মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩১

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩১
ইয়াসমিন খন্দকার

সুনীতি ও অভিককে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সবাই মিলে ঘর থেকে বের হয়। অভিক সুনীতির সাথে এভাবে একা অবস্থায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে, যেহেতু তার আগের কোন স্মৃতি মনে ছিল না। সুনীতি অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার কি সত্যি কিছু মনে পড়ছে না অভিক? আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?”

অভিক স্তিমিত স্বরে বলে,”না। যদিও আপনি দাবি করছেন, আপনি আমার স্ত্রী হন কিন্তু আমার এই সম্পর্কিত কোন স্মৃতিই মনে নেই। আমি…আমি বড্ড অসহায়। আমার শুধু এটাই মনে আছে যে আজ থেকে ২০ বছর আগে আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি আর অতীতের কোন ঘটনা মনে করতে পারিনি। আর এখনো অব্দি আমার অতীতের কোন স্মৃতিই আমি মনে করতে পারিনি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুনীতি কাদো কাদো সুরে বলে,”আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা। কিন্তু তোমায় আমাকে ভরসা করতে হবে। আমার হাত ধরে তোমায় ফিরতে হবে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে। আমার বিশ্বাস, আবারো নিজের অতীতের পরিচিত স্থানে ফিরে গেলে ধীরে ধীরে তোমার সব স্মৃতি আবার ফেরত আসবে। তোমার বৃদ্ধ মা অপেক্ষা করছে যে তোমার জন্য। তার শেষ জীবনে যদি তোমার সান্নিধ্য পায় তাহলে শান্তিতে জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করতে পারবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করবে?”
অভিক কিছুটা ভেবে বলে,”আমার সময় লাগবে। আমাকে কিছুটা ভাবতে হবে।”
“বেশ, তুমি সময় নেও। আশা করব, তুমি সঠিক সিদ্ধান্তটাই নেবে।”

রূপনগর গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রূপনগরের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার চোখে জল। কারণ এই রূপনগর গ্রামের দেবদূত স্বরূপ মানুষটা আজ চলে যাবে এই গ্রাম ছেড়ে। কালিয়ার চোখের জল আর বাঁধা মানতে রাজি নয়। ছোটবেলা থেকে সে এই লোকটার সান্নিধ্যেই বড় হয়েছে। অথচ আজ এই লোকটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।

মূলত অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তার অতীতের কোন স্মৃতি মনে নেই কিন্তু সুনীতি ও অভীক্ষার কথায় তার মনে ভরসা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সে তাদের প্রতি যে আত্মিক টান অনুভব করেছে তাও ফেলে দেওয়ার নয়৷ এজন্য অভিক বিশ্বাস করেছে তাদের কথায়। রূপনগর গ্রাম থেকে অভিকের বিদায়ের সময় গ্রামের নানা মানুষ এসে চোখের জল ফেলে। তারা অভিক তথা তাদের ওস্তাদজী শেষ বিদায় জানানোর জন্য আসে। অভিক আবেগপ্রবণ হয়ে কালিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোর সাথে হয়তো আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তোকে সবসময় আমি নিজের ছেলের মতোই দেখেছি। ভালো থাকিস রে, গ্রামটাকে দেখে রাখিস।”

কালিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমাকে ভুলে যাইয়েন না ওস্তাদজী।”
অভিক বলে,”ধুর, পাগল। তোদের কি আমি ভুলতে পারি? মাঝে মাঝে সময় পেলে ঠিকই রূপনগরে ঘুরতে আসব।”

সুনীতি গ্রামের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলে,”আপনারা যে এতগুলো দিন ধরে আমার স্বামীর খেয়াল রেখেছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আর কালিয়া, তোমার ঋণ কোনভাবেই ভোলার না। আমরা সময় পেলে এখানে আসব, তুমিও আমাদের দেশে ঘুরতে যেও। ঠিকানা তো দেওয়াই আছে।”
কালিয়া বলে,”আপনারা ভালো থাকবেন আর আমার ওস্তাদজির খেয়াল রাখবেব। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করব যেন, ওস্তাদজী দ্রুত ওনার আগের সব হারানো স্মৃতি ফিরে পান এবং আপনারা আবার আগের মতো সুখী জীবন যাপন করতে পারেন।”
অভীক্ষাও সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। অতঃপর তারা সপরিবারে রূপনগর থেকে বিদায় নিয়ে আসামের গুয়াহাটির বিমানবন্দরে আসে। অতঃপর সেখান থেকে বাংলাদেশের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

বাংলাদেশে পৌঁছে সুনীতি প্রথমে অভিককে নিয়ে একটি সেলুনে যায়। যাতে করে তার বড় বড় দাড়িগুলো ছেটে ফেলা যায়। এতে করে অভিকের আগের হারানো জৌলুস অনেকটাই ফিরে আসে। সুনীতি তো মেকওভারের পর অভিককে দেখে একদম অবাক হয়ে যায়। এ যেন তার সেই আগের অভিক। যদিও চেহারায় বয়সের ছাপ বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ওতোটাও না। সুনীতি এভাবে অভিকের দিকে তাকিয়ে থাকায় অভিক কিছুটা লজ্জা পায়। সুনীতি অভিককে বলে,”তোমাকে একদম আগের মতোই লাগছে।”
অভিক সামান্য হাসে।

