মন রাঙানোর পালা পর্ব ২২
ইয়াসমিন খন্দকার
সুনীতির ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে অভিকের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে। গতকাল রাতের কথা ভেবে লজ্জা এবং সুখের অপূর্ব অনুভূতি অনুভব হয়। সে মোহিত নয়নে অভিকের দিকে তাকায়। এই লোকটা শুধুই তার। ভাবতেই মনে আনন্দ অনুভূত হয়। সুনীতি অভিকের মুখে হাত বোলাতে থাকে। হঠাৎ করেই এমন মুহুর্তে তার কানে বেশ খানিকটা শব্দ আসতে থাকে। সুনীতি উঠে বসে৷ ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”কোথা থেকে শব্দ আসছে?”
বলেই সে উঠে দাঁড়ায়। অভিকেরও ঘুম ভেঙে যায়। সে ঘুম থেকে উঠেই সুনীতিকে বলে,”কি হয়েছে?”
“কোথা থেকে যেন একটা দরজা ধাক্কানোর শব্দ আসছে।”
সুনীতির কথা শুনে অভিকের হুশ ফেরে৷ তার মনে পড়ে যায় গতকাল রাতে সে আনিসার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। সে দ্রুত উঠে বসে শার্টের বোতাম লাগাতে থাকে। অতঃপর ছুট লাগায় গেস্ট রুমের দিকে। সুনীতিও যায় তার পেছন পেছন। অভিক গেস্টরুমের সামনে এসে বুঝতে পারে এই রুম থেকেই দরজা ধাক্কানোর শব্দ আসছিল। সে আর দেরি না করে দ্রুত দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। সাথে সাথেই আনিসা তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। আনিসার এই অবস্থা দেখে অভিক ঘাবড়ে যায়। তাকে একদম উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল। সুনীতি দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আবারো কষ্ট পায়। কাছে আসার সাহস না দেখিয়ে সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। অভিক আনিসার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”কি হয়েছে তোর আনিসা? এমন করছিস কেন? তুই শান্ত হ, প্লিজ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আনিসা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,”ওরা…ওরা আমায় মেরে ফেলবে অভি..তুই দয়া করে ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচা..”
“কারা মারবে তোকে?”
“ওরা..ওরা খুব ভয়ানক….প্লিজ আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচা।”
অভিক বুঝতে পারে না আনিসা ঠিক কাদের কথা বলছে। সে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই আনিসা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অভিক ভয়ে তাকে ডাকতে থাকে,”এই আনিসা..কি হয়েছে তোর? চোখ খোল। দেখ আমি আছি এখানে। তোর কোন ক্ষতি হতে দেব না আমি।”
সুনীতির হৃদয়ে এই দৃশ্য যেন তীরের মতো বিঁধছিল। তার চোখে ছলছল করছিল জল। সে আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দেয়। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে। নিজের মা-বাবার ছবি হাতে নিয়ে বলে,”তোমরা তো আমার কাছে নেই মা-বাবা। এখন তো আমার শুধু ঐ একজনই আছে। তাকেও কি ভাগ্য আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে? এমন হলে যে আমি আর বাঁচবোনা। একদম নিঃশেষ হয়ে যাব।”
এসব ভেবেই তার কান্নার গতি বাড়ে। ঘরপোড়া গরু হয়ে যেন সে সিঁদূরে মেঘ দেখছে। অভিকের সাথে তার সুখের সংসারে কি তবে কারো দৃষ্টি লাগলো?
“ও এখন কেমন আছে ডাক্তার?”
অভিকের এহেন প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার বলে,”চিন্তার কিছু নেই। উনি ভালো আছেন। আমার যতদূর মনে হলো উনি কোন মেন্টাল ট্রমা থেকেই বারবার এমন করছেন। আপনার উচিৎ ওনাকে কোন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া।”
বলেই তিনি বের হয়ে যান। আরাফাত অভিকের কাধে হাত রাখে। অভিক অসহায় কন্ঠে বলে,”আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিৎ। আনিসার এই অবস্থা দেখে আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
আরাফাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমি খুব ভালো একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে চিনি। ওনার চেম্বার যদিওবা ঢাকায় তবে উনি সপ্তাহে একদিন সিলেটে আসেন। আমি ওনার সাথে এপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।”
“অনেক বড় চিন্তা থেকে রক্ষা করলি রে!”
আরাফাত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা, সুনীতি ভাবি কোথায় রে? এখানে এসেছি থেকে তো ওনাকে দেখছি না।”
এতক্ষণে অভিকের হুশ ফেরে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”তাই তো। নীতি কোথায়?”
আরাফাত অভিককে বলে,”তুই এখানে থাক। আমি দেখছি ভাবি কোথায়।”
বলেই আরাফাত বেরিয়ে পড়ে। সারা বাড়ি খুঁজে সুনীতিকে না পেয়ে সে চিন্তায় পড়ে। অনেক খোঁজার পর অবশেষে ছাদে উঠে সুনীতিকে দেখতে পায়। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”ভাবি, আপনি এখানে কি করছেন?”
হঠাৎ করে আরাফাতের কন্ঠ শুনে সুনীতি হচকচিয়ে যায়। পিছন ফিরে আরাফাতকে দেখে নিজের চোখের জল মুছে বললে,”এমনি ভালো লাগছিল না, তাই ছাদে চলে এসেছিলাম।”
আরাফাত সুনীতির চোখের জল লক্ষ্য করে বলে,”আপনি কি কাঁদছিলেন ভাবি?”
