মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৬
ইয়াসমিন খন্দকার
অভিক আনিসাকে সাথে নিয়ে এবং কয়েক জন আর্মিকে নিয়ে একটা নির্জন স্থানে এসেছে। আনিসার ভাষ্যমতে এই স্থানেই তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই স্থানে কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো একটা পরিত্যক্ত বাড়ি।
অভিক আনিসাকে জিজ্ঞেস করে,”তোর কি সঠিক মনে আছে যে তুই এখানেই বন্দি ছিলিস?”
আনিসা মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যাঁ, আমার যতদূর মনে আছে আমি তো এখানেই ছিলাম। তোকে তো আগেই বলেছিলাম এখানে কিছু না পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।”
“তাহলে ফিরে যাওয়া যায়, কি বলিস?”
“হ্যাঁ, চল।”
অভিক বাকি আর্মি সদস্যদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও। আমাদের এখন এখান থেকে যেতে হবে।”
আনিসা হঠাৎ করে বলে,”আমার কেন জানি মনে হচ্ছে,,আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে যাওয়া উচিৎ। হয়তো এখানে আমাদের জন্য কোন ভয়াবহ বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অভিক বিস্ময় নিয়ে বলে,”কি বিপদ হতে পারে বলে তোর মনে হয়?”
আনিসা কিছু বলে ওঠার আগেই পুরো স্থানটা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অভিক এবং তার সহিত আসা অন্যান্য আর্মিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের বন্দি করে নেয়। অভিকরাও ধোঁয়ার কারণে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অভিকের যতদূর মনে পড়ে সর্বশেষ আনিসা তার দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ছিল। যেন ঐ চোখের ভাষায় অনেক দুঃখ এবং অনুশোচনা লুকিয়ে ছিল।
সময় তখন রাত ৯ টা। সুনীতি দুশ্চিন্তায় পুরো ঘরময় পায়চারি করে চলেছে। অহনা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সুনীতিকে। অভিক আনিসার সাথে সেই সকালে বেরিয়েছে। কিন্তু এখনও তাদের ফেরার কোন নাম নেই। সুনীতি শুরুর দিকে ব্যাপারটা স্বাভাবিক নিলেও যত সময় বাড়তে থাকে ততই তার হৃদয়ে ভয় জমা হয়। মন কু ডাকতে থাকে এই ভেবে যে অভিকের কোন বিপদ হলো না তো! সুনীতি প্রথম দিকে এসব ভাবনাকে একদমই পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে এসব নিয়ে ভাবতে হয়। কারণ তাদের ফিরতে এত দেরি হওয়ার কথা না। এরপরই সে চিন্তিত হয়ে আরাফাতকে সব জানায়। এসব শুনে আরাফাতও ভয় পেয়ে যায় তবে সে সুনীতিকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে এবং তাকে জানায় যে, সে কিছু করবে।
সুনীতি এখন সেই ভরসাতেই বসে আছে। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আরাফাতও হয়তো কিছু করতে পারবে না। কারণ সে প্রায় বিকেল ৪ টা থেকে অভিককে খুঁজে চলেছে। কিন্তু এখনো কোন খোঁজ দিতে পারেনি।
অহনা সুনীতিকে এমন দুশ্চিন্তার মধ্যে দেখে মিনমিনে স্বরে বলে,”তুই তো সকাল থেকে কিছু না খেয়ে আছিস। এবার অন্তত কিছু খা৷ এভাবে না খেয়ে থাকলে তো পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যাবি।”
সুনীতি বলে,”আমি কিচ্ছু খাবো না। খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। না জানি অভিক কেমন অবস্থায় আছে। তুই দয়া করে এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে জোরজবরদস্তি করিস না।”
অহনা আর না পেরে কিছু বলে না। এরইমধ্যে আরাফাত হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে আসে। তাকে আসতে দেখেই সুনীতি ছুটে গিয়ে বলে,”অভিকের কোন খোঁজ পেলেন ভাইয়া?”
আরাফাত নতমুখে বলে,”দুঃখিত ভাবি। আমি অভিকের এখন অব্দি কোন খোঁজ পাইনি। ওর ফোনের লাস্ট লোকেশন যেখানে ছিল সেখানেও গিয়েছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।”
সুনীতি ভারাক্রান্ত মনে দু কদম পিছিয়ে পড়ে যেতে নেয়। অহনা সুনীতিকে ধরে নিয়ে আরাফাতের উপর চিল্লিয়ে বলে,”কেমন আর্মি হয়েছে আপনি, হ্যাঁ? আপনাদের নাকি অনেক ক্ষমতা। তাহলে নিজেদের একজন সহকর্মী হুট করে এভাবে উধাও হয়ে গেল আর তার কোন খোঁজ দিতে পারছেন না কেন?”
