মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ১৯
ইয়াসমিন খন্দকার
অভীক্ষা সারাটা রাত জেগেই কাঁটিয়ে দিলো। তার কাছে মনে হলো তার সাথে অনেক বড় প্রতারণা হয়েছে। অভীক্ষার চোখে জল ছলছল করছে। অভীক্ষা সেই চোখের জল মুছে বলে,”আপনাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করব না সারজিস। কক্ষনো না।”
সারজিসও রুম থেকে বেরিয়ে বলে,”আমাকে কি একটু বিশ্বাস করা গেল না অভীক্ষা? আপনাকে তো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। চেয়েছিলাম এই খারাপ সময়ে আর কেউ আমার পাশে না থাকলেও আপনি থাকবেন কিন্তু….হাহ! আপনিও আর সবার মতো আমাকেই দোষী করে দিলেন। গোটা পৃথিবীর কাছে আজ আমিই দোষী!”
বলেই সারজিস ছাদে উঠে চাঁদের দিকে তাকালো। সারাটা রাত এভাবেই কাটালো।
নতুন সকালের সূচনা হলো। আমায়রার খুব একটা বেশি সিরিয়াস কিছু হয়নি। তাই তাকে সকালেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হলো। অহনা আর সাগর আমায়রাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এলো। বাসায় আসতেই ইভা তাদের সম্মুখীন হলো। আমায়রাকে দেখামাত্রই তার কাছে গিয়ে বলল,”এখন কেমন আছ তুমি আমায়রা? এত বড় একটা বোকামি তুমি কি করে করলে? আমি তো তোমায় আশ্বাস দিয়েছিলাম, যেকোন মূল্যে সারজিস আর তোমাকে এক করবো। আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখতে পারলে না?”
অহনা রাগী কন্ঠে বলে,”খবরদার ভাবি,আপনি আমার মেয়েকে আর এমন মিথ্যা আশা দেবেন। এমনিতেই আপনার এসব মিথ্যা আশার জন্য ওর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এবার একটু ক্ষমা করে দিন প্লিজ। আমি একজন মা হিসেবে আপনার সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি।”
“আমি আমায়রাকে কোন মিথ্যা আশা দিচ্ছি না অহনা। তোমার কি মনে হয় ঐ অভীক্ষাকে আমি নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেব? মরে গেলেও না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এবার সাগর বলে ওঠে,”আপনি মেনে নেবেন কি নেবেন না সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার ভাবি। তবে আমার মেয়েকে এরমধ্যে টানবেন না। ওকে অনেক কষ্টে আমরা বুঝিয়েছি যাতে ও এবার মুভ অন করার চেষ্টা করে। দয়া করে আপনি সেই চেষ্টায় পানি ঢেলে দেবেন না। এমনিতেও আর কিছুদিনের মধ্যে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে উঠব। অন্তত সেই কয়টা দিন আমাদেরকে একটু নিজেদের মতো শান্তিতে থাকতে দিন।”
“এসব তুমি কি বলছ সাগর? তোমরা কেন এই বাড়ি ছেড়ে যাবে? তাও আবার একটা বাইরের মেয়ের জন্য! যদি কেউ এই বাড়ি থেকে বের হয় তবে সেটা হবে অভীক্ষা। প্রয়োজনে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
এমন সময় অভীক্ষা নিজের সমস্ত কাপড়-চোপড় ট্রলি ব্যাগে করে গুছিয়ে নিয়ে এসে বলে,”আপনাদের কাউকেই আমায় এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে না। আমি নিজে থেকেই এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি।”
অভীক্ষাকে এভাবে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসতে দেখে ইভার চোখ চকচক করে ওঠে। সে মনে মনে বলে,”অবশেষে আমি যা চেয়েছি তাই হতে চলেছে। আমার পরিকল্পনা সফল।”
অহনা অভীক্ষাকে এভাবে সব জিনিসপত্র নিয়ে বের হতে দেখে বলে,”তুমি এখান থেকে চলে যাবে মানে? তোমার সাথে সারজিসের বিয়ে হয়েছে। তুমি এখন এই বাড়ির বউ।”
“আমি কখনোই এই বিয়েটা করতে চাইনি৷ বাধ্য হয়ে করেছি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি কিছুতেই এই বাড়িতে থাকব না। আমার জন্য আপনাদের ফ্যামিলিতে কোন সমস্যা হোক সেটা আমি চাই না।”
আমায়রা বলে ওঠে,”তোমার এসব ভালো মানুষির নাটক অন্য কোথাও গিয়ে করো। আমার এসব নাটক দেখার সময় নেই, রিয়ালি বলছি আমার গা জাস্ট জ্বলে যাচ্ছে। আম্মু, আব্বু তোমরা আমায় এখান থেকে নিয়ে চলো প্লিজ।”
সাগর বলে,”হ্যাঁ, আম্মু। তুমি আমাদের সাথে চলো। এসব ফ্যামিলি ড্রামা তোমায় দেখতে হবে না।”
বলেই আমায়রাকে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অহনা সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। যতই সে সুনীতিকে কথা শোনাক বা রাগ করে থাকুক, তার জীবনে সুনীতির অবদানকে সে অস্বীকার করতে পারবে না। হ্যাঁ, নিজের মেয়ের এরকম পরিস্থিতি দেখে তার মেজাজ গরম হয়ে যাওয়ায় সুনীতি আর অভীক্ষাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অহনা তাদের খারাপ চায়।
সাগর অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”কি হলো? তুমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
“তুমি আমায়রাকে নিয়ে যাও। আমি একটু পরে আসছি।”
সাগর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমায়রাকে নিয়ে তার রুমের দিকে যায়। অহনা অভীক্ষার কাছে এসে বলে,”যা সিদ্ধান্ত নেবার একটু ভেবে নিও। এমনিতেই তোমার একটা ভুলের জন্য আমাদের সবাইকে অনেক অপদস্ত হতে হয়েছে। এখন এভাবে বিয়ের পর তুমি শ্বশুর বাড়ি থেকে গিয়ে সুনীতির বিড়াম্বনা আর বাড়িও না। এমনিতেই বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে তোমার বাবার জন্য। এখন তুমিও কি তাকে আরো কষ্ট দেবে।”
অভীক্ষা মলিন হেসে বলে,”আমি এখানে থাকলেও তো তোমরা কষ্ট পাবেন। তো কোথায় যাব আমি? আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেন অহনা আন্টি? হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে সৃষ্টিই করেছেন অন্যের কষ্টের কারণ হতে।”
এদিকে অহনার হঠাৎ ভোল বদলে ইভা চিন্তিত হয়ে উঠে। সে এগিয়ে এসে বলে,”তুমি ওকে আটকাচ্ছ কেন অহনা? ও তো একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও বুঝে গেছে যে, এখানে আমরা কেউই ওকে এই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেব না। তাছাড়া সারজিস এখন মুখে যাই বলুক, ওর প্রতারণার কথা জানতে পারলে এমনিতেই ওকে ছেড়ে দেবে। তাই ওর চলে যাওয়াই ভালো। এই মেয়ে তুমি আর এখানে থেকে সময় নষ্ট করো না, এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।”
অভীক্ষা বাড়ি থেকে বের হতে পা বাড়ায় এমন সময় সারজিস সেখানে চলে এসে গর্জে উঠে বলে,”খবরদার! আর এক পাও যদি সামনে বাড়াও তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না!”
অভীক্ষা সারজিসের থেকে এহেন হুমকি পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সারজিস এগিয়ে এসে অভীক্ষার হাত টেনে ধরে বলে,”এত বড় সাহস কে দিলো তোমায়? কোন সাহসে তুমি এই বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলে?”
অভীক্ষাও প্রতিবাদ করে বলে,”আমি যদি যেতে চাই তাহলে আমাকে আটকানোর অধিকার কারো নেই।”
“আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমাকে আটকানোর। কারণ আমি স্বামী হই তোমার। ইসলাম আমাকে এই অধিকার দিয়েছে। এখন ভালোয় ভালোয় আমার সাথে ভেতরে চলো। নাহলে..”
“নাহলে কি করবেন আপনি?”
“তুলে নিয়ে ঘরে নিয়ে যাব। আর তোমার বাইরে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দেব।”
“সারজিস!”
অবস্থা বেগতিক দেখে ইভা মনে মনে বলে,”না, এমনটা চলতে দিলে তো হবে না। তাহলে তো আমার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। এবার আমাকেই কিছু করতে হবে।”
এমন ভাবনা থেকেই ইভা বলে ওঠে,”ও যখন যেতে চাইছে তখন তুমি ওকে কেন আটকাচ্ছ সারজিস? ওকে যেতে দাও, তাতেই সবার ভালো হবে।”
সারজিস আবারো গর্জে উঠে বলে,”খবরদার মম, তুমি আমাদের মধ্যে আসবে না। মনে রেখো যদি অভীক্ষা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমিও চিরকালের মতো এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব।”
“সারজিস!”
সারজিস আর কথা না বাড়িয়ে অভীক্ষাকে একপ্রকার টেনে টেনে তাদের রুমে নিয়ে যায়। অহনা এসব দেখে বলে,”তুমি যতই যাই করো ভাবি, সারজিসের চোখে অভীক্ষার জন্য যা অধিকারবোধ দেখলাম, আমার মনে হয় না তোমার পক্ষে ওদেরকে আলাদা করা সম্ভব। তাই এই চেষ্টা না করাই ভালো। এমনিতেই এত অশান্তি হয়ে গেছে এবার একটু শান্ত হতে দাও সবকিছু।”
মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ১৮
বলেই অহনা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। এদিকে ইভা বলে,”যে যাই বলুক আমি কিছুতেই হার মানবো না। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি চেষ্টা করে যাব ওদের আলাদা করার। এবার আমাকে ভিন্নভাবে কাজ করতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে সারজিস নিজেই অভীক্ষাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়।”