মন রাঙানোর পালা পর্ব ২১

মন রাঙানোর পালা পর্ব ২১
ইয়াসমিন খন্দকার

আনিসা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয় এমন সময় অভিক তাকে ধরে ফেলে। এই দৃশ্যটা দেখে সুনীতির একদম ভালো লাগে না। অভিক শক্ত করে আনিসার হাত ধরে বলে,”সাবধানে চলবি তো নাকি?এখনো নিজের দায়িত্ব নিতে শিখলি না?”
আনিসা ব্যথিত স্বরে বলে,”দায়িত্ব নেয়ার মতো, সঙ্গ দেয়ার মতো কেউ ছিল না যে৷ তাই নিজে যতটা পেরেছি যত্ন নিয়েছি। বেঁচে যে আছি এটাই অনেক।”

আনিসার এমন হেয়ালিপূর্ণ করার মানে বুঝল না অভিক। সুনীতি হালকা কেশে বলল,”আপনি ভেতরে আসুন আপু। আমি আপনার জন্য গেস্টরুমটা পরিস্কার করে দিচ্ছি। কিছুটা সময় দিন।”
অভিক সুনীতিকে লক্ষ্য করে আনিসার থেকে দূরে সরে আসে৷ আনিসা হালকা হেসে বলে,”আমাকে নিয়ে তোমার এত ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না নীতি। তোমাকে নীতিই বলি, কেমন? আমার থেকে তুমি বয়সে ছোটই হবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ঠিক আছে,অসুবিধা নেই। আপনি একটু সোফায় বসে বিশ্রাম নিন। আমি গেস্টরুমটা গুছিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ, অভিক আমি সকালে স্যুপ তৈরি করেছিলাম৷ তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে খেয়ে নিও আর ওনাকেও দিও।”
বলেই সুনীতি গেস্টরুমের দিকে পা বাড়ায়। আনিসা সোফায় বসে পড়ে। অভিক রান্নাঘর থেকে গিয়ে স্যুপ নিয়ে এসে আনিসার দিকে একটা স্যুপের বাটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নে।”
আনিসা স্যুপটা নিয়ে খেতে থাকে৷ অভিক নিজেও খেতে থাকে অন্য একটা বাটিতে। আনিসা স্যুপ খেতে খেতে বলে,”ভারী লক্ষীমন্ত বউ পেয়েছিস….মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছে আমার। তোর জন্য এমন কারো প্রয়োজন ছিল।”

অভিকের বুকে কেমন জানি চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। সে সামান্য হেসে বললো,”তোর খবর বল, এখনো কি একা আছিস? নাকি বিয়েশাদিও হয়েছে?”
অভিকের প্রশ্ন শুনে আনিসা থমকে যায়। খাওয়া থামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিচের দিকে। তার চোখ-মুখ হঠাৎ করে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। অভিম আনিসার এমন মুখভঙ্গি দেখে হচকচিয়ে যায়। আনিসার কাছাকাছি এসে তার হাত ধরে বলে,”তুই ঠিক আছিস তো?”

আনিসা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে,”হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক আছি৷ তোর কাছে একটাই অনুরোধ..দয়া করে আমি নিজে থেকে কিছু না বলার আগে আমার থেকে কিছু জানতে চাস না।”
অভিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”বেশ, তুই যা চাস তাই হবে৷ তুই নিজে থেকে না বললে আমি আর তোর কাছে কিছু জানতে চাইব না। তুই প্লিজ হাইপার হয়ে যাস না।”

সুনীতি ঘরদোর গুছিয়ে এসে অভিক এবং আনিসাকে এতটা কাছাকাছি দেখে ভড়কে যায়। তার বুকের মাঝে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়। কেন জানি এই আগন্তুক রমনীর আগমন তাকে শান্তি দিচ্ছে না। সুনীতি নিজের কষ্ট লুকিয়ে মুখে মেকি হাসি নিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলে,”আপনার জন্য গেস্টরুমটা আমি গুছিয়ে দিয়েছি আপু। আপনি এখন চাইলে ওখানে গিয়ে থাকতে পারেন।”
সুনীতির গলার স্বর শুনে অভিক উঠে দাঁড়ায়। সুনীতির দিকে তাকিয়ে বলে,”আনিসা একটু দূর্বল। তুমি কাইন্ডলি ওকে একটু ধরে ধরে নিয়ে যাও।”

“ঠিক আছে।”
বলেই সুনীতি এগিয়ে আসে। আনিসা হালকা হেসে বলে,”এইটুকুনি একটা মেয়ে কিভাবে আমায় সামলাবে, বলতো অভি? তোর না আজও কোন বোধবুদ্ধি হলো না৷ সারাটা রাস্তা তো তুই”ই আমাকে ধরে নিয়ে এলি। গেস্টরুম পর্যন্তও নাহয় তুই’ই নিয়ে চল। কি বলো নীতি? অভি আমাকে গেস্টরুম পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”

আনিসার এহেন কথা একদম ভালো লাগে না সুনীতির। তবুও সে ভদ্রতার খাতিরে বলে,”না, আপু। আপত্তি থাকবে কেন? তবে আমিও কিন্তু আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। এতটুকু শক্তি আমার শরীরে আছেই।”
অভিক বলে ওঠে,”না, থাক। আনিসা ঠিকই বলছে। তুমি ওকে সামলাতে পারবে না। তার থেকে বরং আমিই ওকে নিয়ে যাই।”

