মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩০
ইয়াসমিন খন্দকার
সুনীতি যখন প্রবল আবেগ ও অনুভূতির সাথে অভিককে জড়িয়ে ধরেছিল তখন অভিকের চোখে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছিল। এদিকে অভীক্ষার কাছেও এতক্ষণে স্পষ্ট হয় কেন প্রথম দেখায় লোকটিকে তার এত চেনা চেনা লাগছিল। কারণ লোকটা তার জন্মদাতা পিতা। বুঝ হওয়ার পর থেকে সে শুধু বাবার ছবিই দেখেছে কখনো সামনাসামনি দেখেনি। আর ২০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় অভিকের চেহারাতেও কিছু বদল এসেছে যার কারণে তাকে কখনো সামনাসামনি না দেখা অভীক্ষার প্রতি নিজের বাবাকে চেনা খানিকটা কঠিন ছিল৷ কিন্তু সুনীতির সাথে অভিকের হৃদয়ের আত্মিক বন্ধনের কারণে সে খুব সহজেই নিজের ভালোবাসা, নিজের অভিককে চিনে নেয়।
সুনীতি অভিককে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বলে,”এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? জানো, আমি কোথায়, কোথায় খুঁজেছি তোমায়? কিন্তু কোথাও তোমার সন্ধান পাইনি। আজ সুদীর্ঘ ২০ বছর পর তোমায় নিজের চোখের সামনে দেখলাম। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি অভিক? কেন একবারও আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করো নি? তোমার অনুপস্থিতি আমাদের জন্য কতটা কষ্টকর ছিল জানো? তোমার বাবা তো তোমার শোকে নিজের জীবনই দিয়ে দিলেন, তোমার বৃদ্ধ মা আজও তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। আর আমাদের ছোট্ট অভীক্ষাকে তোমার মনে আছে? আজ ও অনেক বড় হয়েছে। একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার ও, এমনকি ওর বিয়েও হয়ে গেছে। অভীক্ষা মা, এসো দেখো তোমার বাবা ইনি..”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বলেই অভীক্ষার দিকে তাকায় সুনীতি। অভীক্ষাও স্টেজে উঠে পড়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আবেগঘন স্বরে বলে,”একজন আমার তোমার প্রতি একটা টান অনুভব হচ্ছিল তখন, বাবা? তুমি..তুমি আমার জন্মদাতা পিতা অথচ প্রথম দেখায় আমি তোমায় চিনতেই পারলাম না। জানো, আমার জীবনে তোমার অনুপস্থিতি কতটা জোরালো ছিল? আমি জীবনে প্রত্যেকটা মুহুর্তে বাবার অভাব বোধ করতাম। আজ এতগুলো বছর পর যে তোমায় একদম সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ফিরে পাবো তা কখনো কল্পনাতেও আনিনি, আমি।”
অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার মুখের পানে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে৷ সুনীতি অভিককে বলে,”কিগো! কিছু বলছ না কেন মেজর সাহেব?”
অভিক অবাক স্বরে বলে,”কে আপনারা? আর এসব কি বলছেন? কে অভিক? আপনা তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না।”
অভিকের কথায় সুনীতি ও অভীক্ষা যেন বড় একটা ধাক্কা খায়। বিশেষ করে সুনীতির মনে এতদিন পর জ্বলে ওঠা আশার আলোটা যেন নিভে যেতে বসে। সে দুই ধাপ পিছিয়ে বলে,”কি বলছ টা কি তুমি? আমায় তুমি চিনতে পারছনা অভিক? আমি সুনীতি, তোমার স্ত্রী।”
অভিকের মাথায় হঠাৎ করে তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে। সে নিজেকে মাথা চেপে ধরে। কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি ভেসে ওঠে তার মাথায়। সে চিৎকার করে বলতে থাকে,”না,না। আমি তোমাদের কাউকে চিনি না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। চলে যাও।”
বলতে বলতেই হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। কালিয়াসহ রূপনগর গ্রামের আরো কিছু সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে মঞ্চের মধ্যে। এদিকে অভিকের মুখে এহেন কথা শুনে সুনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। অভিকের এহেন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও তাকে অস্থির করে তোলে। এমতাবস্থায় অভীক্ষা সুনীতির কাধে ভরসার হাত দিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না, মা। এতদিন পর যখন ভাগ্য আমাদের আবার বাবার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছে তখন আমরা কিছুতেই আর হার মানবো না। কোন কারণে হয়তো বাবা আমাদের চিনতে পারছে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমরা আবারো বাবাকে ফিরে পাবো।”
নিজের মেয়ের কথা সুনীতি আবারো তার হারানো বিশ্বাস ফিরে পায়।
সুনীতি এবং অভীক্ষা এখন বসে আছে কালিয়ার মুখোমুখি। অভিকের জ্ঞান তখনো ফেরেনি। এই রূপনগর গ্রামে অভিকের সাথে কালিয়ার সম্পর্কই যেহেতু সবথেকে ঘনিষ্ঠ তাই অভীক্ষা ও সুনীতি তা সাথেই অভীকের বিষয়ে কথা বলতে আসে।
সুনীতি কালিয়াকে জিজ্ঞেস করে,”তোমার সাথে ওনার প্রথম পরিচয় কোথায় হয় এবং কিভাবে?”
