মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্র ১১

মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্র ১১
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

এলোমেলো পায়ে রুমে গেলো অয়ন। রুমটা দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো৷ এখনো কত সুন্দর করে সাজানো রুমটা। অয়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বেডের দিকে৷ নিজের নামের পাশে নয়নার নামটা দেখে চোখ ভড়ে উঠলো নোনাজলে। এই একটা ভুলের জন্য আজ তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। অয়ন খুব সাবধানে নয়নার জায়গায় নিঝুমের নাম লিখে দিলো। তারপর বেড থেকে নেমে দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো।

অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট নিঝুম। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভার্সিটি চেঞ্জ করার জন্য বেশ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। সারাবছরও তেমন একটা পড়াশোনা হয়নি। মানসিক যন্ত্রণার সাথে লড়ে, পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। আজই প্রথম ভার্সিটি গিয়েছিলো। মনে হচ্ছে টিউশন ছাড়া খুব বাজে অবস্থা হবে রেজাল্টের।
নিঝুম ডিনারের সময় বললো, বাবা আমার একটা টিউটর প্রয়োজন। রেজাল্টের অবস্থা নাহলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।
নিয়াজ মুচকি হেসে বললো, ঠিক আছে আমি দেখছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাথীর জন্যেও প্রয়োজন। দু’জনকেই যাতে সময় দিতে পারে এমন কাউকেই দেখো।
নিয়াজ সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলে ?
সাথী মাথা নিচু করে বললো, নাইনে উঠার পরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো মা।
আচ্ছা তোমাকেও ভর্তি করে দিবো। ক্লাস করার প্রয়োজন নেই, বাড়িতে পড়েই এসএসসি পরীক্ষা দাও। কলেজে ভর্তি হয়ে গেলে ক্লাস করো।

সাথী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো নিয়াজ চৌধুরীর দিকে। সাথী বাবা মারা গেছে সাথী তখন অনেক ছোট। মা মানুষের বাড়ি কাজ করে তাও এতটুকু পড়াতে পেরেছিলো। বাবার ভালোবাসা পাওয়া হয়নি সাথীর।
নিয়াজ সাথীর মাথায় হাত রেখে বললো, আমার নিঝুম মাকে আমি খুব ভালোবাসি। সে যখন তোমাকে নিজের বোনের জায়গা দিয়েছে, আমরা তাহলে কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবো।

সাথীর কোল থেকে হঠাৎ কেঁদে উঠলো তিথি। নিয়াজ তিথির মাথায় হাত রেখে বললো, নানুভাই তুমি কবে স্কুলে যাবে ?
তিথি কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো নিয়াজের দিকে। তা দেখে সবাই হেসে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নিঝুম। সেটা সবার চোখে না পরলেও সাথীর চোখে ঠিক পড়লো। সাথী এখন নিঝুমের সম্পর্কে সবই জানে৷ নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে সাথী দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। সাথীর কাছে এখন মনে হয়, তার থেকে বেশি অসহায় নিঝুম।

খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেলো। নিঝুম একটা চাদর জড়িয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। কুয়াশা দখল করে নিয়েছে চারপাশটা। বেলকনির বাইরে সাদা কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা বরাবরই ভালো লাগে নিঝুমের। তাই উপভোগ করতে লাগলো সময়টা। স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আবছা কুয়াশায় অয়নের সাথে কাটানো মধুর স্মৃতি। অয়নদের বাড়ির পেছনে একটা জলপাই গাছে আছে। ফজরের নামাজ পড়ে কুয়াশা ঘেরা সকালে জলপাই কুড়াতে খুব ভালো লাগতো নিঝুমের। একদিন মনে হলো অয়নকে নিয়ে যাওয়া যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, কনকনে শীত তখন। ফরজের নামাজ পড়ে ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছিলো অয়ন। নিঝুম নিঃশব্দে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
মিনমিনে গলায় বললো, শুনুন না।
হঠাৎ করে কথা বলায় অয়ন একটু চমকে উঠলো। পা পিছলে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নেয়।
রাগী গলায় বললো, এখনই তো পড়ছিলাম তোমার জন্য।
যাহ্ বাবা আমি আবার কী করলাম ?
এভাবে ভূতের মতো পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছো কেন ?
কোথায় ভূতের মতো দাঁড়ালাম ? আচ্ছা বাদ দিন, একটা কথা বলার ছিলো।
কান খোলা আছে, না চাইলেও শুনতে পাবো।

