মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৯+৬০

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৯+৬০
নাফিসা তাবাসসুম খান

সিন্ড্রেল পাহাড়ের চূড়ায় ঝড়ের কারণে সবকিছু উড়ে যাওয়ার উপক্রম ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু এখন সেই ঝড়ের তীব্রতা অনেকটাক কমে এসেছে। পাহাড়ের চূড়ার মাঝেই সোজা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা। তার সামনে মাটির উপর একটি বিশাল গোল চক্র করা। চক্রের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন মৃত পশুর হাড্ডি। সেই চক্রের মাঝেই শুয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে ক্যামেলিয়া। ক্যামেলিয়ার কান্না মার্থার চেহারায় হাসি এনে দেয়। মার্থা বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে উঠে,

” আলফা আরোণ রদ্রিগেজের মেয়ে লুনা ক্যামেলিয়া রদ্রিগেজ। আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদো। তোমার চিৎকার যেন তোমার পিতাকে টেনে এখানে নিয়ে আসে। ”
এটুকু বলেই মার্থা তার হাতে থাকা একটি কাপড়ের থলি থেকে সাদা কিছু একটার গুড়ো সেই চক্রের চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে কোনো তন্ত্রমন্ত্র। সেই সাদা গুড়ি গুলো গোল করে চক্রের চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্যামেলিয়ার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট করে বলে উঠে,
” আমার ভাইয়ের রক্তের দাম তোমার মাধ্যমে নিবো আমি। আলফা আরোণ সারাজীবন নরক যন্ত্রণা অনুভব করবে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ক্যামেলিয়া গলা ফাটিয়ে কেঁদে চলেছে। মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় হাত পা ছুড়াছুড়ি করে যাচ্ছে সমানে। মায়ের কোলের শূণ্যতা অনুভব করছে সে। মার্থা এখন নিজের চারিদিকেও একইভাবে একটি গোল চক্র একে নেয় সেই সাদা গুড়ি দিয়ে।
হঠাৎই বড়সড় পায়ের ধাপ ফেলে সেখানে উপস্থিত হয় একটি নেকড়ে। হিংস্র রক্তিম চোখের দৃষ্টি তার। সাথে সাথে সে নেকড়ে রূপ ছেড়ে মানব রূপ ধারণ করে। তবে চোখের রক্তিম রঙ বদলায় না তার। মাটির উপর পড়ে থাকা ক্যামেলিয়াকে দেখে তার শরীরে যেন আগুন ধরে যায়। যেই মেয়েকে সে আর ক্যাথরিন সবসময় বুকের সাথে মিশিয়ে আগলে রাখে তাকে কিনা এই নোংরা মাটির উপর ফেলে রেখেছে মার্থা? ক্যামেলিয়ার কান্নার শব্দে আরোণ উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠে,

” ক্যামেলিয়া। জান আমার। বাবা এসেছে। কিছু হবে না। ”
আরোণের উদ্বিগ্নতা দেখে মার্থা হাসে। স্ব শব্দে হেসে সে বলে উঠে,
” স্বাগতম আলফা। আমি জানতাম তুমি আসবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে ঠিক তেমনই তোমার মেয়েকে তুলে আনলে তুমি নিজেই তার পিছু পিছু আমার কাছে এসে পৌঁছাবে। ”
আরোণ মার্থার দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
” তোর এতো বড় কলিজা তুই আমার প্রাসাদে আমার কক্ষ থেকে আমার মেয়েকে তুলে আনিস? ”
” হ্যাঁ। আর তুলে আনার সময় এক মুহুর্তের জন্য ইচ্ছে করছিলো তোর স্ত্রীকেও খুন করে আসি৷ কিন্তু তা করি না। কারণ তোর স্ত্রী সন্তান হারিয়ে তোর সামনে ছটফট করলে সেটা তোকে আরো বেশি পীড়া দিবে। ”