অভীক্ষা বাড়িতে ফিরে তার দাদিকে বলছিল,”দাদি, দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। তোমার জন্য অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ আছে। যা তোমায় অবাক করে দেবে।”
রাহেলা খাতুন অবাক সুরে বলেন,”এসব কি বলছিস তুই সই?”
অভীক্ষা বলে,”একটু পরই তুমি সেটা বুঝবা। দেখিও, খুশিতে আবার অজ্ঞান হয়ে যেও না।”

রাহেলা খাতুন নিজের নাতনীর কথা কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। এরইমধ্যে বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠায় অভীক্ষা গিয়ে দরজা খুলে দেয়৷ দরজা খুলে সারজিসকে দেখতে পেয়েই থমকে যায়। সারজিস অভীক্ষার পানেই তাকিয়ে ছিল। সারজিসের পেছন পেছন অহনা, সাগর, আমায়রা, সাজিদ সবাই চলে আসে। অভীক্ষাই তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। তাদের সবাইকে একসাথে দেখে অভীক্ষা বলে,”আপনারা সবাই ভেতরে আসুন।”

অহনা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”সবকিছু ঠিক আছে তো অভীক্ষা? তুমি হঠাৎ আমাদের সবাইকে এভাবে ডেকে পাঠালে কেন? তুমি তো সুনীতিকে নিয়ে আসামে গেছিলে। ফিরলে কবে? সবকিছু ঠিক আছে তো? সুনীতির কিছু হয় নি তো?”
অভীক্ষা হাসিমুখে বলে,”কারো কিছু হয় নি, আন্টি। তোমাদের সবার সাথে খুশি শেয়ার করার জন্য আমি এখানে ডেকেছি। আমাদের পরিবারের পুর্নঃমিলনের সাক্ষী হও তোমরা সবাই।”
অহনা অভীক্ষার কথার কিছু বুঝতে পারে না। সারজিস বলে,”কি হয়েছে অভীক্ষা? একটু খোলাসা করে বলো।”

আমায়রাও বলে,”হুম, আমার কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে।”
এরইমধ্যে সুনীতি সেখানে এসে বলে,”আমি সবটা বলছি।”
অহনা সুনীতিকে সহি সালামত দেখে বলে,”যাক এটা দেখে নিশ্চিত হলাম যে তুই ঠিক আছিস।”
সুনীতি হেসে বলে,”ঠিক তো আমাকে থাকতেই হতো। ২০ বছর…সুদীর্ঘ ২০ বছরের অপেক্ষার পর আজ আমার জীবনে সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত এসেছে যার জন্য আমি এতগুলো দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম?”
রাহেলা খাতুন অস্থির হয়ে বলেন,”মানে?”
সুনীতি পিছনে তাকিয়ে বলে,”কই গো তুমি? ভেতরে এসো।”

ধীরে ধীরে চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে অভিক। অভিককে এত গুলো বছর পর একদম সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সবাই। সবার চোখে যেন এক অদ্ভুত বিস্ময়। রাহেলা খাতুনের চোখেও জল জমছে। তিনি যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এতদিন ধরে তো তিনি আশাও করেন নি এই জীবনে আবারো নিজের ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পাবেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে যে শেষ বয়সে এসে এই সুখ দেবেন তা অবিশ্বাস্য ছিল। রাহেলা খাতুন চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন,”তুমি ফিরে এসেছ অভিক? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আমার ছেলেটা বেঁচে আছে..এটা কি সত্যি..হায় আল্লাহ!”

সুনীতিও আবেগঘন স্বরে বলে,”হ্যাঁ, মা। এটাই সত্যি। আপনার ছেলে বেচে আছে এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।”
রাহেলা খাতুন আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন,”এতদিন তুমি কোথায় ছিলে অভিক? এই বুড়ো মা টার কথা একবারও মনে পড়েনি? তোমার বাবা তো তোমার ফেরার আশায় থাকতে থাকতে চোখ বুঝলেন। আর আমি..আমাকে বোধহয় আল্লাহ এই সুখের দিনটা দেখানোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমার আর আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ নেই, নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।”
অহনা সুনীতিকে বলে,”এটা কি সত্যি সুনীতি? অভিক ভাই আবার ফিরে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, এটাই সত্যি।”

সারজিস অভীক্ষাকে বলে,”ইনি তোমার বাবা? যিনি এত বছর নিখোঁজ ছিলেন?”
অভীক্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়। সাগর এগিয়ে এসে অভিককে স্যালুট জানিয়ে বলে,”আপনি সবসময় আমার আদর্শ ছিলেন, আজো আছেন। আপনাকে এতদিন পর ফিরতে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। আমি ভাবতেও পারিনি আপনি আবার ফিরবেন। এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩০

হঠাৎ এতগুলো অপরিচিত মুখকে একসাথে দেখে অভিকের মাথায় হঠাৎ ব্যাথা অনুভূত হয়। যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সুনীতি চিৎকার করে বলে ওঠে,”অভিক!”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ৩২