মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৮

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৮
ইয়াসমিন খন্দকার

অভীক্ষা তার মা সুনীতিকে নিয়ে চলে এসেছে আসাম রাজ্যে। চা-বাগানে আবৃত আসাম রাজ্য শুধু চা-বাগান নয়, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা সহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে এই রাজ্যকে। অভীক্ষা ও সুনীতি চোখ ভড়ে দেখছে এই সৌন্দর্য। এর মাঝেই সুনীতি বলে উঠল,”জানো অভীক্ষা, আমার মনে হচ্ছে আজ এখানে এসে আমি খুব উত্তেজনা অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, মূল্যবান কিছু ফেরত পেতে চলেছি। হাওয়া বদল করতে এসে যেন আমার জীবন বদলে যেতে চলেছে।”

অভীক্ষা হালকা হেসে বলে,”এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করো মা। এটা তোমার শরীরের জন্য ভালো হবে।”
সুনীতি মাথা নাড়িয়ে সহমত জানায়। এরইমধ্যে হঠাৎ করে সুনীতি বলে ওঠে,
“আচ্ছা, মা। চলো কাল আমরা কাল করিমগঞ্জের কয়েকটা চা-বাগানে ঘুরতে যাই। যদিও এখানকার চা-বাগান গুলো আসামের অন্যান্য জেলার মতো সুবিশাল নয় তবে আমি শুনেছি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রূপনগর নামক একটা গ্রামে উন্নত জাতের কিছু চা-বাগান গড়ে উঠেছে যা যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। আবার কাল নাকি ওখানে চা উৎসবও পালিত হবে। দেশ বিদেশের হাজার হাজার দর্শনার্থী ভীড় করবে কাল ওখানে। তো আমি ভাবছি, কাল আমরাও সেখানে ঘুরতে যাব। তুমি কি বলো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বেশ, তাহলে তো যাওয়াই যায়। আমারও ব্যাপারটা ভালোই লাগছে শুনতে। বিশেষ করে এমন প্রত্যন্ত একটা গ্রামে যখন এত বড় উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে তখন আশা করছি এটা ভালো কিছুই হবে।”
সুনীতিকে কেন জানি অনেকটা অন্যমনস্ক লাগছিল। আসামে পা রেখেছে থেকে তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েছে খানিক। মনও এখন খানিকটা চঞ্চল। কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে তার এই মানসিক অবস্থা? তাহলে কি এই আসাম সত্যিই কোন বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে?!

আসামের করিমগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম রূপনগর। এই গ্রামটা বাংলাদেশ সীমান্তের বেশ কাছেই। নিতান্তই অপরিচিত এই স্থানটি ইদানীং শিরোনামে উঠে এসেছে এর চা-বাগানের জন্য। যদিও কিছু বছর আগেও এই গ্রামের বিস্তীর্ণ ভূমি পড়েছিল চাষ অনুপোযোগী, পরিত্যাক্ত স্থান হিসেবে৷ তবে একজন মানুষের প্রচেষ্টায় এই গ্রামের পুরো মানচিত্রই যেন বদলে যায়। তিনি এই গ্রামের বেকার ও কর্মক্ষম যুবকদের সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে কাজে লাগিয়ে বিস্তীর্ণ আগাছাপূর্ণ জমি ছাপ করিয়েছেন। অতঃপর সেই জমির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সার ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে চাষ উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন। এরপরই সেই জমিতেই গড়ে তুলেছেন চা-বাগান। তারই উদ্দ্যেগে গোটা গ্রামের মানুষ আজ দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। হয়েছে আজ সাবলম্বীও।
নিজের ব্যাপারে এত সুনাম অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দেন গ্রামের সবার কাছে ওস্তাদজি নামে পরিচিত সেই ব্যক্তিটি। তবে তার অবদান যে এই গ্রামের জন্য অনস্বীকার্য তা এই গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিতে কার্পণ্য করবে না।

সেই ওস্তাদজির মনও আজ ভালো নেই। সকাল থেকে সরাইখানাতে বসে কিসব যেন ভেবে চলেছেন তিনি। ওস্তাদজির একনিষ্ঠ ভক্ত কালিয়া নিজের ওস্তাদকে এমন নির্জীব দেখে তাই তো আর চুপ থাকতে পারে না। ওস্তাদজির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে ওস্তাদজি আপনার? সকাল থেকে আপনাকে এমন অন্যমনস্ক লাগছে কেন? আপনার কি শরীর খারাপ করছে? ডাক্তার ডাকব কি?”
ওস্তাদজি বলেন,”আমাকে নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ো না, কালিয়া। আমি একদম ঠিক আছি অন্তত শারীরিক দিক থেকে। কিন্তু মানসিক দিক থেকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করছি। জানি না, এর কারণ কি। তবে কোন না কোন কারণ তো রয়েছেই।”

“আপনার মন খুশি করার জন্য আমায় কি করতে হবে ওস্তাদ জি? আপনি যদি বলেন, আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও আপনাকে খুশি করব।”
ওস্তাদজী হালকা হেসে বলেন,”পাগল ছেলে! তোকে কিছু করতে হবে না। যা গিয়ে বিশ্রাম নে। কাল গ্রামে চা উৎসব সেটা মনে আছে? দেশ-বিদেশের কত অতিথি আসবে। তাদের সামনে আমাদের রূপনগরকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে হবে তো নাকি? এই উছিলায় যদি এখানে পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করে তাহলে তো আমাদেরই লাভ। গ্রামের আরো কত অসহায় মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে!”