” নিজের ভাইয়ের মতো পরিণতি হবে তোর লিখে রাখ। ”
” মৃত্যুকে ভয় পেলে আমি এই মুহুর্তে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না আরোণ রদ্রিগেজ। মৃত্যু আমার নিশ্চিত তা সম্পর্কে আমি অবগত। কিন্তু মৃত্যুর আগে তোর চোখের সামনে তোরই মূল্যবান কাউকে মেরে তোকে সারাজীবনের জন্য নরকের আগুনে পুড়াতে চাই আমি। এজন্যই তোর মেয়ে আজ ঠিক সেই জায়গায়ই শুয়ে আছে যেখানে তুই আমার ভাইয়ের লাশ পুড়িয়েছিলি। ”

আরোণ হিংস্র রূপে দৌঁড়ে এগিয়ে যায় ক্যামেলিয়াকে নিতে। কিন্তু সেই চক্রের উপর তার পা পড়তেই সে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার মনে হয় কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ছুড়ে দূরে নিয়ে ফেললো যেন। মার্থার মুখে আবার বিশ্রী হাসি ফুটে উঠে। আরোণ উঠে দাঁড়িয়ে হিংস্রতার সহিত মার্থার দিকে তাকায়। মার্থা বলে উঠে,
” এই চক্র পাড়ি দিয়ে তোর মেয়ের কাছে তুই পৌঁছাতে পারবি না। কোনো নেকড়ের সাধ্যি নেই এই চক্র পাড় করে ভেতরে প্রবেশ করার। বিশেষ জাদুবিদ্যা দ্বারা শিখেছি আমি এই চক্র বানানো। কিন্তু নেকড়ে হওয়ার কারণে আমি নিজেও এখন আর এই চক্রের ভেতর প্রবেশ করতে পারবো না। ”
বলেই সাথে সাথে মার্থা একটি রুপোর বুলেট বের করে ক্যামেলিয়ার দিকে তাক করে। আরোণ চিৎকার করে উঠে। মার্থা হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

” যদি নিজের মেয়েকে বাঁচাতে চাস তো আমার সামনে হাঁটু গেড়ে তোর মেয়ের প্রাণের ভিক্ষা চা। ”
আরোণ বলে উঠে,
” খুন করে ফেলবো মার্থা আমার মেয়ের কিছু হলে। ”
” সেটা তো তোর উপর নির্ভর করে। যদি তুই আমার সামনে নত হস এবং নিজের মেয়ের প্রাণের ভিক্ষা চাস তাহলে আমি তোর মেয়েকে ছেড়ে দিবো। ”
” আমি? আমি তোর সামনে নত হবো? কখনোই না। ”
” তোর অহংকার তোর মেয়ের প্রাণ নিবে। ”

এটুকু বলেই মার্থা বন্দুক চালায়। আরোণ ক্যামেলিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে উঠে। তার সম্পূর্ণ শরীর কেঁপে উঠে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করে সে দেখতে পায় বুলেটটা ক্যামেলিয়ার শরীরে নয় বরং তার পাশে মাটিতে লেগেছে। কিন্তু ক্যামেলিয়া হয়তো এই শব্দে প্রচুর ভয় পেয়েছে। তাই তো মেয়েটা গলা ফাটিয়ে কেদে যাচ্ছে। আরোণ আক্রোশে এবার মার্থার দিকে তীব্র গতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু চক্রের উপর পা পড়তেই একইভাবে সে ছিটকে আবার দূরে গিয়ে পড়ে। আরোণ কিছু বলবে তার আগেই মার্থা বলে উঠে,
” পরবর্তী বুলেট কিন্তু তোর মেয়ের বুকে গিয়ে বিঁধবে। ”

আরোণ মেয়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যামেলিয়ার কান্নার আওয়াজ আরোণের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। তার মস্তিষ্কের নেকড়ে স্বত্তা তাকে বলছে মার্থার সামনে না ঝুঁকতে। কিন্তু তার মনের পিতা স্বত্তা তাকে বলে উঠছে যে মেয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য যা প্রয়োজন সব করতে। মন এবং মস্তিষ্কের দ্বন্দের ইতি ঘটিয়ে আরোণের পিতৃ স্বত্তা জিতে যায়। মার্থার সামনে নত হওয়ার জন্য সে এক হাঁটু গেড়ে বসতে নেয়। আরোণকে নত হতে দেখে মার্থার কলিজা যেন ঠান্ডা হয়ে যায়। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।

কিন্তু তখনই হঠাৎ ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়ে তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। আরোণের পা জোড়া থমকে যায়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ডানপাশে তাকায় সে। অন্ধকার ছাপিয়ে স্পষ্ট হয় ধীরে ধীরে আগত ব্যক্তির চেহারা। ভ্যালেন্টাইনের পিঠে চড়ে ক্যাথরিন এগিয়ে আসছে এদিকেই। গায়ে তার এখনো সেই লাল গাউন। এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। আরোণ ক্যাথরিনকে আসতে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। একই সময় বাম পাশ হতে পাতার মড়মড় শব্দ হতেই সেদিকে ফিরে তাকায় আরোণ এবং মার্থা। মুহুর্তেই তারা রিকার্ডোকে দেখতে পায়। রিকার্ডো যেন বাতাসের গতিতে এসেছে এখানে। আরোণ সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ক্যাথরিনের দিকে তাকায়। ততক্ষণে ক্যাথরিন ভ্যালেন্টাইনের পিঠ থেকে নেমে দৌঁড়ে এদিকে আসছিলো। আরোণ ক্যাথরিনকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

” ক্যাথ ফিরে… ”
আরোণের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। একটি বিকট শব্দ হয়। এই বিকট শব্দে যেন প্রকৃতির নিস্তব্ধতা হুট করে কাঁচের মতো ভেঙে যায়। পরক্ষণেই আবার নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ক্যামেলিয়ার কান্না থেমে যায়, রিকার্ডোর পা জোড়া থেমে যায়, আরোণের মুখের বাকি কথাটুকু থেমে যায়। ক্যাথরিন ধীর চোখে মাথা নত করে নিজের বুকের দিকে তাকায়। ঠিক তার বুকের বাম পাশ হতে গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। লাল গাউন লাল রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে মুহুর্তেই। ক্যাথরিনের শ্বাস যেন গলায় এসে আটকে গিয়েছে কিছু একটার সাথে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মুহুর্তেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মার্থা হাতের বন্দুকটি নামিয়ে ফেলে। মুখের হাসি তার প্রশস্ত হয়। ক্যাথরিনের আগমনে এবং নিজের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে বিজয়ের হাসি হাসে সে। এখন সে এগিয়ে গিয়ে ক্যাথরিনের বক্ষস্থল ভেদ করে তার হৃৎপিণ্ড টেনে বের করে আনবে। এই উদ্দেশ্যেই মার্থা বাতাসের গতিতে এগিয়ে যায় ক্যাথরিনের দিকে। রিকার্ডো দৌঁড়ে আসবে তার দিকে কিন্তু তার আগেই মার্থা ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে হাসি টেনে সে বলে উঠে,

” বিদায় বন্ধু। ”
সাথে সাথে ক্যাথরিন তার পায়ের কাছের বাঁধন থেকে সেই খঞ্জরটি নিয়ে মার্থার পেটে তা প্রবেশ করায়। সাথে সাথেই মার্থা চিৎকার করে দূরে ছিটকে পড়ে। ক্যাথরিন শীতল স্বরে বলে উঠে,
” এটা আমার ইতি নয় এটা তোমার ইতি মার্থা। ”
মার্থার দেহ কিছুক্ষণ ঝাঁকি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয় সেখানে।
আরোণ এতক্ষণ ধরে নিস্তব্ধ হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তার মনে হচ্ছে তার প্রবলভাবে বুক কাঁপছে। এইমাত্র চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সব কিছু কেবল তার ভ্রম। কিন্তু ক্যামেলিয়ার কান্নার আওয়াজে আরোণ সম্ভিত ফিরে পায়। অনুভব করে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা ভ্রম নয় বরং সত্যি। ক্যাথরিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্যাথরিনের দৃষ্টি এলোমেলো করে দেয় আরোণকে। আরোণ এলোমেলো পা ফেলে ক্যাথরিনের দিকে এগিয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তার সামনে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না তার। ক্যাথরিন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে আরোণের গালে রাখে। সাথে সাথে ক্যাথরিনের হাতে লেপ্টে থাকা রক্ত আরোণের গালে মেখে যায়। ক্যাথরিন অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

” আরোণ। ”
এটুকু বলতেই ক্যাথরিনের দেহ ঢলে পড়ে আরোণের বুকে। আরোণ দু’হাতে ক্যাথরিনকে বুকে আগলে নেয়। কম্পিত স্বরে বলে উঠে,
” ক্যাথ। না। যেও না। ”
এটুকু উচ্চারণ করতেই আরোণের বুকে ঝড় বয়ে যায়। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে অশ্রু। অস্থির হয়ে পড়ে সে। এলোমেলো নিঃশ্বাস ছেড়ে চলেছে ক্রমে। আরোণের বুকে লেপ্টে থেকেই ক্যাথরিন আরোণকে দেখছে। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতর তার প্রাণপ্রদীপ নিভু নিভু প্রায়। আধো স্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠে,
” ক্যামেলিয়া কাঁদছে। আমার মেয়েকে কাঁদতে দিও না। ”
আরোণের অশ্রুধারার গতি আরো বাড়ে। সে বলে উঠে,
” না। তুমি যেও না তাহলে ক্যামেলিয়াও কাঁদবে না। আমাদের একা ছেড়ে দিও না। ”
ক্যাথরিন বলে,

” তুমি আর কখনো একা থাকবে না। ক্যামেলিয়া আমার ছায়া হয়ে তোমার জীবনে রয়ে যাবে। ”
আরোণ কিছু শুনতে নারাজ। সে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে ক্যাথরিনকে। যেন ছেড়ে দিলেই চলে যাবে। কিন্তু আরোণের আঁকড়ে ধরা অবস্থায়ই ক্যাথরিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ক্যাথরিনের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরোণ তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। দেখে ক্যাথরিনের চোখ জোড়া বন্ধ। আরোণ এলোমেলো স্বরে পরপর কয়েকবার ক্যাথরিনের নাম ধরে ডাকে। কিন্তু কোনো জবাব পায় না সে। আরোণ এবার চিৎকার করতে থাকে। নিজের স্বত্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। ক্যাথরিনকে ছেড়ে সে কিছুটা দূরে সড়ে যায়। নিজের মাথার চুল টেনে ধরে সে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে। পরপর বিলাপ করে কাঁদতে থাকে। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো রিকার্ডো আরোণের কিছু বিলাপ স্পষ্ট শুনতে পায় তো কিছু অস্পষ্ট লাগে তার কাছে। তার চেহারা নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। চোখের সামনে সে দেখছে এক প্রেমিক যুগলের করুণ পরিণতি। স্ত্রীকে হারানো এক স্বামীর বিপর্যস্ত অবস্থা। এক নেকড়ে মানবের অসমাপ্ত ভালোবাসা।

রিকার্ডো পাশ ফিরে একবার মাটির দিকে তাকায়। ক্যামেলিয়া এখনো কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটা কি কোনোভাবে টের পেলো যে সে মা হারিয়েছে? রিকার্ডোকে ভাবায় এই প্রশ্ন। পরপরই সে এগিয়ে যায় ক্যামেলিয়ার দিকে। বিনা বাঁধায় চক্রের ভেতর প্রবেশ করে সে। এই চক্রের যাদু কেবল নেকড়ের জন্য ছিলো। তাই রিকার্ডোর প্রবেশ করতে কোনো সমস্যা হয় নি। এগিয়ে গিয়ে ক্যামেলিয়াকে কোলে তুলে নেয় সে। আবার পাশ ফিরে তাকায় আরোণের দিকে। আরোণের আর্তনাদ, বিলাপ, চিৎকার বাতাসকে গুমোট এবং ভারী করে তুলছে।

আরোণ ক্যাথরিনের নিষ্প্রাণ দেহের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তার চোখ, মুখ, গলা, ঠোঁট সবকিছু গভীর ভাবে দেখছে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতের পাতা। আবার মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার বর্তমান। যেই বর্তমানে ক্যাথরিন আর সেই চোখ মেলে তার দিকে তাকায় না। না সেই ঠোঁটের কোণে আছে কোনো হাসি। যেই বর্তমানে আরোণ একা। ভীষণ একা। ক্যাথরিনের লাশের দিকে তাকিয়ে আরোণ অস্পষ্ট স্বরে শেষ বারের মতো বলে উঠে,