বলেই সে আনিসাকে ধরে সোফা থেকে টেনে তোলে এবং আস্তে আস্তে তাকে ধরে গেস্টরুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সুনীতির ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যেতে থাকে। সে হনহন করে নিজের রুমের দিকে এগোয়।
আনিসা ধরে ধরে গেস্টরুমে নিয়ে এসে তাকে আলতো করে শুইয়ে দেয় অভিক। অতঃপর বলে,”তুই এখন এখানে শান্তিতে বিশ্রাম নে। একদম ভয় পাবি না। এখানে তুই একদম নিরাপদ।”
বলেই অভিক চলে যেতে নেয়। এমন সময় আনিসা অভিকের হাতটা টেনে ধরে বলে,”প্লিজ আমার পাশে একটু বসে থাক না অভি। তুই চলে গেলে আমার ভীষণ একাকীত্ব বোধ হবে।”
অভিক আলতো করে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,”তোর বিশ্রামের প্রয়োজন আনিসা। তুই একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।”

আনিসা কাতর স্বরে বলে,”আমার চোখে ঘুম আসবে না রে, অভি! জানিস, কতগুলো দিন আমি ঠিকমতো ঘুমাই নি। এখন পরিস্থিতি এমন যে আমি ঘুমাতেই ভুলে গেছি।”
“তোর শরীর খুব একটা ভালো না। ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
“আচ্ছা, চেষ্টা করছি। কিন্তু তুই আমায় ছেড়ে কোথাও যাস না, প্লিজ। অন্তত আমি না ঘুমানো পর্যন্ত আমার পাশে বসে থাক।”

অভিক আনিসার এই অনুরোধটা আর ফেলতে পারে না। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ঠিক আছে।”
অতঃপর কিছু সময় অঅতিবাহিত হয়। আনিসা ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। অভিক উঠে বসে আনিসার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে রুমের বাইরে এসে দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।

নিজের রুমে প্রবেশ করেই অভিক দেখতে পায় সুনীতি ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। সুনীতির দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে অভিক। অতঃপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কাপড়-চোপড় বদলে সুনীতির পাশে শুয়ে পড়ে। সুনীতি তখনো অন্যদিকে ফিরে ছিল। অভিক সুনীতির পাশে শুয়েই শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে সুনীতিকে নিজের কাছে টেনে নেয়। তার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে দেখে সুনীতি তখনো চোখ বন্ধ করে ছিল। অভিক সুনীতির কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,”আমার উপর রাগ করে আছ নীতি?”

সুনীতি কোন জবাব দেয়না। অভিক সুনীতির এমন মৌনতা দেখে বলে,”আনিসা আমার স্কুল এবং কলেজ লাইফের অনেক ভালো বন্ধু ছিল। ওর এই অসহায় অবস্থা দেখেই আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমি ভেবেছি তুমি ব্যাপারটা বুঝবে। আচ্ছা, ওর উপস্থিতি কি তোমায় কষ্ট দিচ্ছি, নীতি? যদি এমন হয় তো বলো। আমি ওকে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে রাখব।”
সুনীতি এবার চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,”আমি তো তোমাকে একবারও বলিনি যে, ওনার উপস্থিতিতে আমার সমস্যা হচ্ছে। তুমি নিজে নিজেই সবটা ভেবে নিচ্ছ।”

“তাহলে তুমি আমার উপর অভিমান করে আছ কেন?”
“কেন? আমার কি অধিকার নেই তোমার উপর অভিমান করার? এই যে তুমি হুটহাট করে মিশনে চলে যাও..জানো আমার কতটা চিন্তা হয় তোমার জন্য।”
“এটাই তো আমার কাজ নীতি..”
“জানি তো..এজন্যই তো রাগ করে থাকতে পারি না। আমি বুঝতে পারি তোমার ব্যাপারটা। কিন্তু তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো না।”
“হঠাৎ এমনটা কেন মনে হলো?”

“দেখো, আনিসা আপুর এখানে থাকা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার কি আমাকে এতটা দূর্বল মনে হয়, যে আমি ওনাকে ওনার রুমে পৌঁছে দিতে পারতাম না?”
“উফ..তুমি আবার এই ব্যাপারটা নিয়ে পড়লে কেন?”
“কেন পড়লাম..সেটা তুমি বুঝবে না অভিক। আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে। আসলে তোমরা সব ছেলেরাই এমন। আমার এ নিয়ে আর কিছু বলার নেই।”
অভিক সুনীতিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলে,”এসব বাদ দাও..আজকের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর তো চলো..”

মন রাঙানোর পালা পর্ব ২০

অভিকের এমন কথায় সুনীতি লজ্জায় তার বুকে মুখ লুকায়। অভিক সুনীতির মুখ তুলে তার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আমার উপর ভরসা রাখতে পারো। তুমি ছাড়া আর কাউকে আমি এই নজরে দেখবো না।”
অভিকের কথায় শীতল স্রোত বয়ে যায় সুনীতির শরীর দিয়ে।

মন রাঙানোর পালা পর্ব ২২