মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৫+৬৬
নাফিসা তাবাসসুম খান
আনাস্তাসিয়া আজ সারাদিন কক্ষ থেকে বের হয় নি দেখে ম্যাথিউ বেশ কয়েকবার ওর খোঁজ নিতে আসে। কিন্তু কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পায় না সে। আনাস্তাসিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে একা থাকতে চায় আপাতত। ম্যাথিউর মনে মনে চিন্তা হয়। আনাস্তাসিয়া চুপচাপ কক্ষে বসে থাকার মেয়ে নয়। তাহলে আজ কি হলো? রিকার্ডোর সাথে ঝগড়া হলো না তো? কিন্তু যেচে পড়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না ম্যাথিউ। অনাধিকার চর্চা করতে চায় না সে তাই।
প্রাসাদের বাহিরে বিশাল বাগিচায় হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবনায় বুদ ছিলো ম্যাথিউ। তখনই লক্ষ্য করে রিকার্ডো প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করছে। রিকার্ডোকে দূর থেকে দেখে ম্যাথিউর মন কিছুটা শান্ত হয়। সে জানে রিকার্ডো থাকতে আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। তাই নিশ্চিন্তে সেও প্রাসাদের ভেতর হাঁটা ধরে।
দোতলায় আসতেই রিকার্ডোর বুকে একটা ধাক্কা লাগে। তার কক্ষ থেকে ভেসে আসছে বেহালার ধ্বনি। সেই একই সুর যা রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে বাজানো শিখিয়েছে। রিকার্ডো চুপচাপ কক্ষের দিকে এগোয়। কক্ষে প্রবেশ করে সে ডায়েরিটা টেবিলের উপর রেখে ধীরে ধীরে বারান্দায় প্রবেশ করে। হালকা জলপাই রঙা একটি পাতলা গাউন পড়ে বারান্দার রেলিঙের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে আনাস্তাসিয়া। চোখ বুজে এক ধ্যানে বেহালা বাজাচ্ছে সে।
রিকার্ডো নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আনাস্তাসিয়ার দিকে। কাছে যেতে নিয়েও ওর সাহস হয় না সামনে এগোনোর। হঠাৎ আনাস্তাসিয়া নিজেই বেহালা বাজানো বন্ধ করে পিছু ফিরে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। সাথে সাথেই রিকার্ডো দেখতে পায় আনাস্তাসিয়ার চেহারায় চিন্তার আভাস। আনাস্তাসিয়া বেহালাটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে রিকার্ডোকে প্রশ্ন করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে? ”
রিকার্ডো দেওয়ার মতো উত্তর খুঁজে পায় না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে রিকার্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” রিক? ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” কাজ ছিলো কিছু। ”
এতটুকু বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কাধের পাশ থেকে চুল সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে দাগ এখানো আছে নাকি। দাগ এখনো স্পষ্ট সকালের মতো আছে। রিকার্ডোর ভ্রু কুচকে আসে। আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” তুমি কি ওই ঔষধ লাগাও নি? ”
আনাস্তাসিয়া চুপচাপ মাথা নত করে রয়। রিকার্ডো আবার প্রশ্ন করে,
” নাসিয়া? কেন লাগাও নি? ”
আনাস্তাসিয়া এবার আর কথা না বলে রিকার্ডোকে সোজা জড়িয়ে ধরে। আনাস্তাসিয়ার এভাবে আচমকা জড়িয়ে ধরা রিকার্ডোকে অবাক করে বেশ। তবুও সে দু’হাতে আনাস্তাসিয়াকে আগলে ধরে। আনাস্তাসিয়া নিজ থেকেই বলে উঠে এবার,
” তুমি আমার উপর রেগে থেকো না দয়া করে। ”
রিকার্ডো থমথমে স্বরে বলে উঠে,
” তোমার উপর রেগে নেই আমি। কষ্ট তো আমি দিয়েছি তোমাকে। ”
” তুমি আমার জন্য সব সহ্য করতে পারো রিক। আমি কেন পারবো না? ”
রিকার্ডো এবার আনাস্তাসিয়ার কানে চুমু দিয়ে বলে,
” আমি জানি তুমি সব পারবে। এবার চলো ওই ঔষধ লাগিয়ে দেই। দাগ চলে যাবে। ”
এটা বলে রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে কক্ষের ভেতর যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু হাতে টান অনুভব করতেই সে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকায়। আনাস্তাসিয়া আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রিকার্ডো প্রশ্ন করে,
” কি হলো? ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” আমি ওই ঔষধ লাগাবো না। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” কেন? ”
” আমার যখন তীর লেগেছিলো মনে আছে? ”
রিকার্ডোর মনে পড়ে যায় সেই ভয়ংকর রাতের কথা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার। তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আনাস্তাসিয়া বলে,
” সেই রাতে আমাকে বাঁচানোর জন্য তুমি আমাকে তোমার রক্তপান করিয়েছিলে মনে আছে? ”
রিকার্ডো এবার বুঝতে পারে আনাস্তাসিয়া কি বলতে চাইছে। সে অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
” তুমি কি আমার রক্তপান করতে চাইছো? ”
আনাস্তাসিয়া ইতস্তত করে বলে,
” তাহলে এই দাগ নিমিষেই সব চলে যাবে না? ”
রিকার্ডো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সে এখনো বুঝতে পারছে না আনাস্তাসিয়া কেন রক্তপান করতে চাইছে। তবুও চুপচাপ বারান্দার ডিভানে আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে বসে পড়ে সে। নিজের হাতে নিজেই কামড় বসায় প্রথমে রিকার্ডো। রক্ত বেরিয়ে আসতেই সে নিজের হাত আনাস্তাসিয়ার দিকে মেলে ধরে। আনাস্তাসিয়া বিনা বাক্য ব্যয়ে রিকার্ডোর হাত থেকে রক্তপান করা শুরু করে। প্রথমে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক ভাবে পান করলেও ধীরে ধীরে আনাস্তাসিয়া কিছুটা নেশাগ্রস্তের মতো পান করা শুরু করে। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার ঘাড় এবং হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ধীরে ধীরে আনাস্তাসিয়ার দেহের সকল কাঁটা দাগগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। রিকার্ডো অপেক্ষা করে। দাগগুলো সম্পূর্ণ ভাবে মিলিয়ে যেতেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায়। আনাস্তাসিয়া এখানো একইভাবে রিকার্ডোর রক্তপান করছে।
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার রক্ত তেষ্টা সংবরণ করার জন্য নিজের হাত সরিয়ে ফেলে আচমকা। আনাস্তাসিয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ঠোঁট উল্টে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। রিকার্ডো বলে উঠে,
” স্পষ্ট বললেই পারতে তোমার রক্ত তেষ্টা পাচ্ছে। ”
রিকার্ডোর কাছে এভাবে ধরা খেয়ে যাওয়ায় আনাস্তাসিয়ার লজ্জা লাগে। মাথা নিচু করে রয় সে। রিকার্ডো হাত বাড়িয়ে আনাস্তাসিয়ার গালে রাখে। তার মুখ উঁচু করে ধরে তার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা রক্তটুকু মুছে দেয়। আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” আমি দুঃখিত। ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে বলে,
” তোমার কোনো দোষ নেই নাসিয়া। এই তেষ্টা তোমার নয়। ”
আনাস্তাসিয়া সন্ধিহান চোখে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। রিকার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে আনাস্তাসিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে,
” কক্ষে চলো। ”
আনাস্তাসিয়া চুপচাপ রিকার্ডোর হাত ধরে কক্ষে প্রবেশ করে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় দুজনে। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” এই তেষ্টা ওর। ”
এটা বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার পেটের উপর হাত রাখে আলতোভাবে। আনাস্তাসিয়া থমকায়। পরপর কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে। আয়না দিয়েই রিকার্ডোর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। রিকার্ডোর চেহারায় হাসির কোনো ছাপ নেই। কেবল রয়েছে ভয় এবং আতংক।
সিন্ড্রেল পর্বতের চূড়ায় একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আরোণ। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে। সামনে অনুভূতিশূন্যের মতো তাকিয়ে আছে আরোণ। মনে পড়ে যায় সেই বিভৎস্য রাতের কথা। যেই রাতে তার ক্যাথকে সে হারিয়েছিলো। ঠিক এই জায়গায়।
আরোণ এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে শূন্য গলায় বলে উঠে,
” তোমার স্মৃতি নয় তোমাকে চেয়েছিলাম আমি।
কিন্তু মাঝপথে একা ছেড়ে কেন চলে গেলে তুমি?
সবকিছুই চলছে আপন গতিতে থমকে কেবল আমি।
যাওয়ার হলে আমায় তবে সঙ্গে কেন নিলে না তুমি?
এতো স্বপ্ন, এতো ইচ্ছে সব রয়ে গেলো অপূর্ণ,
দেখছো না তুমি তোমায় হারিয়ে আজ আমি শূণ্য?
অন্ধকার রাত থেকে টেনে বের করে নতুন ভোরের সাথে পরিচয় করালে,
নির্বোধ আমি বুঝতেই পারি নি যে দিনের শেষে আবার যে রাত আসে।
আমার জীবন, আমার আত্মা, আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে মিশে থেকেও
তুমি নেই আমার কাছে।
কি ছিলো আমার অপরাধ?
কেন ভালোবাসালে ক্যাথ? ”
কথাটুকু বলতে বলতে আরোণের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তবুও তার চোখের পলক পড়ে না। হঠাৎ সে সেখানেই দুই হাত মেলে মাটির উপর শুয়ে পড়ে। চোখ বুজতেই সে দেখতে পায় ক্যাথরিন তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বলছে,
” আমি প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে একটা জিনিসই চাই জানো? তিনি যেন তোমাকে অন্য কারো হাতে মরতে না দেয়। কারণ তোমার মৃত্যুর কারণ হওয়ার একমাত্র অধিকার আমার। আমি চাইনা আমার অধিকারে অন্য কেউ ভাগ বসাক। তোমার বিনাশীনি হিসেবে একমাত্র আমাকেই শোভা পায়। ”
আরোণ সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” আমার বিনাশীনি কেবল তুমিই হয়েছো। আর কারো ক্ষমতা নেই আমাকে এভাবে বিনাশ করার। ”
ঘুম থেকে উঠে রিকার্ডোকে দেখতে পায় না আনাস্তাসিয়া। তাই চুপচাপ উঠে তৈরি হয়ে জোসেফকে ডেকে পাঠায় কাউন্টেসের খাস কামরায়৷ কাউন্টেসের জন্য তৈরি খাস কামরা মূলত কাউন্টেস কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্য ব্যবহার করে। কক্ষের মাঝ বরাবর থাকা ডিভানে বসে আছে আনাস্তাসিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করে জোসেফ। মাথা নত করে প্রবেশ করে প্রথমে সে আনাস্তাসিয়াকে সম্মান প্রদর্শন করে, তারপর বলে উঠে,
” আমাকে ডেকেছিলেন কাউন্টেস? ”
আনাস্তাসিয়া স্পষ্ট প্রশ্ন করে বসে,
” কাউন্ট রিকার্ডো কাল রাতে কোথায় ছিলো? ”
জোসেফ পড়ে যায় বিপদে। রিকার্ডো তাকে এই বিষয়ে কাউকে জানাতে মানা করেছে। তাই সে আমতা আমতা করে বলে,
” আমি কি করে জানবো কাউন্টেস? ”
আনাস্তাসিয়া বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
” আমার সাথে মিথ্যে বলবে না মোটেও। সত্যি সত্যি করে বলো। ”
জোসেফ মনে মনে ভাবে যদি সে এই মুহুর্তে সত্যি বলে দেয় তাহলে রিকার্ডো তার গর্দান নিয়ে নিবে৷ আর যদি সে সত্যি না বলে তাহলে আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে তার মাথা চিবিয়ে খাবে৷ জীবন যাওয়ার ভয়ে জোসেফ বলে উঠে,
” আমায় ক্ষমা করুন কাউন্টেস৷ কিন্তু আমার পক্ষে আপনাকে জানানো সম্ভব নয়। কাউন্ট নিষেধ করেছেন। ”
কথাটুকু বলেই জোসেফ মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকে আনাস্তাসিয়ার কথা শুনার। কিন্তু আনাস্তাসিয়া তাকে অবাক করে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠে,
” আচ্ছা। তুমি যেতে পারো। ”
জোসেফ প্রথমে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় আনাস্তাসিয়ার দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না আনাস্তাসিয়া তাকে জেরা না করে ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করতেই জোসেফ তাড়াতাড়ি সেখান থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে আসে।
আনাস্তাসিয়া জোসেফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শরীর দূর্বল লাগছে তার। সকালে এখনো নাস্তা করতে পারে নি সে। বারবার কেবল রক্ত তেষ্টা পাচ্ছে তার। আনাস্তাসিয়া আনমনে পেটে হাত রাখে। মলিন মুখে সে ভাবতে থাকে সে কার কাছে রক্ত চাইবে?
কালকে রাতে আনাস্তাসিয়াকে আয়নার সামনে রেখেই রিকার্ডো আবার বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার আগে বলে যায় সে জলদি ফিরে আসবে। কিন্তু এখনো তার আসার নাম নেই। রিকার্ডো যে এই ঘটনায় মোটেও খুশি নয় তা রিকার্ডোর চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো।
আনাস্তাসিয়া মনে মনে ভাবে তার সন্তানই হয়তো প্রথম সন্তান যার আগমনে তার বাবার মুখে হাসি বা আনন্দ নেই। উল্টো তার মনে অজানা আশংকা এবং ভয় বাসা বেঁধে রয়েছে। কিন্তু আনাস্তাসিয়া কি করবে? সে তো মা। তার তো ইচ্ছে করছে খুশিতে সকলকে জানাতে৷ কিন্তু রিকার্ডোর সাথে কথা না বলে এমনটা করা উচিত হবে না দেখে সে আর কিছু বলে না।
আজকে সকালে যে কক্ষে প্রবেশ করেছে আনাস্তাসিয়া তারপর আর একবারও বেরোয়নি সারাদিনে। ম্যাথিউর মনের চিন্তা গাঢ় হয়। একে তো আনাস্তাসিয়া নিজেকে কক্ষবন্দী করে রেখেছে অপরদিকে রিকার্ডো সারাদিন লাপাতা। নিজেকে আর সংবরণ না করতে পেরে ম্যাথিউ আনাস্তাসিয়ার কক্ষের সামনে এসে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বলে,
” আমি কাউন্টেসের সাথে দেখা করতে চাই। ”
প্রহরীদের মধ্যে একজন বলে উঠে,
” কাউন্টেস আজ কারো সাথে দেখা করতে চায় না জানিয়ে দিয়েছেন৷ ”
ম্যাথিউ বিরক্ত হয়। রাগী সুরে বলে উঠে,
” আমার উনার সাথে দেখা করা গুরুত্বপূর্ণ। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। ”
প্রহরীরা তবুও ম্যাথিউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ায় ম্যাথিউ রাগে নিজের পিশাচ স্বত্তার রূপ ধারণ করে। মুহুর্তেই প্রহরী দুজন ভয়ে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। সাথে সাথে ম্যাথিউ দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করে।
কক্ষে প্রবেশ করতেই ম্যাথিউ দেখে আনাস্তাসিয়া গায়ে চাদর টেনে বিছানায় শুয়ে আছে। ম্যাথিউ বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আনাস্তাসিয়াকে নাম ধরে ডাকে। কিন্তু আনাস্তাসিয়া সারা দেয় না। চোখমুখ খিচে পড়ে রয়। ম্যাথিউ এবার আরেকটু বিছানার কাছে ঘেঁষে আনাস্তাসিয়াকে ডাকে। আনাস্তাসিয়া এবার আলতো করে ঘাড় ঘুরিয়ে ম্যাথিউর দিকে তাকায়। সাথে সাথে ম্যাথিউ ভয়ে আঁতকে উঠে।
আনাস্তাসিয়ার চেহারা অনেক বেশি ফ্যাকাসে লাগছে। শরীরও অনেক দূর্বল দেখাচ্ছে। ম্যাথিউ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
” আনাস্তাসিয়া? কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন? ”
আনাস্তাসিয়া কোনো উত্তর দেয় না। ম্যাথিউ চেঁচিয়ে দাসীকে ডাকে। দাসী তড়িঘড়ি করে কক্ষে আসতেই ম্যাথিউ প্রশ্ন করে,
” কাউন্টেসের কি হয়েছে? সারাদিন কোথায় ছিলে তোমরা? ”
দাসী ভয়ে মাথা নত করে জবাব দেয়,
” কাউন্টেস সকাল থেকে এখনো মুখে কিছু তুলে নি। উনার জন্য আনা সকল খাবার উনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। আর আমাদেরও কক্ষে উনার সাথে থাকার অনুমতি দেন নি। ”
ম্যাথিউ চেঁচিয়ে বলে,
” আগে জানাও নি কেন আমাকে? আর এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? এক্ষুণি রাজ চিকিৎসককে খবর দাও। ”
দাসী দৌঁড়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। ম্যাথিউর চেঁচামেচিতে ক্যামিলোও কক্ষে এসে উপস্থিত হয়। আনাস্তাসিয়াকে একবার দেখে দৌঁড়ে গিয়ে তার পাশে বসে। ম্যাথিউর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” রিকার্ডো কোথায়? ”
ম্যাথিউ বেশ অস্থির হয়ে আছে। সে জবাব দেয়,
” ভাই সারাদিন প্রাসাদে নেই। কোথায় গিয়েছে জানিনা। ”
আনাস্তাসিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
” রিককে ডাকো। ”
ম্যাথিউ পড়ে যায় বিপাকে। এই মুহুর্তে রিকার্ডোকে সে কোথায় পাবে? সে তো জানেও না রিকার্ডো কোথায় গিয়েছে। ক্যামিলো আনাস্তাসিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
” চিন্তা করো না মা। রিক এসে পড়বে। ”
ম্যাথিউ আরেকবার চিল্লিয়ে উঠে,
” চিকিৎসকের আসতে এতো সময় লাগছে কেন? ”
ম্যাথিউর চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই রিকার্ডো কক্ষে এসে প্রবেশ করে। তার সাথে রয়েছে আরোণ, হান্নাহ। রিকার্ডোর সাথে ওদের দেখে ক্যামিলো এবং ম্যাথিউ চমকে যায়। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পায় না। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কাছে এসে তার পাশে বসে। শক্ত করে তার হাত ধরে বলে উঠে,
” নাসিয়া। আরেকটু কষ্ট সহ্য করে নাও। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
আনাস্তাসিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
” আমার রক্ত তেষ্টা পাচ্ছে রিক। ”
আনাস্তাসিয়ার কথা শুনে ক্যামিলো এবং ম্যাথিউ দু’জনই চমকে উঠে। তারা আনাস্তাসিয়ার কথার মানে বুঝতে পারে না। রিকার্ডো বলে উঠে,
” রক্তের তেষ্টা কিছুক্ষণ পরেই চলে যাবে। হান্নাহ এসেছে সব ঠিক করে দিবে। ”
আনাস্তাসিয়া আধো খোলা চোখ দিয়ে একবার হান্নাহর দিকে তাকায়। সাথে সাথে দেখে পিছনে একজন দাসী প্রবেশ করছে। সেই দাসীর হাতে একটি ট্রে। ট্রে-তে রাখা ছুঁড়ি, কাঁচি, কিছু পাতলা সাদা কাপড় এবং আরো কিছু সরঞ্জাম। আনাস্তাসিয়া আঁতকে উঠে। রিকার্ডোকে প্রশ্ন করে,
” কি করবে তোমরা? ”
রিকার্ডো থমথমে গলায় জবাব দেয়,
” বাচ্চাটাকে মারতে হবে নাসিয়া। নাহয় ও তোমায় মেরে ফেলবে। ”
আনাস্তাসিয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। সে বুকের ভেতর একটা চাপ অনুভব করে। রিকার্ডোর দিকে লক্ষ্য করে দেখে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আছে। মনে মনে ভাবে রিকার্ডোর কি এই কথা বলতে একবারও বুক কাঁপলো না? কক্ষে উপস্থিত আরোণ এবং হান্নাহ ব্যতীত ম্যাথিউ এবং ক্যামিলো চমকে উঠে। তারা এতক্ষণে বুঝতে পারে আনাস্তাসিয়াকে এতো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন। আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে কিছু বলতে চায় তার আগেই রিকার্ডো বলে উঠে,
” তোমার বেঁচে থাকার জন্য বাচ্চাটার মরতেই হবে নাসিয়া। ”
দূর্বল শরীর নিয়েই আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর হাত থেকে ঝামটি মেরে নিজের হাতটা সড়িয়ে ফেলে। ক্লান্ত গলায় বলে উঠে,
” ভুলেও এই সাহস করবে না তুমি। ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমার প্রতি যত রাগ, অভিমান আছে তোমার সব মাথা পেতে নিবো কিন্তু আপাতত তোমার ভালোর জন্য যা প্রয়োজন আমি তাই করবো। ”
আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” আমার ভালো মানে? তুমি আমার সন্তানকে মেরে আমার কি ভালো করবে? এরকম ভালো আমি চাই না। ”
রিকার্ডোর চেহারা করুণ দেখায়। সে বলে উঠে,
” আমাকে ক্ষমা করো কিন্তু আমার আর কিছু করার নেই। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো আরোণ এবং ম্যাথিউকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা দেয়। সাথে সাথে তারা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দরজা লাগিয়ে চারজন দাসী এসে আনাস্তাসিয়ার দু’হাত এবং পা চেপে ধরে। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া চিৎকার শুরু করে। তার চিৎকারে প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল যেন ধ্বসে পড়ছে। রিকার্ডো সহ্য করতে পারে না। সে বারান্দায় এসে পড়ে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। আনাস্তাসিয়াকে সে কি করে বুঝাবে নিজের মনের অবস্থা? আনাস্তাসিয়ার তো মায়ের মন। সে কখনোই রিকার্ডোর কঠোরতার আড়ালে চাপা কষ্ট অনুভব করতে পারবে না।
হান্নাহর খারাপ লাগছে। তবুও তার কিছু করার নেই। সে চুপচাপ আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। হান্নাহকে এগিয়ে আসতে দেখে আনাস্তাসিয়া ভয়ে কুঁকড়ে উঠে। চিৎকারের আওয়াজ আরো জোরে শোনা যায় তার। ক্যামিলো তড়িঘড়ি করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রিকার্ডোর পাশে। আলতো স্বরে বলে উঠে,
” তুই কি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বাবা? ”
রিকার্ডো ক্যামিলোর দিকে ফিরে তাকায়। তার চোখ ছলছল করছে। ক্যামিলোর বুক মুচড়ে উঠে। তার মনে নেই সে কখনো রিকার্ডোর চোখে পানি দেখেছে কিনা। রিকার্ডো করুণ স্বরে বলে উঠে,
” আমার কাছে নাসিয়া সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মা। ওকে ছাড়া সবকিছু অনর্থক আমার জন্য। ”
রিকার্ডোর কথা শেষ হতে না হতেই কক্ষ থেকে আনাস্তাসিয়ার চিৎকার এবং আর্তনাদ ভেসে আসে। সে চিল্লিয়ে বলে উঠে,
” আমার বাচ্চাকে মেরে তুমি কখনোই আমাকে বাঁচাতে পারবে না রিক। আমি নিজে নিজের জীবন নিয়ে নিবো। ”
রিকার্ডো দু’হাতে কান চেপে ধরে। তার সহ্য হচ্ছে না এসব। কিন্তু সাথে সাথেই আনাস্তাসিয়ার চিৎকার থেমে যায়। কক্ষ থেকে ভেসে আসে হান্নাহর চিৎকার। হান্নাহ আনাস্তাসিয়ার নাম ধরে ডাকছে। রিকার্ডো কান থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। ভয়ে তার শীতল শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। অনেক কষ্টে সে পা বাড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। কক্ষে পা রাখতেই রিকার্ডোর ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। শরীরের তাল সামলানোর জন্য সে দরজায় একহাতে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
হান্নাহসহ সকলে আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। হান্নাহ একটি ছোট কাঁচের আয়না আনাস্তাসিয়ার নাকের কাছে ধরে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করছে। এতক্ষণে তার চিৎকারে ম্যাথিউ এবং আরোণও কক্ষে প্রবেশ করেছে। আনাস্তাসিয়াকে চোখ বন্ধ অবস্থায় দেখে ম্যাথিউ ভয়ে সামনে এগোতে পারে না। তার শরীর অসাড় হয়ে আসে। আরোণ একবার আনাস্তাসিয়াকে দেখে আবার সামনে রিকার্ডোর দিকে তাকায়। সে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় রিকার্ডোর কাছে। বলে উঠে,
” কিছু হবে না অ্যানার। নিজেকে সামলাও। ”
রিকার্ডো যেন পাথরের ন্যায় জমে আছে। তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে কেবল এটা শোনার জন্য যে তার নাসিয়া ঠিক আছে। অবশেষে তার ব্যাকুলতা কমিয়ে হান্নাহ বলে উঠে,
” নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কেবল জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু এখনই ওকে রক্ত পান করানো প্রয়োজন। ”
আনাস্তাসিয়া নিঃশ্বাস নিচ্ছে কথাটুকু শুনে রিকার্ডোর বুকে প্রাণের সঞ্চার হয়। বুকে হাত রেখে চোখ বুজে সে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য তার মাথায় যা ভাবনা উঁকি দিয়েছিলো তা ঝেড়ে ফেলে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে যায়।
আনাস্তাসিয়ার যখন জ্ঞান ফিরে তখন মধ্যরাত প্রায়। জ্ঞান ফিরতেই আনাস্তাসিয়া দূর্বল চোখ জোড়া মেলে তাকায়। চারিদিকে চোখ বুলাতে নিয়ে দেখে রিকার্ডো তার দিকে পিঠ করে বিছানায় বসে আছে। দু’হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে রয়েছে সে। আনাস্তাসিয়া একবার রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকায়। তার মনে পড়ে যায় নিজের সন্তানের কথা। আনাস্তাসিয়া ভয়ে আঁতকে উঠে। নিজের পেটের উপর হাত রেখে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই অনুভব হচ্ছে না তার।
সাথে সাথে আনাস্তাসিয়ার ভয়ার্ত চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে উঠে সে,
” আমার বাচ্চা! ”
রিকার্ডো মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আনাস্তাসিয়ার দিকে। আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
” মেরে ফেললে আমার বাচ্চাটাকে? শেষমেশ নিজের সন্তানের খুনিও হয়ে গেলে তুমি? ”
রিকার্ডো শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় আনাস্তাসিয়ার দিকে। তারপর শীতল স্বরে বলে উঠে,
” বেঁচে আছে সে। ”
আনাস্তাসিয়ার কান্নার বেগ কমে আসে৷ কিন্তু কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
” তাহলে আমার সব স্বাভাবিক অনুভব হচ্ছে কেন? ”
রিকার্ডো একইভাবে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
” পিশাচটার রক্তের চাহিদা মিটেছে। তাই তোমাকে জ্বালিয়ে মারছে না আর। ”
আনাস্তাসিয়ার হৃদয় আহত হয়। কম্পিত স্বরে বলে উঠে,
” যাকে তুমি পিশাচ বলছো সে তোমারও সন্তান রিক৷ তোমার মনের মায়া দয়া কি মরে গিয়েছে? ”
রিকার্ডো রাগী স্বরে বলে উঠে,
” সে আমার সন্তান দেখেই তাকে পিশাচ বলছি। পিশাচের সন্তান তো পিশাচই হবে। আর তুমি আমার মায়া দয়ার কথা বলছো? এই বাচ্চা কি একবারও তোমার প্রতি মায়া দয়া দেখাচ্ছে? এক দিনেই তোমার কি অবস্থা করে ছেড়েছে দেখছো? তোমার শরীরের সব রক্ত শুষে নিজে বেড়ে উঠছে সে। ”
আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” ওর রক্তের তেষ্টা মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন হয় তাই করবো আমি। তবুও ওকে মারার কথা বলো না আমায়। আমি পারবো না। ”
আনাস্তাসিয়ার কথা শুনে রিকার্ডো অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। বিস্মিত স্বরে বলে উঠে,
” এই কথা তুমি বলছো নাসিয়া? তুষ দূর্গে আমি তোমাকে জোর করে রক্ত পান করিয়েছিলাম দেখে সেদিন তুমি আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলে। আর আজ সেচ্ছায় রক্ত পান করতে চাইছো? ”
আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে বলে উঠে,
” ওর জন্য আমি সব পারবো। ”
রিকার্ডো ছলছল নয়নে আনাস্তাসিয়ার পানে তাকিয়ে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
” আর আমার জন্য? ”
আনাস্তাসিয়া জবাব দিতে পারে না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। রিকার্ডো আবার বলে উঠে,
” ওর জন্য তুমি নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবে, কিন্তু আমার জন্য তুমি ওকে উৎসর্গ করতে পারবে না? ”
আনাস্তাসিয়া এবার নিঃশব্দে কাঁদছে। সে কি বলবে? তার জন্যও এই পরিস্থিতি সহজ নয়। কিন্তু সে কখনো নিজের সন্তানকে মারার মতো পাপ করতে পারবে না। রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমি এতদিন ভাবতাম তুমি আমাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসো। কিন্তু আজ অন্য কেউ এসেছে যার প্রতি তোমার ভালোবাসার পরিধি আমার থেকেও বেশি। তুমি তাকে এতটাই ভালোবাসো যে তার জন্য তুমি নিজের জীবন শেষ করে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। অথচ আমাকে ভালোবেসে তুমি আমার জন্য জীবিত থাকতে পারবে না। ”
রিকার্ডোর গলার স্বর এবার গম্ভীর হয়। নিজের নমনীয়তা কাঁটিয়ে সে বলে উঠে,
” বেশ তবে থাকো তুমি তোমার সন্তানকে নিয়ে। জন্ম দাও ওকে। আমি তোমাকে আর কোনো বাঁধা দিবো না। কিন্তু মনে রাখবে যেই সন্তান আমার থেকে আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিবে সে কখনো আমার ভালোবাসা পাবে না। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো সাথে সাথে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আনাস্তাসিয়ার বুকের ভেতর ঝড় উঠে। উদাস চোখে পেটের উপর হাত রাখে সে আবার। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৩+৬৪
” তুমি যা শুনেছো সব ভুল। তোমার বাবা তোমাকে ভালোবাসে। ”
কথাটুকু বলে আনাস্তাসিয়া আবার নির্জীব নয়নে তাকিয়ে রয়। তার খুব ইচ্ছে করছে রিকার্ডোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু রিকার্ডো পাষাণ। নির্দয়। আনাস্তাসিয়ার প্রতি ভালোবাসা তাকে জগতের সবথেকে স্বার্থপর পিতা বানিয়ে দিচ্ছে। যা সহ্য হয় না আনাস্তাসিয়ার। সে চায় রিকার্ডোও তাদের সন্তানকে ভালোবাসুক। কাছ থেকে অনুভব করুক। আনাস্তাসিয়া না থাকলে তো তার বাচ্চার সবথেকে আপন বলতে কেবল রিকার্ডোই থাকবে। আনাস্তাসিয়া মনে মনে ভাবে সে কি দেখে যেতে পারবে তার সন্তানকে? নাকি সেই সুযোগটাও পাবে না সে? এসব ভাবনা আনাস্তাসিয়ার হৃদয়কে দূর্বল করে তুলে। মনে মনে বলে,
” ভাগ্য তুমি খুব নিষ্ঠুর। ”
