মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২১

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২১
ইয়াসমিন খন্দকার

অভীক্ষার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজের চোখের সামনে সারজিসকে দেখতে পায়। তার মনে পড়ে যায় জ্ঞান হারানোর আগের সমস্ত কথা। আগুনের সেই লেলিহান শিখার কথা মাথায় আসতেই সে ভীত হয়ে পড়ে আর ভয়ে সারজিসকে জড়িয়ে ধরে। সারজিস অভীক্ষাকে নিজের বুকে জড়িয়ে বলে,”তুমি একদম চিন্তা করো না অভীক্ষা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাছে তুমি সবথেকে বেশি নিরাপদ।”

এমন সময় সুনীতি ছুটে চলে আসে। অহনা তাকে ফোন করে সমস্ত কিছু জানিয়েছে। সুনীতি এসেই অভীক্ষার কাছে ছুটে চলে আসে। সারজিস অভীক্ষাকে ছেড়ে দেয়। সুনীতি বলে ওঠে,”তুমি ঠিক আছ তো, মামনী? অহনার মুখে সব শুনে তো আমার আত্মা শরীর থেকে প্রায় বিছিন্নই হয়ে যাচ্ছিল। ছোটবেলা থেকে তোমার এই ফোবিয়ার জন্য আমি তোমাকে কত সাবধানে মানুষ করেছি আর আজ..!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারজিস বলে ওঠে,”আমি অনেক লজ্জিত এই ঘটনার জন্য। আমি ভাবতেও পারিনি যে মম এমন কিছু করবে!”
সুনীতি এবার সারজিসকে বলে,”তোমার মম যে এত জঘন্য কাজ করেছে ভেবেও আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। এরপর আমি কোন ভরসায় আমার মেয়েকে এই বাড়িতে রাখব?”
এমন সময় সাজিদ সেখানে এসে বলে,”তুমি তোমার মেয়েকে নিশ্চিন্তে এখানে রাখতে পারো৷ কারণ ইভাকে আমি এই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। এখন তাই, তোমার মেয়ে এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ!”
সাজিদের কথা শুনে সুনীতি এবং অভীক্ষা দুজনেই অবাক হয়ে যায়। অভীক্ষা বলে ওঠে,”এসব আপনি কি বলছেন আঙ্কেল?! আপনি আন্টিকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন মানে..!”
সারজিস বলে,”মম যা করেছে তাতে করে তাকে নিজের মা ভাবতেও আমার লজ্জা করছে। ড্যাড একদম ঠিক ডিশিসন নিয়েছে।”

“কিন্তু আন্টি এখন কোথায় যাবেন আর কোথায় থাকবেন? আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। আমার জন্যই সবকিছু হলো। আন্টি তো আর জানতেন না যে আমার আগুনে ফোবিয়া। জানলে নিশ্চয়ই এমন করতেন না। আমি তো স্বেচ্ছায় রান্না করতে..”
সুনীতি রেগে বলে,”কি তুমি নিজেই স্বেচ্ছায় রান্না করছ? কেন তুমি জানতে না যে তোমার আগুনে ফোবিয়া? এত বড় ব্লান্ডার তুমি কিভাবে করলে?”

সাজিদ বলে ওঠে,”তোমার আন্টিকে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। সে এতোটাইও অসহায় নয়। তার নিজস্ব বিজনেস আছে, যথেষ্ট প্রভাবশালী সে। নিজের খেয়াল নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে। আমি নিজেও ইভাকে নিয়ে বিরক্ত ছিলাম। বিয়ের পর থেকে এতগুলো বছর শুধু সারজিসের মুখ চেয়ে ওকে সহ্য করেছি। কিন্তু এখন ও যা করছে তা সহ্যের বাইরে। আর ও এটা অবশ্যই জানত যে তোমার আগুনে ফোবিয়া আছে। তোমার মা তো সেদিন নিজেই ওর সামনেই আমাকে বলে গেছিল, তোমায় যাতে রান্না করতে না দেই কারণ তোমার আগুনে ফোবিয়া। তাও সে জেনেশুনে এসব করেছে শুধু নিজের জেদ মেটাতে। সে যদি এখানে থাকে তো তোমার আরো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তাই আমি একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তো আরো ভেবে নিয়েছি যে, আমি ওকে ডিভোর্স দিব।”
সুনীতি ভয়ে কেপে ওঠে। অভীক্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তবুও যে আমার নিজের মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। ইভা যদি বাড়িতে থেকেই এত কিছু করতে পারে তাহলে না জানি বাড়ির বাইরে গিয়ে আরো কত ভয়াবহতা দেখাবে।”
সারজিস বলে ওঠে,”আপনি কোন চিন্তা করবেন না। মম যাই করার চেষ্টা করুক না কেন, আমি তার সব প্ল্যান ভেস্তে দেব। আমি অভীক্ষার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগতে দেব না। এটা আমার ওয়াদা।”

সুনীতি এবার একটু নিশ্চিত হয়।
একটু পর অহনা সেখানে আসে। সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”সেদিন রাগের মাথায় তোকে অনেক কথা শুনিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে চোখের সামনে নিজের মেয়ের ওমন অবস্থা দেখে নিজেকে আমি সামলাতে পারিনি। তুই পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

অহনার থেকে এহেন কথা শুনে সুনীতি বলে,”তুই যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক। যদিও আমি তোর অবস্থাটা বুঝতে পেরেছি কিন্তু তবুও আমি বলব সেদিন তুই একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলি। সে যাইহোক, তোকে অনেক সাধুবাদ জানাই যে তুই এখন সবটা বুঝেছিস। খুব ভালো হতো, যদি সাগর আর আমায়রাও সবটা বুঝত। যা হয়েছে তাতে আমার মেয়েটার কোন দোষ নেই। ও কখনো আমায়রার সাথে এমন করতে চায় নি। বরং আমায়রা সুখের কথাই ভেবেছিল। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল আর..!”