“ঠিক আছে, ওস্তাদজী। আমি দেখছি ওদিকটা। আপনি কিছুটা বিশ্রাম নিন।”
বলেই কালিয়া বেরিয়ে যায়। ওস্তাদজী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,”ইয়া রব! তুমি কি লিখে রেখেছ আমার ভাগ্যে? কেন এমন উৎকন্ঠা বোধ হচ্ছে? নিজের ২০ বছরের স্মৃতিতে তো কখনো এমন উৎকণ্ঠা বোধ হয়নি। তাহলে এই উৎকণ্ঠা কিসের ইঙ্গিত?”

নতুন দিন, পৃথিবীর বুকে এক নতুন সূর্যের আগমন। সুনীতি ও অভীক্ষা আজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে রূপনগরের উদ্দ্যেশ্যে। তাদের মূল উদ্দ্যেশ্য, রূপনগরের বিখ্যাত চা-উৎসবের সাক্ষী হওয়া।
এদিকে রূপনগরের মানুষের জীবন কাটছে নানান ব্যস্ততায়। তাদের যেন আজ দম নেওয়ারও ফুরসত নেই। সকাল থেকেই সবাই কোমড় বেঁধে নেমে পড়েছে চা উৎসবের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে। তাদের মূল উদ্দ্যেশ্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকরাম করা। তাই তো আজ চা-বাগান গুলো সেজে উঠেছে নতুন উদ্যমে। অনেকে বিভিন্ন ধরনের চায়ের স্টলও বসিয়েছে। এছাড়া গ্রামের স্থানীয় কিছু নারী-পুরুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সামনে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী নাচ “ঝুম নৃত্য” উপস্থাপন করার জন্য। এছাড়া রূপনগরের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার যেমন, ভেড়ার বিরিয়ানী, ভেড়ার সব্জি-রুটি এবং ভেড়ার রোস্টও তৈরি করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। অতএব, সবাই ভীষণ ভাবে প্রস্তুত এই চা উৎসবকে একটি সুন্দর মোড় দিতে।

গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত তখন অন্যদিকে, সুনীতি গ্রামে প্রবেশ করেই থমকে গেল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। অভীক্ষা নিজের মায়ের অস্থিরতা খেয়াল করে বলল,”কি হয়েছে মা? তোমাকে এমন লাগছে কেন? সবকিছু ঠিক আছে তো?”
সুনীতি হালকা হেসে বলে,”হুম, আমি ঠিক আছি।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একদম ঠিক ছিল না। আকাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। রূপনগর গ্রামে যেদিকেই চোখ যায় শুধু মনোরম সৌন্দর্যমন্ডিত চা-বাগান। যেই চা-বাগান বদলে দিয়েছে এই পুরো গ্রামের কয়েকশো মানুষের ভাগ্য। রূপনগরের প্রবেশের পথেই দাঁড়িয়ে ছিল কালিয়া সহ এই গ্রামের আরো কিছু যুবক। ঘুরতে আসা সকল পর্যটককেই তারা ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এবং সাথে করে বিনামূল্যে পান করাচ্ছে এই গ্রামের বিখ্যাত চা।
সুনীতি সেই চা খেয়ে যেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে। যেন চেনা এক স্বাদ খুঁজে পায় এই চায়ের মাঝে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে,”কে বানিয়েছে এই চা?”

কালিয়া হেসে বলে,”এই চা তো আমার ওস্তাদজী বানিয়েছে। কেন ভালো হয়নি খেতে?”
সুনীতির অস্থিরতা বাড়ে। সে বলে,”কোথায় আপনার ওস্তাদজী? তার সাথে কি দেখা করা যাবে?”
কালিয়া সহ আরো কিছু ছেলে যারা ছিল তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অভীক্ষা সুনীতির এহেন ব্যবহার দেখে বলে,”কিছু কি হয়েছে মা? তুমি এমন করছ কেন?”
কালিয়া আন্তরিক হেসে বলে,”আপনারা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঝুমুর নৃত্য আর বিভিন্ন খাবার উপভোগ করুন। ওস্তাদজী আজ এই অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্য এবং সংগীত পেশ করবেন। চাইলে তখন তার সাথে দেখা করতে পারেন।”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৭

সুনীতির ব্যাকুলতা বাড়ে। সে বলে,”তার আগে কি দেখা করার কোন সুযোগ নেই?”
“দুঃখিত, ম্যাডাম। কিন্তু আমরা অপারগ।”
অভীক্ষা বুঝতে পারে না তার মা কেন এমন একজন আগন্তুকের সাথে দেখা করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। তবে ব্যাপারটা তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। কারণ আশেপাশের সবাই কেমন ভাবে যেন তাকাচ্ছে তাদের দিকে। এজন্য অভীক্ষা বলে,”মা, তুমি চলো আমার সাথে ভেতরে। সঠিক সময় হলে ঠিকই ওনার সাথে দেখা হবে।”
নিজের মেয়ের কথাতেও যেন আশ্বস্ত হতে পারে না সুনীতি। যেন ভাগ্য আজ এক খেলা খেলতে প্রস্তুত! যেই খেলা বদলে দেবে অনেকের জীবনের গতিপথ।

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৯