নিঝুম মুখ ভেংচি কাটলো অয়নের কথা শুনে। কারণ অয়ন সবসময় এভাবে ত্যাড়াভাবে কথা বলে তার সাথে।
ভেংচি কাটা বন্ধ করে যেটা বলতে এসেছিলে সেটা বলো।
নিঝুম চমকে উঠলো অয়নের কথা শুনে। সে বুঝলো কীভাবে, নিঝুম ভেংচি কেটেছে। জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই মনে পড়ে গেলো সামনে কাঁচের দেয়াল।
তাই ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বললো, বাড়ির পেছনের জলপাই গাছে না ? সেটায় অনেক জলপাই হয়েছে।
অয়ন ট্রেডমিল থেকে নেমে ভ্রু কুঁচকে বললো, তো ?

নিঝুম উৎফুল্ল হয়ে বললো, সকালে অনেক জলপাই গাছের তলায় পড়ে থাকে।
অয়ন আগের ভঙ্গিতে বললো, তো ?
নিঝুম চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিলে বললো, লবণ মরিচ দিয়ে জলপাই কামড়ে খেতে যা লাগে না। চলুন না কুড়িয়ে নিয়ে আসি।
অয়ন নাক ছিটকে বললো, তুমি জলপাই কুড়িয়ে খাবে ? দারোয়ানকে বললে এমনই পেরে দিবে আর তাছাড়া বাজারে কত কিনতে পাওয়া যায়।

নিঝুম মুখ ফুলিয়ে বললো, কুড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা।
অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। নিঝুম তা দেখে ভয়ে ঢোক গিললো।
এই নিয়ে কতদিন কুড়িয়ে এনে খেয়েছো ?
নিঝুম আমতা আমতা করে বললো, যেদিন থেকে গাছে জলপাই দেখেছি।
অয়ন বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। নিঝুম ভয় সাইডে রেখে অয়নের হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো, চলুন তো।
অয়ন কিছু বলার সুযোগ পেলো না। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই বাইরের ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগলো। অয়ন শুধু কালো রঙের একটা সেন্টু গেঞ্জি পরে আছে।

নিঝুম হঠাৎ বলে উঠলো, আপনি দাড়ান আপনার জন্য একটা চাদর নিয়ে আসি। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছে।
অয়ন গম্ভীর গলায় বললো, লাগবে না।
নিঝুম মনে মনে বললো, লাগবে না তো ? আজ ঠান্ডায় মজা বুঝবে বাছাধন।
মুখে বললো, চলুন চলুন।

কুয়াশায় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অয়ন টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিঝুমের সাথে যেতে লাগলো। মুলত অয়ন দেখতে চায় নিঝুম কী কী করে বেড়ায়। তাই নিঝুম জোর করায় সে বাঁধা দেয়নি। গাছের নিচে এসে নিঝুম জলপাই খুঁজতে লাগলো। বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষে জলপাই গাছটা। গাছের নিচে সবুজ ঘাঁস। অয়ন গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলো গাছ ভর্তি বড় বড় জলপাই। এই গাছ নিয়ে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। অথচ নিঝুম ঠিক খোঁজে বের করেছে।
নিঝুম চেঁচিয়ে বলে উঠলো, পেয়েছি।

নিঝুমের হাতে একটা জলপাই দেখতে পেলো অয়ন। নিঝুমের কান্ড দেখে আড়ালে হাসলো। নিঝুমের অনেক আচরণই বাচ্চাদের মতো। কথায় আছে এক বাবার এক মেয়ে একটু বেশি আহ্লাদী হয়। নিঝুম তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
অয়ন নিজের হাতে হাত ঘঁষে বললো, ঠান্ডা লাগছে, পেয়েছো তো এবার চলো।
নিঝুম বললো, কেবল তো একটা পেয়েছি। আপনাকে আগেই বলেছিলাম একটা চাদর নিয়ে আসি, শুনলেন না। আপনি চাইলে আমার সাথে চাদর শেয়ার করতে পারেন।
নিঝুমের কথা শুনে অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তা দেখে নিঝুম ঘাসের মাঝে আবার জলপাই খুজতে লাগলো। অয়ন দেখতে লাগলো নিঝুমকে।

বিড়বিড় করে বললো, পাগলী একটা।
ধীরে ধীরে অয়নের শীত বাড়তে লাগলো। একটু পর নিঝুম পাশে এসে বললো, হয়ে গেছে চলুন।
কয়টা পেয়েছো দেখি।
নিঝুম নিজের হাতের মুঠো খোলে দেখালো অয়নকে। আট দশ-টা বড় বড় জলপাই দু’হাতের মুঠোয়। জলপাইয়ের সাথে ঘাসের ময়লা লেগে আছে।