অহনা বলে,”বাদ দে সেসব কথা, ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। ভাগ্যের লেখা তো আর বদলানো যায়না। এখন আমার মেয়েটা নিজেকে একটু সামল নিলেই হয়। তাহলে দেখবি সাগরের রাগটাও কমে যাবে।”
“তাই যেন হয়।”

এরপর সুনীতি অভীক্ষা ও সারজিসের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”যেভাবেই হোক না কেন, তোমাদের বিয়েটা কিন্তু হয়েছে আর এটা মিথ্যা নয়৷ তাই তোমরা দুজনেই এই সম্পর্কটাকে সিরিয়াস ভাবে নাও। যদিও তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে আমার কথা বলা সাজে না তবুও আমি তোমাদের পরামর্শ দেব একে অপরের সাথে মানিয়ে চলতে৷ বিশেষ করে অভীক্ষা, তোমায় বলব তুমি সারজিসের সাথে খারাপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকো। এখানে তুমি যেমন নির্দোষ তেমনি সারজিসও। আমার বারবার মনে হয়, এখানে কোন তৃতীয় পক্ষ নিজের স্বার্থে কাজ করেছে। আমাদের উচিৎ নয় তার ফাঁদে পা দেওয়া। তাই তোমরা নিজেদের মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি রেখো না।”

ইভাকে সাজিদ বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর থেকেই সে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে আছে। ইভা বর্তমানে একটি ফ্ল্যাটে উঠেছে। সেখানে উঠেই সে সারজিস ও অভীক্ষাকে আলাদা করার জন্য নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। ইভা বলে,”ঐ অভীক্ষার জন্য আমার এতদিনের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের এই অবস্থা! বিয়ের পর থেকে আমি যেভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছি সেটা আর হচ্ছে না..এমনকি সাজিদের সাহস এত বেড়ে গেছে যে ও আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। এটা আমি কিছুতেই সহজ ভাবে নেব না। আমি যতটা না অপমানিত হয়েছি তার থেকে কয়েকগুণ বেশি অপমানিত করব ঐ অভীক্ষাকে। আর এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”

বলেই সে কাউকে একটা ফোন করে।
কিছুক্ষণ পর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাফেতে যায়। একটু পর সেই ক্যাফেতেই প্রবেশ করে আমায়রা। আমায়রা এসে ইভার সামনাসামনি বসে। আমায়রাকে দেখে ইভা বলে,”তুমি এখন কেমন আছ আমায়রা?”
“কেমন আছি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছ। এখন বলো আমায় কিজন্য ডেকে পাঠিয়েছ!”
ইভা বলে,”ঐ অভীক্ষার জন্য আমাদের পরিবারে কি কি অশান্তি নেমে এসেছে সেটা তো তুমি দেখলেই। প্রথমে ও তোমার থেকে সারজিসকে কেড়ে নিয়ে সারজিসকে বিয়ে করে নিল আর তারপর কৌশলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করল। কেন জানো? কারণ আমি ওর পথে সবথেকে বড় বাঁধা। আমি চেয়েছি তোমাকে আর সারজিসকে পুনরায় এক করতে সেইজন্য।”

আমায়রা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ইভা আরো বলে,”এখন তো আমি ঐ বাড়িতে নেই তাই যা করার এখন তোমাকে করতে হবে। আমার উপর ভরসা করে আমার সাথে হাত মেলাও। তারপর আমরা দুজনে মিলে ঐ অভীক্ষাকে খন্দকার বাড়ি থেকে বের করব। তারপর তুমি সারজিসকে সম্পূর্ণ নিজের করে পাবে।”

আমায়রা রাগী কন্ঠে বলে,”তোমার ফালতু কথা বলা শেষ হয়েছে, চাচি? যদি হয় তো এবার আমায় বলতে দাও। আমি মোটেই তোমার পাতা ফাঁদে পা দেব না। হ্যাঁ, সারজিস ভাইয়ের প্র‍তি আমার অনুভূতি রয়েছে এটা আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু তার মানে এই নয়, সে সবার সামনে অভীক্ষাকে পছন্দ করে আমার প্রতি কোন অনুভূতি নেই বলার পরেও আমি তাকে পাওয়ার আশা রাখব৷ আর এজন্য অভীক্ষার ক্ষতি চাইবো। এটা ঠিক, এই বিয়েটা আমি মানতে পারিনি নাতো সারজিস ভাই আর অভীক্ষার সবটা লুকানোর জন্য তাদের ক্ষমা করতে পেরেছি কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি তাদের আলাদা করার জন্য ষড়যন্ত্র করব। এমন কূটনীতি আমার মনে নেই।”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২০

“তুমি বোকামি করছ আমায়রা! আমার সাথে হাত মিলালে তোমারই লাভ! আমি তোমার ভালোর কথা ভেবেই..”
“তুমি আমার অনেক ভালো ভেবে নিয়েছ, চাচি। আর তোমায় ভাবতে হবে না।”
বলেই আমায়রা উঠে দাঁড়ায় এবং ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যায়। ইভা ব্যর্থতা মেনে নিতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে।

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২২