মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩১

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩১
ইয়াসমিন খন্দকার

সুনীতি মনমরা হয়ে সোফায় বসে পড়ে। বিলকিস বেগম একটু আগেই ফিরে গেছেন। যাওয়ার আগে সুনীতিকে আরো একটু সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সুনীতির কানে সেসব কথা যায়নি। সে তো ভাবছে শুধু অভিকের বলা সেই কথাটা,”তোমার বাবা-মায়ের মৃত্যুটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয় যার ফলবশত তোমার মা-বাবা মারা যায় এবং তুমি মারাত্মক ভাবে আহত হয়।”

সুনীতির চোখে জল চলে আসে। সে এখনো কিছুতেই এটা মানতে পারছে না যে অভিক তার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে গেছে। তার উপর এমন একটা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছে। সুনীতি কিছুক্ষণ এই ব্যাপার নিয়ে ভেবে নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে বলে,”তোমাকে এর জবাব দিতেই হবে অভিক! কেন তুমি আমার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে গেলে? আমার কি নিজের মা-বাবার মৃত্যু সম্পর্কে জানার কোন অধিকার ছিল না?”
সুনীতির এহেন ভাবনার মাঝেই আহসান চৌধুরী ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হন। সুনীতির চোখে জল দেখে বলেন,”তুমি কাঁদছ কেন মা?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুনীতি হচকচিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।”
আহসান চৌধুরী এগিয়ে এসে স্নেহের সহিত সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করবে বলো, এটাই তো বাস্তবতা।”
সুনীতির কাছে আহসান চৌধুরীকে ভরসাযোগ্য একজন মানুষ মনে হয়। তাই সে আহসান চৌধুরীকে প্রশ্ন করে বসে,”আচ্ছা, আমার মা-বাবার মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক কোন দূর্ঘটনা ছিল? আপনাকে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি৷ দয়া করে সত্যটাই বলবেন।”

আহসান চৌধুরী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”তুমি যখন এমন প্রশ্ন করছ তার মানে নিশ্চয়ই তুমি সবটা জেনেই গেছ। অভিক আমাদেরকে তোমায় এসব জানাতে মানা করেছিল তাই আমি বা রাহেলা তোমাকে কিছু বলি নি। তুমি এই বিষয়টা নিয়ে অভিককে ভুল বুঝোনা,,ও তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করেছে।”
সুনীতি কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সুনীতির এমন নীরবতা দেখে আহসান চৌধুরী বুঝতে পারেন তার একটু একা থাকা প্রয়োজন। এজন্য তিনিও নীরবে স্থান ত্যাগ করেন। সুনীতি আহসান চৌধুরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমার ভালো অভিক একটু বেশিই বুঝে ফেলেছে। যা আখিরে আমার জন্য ক্ষতিই বয়ে আনল। আমি তো অভিককে ভরসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমার ভরসাটা পুরোপুরি ভেঙে দিল।”

রাতে ডিনারের সময় অভিক এসে খেতে বসে পড়ে। তার চোখ অবশ্য খুঁজছে সুনীতিকে। আজ বিকেল থেকে সে সুনীতিকে দেখে নি। সুনীতি আজ সারাদিন তার চোখের আড়ালে ছিল। অভিক তাই ভীষণ ছটফট করছে এক পলক সুনীতিকে দেখার জন্য। অবশেষে তার এই অপেক্ষার অবসান ঘটে যখন সুনীতি খাবার হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে উপস্থিত হয়। সুনীতিকে দেখে অভিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু সুনীতি একদম রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাহেলা খাতুনও অনেকক্ষণ থেকে নজর করছেন সুনীতির নির্লিপ্ততা। এই তো বিকেলেও কি আগ্রহ নিয়ে অভিকের জন্য চিকেন কাটলেট বানালো। কিন্তু তারপর থেকে কেমন জানি নির্জীব লাগছে তাকে। আহসান চৌধুরী অবশ্য পুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারছেন কিন্তু তিনিও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। কারণ তার মতে,এমনটা হওয়ারই ছিল। এখন অভিককেই সুনীতিকে সামলানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্যই তিনি শুরুতেই অভিককে বলেছিলেন যেন অভিক এই ব্যাপারটা সুনীতির থেকে লুকিয়ে না রাখে।

সুনীতিকে চুপচাপ অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহেলা খাতুন গলা খাকারি দিয়ে বলেন,”সুনীতি, তুমি অভিককে চিকেন কাটলেট টা দাও। বিকেলে যে কত যত্ন করে বানালে। জানো অভিক, তোমার চিকেন কাটলেট পছন্দ জন্য সুনীতি কত আনন্দ করে তোমার জন্য এটা বানিয়েছে।”
অভিক স্মিত হেসে বলে,”সত্যি? তাহলে তো খেয়ে দেখতে হয় কেমন হয়েছে।”
সুনীতি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে অভিকের পাতে চিকেন কাটলেট তুলে দেয়। অভিক চিকেন কাটলেট টা ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বলে,”এটা ভীষণ ভালো খেতে হয়েছে। গুড জব নীতি।”

এমন প্রশংসাসূচক বাক্যও সুনীতির মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। এবার অভিক বুঝতে পারে সুনীতির নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তাই সে এমন আচরণ করছে। দ্রুত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অভিক উঠে দাঁড়িয়ে সুনীতিকে বলে,”একটু ঘরে আসো তো, তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
বলেই সে চলে যায়। অভিক যাওয়ার পর সুনীতিও তার পিছু পিছু যায়। রাহেলা খাতুন তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আহসান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেন,”কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছ তুমি? সুনীতির ব্যবহার কেমন অদ্ভুত না? বিকেল অব্দি তো স্বাভাবিকই ছিল।”

আহসান চৌধুরী বলেন,”আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, সুনীতি আর অভিকের মধ্যে হয়তো মান-অভিমানের পালা আসতে চলেছে। এখন এটাই দেখার পালা যে এই মান অভিমান তাদের সম্পর্কে কি প্রভাব ফেলে। তারা কি সব মান-অভিমান ভুলে আবারো একে অপরের মন রাঙিয়ে দিতে পারে নাকি ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ায়।”

অভিক অস্থির হয়ে পুরো ঘরময় পায়চারি করে চলেছে। সুনীতির এমন শীতল ব্যবহার তাকে বড্ড ভাবাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ সুনীতি রুমে চলে আসে। তাকে আসতে দেখেই অভিক তার মুখোমুখি হয়ে বলে,”কি ব্যাপার বলো তো নীতি? তোমায় এমন লাগছে কেন?”
“এমন মানে?”
“এই যে কেমন চুপচাপ,,,,এর কারণ কি?”
সুনীতি মলিন হেসে বলে,”যখন কাউকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি কিন্তু সে সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করে তখন কি এমন ব্যবহার করাই স্বাভাবিক নয়?”
অভিক হতবাক স্বরে বলে,”মানে?”

“আমার মা-বাবার মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক কোন দূর্ঘটনা নয় বরং তাকে ঐ মন্টু খু*ন করেছে এই ব্যাপারটা তুমি কেন আমার থেকে লুকিয়ে গেলে? আমার কি কোন অধিকার ছিল না আমার মা-বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে জানার?!”
“তার মানে তুমি সব জেনে গেছ নীতি?”
“কেন? আমি জেনে বুঝি তোমার অনেক অসুবিধা হয়ে গেল। আমার থেকে সত্যটা লুকিয়ে আমায় অন্ধকারে রেখে কি লাভ পেলে তুমি অভিক?”
“তুমি আমায় ভুল ভাবছ নীতি..”
“ভুল আমি তোমায় ভাবছি না অভিক। বরং তোমায় এতদিন আমি ভুল ভাবতাম। অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম তোমায় আর তুমি তার এই প্রতিদান দিলা।”
“আমাকে অন্তত নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগটা দাও!”

“জানি, তুমি কি বলবে! এটাই বলবে তো যে, যা করেছ আমার ভালোর জন্যই করেছ। আমার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে করেছ, ব্লা ব্লা ব্লা,,কিন্তু এসব কথা আমার কাছে কোন দাম রাখে না। আমার মা-বাবার পর তুমিই ছিলে আমার ভরসার যায়গা। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারতাম। আমার বিশ্বাস ছিল তুমি অন্তত আমার থেকে কিছু লুকাবে না কিন্তু তুমি সেই বিশ্বাস নিজেই ভেঙে দিলে। এরপর হয়তো আমি আর কখনোই কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না।”

“আমি তোমাকে সবটা জানাতেই চেয়েছিলাম।”
“কবে জানাতে? আরো একযুগ পর? আমার মা-বাবার খু*নী এখনো খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ এখনো তাকে ধরতে পারেনি আর তুমি এমন ভাবে ছিলে এতদিন যেন সবটা কত স্বাভাবিক।”
“আমার উপর বিশ্বাস রাখো নীতি। আমি এবার ঢাকায় ঐ মন্টুকে ধরার জন্যই এসেছি। তোমার মা-বাবার খুনিকে আমি উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে দেবোই।”

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩০

“অনেক ভরসা করেছি তোমার উপর, আর না। এবার থেকে আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভরসা করব না। তুমি যথেষ্ট করেছ, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আমার মা-বাবার খু*নিকে আমিই শাস্তি পাইয়ে দেব। তোমার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ, পারলে আমায় একটু একা থাকতে দাও। তোমার উপস্থিতিও আমায় কষ্ট দিচ্ছে।”
সুনীতির কথা অভিকের বুকে ঝড়ের সৃষ্টি করে। সে দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩২