মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬১+৬২

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬১+৬২
নাফিসা তাবাসসুম খান

” আর কান্না করে না জান। নিয়ে যাচ্ছি তো তোমাকে মার কাছে। ”
কথাটা বলতে বলতে আরোণ একটি লম্বা ক্লক গায়ে জড়িয়ে নেয়৷ পরপর দোলনা হতে ক্যামেলিয়াকে কোলে তুলে নেয়। গত ছয় মাসে ক্যামেলিয়া বেশ অনেকটাই বড় হয়েছে। একা একা বসে থাকতে পারে সে এখন। মুখ ফুটে টুকটাক দু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে। আজ সকাল থেকেই অস্পষ্ট স্বরে মা বলে কাঁদছে কেবল। আরোণ প্রাসাদে ফিরতেই ক্রিনা তাকে এটা জানাতেই সে আর অপেক্ষা না করে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তার মার কাছে।

গ্রীষ্ম কাল চলেছে। আরোণের আখ্যায়িত বরফকুচির খামে এখন কোনো বরফের ছিটেফোঁটাও নেই। না আছে কোনো শীতকালীন ফুল। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে একটি পাথরের ফলকের সামনে এসে দাঁড়ায় আরোণ। পাথরের উপর মোটা মোটা অক্ষরে লেখা ‘ ক্যাথরিন রদ্রিগেজ ‘। আরোণ ক্যামেলিয়াকে নিয়ে বসে পড়ে সেই ফলকের পাশে। আলতো হাত বাড়িয়ে ফলকটা একবার ছুঁয়ে দেখে। সাথে সাথে চোখ বুজে ফেলে সে। অনুভব করে ক্যাথরিনকে ছুঁয়ে দেখছে সে। চোখ মেলে আবার তাকায় আরোণ। কোলের ক্যামেলিয়ার দিকে তাকায় সে। ক্যামেলিয়াও সামনের দিকে ঝুঁকে সেই ফলকটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ছুঁতে না পেরে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। আরোণ মলিন হেসে ক্যামেলিয়াকে আরেকটু সামনের দিকে নিয়ে ধরে। এবার ক্যামেলিয়া ফলকটা ছুঁতে পারে। সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরোণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সেই হাসির দিকে। ক্যামেলিয়া হাসলে তারও ক্যাথরিনের মতো এক গালে টোল পড়ে। আরোণ আবার সামনে সেই ফলকের দিকে তাকায়। স্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
” ক্যামেলিয়ার জন্যই বেঁচে আছি কেবল। নাহয় জীবন মরণ দুটোই আমার কাছে এক। তুমি শুধু বিশ্বাসঘাতক নও, নিষ্ঠুরও। আমাকে মারার জন্য তৈরি হওয়া খঞ্জরটার ব্যবহার কেবল একবারই করা যায় তুমি জানতে। তবুও ওই খঞ্জরটাই সেদিন কেন ব্যবহার করলে? ওই রাতে তাহলে আমিও নিজের প্রাণ নিয়ে নিতে পারতাম। আজ তাহলে আমার স্থান তোমার পাশে হতো। ”
এটুকু বলে আরোণ থামে। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে তার। চেহারায় আর আগের মতো লাবণ্য নেই তার। না চোখে আছে তেমন কোনো অনুভূতির ছোঁয়া। অবহেলায় বেড়ে উঠা ঘন দাঁড়ি এবং চুলের কারণে চেনা মুশকিল তাকে। হঠাৎ গালে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই আরোণ মাথা নামিয়ে নিচে তাকায়। ক্যামেলিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট হাতে আরোণের গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে দিচ্ছে। আরোণ তাকাতেই ক্যামেলিয়া আদুরে স্বরে বলে উঠে,

” বাব্বাহ। ”
আরোণ হেসে বলে,
” হ্যাঁ জান। ”
আরোণ জান বলে ডাকতেই ক্যামেলিয়ার যেন কি হলো। মাথা এলিয়ে দিলো আরোণের বুকে। আরোণ ক্যামেলিয়ার মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বলে উঠে,
” ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তোমার মা আমাদের কোনো কথার জবাব দিবে না। নিষ্ঠুর সে। ”
এটুকু বলেই আরোণ ক্যামেলিয়াকে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। একবার ক্যাথরিনের কবরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে সে। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে।

লঙ্গরখানায় উপচে পড়া ভীড়। সকলে লম্বা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে অন্ন এবং বস্ত্র পাওয়ার আশায়। ভীড় জমার আরেকটি কারণও আছে। তা হলো কাউন্টেসের দেখা পাওয়া। সাম্রাজ্যের এতো বছরের ইতিহাসে কখনো কোনো কাউন্টেস প্রাসাদের গন্ডি পেরিয়ে এভাবে জনসাধারণের সাহায্য করার জন্য কখনো এগিয়ে আসে নি। কিন্তু কাউন্টেস আনাস্তাসিয়া ব্যতিক্রম ধর্মের মানুষ। কোনো নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার নারী সে নয়। এখনো যেমন লঙ্গরখানায় নিজ হাতে সে সকলকে খাবার বিতরণ করে চলেছে এটা যারা নিজ চোখে না দেখবে তাদের সকলের কাছেই অকল্পনীয় মনে হবে।

একটি বাটিতে স্যুপ এবং সাথে আরো কিছু খাবার বেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে এগিয়ে দেয় আনাস্তাসিয়া। মহিলাটি খাবারের বাটি হাতে নিয়ে চলে যেতেই পরবর্তী আরেকজন মহিলা এগিয়ে এসে দাঁড়ায় আনাস্তাসিয়ার সামনে। তার কোলে রয়েছে একটি ছেলে শিশু। বাচ্চাটিকে দেখতেই আনাস্তাসিয়ার মুখে হাসি ফুটে। সে হেসে মহিলাকে প্রশ্ন করে,
” ওর নাম কি? ”
মহিলাটি মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
” মাইকেল। ”
মহিলার কণ্ঠস্বর গুমোট মনে হওয়ায় আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে তোমার? ”
মুহুর্তেই সেই মহিলাটি কেঁদে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দুজন সেনা। তারা আনাস্তাসিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মহিলাটিকে পিছনের দিকে ধাক্কা দেয়। মহিলাটি মেঝেতে পড়ে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে,

” দয়া করে আমার ছেলেকে বাঁচান কাউন্টেস। আমার সাহায্য করুন। ”
আনাস্তাসিয়া সেনাদের দিকে তাকিয়ে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,
” সামনে থেকে সড়ে দাঁড়াও। ”
একজন সেনা কাচুমাচু করে বলে উঠে,
” কিন্তু কাউন্টেস? ”
আনাস্তাসিয়া আদেশের সুরে বলে উঠে,
” আমি আদেশ দিচ্ছি। ”
সৈন্য দুজন আর কিছু বলার সাহস পায় না৷ তারা আনাস্তাসিয়ার সামনে থেকে সড়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে সেই মহিলাটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে তোমার? আমায় খুলে বলো। ”
মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়,

” আমার ছেলে খুব অসুস্থ কাউন্টেস। আমার স্বামীও দু’বছর আগে মারা গিয়েছে। এই অসুস্থ বাচ্চার চিকিৎসা করার মতো অর্থ আমার কাছে নেই। আমি একা সারাদিন বাচ্চা সামলিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কিছু করার সুযোগ পাই না। এতদিন আমি আমার গয়না এবং বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে যা মুদ্রা পেয়েছিলাম তা দিয়ে ঘর চালিয়েছি। কিন্তু এখন তাও শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার ছেলে তো চিকিৎসার অভাবে মরে যাবে। ”
সবটা শুনে আনাস্তাসিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” তোমার ছেলের চিকিৎসার খরচ রাজকোষ বহন করবে। কিন্তু এভাবে কোনো কাজ না করে বসে থাকাও সমীচীন নয়। তুমি বাগানের কাজ জানো? ”

মহিলাটি সাথে সাথে সম্মতি জানায় মাথা নাড়িয়ে। আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” বেশ। তবে তুমি রাজপ্রাসাদের বাগানে কাজ করতে পারো চাইলে জীবিকা নির্বাহের জন্য। মনে রাখবে সাবলম্বী হওয়া খুব প্রয়োজন। জীবনে চলার পথে সাবলম্বী না হলে প্রতি কদমে তোমার হোঁচট খেতে হবে। ”
মহিলাটি উঠে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
” অসম্ভব ধন্যবাদ কাউন্টেস। ঈশ্বর আপনার কোল জুড়েও একটি ফুটফুটে সন্তান দান করুক। ”
মহিলাটির কথা শুনতেই আনাস্তাসিয়ার চেহারা মলিন হয়ে যায়। দূর হতে রিকার্ডো দাঁড়িয়ে এতক্ষণের দৃশ্য দেখছিলো। মহিলাটির কথায় আনাস্তাসিয়ার মলিন মুখ তার দৃষ্টিগোচর হয় না। রিকার্ডোর বুকে গিয়ে বিঁধে সেই মলিন চেহারা। রিকার্ডো মুখ ঢেকে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কেউ তাকে তেমনভাবে লক্ষ্য করে নি এখনো। তার সাথে প্রধান সেনাপতি স্টেফেনও রয়েছে। স্টেফেনও একটা কাপড় দ্বারা নিজের অর্ধেক মুখশ্রী ঢেকে রেখেছে। আনাস্তাসিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যকে ধীর স্বরে বলে উঠে,

” মহিলাটির পরিচয় এবং সকল খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবে আজকের মধ্যে। যদি তার কাজ সত্যি হয় তাহলে কালকে প্রাসাদে আসলেই তার কাজের ব্যবস্থা করে দিবে৷ এবং যতক্ষণ সে প্রাসাদে কাজ করবে তার বাচ্চার দেখাশোনার ব্যবস্থাও করে দিবে। ”

সৈন্যটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মনে মনে বেশ অভিভূতও হয় সে কাউন্টেস দ্বারা। তাদের কাউন্টেস কেবল আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়েও সবটা সামলায়৷ অন্য কেউ হলে হয়তো আবেগের বসে মহিলাকে কেবল সাহায্য করে বসতো৷ কিন্তু আনাস্তাসিয়া মহিলাটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই মহিলাটির সাহায্য করবে এই জিনিসটা তার বেশ ভালো লাগে। একজন আদর্শ কাউন্টেসের তো এমনই হওয়া উচিত। আনাস্তাসিয়া আবার কাজে মন দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে নিলেই পিছন থেকে একটা ভারী পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠে,
” যেই সাম্রাজ্যের কাউন্টেস নিজের এবং প্রজার মাঝখানের সীমা ভুলে রাজ প্রাসাদ ছেড়ে সাধারণ লঙ্ঘরখানায় নেমে আসে, তার সাম্রাজ্য কয়দিন টিকে সেটাই দেখার বিষয়। ”
কথাটি যে আনাস্তাসিয়াকে কটাক্ষ করে বলে হয় তা স্পষ্ট। রিকার্ডো এবং স্টেফেনের কানেও পৌঁছায় এই কথা। স্টেফেন রেগেমেগে সেই প্রজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু রিকার্ডো হাত দিয়ে তাকে বাঁধা দেয়। স্টেফেন রাগান্বিত স্বরে বলে,

” কিন্তু সে কাউন্টেসকে কটাক্ষ করে কথা বলেছে কাউন্ট। আমাকে আদেশ দিন এক্ষুনি গিয়ে এই বেয়াদবের গর্দান নিয়ে নিচ্ছি। ”
রিকার্ডো চোখের ইশারায় স্টেফেনকে চুপ থাকার আদেশ দেয়। স্টেফেন বুঝতে পারে না যে কাউন্ট কেন তাকে বাঁধা দিচ্ছে। তাই রাগ দমিয়ে রেখে সে সামনে তাকিয়ে থাকে কাউন্টেসের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
আনাস্তাসিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। এখানে অনেকজন পুরুষই দাঁড়িয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

” এইমাত্র কে কথা বলেছে? ”
বাকি প্রজারা মাথা নত করে ভয়ে ভয়ে একজন ব্যক্তির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। আনাস্তাসিয়া দেখে একটি চল্লিশার্ধো পুরুষ মুখে কিছু একটা চিবুচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে। তার দৃষ্টি মোটেও সুবিধার নয়। আনাস্তাসিয়া ওই লোকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” কি বলেছো এইমাত্র? আরেকবার বলো। ”
লোকটা একই সুরে আবার বলে উঠে,
” যেই কাউন্টেস কিনা শত বছরের নিয়ম ভেঙে রাজ প্রাসাদের বাহিরে বেরিয়ে প্রজাদের উপকার করার নাটক করে তার সাম্রাজ্য দু’দিনও টিকবে না। ”

লোকটার কথা শেষ হতে দেরি কিন্তু আনাস্তাসিয়ার ক্লকের ভেতর থেকে তলোয়ার বের করে লোকটার গলায় ধরতে দেরি হয় না। আনাস্তাসিয়া অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে মুহুর্তেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠে,
” আমার এখন তোর থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে কোন নিয়ম আমার মেনে চলা উচিত এবং কোনটা অনুচিত? ”
আনাস্তাসিয়ার আচমকা এমন রূপ দেখে লোকটা ঘাবড়ে যায়। সে আশা করে নি কাউন্টেস হয়ে আনাস্তাসিয়া তলোয়ার চালানোও জানবে বা এরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আনাস্তাসিয়া লোকটার মুখ থেকে মদের উটকো গন্ধ পায়। মুহুর্তেই তার পেট গুলিয়ে আসার উপক্রম। রাগে লোকটার বুক বরাবর লাথি মেরে তাকে ফেলে উচ্চস্বরে একজন সৈন্যকে ডাকে। সৈন্যটি তার পাশে এসে দাঁড়াতেই আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,

” রোমানিয়ান সাম্রাজ্যের কাউন্টেসকে অসম্মান করার শাস্তি কি সেনাপতি? ”
সৈন্যটা গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
” মৃত্যুদণ্ড। ”
আনাস্তাসিয়া কঠিন স্বরে বলে উঠে,
” তবে এই শাস্তি কার্যকর করা হোক। কাল সকালে বাজারে প্রবেশের প্রধান ফটকের উপর যেন এই অসভ্যের গর্দান ঝুলে। সবাই যেন দেখতে পায় যে কাউন্টেস আনাস্তাসিয়াকে অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ”
” যথা আজ্ঞা কাউন্টেস। ”

সাথে সাথে সেই লোকটা চিৎকার করে নিজের জীবন ভিক্ষা চাওয়া শুরু করে। আনাস্তাসিয়া সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে ফিরে যায় আবার৷ দুজন সৈন্য এসে সেই লোকটিকে ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায়। রিকার্ডোও হেসে সেই লঙ্গরখানা থেকে প্রস্থান করে। তার পিছন পিছন আসা স্টেফেন এখনো হতভম্ব হয়ে আছে। রিকার্ডো একবার পিছনে তাকিয়ে স্টেফেনের এমন প্রতিক্রিয়া পরখ করে নেয়৷ তারপর মৃদু হেসে স্টেফেনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” এটাই আমার নাসিয়া৷ কখনো রণচণ্ডী তো কখনো হৃদয়হরণকারী। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো সামনে এগিয়ে যায় নিজের ঘোড়ার দিকে। ঘোড়ায় উঠে বসতেই মনে মনে হেসে বলে উঠে সে,
” জংলী বিড়াল। ”

আকাশে মেঘ করেছে খানিকটা। বৃষ্টি নামার আশংকা প্রবল। মুক্ত বাতাসে সোনালী এলোমেলো কেশ দুল খাচ্ছে। কিছু চুল উড়ে চেহারার উপর এসে পড়ছে। তবুও আনাস্তাসিয়ার মনোযোগে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না এতে৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে সামনে নিশানার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে থাকা ধনুকে তীর বসিয়ে লক্ষ্য স্থির করে সে। বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু উৎসুক দাসীরা তাকিয়ে আছে তার দিকে। আনাস্তাসিয়া তীর ছুড়তেই তা তীব্র বাতাসের প্রভাবে লক্ষ্যচুত হয়। সাথে সাথে সকল দাসীরা হতাশ মুখ করে ফেলে। আনাস্তাসিয়া বেশ বিরক্ত হয়। সে তীব্র বাতাসে সঠিক নিশানা বরাবর তীর ছোঁড়ার চেষ্টা করছে এতক্ষণ ধরে। কিন্তু একবারো সফল হচ্ছে না।
আবার আরেকটা তীর নিয়ে আনাস্তাসিয়া লক্ষ্য ঠিক করে। তীর ছুঁড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কোমরে কারো স্পর্শ অনুভব করে। আচমকা স্পর্শে আনাস্তাসিয়ার হাত থেকে তীর পড়ে যায়। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

” তুমি মনোযোগ হারাচ্ছো নাসিয়া। ”
রিকার্ডোকে দেখে ততক্ষণে সকল দাসীরা সেখান থেকে কেটে পড়েছে। আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” মনযোগ হারানোর কারণ তুমি। ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমি আবার কি করলাম? ”
” ভূতের মতো হুটহাট কানের কাছে এসে ফিসফিস করার স্বভাব গেলো না তোমার? ”
” আমি তো কেবল তোমার সাহায্য করতে এলাম। ”
এটুকু বলে রিকার্ডো আরেকটা তীর হাতে তুলে নেয়। আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কি সাহায্য করতে চাও? ”

রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে ধনুকে তীর রাখে। তারপর বলে উঠে,
” তীব্র বাতাসে তীর ছুঁড়তে হলে বাতাসের গতিবেগ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা উচিত। কারণ বাতাসের গতিবেগের সাথে লক্ষ্যকে খাপ খাওয়াতে পারলেই তীর নিশানায় লাগবে। ”
কথা বলতে বলতে রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দু’হাতের ভঙ্গি ঠিক করে দেয়। তারপর বলে উঠে,
” এখন যে হাতে ধনুক ধরে আছো তা তিন আঙুল সমান নিচে নামিয়ে মজবুত করে ধরো এবং তোমার তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুলের মাঝে তীর ধরে তা কিছুটা পিছনে টেনে ধরো। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর কথা মতো লক্ষ্য ঠিক করে। দৃষ্টি নিশানার দিকে স্থির। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে একবার পরখ করে নিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

” ছুঁড়ো। ”
রিকার্ডো বলার সাথে সাথেই আনাস্তাসিয়া তীর ছেড়ে দেয়। এবার তীর একদম নিশানার কেন্দ্র বিন্দু ভেদ করে যায়। আনাস্তাসিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠে। রিকার্ডো ভাব নিয়ে বলে উঠে,
” থাক। আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। ”
রিকার্ডোর কথা শেষ হতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে ধরণীর বুকে। আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসে। রিকার্ডো সেই হাসি দেখে ঘাবড়ে যায়। আঁতকে বলে উঠে,
” তুমি যা ভাবছো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো নাসিয়া। ”
আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে না জানায়। তারপর দুষ্টুমির সুরে বলে উঠে,
” ভয় পেয়ে যাচ্ছো? ”
রিকার্ডো আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠে,
” আমি তোমাকে ভয় পাবো? হেহ। গতবার আমি প্রায় জিতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ মুহুর্তে তোমার জন্য মায়া হয় তাই তোমাকে জিততে দেই। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” আজ পারলে হারিয়ে দেখাও। ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” গন্তব্য? ”
” পাইন গাছ পর্যন্ত। ”

রিকার্ডো সাথে সাথে স্ব শব্দে প্রহরীকে ডেকে আদেশ দেয় দুটো ঘোড়া নিয়ে আসতে। প্রহরী ঘোড়া নিয়ে আসতেই রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া চড়ে বসে তাদের পিঠে। প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে বের হতেই পড়ে বিশাল জঙ্গল। সেই জঙ্গলের গভীরে আনাস্তাসিয়া এবং রিকার্ডো ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলে। যে সবার আগে পৌঁছাতে পারবে পাইন গাছ পর্যন্ত সে জিতবে। আর যে জিতবে সে চাইলে হার প্রার্থীর কাছ থেকে যা ইচ্ছে তা চাইতে পারবে। রিকার্ডো গত দু’বার নিজ থেকেই আনাস্তাসিয়াকে জিততে দিয়েছে। আজকেও একই কাজ করবে সে। আনাস্তাসিয়ার মুখের বিজয়ের হাসি তার খুব প্রিয়। আর বিজয় শেষে তার অদ্ভুত অদ্ভুত আবদার পূরণ করতেও তার বেশি ভালো লাগে।
বাতাসের তোড়ে জঙ্গলের গাছগুলো দুলছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টির পানিতে রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া ভিজে জবজবে অবস্থা। তবুও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা ঘোড়ার পিঠে করে ছুটছে। পাইন গাছের কাছাকাছি যেতেই আনাস্তাসিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে রিকার্ডোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

” এবারো আমি জিতে গেলাম রিকার্ডো আলবার্ট। ”
আনাস্তাসিয়ার কথা শেষ হতেই সে পাইন গাছ পাড় করে ফেলে। সাথে সাথে সে ঘোড়ার লাগাম টেনে নিচে নামে। রিকার্ডোও তার পিছু পিছু এসে ঘোড়া থামিয়ে নিচে নেমে আসে। আনাস্তাসিয়া ততক্ষণে বৃষ্টি উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রিকার্ডো একটি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আনাস্তাসিয়াকে দেখছে। তার মুখেও হাসি লেপ্টে আছে। ক্যাথরিন চলে যাওয়ার পর আনাস্তাসিয়ার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেশ অনেকদিন সময় লেগেছে। রিকার্ডো চেষ্টা করতো সর্বক্ষণ আনাস্তাসিয়ার পাশে থাকার। যখনই ফুরসত পেত হয় আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে যায় বা বাসকোভ প্রাসাদে নিয়ে ক্যামেলিয়ার সাথে দেখা করিয়ে আনে। ক্যামেলিয়ার সাথে থাকলে আনাস্তাসিয়াও সব ভুলে বসে৷ ক্যামেলিয়াও আনাস্তাসিয়াকে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু রিকার্ডোর কোলে আসলেই এই মেয়ে রিকার্ডোকে খামচি দেয় শুধু। রিকার্ডো বুঝে পায় না আনাস্তাসিয়া ক্যামেলিয়ার কাছে কি তার নামে নালিশ করে নাকি? নাহয় কেন ক্যামেলিয়া তার কোলে আসলেই তার হাত খামচে ধরবে?

আনাস্তাসিয়ার ডাকে রিকার্ডো ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। তাকিয়ে দেখে আনাস্তাসিয়া তাকে ডাকছে। রিকার্ডো চোখের ইশারায় আনাস্তাসিয়াকে প্রশ্ন করে কি বলতে চায়। আনাস্তাসিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” তোমার হেরে যাওয়ার শোক শেষ হলে এদিকে আসবে একটু? একা একা বৃষ্টিবিলাস করতে হচ্ছে আমায়। ”
রিকার্ডো হেসে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। আনাস্তাসিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই রিকার্ডো তাকে পাজাকোলে তুলে নেয়। ভার সামলাতে আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর ঘাড় দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। রিকার্ডোর আচমকা এই কান্ডে আনাস্তাসিয়া খিলখিল করে হেসে উঠে। রিকার্ডো ভ্রু কুচকায়। এই মেয়ের মতলব কি? দিন দুপুরে এভাবে হেসে রিকার্ডোর উপর যাদুমন্ত্র করার মানে কি? মাতাল করতে চায় নাকি? রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে কোলে রেখেই প্রশ্ন করে উঠে,

” জিতে তো গিয়েছো। এখন বলো কি চাও? ”
আনাস্তাসিয়া রহস্যময়ী কণ্ঠে বলে উঠে,
” সুসময়ে চেয়ে নিবো। ”
কথাটা বলার সময় আনাস্তাসিয়ার চোখে দুষ্টুমি পরিলক্ষিত হয়। রিকার্ডো নতুন করে আরেকবার প্রকৃতি প্রেমী আনাস্তাসিয়ার প্রেমে নিজেকে হারায়। আনাস্তাসিয়ার উচ্ছ্বসিত রূপ দেখার জন্য সে তাকে নিয়ে ঘুরতে শুরু করে। সবুজ ঘাসের ভূমির বুকে বৃষ্টির বিন্দুর সাথে লিখিত হয় এক ভালোবাসার মুহূর্ত।

রাত বিরাতে ক্যামেলিয়ার কান্নার আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে যায় ক্যাথরিনের। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে বিছানার সামনে আরোণ ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। হয়তো কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। ক্যাথরিন উঠে বসতে বসতে বলে,
” আমাকে ডাকো নি কেন? ”
ক্যাথরিন বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে ক্যাথরিন উঠে গিয়েছে। সে বলে উঠে,
” তুমি ঘুমিয়েছিলে তাই শুধু শুধু ডাকি নি। ”
আরোণ কথা বলতে বলতে ক্যাথরিন ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আরোণের কোল থেকে ক্যামেলিয়াকে নিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেলিয়া শান্ত হয়ে যায়। এখন আর সে কান্না করছে না বরং খেলছে৷ আরোণ কোথায় যেন গিয়েছে। তাই ক্যাথরিন বসে ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে খেলছে। একটু পরই আরোণ কক্ষে প্রবেশ করে। হাতে তার একটা ট্রে। ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,

” কোথায় গিয়েছিলে? ”
আরোণ ক্যাথরিনের পাশে বিছানায় বসে বলে,
” তোমার জন্য তোমার প্রিয় পাপানাসি। ”
ক্যাথরিন তাকিয়ে দেখে ট্রে তে একটি পেস্ট্রি এবং তার উপর চেরির জ্যাম ছড়িয়ে দেওয়া। এই খাবারটার নাম পাপানাসি। আরোণ নিজেই আবার বলে উঠে,
” মনে আছে? ক্যামেলিয়া যখন পেটে ছিলো তখন তুমি প্রতি রাতে এটা খেতে চাইতে আর বলতে আমার বাচ্চা তোমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছে না? ”
ক্যাথরিনের হাসি পায়। সে হেসে বলে উঠে,
” আজকেও ক্যামেলিয়া আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে তাই তুমি এটা নিয়ে আসলে? ”
আরোণ হালকা হেসে মাথা চুলকে বলে,

” হ্যাঁ। ”
ক্যাথরিন বলে উঠে,
” কিন্তু ক্যামেলিয়া আমার কোলে। কিভাবে খাবো এখন? ”
আরোণ কোনো কথা না বলে নিজেই এবার চামচ দিয়ে তুলে ক্যাথরিনকে খাইয়ে দিতে থাকে। মিষ্টি খাবার ক্যাথরিনের বরাবরই বেশ পছন্দের। আজকেও পাপানাসি মুখে দিয়ে সে তৃপ্তিতে চোখ বুজে ফেলে। আরোণকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” ওসব পশু পাখি ছেড়ে যদি এটা খেতে তবে তুমিও বলতে তুমি মিষ্টি খেতে ভালোবাসো। ”
আরোণ ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” কে বলেছে ভালোবাসি না? আমি মিষ্টি খেতে সবথেকে ভালোবাসি। ”
আরোণের কথা শুনে ক্যাথরিন চোখ মেলে চমকে তাকায়। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
” তুমি আবার কবে থেকে মিষ্টি খাও? ”

আরোণ এবার ক্যাথরিনের দিকে এগিয়ে আসে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার অধরে গভীর স্পর্শ করে নিজের অধর মিলিয়ে দেয়। ক্যাথরিন হতবাক হয়ে রয়। কোনো মতে কিছুটা সরে এসে সে বলে উঠে,
” ক্যামেলিয়া দেখছে। ”
আরোণ এবার আরো সামান্য এগিয়ে বলে উঠে,
” ক্যামেলিয়া ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে আপাতত। ”
ক্যাথরিন তাকিয়ে দেখে আসলেই ক্যামেলিয়া তার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার আর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরোণ আবার তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আরোণ ক্যাথরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে,

” এই অধরের বিষও আমি অমৃত ভেবে পান করতে দ্বিধাবোধ করবো না। ”
তখনই একজোড়া ঠান্ডা বাতাস এসে আরোণকে ছুঁয়ে যায়। আরোণ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে শীতল দখিনা বাতাস বইছে। মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখে ক্যামেলিয়া তার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে। এতক্ষণ সে তারমানে স্বপ্ন দেখছিলো। ক্যামেলিয়াকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সে তাকে কোলে নিয়ে আরামকেদারায় বসে ছিলো। কখন চোখ লেগে যায় নিজেও খেয়াল করে নি। এতক্ষণ সব কেবল তার অতিতের স্মৃতিচারণ ছিলো বুঝতে পেরেই তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৯+৬০

” আমার জন্য ভালোবাসার রঙ লাল থেকে নীল করে দিয়ে না গেলেও পারতে ক্যাথ। এর থেকে ভালো ছিলো এক শিশি বিষ উপহার দিতে আমায়। এক সমুদ্র নীল রঙা বিষে প্রতিনিয়ত ডুবে মরার থেকে এক শিশি বিষ খেয়ে মরে যাওয়া বেশি সহজ। ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৩+৬৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here