আরাফাতের মেজাজ এমনিতেই ভালো ছিল না৷ তার উপর অহনার এমন কথায় তেতে উঠে বললো,”দেখুন মিস, আমি নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমি তো আর সর্বশক্তিমান নই যে সবকিছু করতে পারব। আমারও সীমাবদ্ধতা আছে। অভিক আমার বেস্টফ্রেন্ড তাই ওকে নিয়ে আমার চিন্তা নিশ্চয়ই আপনার থেকে ঢেড় বেশি৷ তাই এরপর থেকে কিছু বলার আগে ভেবেচিন্তে কথা বলবেন।”
সুনীতিও অহনাকে বকুনি দিয়ে বলে,”তুই শুধু শুধু ওনাকে এভাবে কেমন বলছিস অহনা? এমনি আমার মন মেজাজ কিছু ভালো নেই তার উপর…”
অহনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে,”দুঃখিত..আসলে সুনীতির এমন অবস্থা দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না তাই মুখ ফসকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি।”
আরাফাত বলে উঠল,”নিজের মুখকে এরপর থেকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবেন মিস। সব পরিস্থিতিতে সব কথা মানায় না।”
আরাফাতের এমন কথায় ভীষণ রেগে গেলেও অহনা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
আরাফাত সুনীতির কাধে ভরসার হাত রেখে বলে,”আপনি একদম চিন্তা করবেন না, ভাবি। আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব অভিককে খুঁজে বের করার। প্রয়োজনে নিজের জান বাজি রাখব। কিন্তু নিজের বন্ধুর কোন ক্ষতি আমি হতে দেব না, এটা আমার ওয়াদা।”
চোখে পানির ছিটা পেতেই আধো আধো ভাবে চোখ মেলে তাকায় অভিক। সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটি অন্ধকার বদ্ধ কুঠুরিতে। তার হাত-পা সম্পূর্ণ চেয়ারের সাথে বাঁধা। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এ আমি কোথায় এলাম?”
এরপর চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে তার সহিত ঠিক কি হয়েছিল। তখনই মনে পড়ে যায় আনিসাকে নিয়ে ওকে যেখানে বন্দি করা হয়েছিল সেই স্থানে যাওয়ার পরের ঘটনাসমূহ। আশেপাশে তাকিয়ে অভিক আনিসা সহ নিজের অন্য সহকর্মীদের খুঁজতে থাকে কিন্তু তাদের কারোরই দেখা পায়না।
এমন সময় তার কন্ঠে ভেসে আসে কারো বলা একটা কথা,”কি ব্যাপার মেজর অভিক? কাউকে কি খুঁজছেন নাকি?”
কন্ঠের স্বর অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই অভিক চমকে ওঠে। বহু বছর আগে দেখা সেই চেহারাটা আজ অব্দি সে ভোলে নি। ঘৃণা এবং ক্ষোভ পুষে রেখেছিল এতদিন, আনিসার কথা শোনার পর যা দ্বিগুণ হয়েছে। অভিক মুখ দিয়ে কিছু বিশ্রী গালি উচ্চারণ করে বলে,”কু**র বাচ্চা। তোকে তো আমি..”
শিহাব এগিয়ে এসে শয়তানি হেসে বলে,”কি করবি তুই আমার? আমার একটা চুলও ছিড়তে পারবি না। বরঞ্চ দেখ আমি তোর কি অবস্থা করি।”
শিহাবের এহেন কথায় রাগ বেড়ে ফুসে উঠলো অভিক। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”যদি কাপুরুষ না হোস, তাহলে আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে কথা বল।”
শিহাব বিশ্রী হেসে বলে,”আমাকে বোকা ভাবিস না মেজর। আমি কাপুরুষ হতেও রাজি কিন্তু বোকা হতে নয়।”
অভিক শিহাবের দিকে থু থু ছুড়ে বলে,”শালা…যে একটা নিরীহ মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে দীর্ঘদিন বন্দি রেখে তার সাথে এত নিচকাজ করতে পারে তার থেকে আর কি আশা করব।”
মুখে থু থু এসে পড়ায় শিহাব ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে এসে অভিকের গলা চেপে ধরে। এতটা জোরে যে অভিকের শ্বাস প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়। এমন সময় হঠাৎ সেই স্থানে এসে উপস্থিত হয় আনিসা৷ শিহাবকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,”কি করছ টা কি? ও তো মরে যাবে।”
শিহাব এতে রেগে গিয়ে অভিককে ছেড়ে আনিসার গলা চেপে ধরে বলে,”এই মা**। নিজের পুরান নাগরের প্রতি মায়া উতলে উঠছে না..বেশি বাড় বাড়িস না নাহলে তোর জীবন যে ভিক্ষা দিয়েছি সেটা আর থাকবে না।”
অভিক আনিসার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। শিহাব আনিসাকে ছিটকে দূরে সরিয়ে ফেলে অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই আমাদের অনেক জ্বালিয়েছিস মেজর,,,,তোর জন্য ধান্দায় অনেক লস হয়েছে৷ এজন্য তোকে ফাঁদে ফেলতে এই সামান্য নাটকটা করতে হলো। একে(আনিসার দিকে ইশারা করে) এতদিন ধরে কেন জানি বাঁচিয়ে রাখছিলাম,,,আজ আমার কাজে লেগে এলো।”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৫
অভিক যেন আজ একের পর এক অবাক হচ্ছে। অভিক যেই না অবাক এবং বিস্ময়ের চোখে আনিসার দিকে তাকিয়েছে। আনিসা অভিকের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,”আমাকে ক্ষমা করে দিস রে অভি,,,নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমায় তোকে বিপদে ফেলতে হয়েছে। এছাড়া আমার যে আর কিছু করার ছিল না।”
আনিসার কথা শুনে অভিকের যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। বুঝতে আর বাকি থাকে না বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার সে!