মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৯

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৯
ইয়াসমিন খন্দকার

সুনীতি অস্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের পানে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই রূপনগর গ্রামের মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ঝুম নৃত্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করতে শুরু করে দিয়েছে। যা দেখে সবাই আজ ভীষণ খুশি। বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকরা চারপাশের পরিবেশ দেখে দারুণ ভাবে মুগ্ধ। অভীক্ষাও সব অনুষ্ঠান দেখছে মনযোগ দিয়ে।

কিন্তু সুনীতির তো এসব অনুষ্ঠানে কোন মনই নেই। সে তো আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই সময়ের জন্য যখন এই গ্রামের সেই তথাকথিত ওস্তাদ জি স্টেজে উঠে সবার সামনে গান পরিবেশন করবে। তাকে দেখার জন্যই ছটফট করছে সুনীতির অবুঝ মন। সুনীতি আনমনেই বলে ওঠে,”আমার কেন মনে হচ্ছে..এতদিন পর আবারো নিজের হারানো মানুষটাকে ফিরে পেতে পারি? এটা কি আদৌতেও সম্ভব? নাকি সবটাই আমার মনের ভুল। তা আর মাত্র কিছুক্ষণ পরই জানা যাবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে অভীক্ষা সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মা, তোমাকে কিন্তু আমি অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি। কেন তোমার অস্থিরতা কোন মূল্যেই কমছে না? এর পেছনের কারণ কি?”
সুনীতি নিশ্চিত না হয়ে অভীক্ষাকে কোন কিছু জানাতে চাইছে না। তাই সে বলে,”সময় হলে ঠিকই তুমি সবটা বুঝত পারবে মামনী। আপাতত শুধু এটা জেনে রাখ যে, আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পরিবর্তন আসতে পারে আজ। আমি যা সন্দেহ করছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের জীবনটা এরপর আবারো আগের মতোই অনেক সুন্দর হবে। ”

অভীক্ষা সুনীতির মুখে এহেন কথা শুনে কিছু বুঝতে পারে না। সে নিজের মতো অনুষ্ঠানে মনযোগ দেয়। এরইমধ্যে তার হঠাৎ তেষ্টা পাওয়ায় সে সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মা, আমি একটু পানি খেয়ে আসছি। তুমি এখানেই থেকো, কেমন?”
“আচ্ছা, তুমি গিয়ে পানি খেয়ে আসো। আমি এখানেই আছি।”

অভীক্ষা পানি খাওয়ার জন্য একটু দূরে আসে। কিন্তু সবাই অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত থাকায় কোথাও পানির সন্ধান পাচ্ছিল না সে। তাই মূল অনুষ্ঠান থেকে একটু দূরে এসে পানির খোঁজ করতে থাকে। হঠাৎ করে একটি কলপাড় দেখে তার মনে আশা জেগে ওঠে। সে দ্রুত তার কাছে গিয়ে কল থেকে পানি খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আফসোস, কল থেকে পানি বেরই হয়না। অভীক্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আমার ভাগ্যে বোধহয় আর পানি খাওয়া নেই।”
বলেই সে ফিরে আসতে নেবে এমন সময় পেছন থেকে এক গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পায়,”তুমি কি পানি খেতে চাও?”

কন্ঠস্বরটা শুনেই পিছন ফিরে তাকায় অভীক্ষা। দেখতে পায় এক মধ্যবয়সী পুরুষকে যে স্মিত হেসে তার পানেই চেয়ে আছে৷ অভীক্ষা তার পানে তাকিয়ে বলে,”জ্বি, কিন্তু কলে তো পানিই নেই।”
বৃদ্ধ এবার খানিকটা এগিয়ে আসায় তার মুখটা খানিক স্পষ্ট হয় অভীক্ষার কাছে। অভীক্ষার কাছে এই লোকটার চেহারা অনেকটা চেনা চেনা মনে হয়। যেন কোন এক চেনা মানুষের চেহারার মিল খুঁজে পায় এই চেহারায়। কিন্তু সঠিক ভাবে কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু অবাক স্বরে বলে,”আপনার সাথে আমার খুব চেনা একজনের চেহারার ভীষণ মিল পাচ্ছি মনে হচ্ছে?”
মধ্যবয়সী লোকটা স্মিত হাসি বজায় রেখে বলে,”কার?”

“সেটা জানিনা, কিন্তু পাচ্ছি।”
লোকটা এবার কিছুটা দূর থেকে একটা পিড়ি নিয়ে এসে অভীক্ষার সামনে রেখে অভীক্ষার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি একটু এখানে বসো, মেয়ে। আমি কোন ব্যবস্থা করছি।”
বলেই তিনি ধুপধাপ পা ফেলে একটা সরাইখানার ভেতরে যান। কিছু সময় পর সেখান থেকে এক গ্লাস সরবত ও কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে বের হয়ে বলেন,”এর থেকে বেশি কিছুর ব্যবস্থা করতে পারলাম না। ”
অভীক্ষা বলে উঠল,”আমার তো শুধু এক গ্লাস পানিরই প্রয়োজন ছিল। তবুও যে আপনি আমার জন্য এতটা ব্যবস্থা করেছেন এটাতেই আমি আপ্লুত। সত্যি, এই গ্রামে এসে এখানকার মানুষদের চমৎকার ব্যবহার ও আতিথেয়তা আমায় মুগ্ধ করেছে। এই অভিজ্ঞতা আমি কখনো ভুলব না। যেন মনে হচ্ছে এখানে সবাই আমার কতই না আপন!”