তা দেখে অয়ন নাক কুঁচকে বললো, নোংরা মেয়ে একটা।
নিঝুম নাক ফুলিয়ে বললো, আমি কী না ধুয়ে খেয়ে নিবো নাকি ?
অয়ন এগিয়ে গেলে নিঝুম বললো, একটা জিনিস দেখবেন ?
পেছন ফিরে তাকিয়ে অয়ন বললো, কী দেখবো ?
জুতো খোলেন।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, জুতো খুলতে যাবো কেনো ?
আগে খুলুন তারপর বলছি।
অয়ন জুতো খোলে ঘাঁসে পা রাখতেই গা শিরশির করে উঠলো।
নিঝুম মুচকি হেসে বললো, কেমন লাগলো ?
এর আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি অয়নের। তাই অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করলো মনে।
এবার হাঁটুন, দেখবেন কেমন ভালো লাগে।

অয়ন ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। প্রত্যেকটা কদমে গা শিরশির করে উঠছে। নিঝুম জলপাইগুলো একহাতে নিয়ে অয়নের কাছে গিয়ে নিজের গায়ের চাদর অর্ধেক চাদর অয়নের গায়ে দিলো। অয়ন ফিরে তাকালো তবে কিছু বললো না। মাঝে কিছুটা দুরত্ব রেখে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। অয়নেরও অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করছে মনে। অনেকটা সময় এভাবে হাটলো দু’জনে। হঠাৎ অয়নের হাত টেনে জলপাইগুলো তার হাতে দিকে নিঝুম।

অয়ন কিছু বলার আগেই বললো, আপনি এগুলো নিন আমি জুতো দু’জোড়া নিয়ে আসছি।
অয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই দৌড়ে জুতো আনতে চলে গেলো নিঝুম। অয়ন মাঝে মাঝে অনেক বেশি অবাক হয় নিঝুমের কাজে। দু’জনে ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। অন্যদিনের থেকে আজকের সকালটা সুন্দর লাগছে অয়নের কাছে৷ কারণটা জানা নেই। শুক্রবার তাই অফিস নেই, ব্রেকফাস্ট করে রুমে বসে কাজ করছিলো ল্যাপটপে।
নিঝুম রুমে এসে বললো, খা করুন তো ?

মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্র ১০

অয়ন ভ্রু কুঁচকে কেনো বলার জন্য মুখ খুলতেই নিঝুম একটা জলপাই ঢুকিয়ে দিলো অয়নের মুখে। নিঝুম জানে অয়ন একদমই টক খেতে পারে না। জলপাইয়ে কামড় লাগতেই মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে ফেলে অয়ন। তা দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় নিঝুম।
পুরনো স্মৃতি মনে করে আনমনে হেসে উঠলো নিঝুম আর মুহুর্তেই বাস্তবে ফিরে এলো। হাসি মিলিয়ে চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো নিঝুমের। চোখ বন্ধ করলে আজও সব জীবন্ত মনে হয়। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ঐ তো অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু চোখ খুলতেই চারদিকে কেবলই শূন্যতা। দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো নিঝুম।
ভেজা গলায় বললো, কেনো এমন হলো অয়ন ? আপনি কেনো একটু ভালোবাসতে পারলেন না আমাকে, কেনো,,?

অন্ধকার রুমে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে অয়ন ৷ কানে বারবার অহনার বলা কথা বাজছে। নিঝুম কখনো মা হতে পারবে না। কোথায় তবু তো একটু পরিবর্তন হয়নি মনের। মন বলছে কত মানুষই তো আছে যাদের সন্তান নেই। একে অপরের হাত ধরে সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে পারলেই খুশি অয়ন। না এভাবে বসে থাকলে হবে না৷ নিঝুমকে খুজতে হবে। উঠে দাঁড়ালো অয়ন, গতকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি, উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে গেলো। শারীরিক দূর্বলতা আর মানসিক যন্ত্রণার কাছে হার মেনে সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো সে। মাথায় আঘাত পেলো বেডের কর্ণারে লেগে। একটু একটু করে সাদা ফ্লোর লাল হতে লাগলো তার রক্তে। কেউ না দেখলে বিপদ হতে সময় লাগবে না খুব একটা।

মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্র ১২