধ হলো মেহনূর। ঠিকই মাহতিমকে ইশারা করে প্রশ্ন করলো সে,
– তোমার পাশে এই লোক কে?
মেহনূর দ্বিধার দৃষ্টিতে পাশে দিকে তাকালো। ওমনেই দৃষ্টি ফিরিয়ে একগাল হাসি দিলো। মনে-মনে যোগ্য উত্তর রেডি করে স্বাভাবিক গলায় বললো,

– কেউ না। আমি চিনি না। আমি আসি ম্যাম। আমার জন্য আর্শীবাদ করবেন।
কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে চলে গেলো মেহনূর। সেখান থেকে ব্যাগ তুলে যাওয়ার রাস্তা ধরলো। ভীড় ঠেলে পা চালিয়ে হনহন করে যেতে লাগলো। সাবার দিকে খেয়াল করলো না, সুরাইয়ার দিকে চোখ দিলো না, কারো প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলো না। মেহনূরের চলনভঙ্গি দেখে দূর থেকে হাক দিলো সাবা, গান-বাজনার ভেতর গলা উঁচিয়ে ডাকলো,
– মেহনূর? এ্যাই মেহনূর? তুই কোথায় যাচ্ছিস? এ্যাই পাগল?
প্রচণ্ড সাউন্ডে গান বাজছে। স্টেজের কাছে হৈ-হুল্লোড় করে নাচানাচি। তুমুল উত্তেজনার ভেতর পরিবেশ গরম। সুরাইয়া স্টেজ ছেড়ে নাচে মত্ত। মেহনূর কাউকে পরোয়া না করে সোজা গেটের বাইরে চলে এলো। অটোর জন্য ডানে-বায়ে তাকাতেই পেছন থেকে মৃদ্যু গলা ভেসে আসলো,

– কেনো পালাচ্ছো? দাঁড়াও!
তোয়াক্কা করলো না মেহনূর। রাগে-ক্ষোভে চূর্ণ হয়ে পিছু তাকালো সে। দু’পাটি দাঁত শক্ত করে ঠোঁট কুঁচকে ফেললো। দুই হাত মুঠো করে ক্রুর চোখে তাকালো। অস্বাভাবিক নিশ্বাসগুলো উত্থালভাবে টানছে। প্রচণ্ড ক্রোধে অস্থির হয়ে কেঁদে ফেলেছে মেহনূর। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখদুটো নিরবে গাল ভিজাতে লাগলো। মাহতিম হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু করা, বা বোঝার পূর্বেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডটা হলো! গলার কাছে ডানহাতটা আনলো মেহনূর।

চেইনটা ডানহাতে মুষ্টিবদ্ধ করতেই জোরে একটান মারলো! ওই সামান্য দৃশ্যটুকু মাহতিম বিশ্বাস করতে পারলো না! তার দুচোখ কি ভুল দেখছে? তার মেহনূরটা এই কাজ করছে? মেহনূর মুঠো করা হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিলো। মুঠোটা আলগা করতেই ছিড়ে আসা চেইনটা অযত্নের মতো মাটিতে পরে গেলো। জীবনের চরম আশ্চর্য নিয়ে মাহতিম আজ মূঢ়! তার বিবেক, তার বুদ্ধি, তার সবটুকু চেতনা আজ গুলিয়ে গেছে। অবাক হয়ে লালচে ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে গেছে। তার নিশ্চল কাতর দৃষ্টির মাঝে মেহনূরের ক্রোধাগ্নি মুখ। পায়ে-পায়ে পিছিয়ে মেহনূর, পিছিয়ে সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো সে। কিছুটা পথ এগিয়ে একটা চলন্ত অটো থামালো। পথের ধারে ভাঙা কাঁচের মতো কাকে ভাঙচুর করলো, পরোয়া করলো না মেহনূর। শাঁ শাঁ করে অটোর যানে যাত্রা ধরলো সে। বুকভরা নিশ্বাস ছেড়ে নিচু তাকালো মাহতিম। হাঁটু গেঁড়ে নিচে ঝুঁকতেই ছেঁড়া চেইনটা হাতে তুললো। বাঁ-হাতের তেলোয় নিয়ে ডানহাত দিয়ে ঝিনুকের মতো ঢাকলো। বুক চাপা নিশ্বাস ছেড়ে আস্তে-আস্তে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫ শেষ অংশ

– আমার ঘুমন্ত বাঘিনী, রাগটা কমিয়ে দাও। তোমাকে আদর করার জন্য ছুটে এসেছি। একবার আমার দিকে তাকাও, তোমাকে সবটুকু সত্য বলতে প্রস্তুত।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