” বিশ্বাসঘাতক। ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমায় একা করে দিয়ে চলে গেলে। ”
আরোণ ঠোঁট কামড়ে ধরে। দুচোখ বেয়ে অঝড় ধারায় অশ্রু বইছে। দু’হাতে মাটি আঁকড়ে ধরে সে। তার মস্তিষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ করে বাজতে থাকে একটিই বাক্য। এই বিশাল পৃথিবীতে তার একান্ত ব্যক্তিগত ক্যাথ তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গিয়েছে।

বাসকোভ প্রাসাদের প্রধান দরজার সামনের হলরুমে সকলেই অপেক্ষা করছে আরোণ, ক্যাথরিন, ক্যামেলিয়া এবং রিকার্ডোর ফিরে আসার। প্রায় ভোরের আলো ফুটতে চললো এখনো কেন ফিরছে না তারা এই প্রশ্ন সকলের মনে খচখচ করছে। আনাস্তাসিয়া হলরুম জুড়ে পায়চারি করছে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করে চলেছে কেবল। হঠাৎ একটি কান্নার আওয়াজে তার পা জোড়া থমকে যায়। পায়চারি থামিয়ে চোখ মেলে সে প্রধান দরজার দিকে তাকায়। রিকার্ডো ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করে। সকলের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। ক্যামেলিয়াকে দেখতেই আনাস্তাসিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। সে দৌঁড়ে এগিয়ে যায় রিকার্ডোর দিকে। রিকার্ডোর কাছ থেকে ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে তার কপালে চুমু খায়। বলে উঠে,

” আমার ক্যামি। ”
বাকিরাও এগিয়ে আসে তার কাছে। ক্যামেলিয়াকে ফিরে পেয়ে সকলেই খুশি। ইতিমধ্যে সকলেই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্রিনা তো ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে বলে উঠে,
” যাক। অবশেষে লুনা তার নিজের প্রাসাদে একদম নিরাপদ ভাবে ফিরে এসেছে। ”
সকলের কথার মাঝে ম্যাথিউর দৃষ্টি রিকার্ডোর দিকে স্থির। রিকার্ডো চুপচাপ ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছেও না। ম্যাথিউ সকলের কথার মাঝেই রিকার্ডোকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে উঠে,
” তোমাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন ভাই? ”

ম্যাথিউর প্রশ্ন শুনে সকলের খেয়াল হয়। রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই তার চেহারা নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। আনাস্তাসিয়া এতক্ষণ ক্যামেলিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করে নি। কিন্তু রিকার্ডোকে এভাবে দেখে সে অস্থির হয়ে পড়ে। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
” তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন রিক? আরোণ ভাই এবং ক্যাথ কোথায়? ”
রিকার্ডো কোনো জবাব দেয় না। আনাস্তাসিয়া আরো অস্থির হয়ে পড়ে এবার। আবার প্রশ্ন করে,
” কি হলো? তুমি কোনো কথা বলছো না কেন? ”

রিকার্ডো এবার চুপচাপ ঘুরে প্রধান দরজার দিকে ফিরে তাকায়। রিকার্ডোর দৃষ্টি অনুসরণ করে সকলে সেদিকে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে দেখতে পায় টলমলে পায়ে আরোণ প্রাসাদে প্রবেশ করছে। এলোমেলো চুলগুলো কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার। অর্ধেক মুখশ্রী জুড়ে তাজা রক্তের ছাপ লেপ্টে আছে। তার পাজাকোলে রয়েছে ক্যাথরিন। যার লাল গাউন রক্তে রক্তিম হয়ে আছে। বামহাত বাহিরের দিকে ঝুলে আছে। সেই হাত বেয়ে টুপটুপ করে পড়ছে রক্ত। সকলে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে এই দৃশ্য দেখে। আনাস্তাসিয়া থমকে আছে। চোখ ফেটে একবিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার। হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠে সে। দৌঁড়ে এগিয়ে যেতে নেয় ক্যাথরিনের দিকে। কিন্তু পারে না। রিকার্ডো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরোণ চুপচাপ টালমাটাল অবস্থায় ক্যাথরিনকে নিয়ে সোজা উপরে চলে যায়। আনাস্তাসিয়া নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু রিকার্ডোর সাথে পেরে উঠে না। তাই রিকার্ডোর বাহুতে আবদ্ধ থাকা অবস্থায়ই সে চিৎকার করে বলে উঠে,

” আমার বোনের কি হয়েছে? কেউ ওর কাছে যাও। ওকে বাঁচাও। ও এরকম রক্তাক্ত অবস্থায় কেন? ”
আনাস্তাসিয়ার চিৎকারে বাকি কেউ আর কোনো সাড়াশব্দ করতে পারে না। কিন্তু সকলের চোখেই পানি স্পষ্ট। আনাস্তাসিয়া হান্নাহর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,
” তুমি দাঁড়িয়ে কি দেখছো? উপরে যাও। আমার বোনকে ঠিক করে যেভাবে পারো। ওকে দেখো নি তুমি? কিসের অপেক্ষা করছো? ”
আনাস্তাসিয়া চেঁচামেচির মধ্যে রিকার্ডো বলে উঠে,
” কোনো লাভ নেই নাসিয়া। ক্যাথরিন আর নেই। ”

রিকার্ডোর কথাটা যেন প্রাসাদের প্রতিটা দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়৷ আনাস্তাসিয়া এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে। রিকার্ডো তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রিকার্ডো কখনো সহজে কাঁদার মানুষ নয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কিন্তু তার হৃদয় পুড়ছে। সম্পূর্ণ ঘটনার সাক্ষী সে। এক জোড়া প্রেমিক যুগলের এরকম নিষ্ঠুর পরিণতি কারোই কাম্য নয়। কিন্তু আনাস্তাসিয়ার কান্না আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে তাকে৷ মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন আনাস্তাসিয়ার কান্নার ধ্বনিতে ছিড়ে যাচ্ছে। রিকার্ডোর ইচ্ছে হয় চেঁচিয়ে বলতে,
” তুমি কেঁদো না নাসিয়া। আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমার সকল কষ্ট তুমি আমাকে দিয়ে দাও আর আমার ভাগের সকল সুখ তোমার হয়ে যাক তবুও কেঁদো না। ”
কিন্তু রিকার্ডো মুখ ফুটে বলতে পারে না এমনটা। চুপচাপ সে আনাস্তাসিয়াকে বুকে আগলে ধরে দাঁড়িয়ে রয়।

ক্যাথরিনকে সহ কক্ষে এসেই দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয় আরোণ। ক্যাথরিনকে বিছানার ডান পাশে সন্তর্পণে শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্যাথরিনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই আরোণ উদ্ভ্রান্তের মতো বলে উঠে,
” ক্যাথ? উঠো। দেখো আমরা আমাদের কক্ষে আছি। সব আগের মতো হয়ে গিয়েছে। তাকাও। ”
ক্যাথরিন তাকায় না। আরোণ নিজেই আবার বলে উঠে,
” ক্যাথ তাকাও দয়া করে। আমি নিতে পারছি না। যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে সারা শরীরে। মনে হচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ড কেউ বক্ষস্থল থেকে টেনে ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তুমি তাকাও একবার আমার দিকে। তোমার হাত আমার বুকের বা পাশে রাখো। এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার সব যন্ত্রণা চলে যাবে। আমার সকল ক্ষতের মলম তো তুমি। ”
কথাটুকু বলতে বলতে আরোণ ক্যাথরিনের একহাত নিয়ে নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরে। আরোণের শান্ত চোখ জোড়া বিচলিত হয়৷ সে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে৷ উদ্বিগ্ন গলায় সে বলে উঠে,

” যন্ত্রণা কমছে না কেন? ”
তখনই দরজার বাহির থেকে ক্যামেলিয়ার কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আনাস্তাসিয়া কড়া নাড়ছে আর অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠে,
” ভাই দরজা খুলুন। ক্যামি কাঁদছে ভাই। ওকে থামানো যাচ্ছে না। ”
আরোণের কানে সেই শব্দ আসে না। পৃথিবীর কোনো শব্দই এখন তার কর্ণগোচর হচ্ছে না। আরোণের বুকের সকল যন্ত্রণা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসে। মায়া মায়া চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। নিঃশ্বাস আটকে আছে তার। অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠে,
” ভালোবাসিতো ক্যাথ। কেন শাস্তি দিচ্ছো? ”
কথাটুকু বলতে বলতে আরোণ ক্যাথরিনের হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়।
আনাস্তাসিয়ার দরজা ধাক্কানোর শব্দে ততক্ষণে বাহিরে সকলের ভীড় জমে গিয়েছে। আনাস্তাসিয়া ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে দরজার সামনে থেকে সড়িয়ে দিয়ে ক্রিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

” আরোণ নিজ থেকে দরজা খুলবে না। দরজা ভাঙতে হবে। ”
ক্রিয়াস সম্মতি জানায়। সকলকেই পিছু সরে যেতে বলে সে। সকলে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াতেই রিকার্ডো লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। রিকার্ডোর পিছু পিছু আনাস্তাসিয়া, ক্রিয়াস, ম্যাথিউ এবং ক্রিনাও কক্ষে প্রবেশ করে। কক্ষে প্রবেশ করতেই তারা দেখতে পায় বিছানায় ক্যাথরিনের পাশে শুয়ে আরোণ ডুকরে কাঁদছে এবং বিড়বিড়িয়ে কিছু বলছে। এই দৃশ্য দেখে ক্রিয়াসের খারাপ লাগে অসম্ভব। সে কখনো ভাবে নি নিজের আলফাকে এই অবস্থায়ও দেখতে হবে তার কখনো। রিকার্ডোর ডাকে ক্রিয়াসের স্তম্ভিত ফিরে। রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমি আরোণকে সামলাচ্ছি তুমি ক্যাথরিনকে নিয়ে যাও। ”

ক্রিয়াস কোনো মতে কেবল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
এতক্ষণ ধরে কক্ষে এতো মানুষের সমাগম এবং তাদের কথা কোনো কিছুই আরোণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিলো না। সে সম্পূর্ণ নিজের নিঃস্ব জগতে বিভোর। কিন্তু নিজের জগৎ থেকে বেরিয়ে বাস্তবায় ফিরে সে যখন দেখে ক্রিয়াস তার সামনে থেকে ক্যাথরিনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে৷ আরোণ বলে উঠে,
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওকে? ”

এটুকু বলে আরোণ উঠে বসে সামনে এগোতে নেয় কিন্তু পারে না। রিকার্ডো তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ক্যাথরিনের একহাত এখনো আরোণের হাতে আবদ্ধ। আরোণ সেই হাত ধরে রেখেই চিৎকার করে বলে উঠে,
” আমার ক্যাথকে নিও না কেউ দয়া করে। ওকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও। ওকে আমার থেকে দূরে নিও না তোমরা। ”

আরোণের কথায় কোনো কাজ হয় না। ধীরে ধীরে তার হাতের বাধন থেকে ক্যাথরিনের হাত ছুটে যায়। আরোণ প্রাণপণ চেষ্টা করে ক্যাথরিনের হাত ছোঁয়ার। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ক্রিয়াস ততক্ষণে ক্যাথরিনকে নিয়ে কক্ষের দরজার কাছাকাছি চলে গিয়েছে। আরোণের পৃথিবী যেন কেঁপে উঠে। আর্তনাদ করে উঠে আরোণ।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৭+৫৮

” তোমাদের পায়ে পড়ছি। নেওয়ার হলে আমাকেও নাও সাথে। ক্যাথের সাথে আমাকেও দাফন করে দাও। আমি একা কি নিয়ে বাঁচবো? ”
আরোণের চিৎকারে বাসকোভ প্রাসাদের প্রতিটা কোণায় যেন ঝংকার তুলে। আধারে আচ্ছন্ন এক জঙ্গলের গহীনে একদিন যে প্রণয়ের সূচনা ঘটেছিলো আজ একইভাবে এই জঙ্গলের গহীনে সেই প্রণয়ের ইতি ঘটে।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬১+৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here