কালিয়া বলে,”আমার বাবা রূপনগরের পাশের একটি জঙ্গলে বাস করতেন। আমরা ছিলাম আদিবাসী এবং সেই জঙ্গলে আদিবাসীদের দলপতি ছিলেন আমার বাবা। তো, একদিন আমাদের আদিবাসী দলের কিছু সদস্য শিকারের উদ্দ্যেশ্যে জঙ্গলে যায় সেখানে তারা হঠাৎ করেই একটি খাদের নিচে ওস্তাদজীকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। ওনার পরনে ছিল আর্মির পোশাক। তারা দ্রুতই ওনাকে নিয়ে আমার বাবার কাছে নিয়ে আসেন। বাবা দলের সবাইকে নির্দেশ দেয় ওনার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে৷ ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক উঁচু খাদ থেকে পড়ে গেছে এবং তার শরীরে গুলির চিহ্নও ছিল।
তাই প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওনাকে জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে মফঃস্বল এলাকার একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ওনাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে পাঠানো হয়। অবশেষে চিকিৎসা শেষে উনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর যখন ওনার কাছে ওনার পরিচয়, পরিবারের ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য জানতে চাওয়া হয় তখন উনি কিছুই বলতে পারেন না। যার ফলে সেই সময় ওনার কোন গতি করা সম্ভব হয়নি। তাই সেই সময় বাধ্য হয়ে আমরা ওনাকে আবারো আমাদের জঙ্গলে ফিরিয়ে আনি। তবে এই জঙ্গলের পরিবেশে যে ওনাকে রাখা ঠিক নয় এটা বুঝতে পেরে আবার বাবা ওনাকে নিকটবর্তী গ্রাম অর্থ্যাত এই রূপনগরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই একটি সরাইখানায় উনি থাকতে শুরু করেন।
ওস্তাদজী যে কয়দিন আমাদের ওখানে ছিলেন সেই কয়দিনের মধ্যে ওনার সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই আমি মাঝে মাঝেই ওনার সাথে দেখা করতে রূপনগরে আসতাম। তবে কিছু বছর পর হঠাৎ করে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাদের দলের মধ্যে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমি যেহেতু তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই আমাকে আদিবাসী দলনেতা মানতে কেউ প্রস্তুত ছিল না। যে কারণে আমার চাচা এই সুযোগের ফায়দা তুলে নেতা বনে যান। আমার মা বুঝতে পারে নিজের স্বার্থের জন্য আমার চাচা আমার ক্ষতি করতে দুবার ভাববেন না।
এই কারণে আমাকে নিয়ে চলে আসেন এই রূপনগরে। অতঃপর আমি ওস্তাদজীর সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে থাকি। ওস্তাদজী তার পুরাতন জীবনের কোন কথাই মনে করতে পারতেন না। তবে ওনার মধ্যে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল তা আমায় মুগ্ধ করে। উনি সবসময় জ্ঞানের কথা বলতেন যা আমি মনযোগ দিয়ে শুনতাম। একসময় উনি গ্রামের মানুষদের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করতে শুরু করেন। আর সেই উদ্দ্যেশ্যেই তার উদ্দ্যেগে বদলে যায় এই রূপনগর গ্রাম।”
কালিয়ার সব কথা মনযোগ দিয়ে শোনে সুনীতি ও অভীক্ষা। সব শুনে অভীক্ষা বলে,”তার মানে খাদ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য বাবা তার পুরাতন জীবনের সব স্মৃতি ভুলে গিয়েছে। আর এজন্যই উনি মাকে চিনতে পারছেন না।”
কালিয়া বলে,”হ্যাঁ। কিন্তু জানেন, ওস্তাদজী কিছুদিন থেকে আমায় বলছিল ওনার মনে হচ্ছে যে, ওনার কোন আপনজনের সাথে উনি আবার মিলিত হতে যাচ্ছেন। আমি তখন ওনার কথাকে ওতোটা গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো ভুল ভাবছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, উনি ভুল কিছু বলছিলেন না।”
সুনীতির চোখ জলে ছলছল করছিল। তবে সে এত সহজে ভেঙে না পড়ার পণ করে। সুনীতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলে,”আমি জীবনে অনেক লড়াই লড়েছি। অভিকও আমায় বলত, জীবনযুদ্ধে কখনো হার মানতে নেই। অভিকের মতো একজন সাহসী, অকুতোভয় সৈনিকের স্ত্রী হওয়ার দরুণ তাই আমিও হার মানব না। যেকোনমূল্যে আমার স্বামীর হারানো স্মৃতি আমি ফিরিয়ে আনবো আর এটা আমার চ্যালেঞ্জ।”
এরইমধ্যে গ্রামের একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলে,”ওস্তাদজীর জ্ঞান ফিরেছে।”
মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৯
এই খবর পেয়ে কালিয়া, সুনীতি ও অভীক্ষা সবাই দ্রুতবেগে ছুটে চলে যায় অভিকের কাছে। অভিক কালিয়াকে দেখেই উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন,”ওরা কারা কালিয়া? ওরা তখন ওসব কি বলছিল?”
কালিয়া বলে,”ওরাই আপনার আসল পরিবার ওস্তাদজী। আপনি কয়েকদিন থেকে আমায় বলছিলেন না, আপন কারো আসার ইঙ্গিত পাচ্ছেন, আপনার ধারণাই মিলল। ইনি হলেন আপনার স্ত্রী, আর উনি আপনার মেয়ে।”
অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,”আমার পরিবার!”