“না, মনে হয় চোখে কিছু পড়েছে।”
“আপনি নিজের দুঃখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। এজন্য আমি আরাফাতকে বলেছিলাম আনিসাকে এখানে না আনার জন্য।”
সুনীতি অনুনয় করে বলে,”আপনি প্লিজ আপনার বন্ধুকে এ নিয়ে কিছু বলবেন না। এমনিই ও অনেক চিন্তার মধ্যে আছে। আমি চাই না এসব নিয়ে ভেবে ও আরো চিন্তা করুক।”
“অভিক ঠিকই বলেছিল। আপনি সত্যি অনেক বুঝদার।”
সুনীতি হালকা হাসে। আরাফাত বলে,”আপনার দুশ্চিন্তা করবেন না। অভিককে আমি যতোটা চিনি, এটা হলফ করে বলতে পারি যে, অন্তত ও আপনাকে ঠকাবে না।”
সুনীতির হঠাৎ কি মনে হলো সে জানে না। সে আরাফাতকে বলে উঠল,”আচ্ছা, ভাইয়া। আপনি আমাকে নিজের বোন মনে করে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন প্লিজ?”
“হ্যাঁ, ভাবি। বলুন।”
“অভিকের সাথে কি আনিসা আপুর শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল? নাকি আরো বেশি কিছু..দয়া করে সত্যটাই বলবেন। আমার থেকে কিছু লুকানোর প্রয়োজন নেই।”
আরাফাত একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আসলে সত্যিটা হচ্ছে..আমি, অভিক ও আনিসা আমরা তিনজন স্কুলজীবন থেকে একে অপরকে চিনি। আমরা ঢাকার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে একসাথে একই ক্লাসে ভর্তি হই। সেখান থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা। এরমধ্যে আনিসার বাবা ছিল একজন পুলিশ অফিসার। আমরা নিজেদের বন্ধুত্বের জন্য গোটা স্কুলে পরিচিত ছিলাম। সকলে আমাদের ত্রিপল A গ্যাং বলে জানত।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু যখন আমরা 9 গ্রেড এ ছিলাম তখন সবকিছু চেইঞ্জ হয়ে যায়। আমি খেয়াল করি, অভিক আনিসার একটু বেশিই কেয়ার করছে। তখনই আমি বুঝতে পারি অভিকের মনে আনিসার জন্য ফিলিংস তৈরি হচ্ছে। আমার সন্দেহটাই ঠিক ছিল। একদিন অভিক নিজে থেকেই আমাকে এটা বলে। কিন্তু ও আনিসাকে এটা বলার সাহস করে উঠে পারেনি। ওর মনে ভয় ছিল যে,সত্যটা জানার পর হয়তো আনিসা যদি ওকে রিজেক্ট করে তাহলে আমাদের বন্ধুত্বটা ভেঙে যাবে।
এভাবে আমাদের স্কুলজীবন শেষ হয়। এরপর আমরা তিনজনে একই কলেজে ভর্তি হই। কলেজ লাইফে অন্য একটা ছেলে আনিসাকে ভীষণ বিরক্ত করতো। একটা বললে ভুল হবে, আনিসা ছিল অপূর্ব সুন্দরী তাই বেশ অনেক ছেলেই নিত্যদিন তাকে প্রপোজ করত। কিন্তু তার মধ্যে একটা ছেলে ছিল নাছোড়বান্দা। সে আবার আমাদের সিনিয়র ছিল। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ত, এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলে ছিল। আমরা ধীরে ধীরে লক্ষ্য করি আনিসার ঐ ছেলেটার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার নাম ছিল শিহাব। অভিক এটা মেনে নিতে পারেনি যে আনিসা অন্য কারো প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই সে একদিন হুট করে আনিসাকে প্রপোজ করে বসে। কিন্তু আনিসা ভেবেছিল অভিক মজা করছে। তাই ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। এরপর এমন কিছু হলো যা..”
“কি হয়েছিল এরপর?”
কৌতুহল নিয়ে জানতে চায় সুনীতি। আরাফাত বলে,”এরপর অভিক যে আনিসাকে ভালোবাসে এটা বোঝানোর জন্য সুইসাইট এটেম্প করার জন্য নদীতে ঝাপ দিতে গিয়েছিল। আমি তখন অনেক কষ্টে ওকে আটকাই। সেদিন আমরা এমন এক দৃশ্য দেখি যা..”
“কি দৃশ্য..”
“নদীর পারে আনিসা আর ঐ শিহাব ছেলেটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায়…”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২১
সুনীতি নিশ্চুপ হয়ে যায়। আরাফাত বলে,”এটা দেখে অভিক আরো ভেঙে পড়ে। আমি অনেক কষ্টে ওকে সামলাই। ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরে। কিন্তু আর কোন মেয়ের দিকে তাকায় নি। আর সেই দিনের পর থেকে আনিসাও হুট করে উধাও হয়ে যায়। এতগুলো বছর আমরা ওর কোন খোঁজ পাইনি। গতকাল প্রায় ৮/৯ বছর পর আমরা ওর দেখা পাই।”
“তাহলে এতদিন উনি কোথায় ছিলেন?”
“সেটাই তো সবথেকে বড় প্রশ্ন।”