মধ্যবয়সী লোকটা এবার হঠাৎ করে বলে ওঠেন,”জানো মেয়ে,তোমাকে দেখেও কেন জানি আমার মনে হচ্ছে খুব আপন কেউ..জানিনা এটা কেন হচ্ছে..বা তুমি এই বিষয়টাকে কিভাবে নেবে। এই যেমন দেখো..চিনি না জানিনা তোমাকে কিরকম “তুমি” করে বলছি। এই তুমি ডাকটা কতই না আপন! আমার মন থেকে কেন জানি তুমি ডাকটাই আসছে। তুমি কিছু মনে করো না।”
অভীক্ষা বলে ওঠে,”আরে না না..আমি তো আপনার মেয়েরই বয়সী। আপনি আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন। জানেন, আমি জীবনে কখনো বাবার সান্নিধ্য লাভ করিনি। অনেক ছোটবেলায় আমি নিজের বাবাকে হারিয়েছি। বাবার ভালোবাসা কেমন হয়, সেটা খুব কমই উপলব্ধি করেছি৷ তবে এই যে, আপনি আমাকে এত যত্ন করে এসব খাবার এনে দিলেন আমার কাছে মনে হলো, আজ যদি আমার বাবা থাকতেন তিনিও এইভাবে আমার খেয়াল রাখতেন!”

লোকটি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,”বাবা!”
এরপর কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা বজায় থাকল। অভীক্ষা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”আপনার সাথে পরিচিত হয়ে অনেক ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।”
বলেই সে চলে আসে। মধ্যবয়সী লোকটা তার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে।

এদিকে অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ পর্যায়ে কালিয়া মঞ্চে উঠে বলল,”তো আমাদের রূপনগরের এই বিশেষ চা উৎসব প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। আমাদের পক্ষ থেকে আজকের সর্বশেষ পেশকাশ হবে, সেই মানুষটার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া, যার জন্য আমাদের রূপনগর আজ এতটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। আজ আমরা যে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি তার পেছনে যার অবদান সবথেকে বেশি তার সাথে এবার পরিচয় হবার পালা। তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় ওস্তাদজী। তো চলুন, এবার তার সাথে পরিচয় হয়ে নেয়া যাক। যেই মানুষটা আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের গ্রামে ঠিক যেন স্বর্গদূত হয়ে এসেছিলেন। অতঃপর বদলে দিয়েছেন আমাদের পুরো গ্রামের মানচিত্র। তো আমি আর বেশি কথা না বলি, আমাদের ওস্তাদজী এবার তার খুব পছন্দের একটা গান পরিবেশন করার মাধ্যমে নিজেই আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে নেবেন।”

সুনীতির অস্থিরতা বেড়ে যায়। সে আকুল দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে চেয়ে ছিল। এরইমধ্যে মঞ্চে ওঠেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ। যার গায়ে বাউলের সাজ, মুখে বড় বড় সাদা দাঁড়ি। তিনি মঞ্চে উঠেই গাইতে শুরু করলেন,

❝চাতক প্রায় অহর্নিশি…
চেয়ে আছি কালো শশী..
চাতক প্রায় অহর্নিশি…
চেয়ে আছি কালো শশী..
আমি হব বলে চরণ-দাসী,….
হব বলে চরণ-দাসী,….
ও তা হয় না কপাল-গুণে…
ও তা হয় না কপাল-গুণে.
আমার মনের মানুষের সনে..
আমার মনের মানুষের সনে…
মিলন হবে কত দিনে…
মিলন হবে কত দিনে….
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে..❞

ধীরে ধীরে বহুল কাঙ্খিত সেই চেহারাটা স্পষ্ট হতে থাকে সুনীতির সামনে। গলার স্বরটা শুনেই তো চিনে ফেলেছে নিজের একান্ত আপন মানুষটাকে। এখন যতোই দাঁড়ি গজাক বা চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ুক কিছুটা তবুও সুনীতির চিনতে অসুবিধা হয়না যে রূপনগরের ওস্তাদজীই তার অভিক। সুনীতি যেন কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলে। দুঃখ-সুখের অনুভূতি একত্রে ঘিরে ফেলেছে তাকে। কিছু মুহুর্ত পূর্বে চোখ থেকে ঝড়ে পড়া এক ফোঁটা অশ্রুও যেন দুঃখ-সুখের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সুনীতি চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চিৎকার বলে উঠল,”অভিক…”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৮

বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না দ্রুতবেগে স্টেজে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অভিককে। সবাই হতবিহ্বল হয়ে দেখল এই দৃশ্য। অভীক্ষার চোখেও হতবিহলতা। এদিকে হঠাৎ করেই প্রকৃতি অস্থির হয়ে উঠল। দ্রুত বেগে বাতাস বইতে রইল। প্রকৃতিও যেন আজ পুর্নমিলনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩০