মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৭+৬৮
নাফিসা তাবাসসুম খান
সম্পূর্ণ রাজ্যে ঘোষণা করা হলো কাউন্টেস আনাস্তাসিয়া মা হতে চলেছে। রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লো উৎসবের আমেজ। এতো বছর পর আবার বুখারেস্ট প্রাসাদে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ ভেসে উঠবে ভাবতেই সকলে বেশ খুশি। রাজ্যের অসংখ্য প্রজারাই আর্শীবাদ সরূপ আনাস্তাসিয়ার জন্য বিভিন্ন উপহার পাঠায়।
কিন্তু রাজ প্রাসাদের কেউই এই সন্তানের আগমনে সম্পূর্ণ খুশি হতে পারছে না। কারণ দিনকে দিন আনাস্তাসিয়ার শারীরিক অবস্থা আরো বেগতিক হচ্ছে। শরীর শুকিয়ে হাড্ডি ভেসে উঠছে। চেহারা দিন দিন রক্তশূন্যতায় ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। যদিও তিন বেলা আনাস্তাসিয়াকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে পান করার জন্য তবুও রক্তশূণ্যতার পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাত্র বত্রিশ দিনেই পেট অনেকটা ফুলে উঠেছে। হান্নাহ জানিয়েছে ভ্যাম্পায়ারের সন্তানের বৃদ্ধি এতো দ্রুত হওয়াই স্বাভাবিক।
বাকি সবাই আনাস্তাসিয়ার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও কেবল রিকার্ডোই স্বাভাবিক হতে পারে নি। এমন নয় যে সে আনাস্তাসিয়াকে অবহেলা করছে। উল্টো তার সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখছে। কেবল আগের মতো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না তার সাথে৷ আর সারারাত বেশির ভাগই প্রাসাদের বাহিরে কাটায়। এ নিয়ে আনাস্তাসিয়ার কষ্টের শেষ নেই। প্রায় রাত জেগেই সে আপনমনে পেটের উপর হাত রেখে তার সন্তানের সাথে কথা বলে সময় পার করে। আজকাল তো বাচ্চাটা নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়াও শুরু করে দিয়েছে। প্রায়শই আনাস্তাসিয়ার পেটে লাথি মারে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিজ কক্ষে বিছানায় বসে ক্যামেলিয়ার সাথে খেলা করছে আনাস্তাসিয়া। রিকার্ডোও টেবিলে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। ক্যামেলিয়া হঠাৎ খেলার মাঝেই হাত বাড়িয়ে আনাস্তাসিয়ার পেটের উপর হাত রাখে। আনাস্তাসিয়া মুচকি হেসে বলে,
” কিছু টের পেয়েছো ক্যামি? ”
ক্যামেলিয়া আচমকা একগাল হেসে মাথা আনাস্তাসিয়ার পেটের উপর রাখে। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়ার পেটে ব্যাথা করে উঠে। সে মৃদুস্বরে আহ বলে উঠে। টেবিলে বসে থাকা রিকার্ডো এতক্ষণ আড়চোখে আনাস্তাসিয়াকেই দেখে যাচ্ছিলো। আনাস্তাসিয়ার আর্তনাদ শুনে সে সাথে সাথে উঠে আসে বিছানার কাছে। এগিয়ে এসে ক্যামেলিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে আনাস্তাসিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” ক্যামেলিয়া তো বাচ্চা। কিন্তু তোমার মাথায় তো বুদ্ধি আছে। নাকি শরীরের রক্তর সাথে মাথার বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে? ক্যামেলিয়া যদি আচমকা লাফ দিয়ে তোমার পেটের উপর পড়তো? ”
রিকার্ডোর ধমক শুনে আনাস্তাসিয়া মুখ কালো করে ফেলে। আজকাল রিকার্ডো ছোট থেকে ছোট বিষয়ে তাকে কেবল ধমকায়। ভালো করে কথা বলা যেন ভুলেই গিয়েছে। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে জবাবে আনাস্তাসিয়া বলে,
” হ্যাঁ। লোপ পেয়েছে আমার বুদ্ধি। সব দোষ আমার। ”
রিকার্ডো কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারে না। ক্যামেলিয়া তার হাত খামচে ধরে রেখেছে। রিকার্ডো বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” ঢংগী খালার ঢংগী ভাগ্নি। ”
তখনই কক্ষের দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়। রিকার্ডো অনুমতি দেয় ভেতরে প্রবেশ করার। আরোণ এবং হান্নাহ কক্ষে প্রবেশ করে। আরোণ কক্ষে প্রবেশ করতেই আনাস্তাসিয়ার গোমড়া মুখ দেখে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে অ্যানা? ”
আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে অভিযোগের সুরে বলে উঠে,
” আমার কি হবে ভাই? সব দোষ তো আমার শুধু। এজন্য সারাদিন ধমকের উপর থাকি। ”
আরোণ ভ্রু কুচকে একবার আনাস্তাসিয়ার দিকে তো একবার রিকার্ডোর দিকে তাকায়। তারপর রিকার্ডোকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
” তুমি কি অ্যানার উপর রাগ দেখিয়েছো? ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমি রাগ দেখানোর কে? এখানে সবকিছু তো একজনের মর্জিতেই চলে। সে যা ইচ্ছা করতে পারবে কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। ”
আরোণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
” বুঝতে পেরেছি তোমাদের সমস্যা। ইদুর এবং বিড়ালের মতো ঝগড়া না করলে তোমাদের চলে না। ”
রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে চেঁচিয়ে একসাথে বলে উঠে,
” কে ইদুর এবং কে বিড়াল? ”
একসাথে কথাটা বলেই রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। আরোণ ক্যামেলিয়াকে রিকার্ডোর কোল থেকে তুলে নিয়ে বলে উঠে,
” আপাতত আমার মেয়ের ঘুমানোর সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই। ”
এটুকু কথা বলেই আরোণ দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে তাকায়। রিকার্ডোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” তুমি ইদুর। ”
তারপর আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” এবং তুমি বিড়াল। ”
কথাটুকু বলে একমুহূর্ত অপেক্ষা করে না আরোণ। সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ে। আরোণের বলে যাওয়া শেষ কথা শুনে হান্নাহ হেসে দেয়। সাথে সাথে রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া তার দিকে চোখ গরম করে তাকায়। তা দেখে হান্নাহর হাসি থেমে যায়। সে আমতা আমতা করে হাতের ট্রে দেখিয়ে বলে উঠে,
” আমি তো কেবল কাউন্টেসের জন্য রক্ত নিয়ে এসেছি। ”
এটা বলেই হান্নাহ হাতের ট্রে টা আনাস্তাসিয়ার সামনে রেখে বলে উঠে,
” আমি যাই এখন। ”
এটা বলেই হান্নাহ সেখান থেকে কেটে পড়ে। কক্ষে রয়ে যায় কেবল রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া। রিকার্ডো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এসে আনাস্তাসিয়ার পাশে বসে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই প্রশ্ন করে,
” বেশি ব্যাথা পেয়েছো? ”
আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে বলে উঠে,
” সামান্য। ”
রিকার্ডো আর কোনো কথা না বলে ট্রে তে থাকা বাটির ঢাকনা তুলে। বাটিতে টকটকে লাল তাজা রক্ত। রক্ত দেখেই আনাস্তাসিয়ার মানব স্বত্তার ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে। কিন্তু তার মধ্যে থাকা তার সন্তানের পৈশাচিক স্বত্তা রক্ত তৃষ্ণায় ততক্ষণে কাতর। আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে বাটিটা হাতে তুলে এক চুমুকে সম্পূর্ণ রক্ত শেষ করে ফেলে।
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার রক্তপানের দিকে নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। সে কখনোই আনাস্তাসিয়ার জন্য এমন জীবন চায়নি। তার নাসিয়া একজন কোমল মানবী। যার উপর রাগ, তেজ, দুঃসাহসিকতা সহ সব মানায়। কিন্তু এই পিশাচ স্বত্তার রূপ মানায় না। রক্ত পান শেষে আনাস্তাসিয়া বাটিটা আবার ট্রের উপর রেখে দেয়। রিকার্ডো চুপচাপ একটা পাতলা কাপড়ের সাদা রুমাল দ্বারা আনাস্তাসিয়ার মুখে লেপ্টে থাকা রক্ত মুছে দেয়। পরপরই সে ট্রে হাতে উঠে পড়তে নেয় কিন্তু আনাস্তাসিয়া তার হাত ধরে অস্পষ্ট স্বরে ডাকে,
” রিক? ”
রিকার্ডো থামে। সময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায়। আনাস্তাসিয়া কিছু একটা বলতে নিবে তখনই দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়। রিকার্ডো হাতের ট্রে টা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অনুমতি দেয় প্রবেশের। সাথে সাথে একজন প্রহরী মাথা নত করে কক্ষে প্রবেশ করে বলে উঠে,
” কাউন্ট, কাউন্টেস। বিরক্ত করার জন্য মাফ করবেন। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদের জানানো প্রয়োজন। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? ”
প্রহরী মাথা নত রেখেই ভীত স্বরে জবাব দেয়,
” প্রায় এক হাজার জন প্রজা একত্রিত হয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ”
রিকার্ডো চিন্তিত সুরে বলে উঠে,
” মানে? ”
প্রহরী বলে উঠে,
” তাদের উদ্দেশ্য হয়তো বিদ্রোহ করা কাউন্ট। ”
আনাস্তাসিয়া এবং রিকার্ডো দুজনেই একে অপরের দিকে একবার তাকায়। আনাস্তাসিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
” বিদ্রোহ? ”
রিকার্ডো কাপড় বদলে তলোয়ার নিয়ে তৈরি হচ্ছে। আনাস্তাসিয়া ক্লান্ত পায়ে তার পিছু পিছু ঘুরঘুর করছে আর চিন্তিত সুরে প্রলাপ পারছে। তৈরি হওয়া শেষ হতেই রিকার্ডো আচমকা পিছনে ফিরে আনাস্তাসিয়াকে কোলে তুলে নেয়। আনাস্তাসিয়া হকচকিয়ে বলে উঠে,
” কি করছো? ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চাদর টেনে তার কোমর পর্যন্ত দিয়ে দেয়। তারপর বলে উঠে,
” চুপচাপ আমি ফেরার আগ পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকবে তুমি। মেঝেতে যদি পা পড়ে তোমার তাহলে কৃষ্ণ সাগর কত প্রকার এবং কি কি সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে আনবো। ”
রিকার্ডোর ধমক খেয়ে আনাস্তাসিয়া দমে যায় কিছুটা। কিন্তু প্রশ্ন করা থামায় না। মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করে,
” তুমি তলোয়ার হাতে কেন যাচ্ছো? ওরা কি তোমার উপর আক্রমণ করবে? ”
” কারো সাধ্য নেই আমার কিছু করার। চিন্তা করে নিজের শরীর আর দূর্বল করবে না তুমি। ”
এটুকু বলেই দরজার কাছে এগিয়ে যায় রিকার্ডো। দরজা খুলে বের হতে নিলেই দেখে আরোণ এবং ম্যাথিউ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিকার্ডো আরোণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ক্যামেলিয়া একা? ”
” না। ও ঘুমিয়ে পড়েছে। হান্নাহ আছে ওর পাশে। ”
রিকার্ডো মাথা নেড়ে এগিয়ে যায়। ম্যাথিউ এবং আরোণও তার পিছু পিছু হাঁটা ধরে। কক্ষে একা বসে থাকা আনাস্তাসিয়া মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে যেন সবকিছু ঠিক থাকে।
প্রাসাদের মূল ফটকের বাহিরে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে সহস্র প্রজা। হাতে তাদের বিভিন্ন ধরনের তলোয়ার। সকলেই প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু প্রধান সেনাপতি স্টেফেনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেনাদের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে কেউই এগোতে পারছে না। প্রাসাদের মূল দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেফেন তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” যেই অকৃতজ্ঞ আক্রমণের চেষ্টা করবে সবগুলোর গর্দান যেন মাটিতে পড়ে। ”
এটুকু বলেই সে নিজের তলোয়ার বের করার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু তখনই স্ব শব্দে তার পিছনে প্রাসাদের প্রধান দরজা খোলার শব্দ হয়। স্টেফেনের হাত থেমে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। রিকার্ডো রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। তার পিছু পিছু আরোণ এবং ম্যাথিউও আসছে। স্টেফেন সাথে সাথে একপাশ হয়ে সড়ে দাঁড়ায়। রিকার্ডো তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে বলে উঠে,
” আপনি কক্ষে ফেরত যান কাউন্ট। আমি সবকটাকে ওদের আসল জায়গা চিনিয়ে দিবো। বিদ্রোহ করার ফল কি তা ভালো করে টের পাবে মূর্খ গুলো। ”
রিকার্ডো স্টেফেনের কথার জবাব না দিয়ে নিজের মতো প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে স্টেফেনও আরোণ এবং ম্যাথিউর সাথে রিকার্ডোর পিছু হাঁটা ধরে। প্রধান ফটকের সামনে গিয়েই রিকার্ডো জোর গলায় বলে উঠে,
” ফটক খোলা হোক। ”
রিকার্ডোর আদেশ শুনে প্রহরীরা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। কিছুটা সংকোচ কাজ করছে তাদের মধ্যে। রিকার্ডো আবার জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” কথা কি কানে যায় নি? ”
সাথে সাথে প্রহরীরা তড়িঘড়ি করে প্রধান ফটকটা খুলে দেয়। রিকার্ডোকে প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে বিদ্রোহীদের মধ্যে সোরগোল আরো বেড়ে যায়। ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে তারা। রিকার্ডো দু’হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার চোখ বুলায়। বেশ উগ্র অবস্থা। সেনাদের সুরক্ষা জাল পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশের জন্য বিদ্রোহীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
রিকার্ডো হিংস্র স্বরে হুংকার দিয়ে বলে উঠে,
” যেই বিদ্রোহী এই প্রাসাদের ভেতর পা রাখার সাহস দেখাবে তার লাশ আমি এতো টুকরো করে ছাড়বো, যে কেউ লাশের হদিস মিলাতে পারবে না। ”
বিদ্রোহীদের সোরগোল কিছুটা কমে। কিন্তু তাদের ক্ষীপ্ত মুখশ্রী এখনো আগের মতোই আছে। একজন বিদ্রোহী জোর গলায় বলে উঠে,
” দেখো তোমরা সবাই। ভালো করে দেখো। কোন পিশাচকে সিংহাসনে বসিয়েছো। যে নিজের প্রজাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ”
ম্যাথিউর রক্ত গরম হয়ে আছে এতক্ষণ ধরে। বিদ্রোহীর কথা শুনে তার রাগ আরো চওড়া হয়। সে বলে উঠে,
” আর যে প্রজারা নিজেদের কাউন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দুঃসাহস দেখায় তাদের কি বলা উচিত? অকৃতজ্ঞ এবং বিশ্বাসঘাতকের দল। ”
আরেকজন বিদ্রোহী বলে উঠে,
” তাহলে কি আমরা চুপ করে থাকবো নাকি? আর কতদিন নিজেদের সিংহাসনে একজন রক্তচোষা পিশাচকে শাসন করতে দেখবো? ”
রিকার্ডোর কানে এসে বিঁধছে কথাগুলো। সে শান্ত স্বরে বলে উঠে,
” কোনো প্রজা বুকে হাত রেখে বলতে পারবে আমি তাদের সাথে পিশাচের ন্যায় আচরণ করেছি? ”
আরেকজন বিদ্রোহী চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” এই পিশাচের কথায় বিশ্বাস করো না ভাইয়েরা। এ কেবল আমাদের বোকা বানাতে চাইছে। এই পিশাচ সিংহাসনে থাকলে আজীবন আমাদের রোমানিয়ান সাম্রাজ্য পিশাচদের কবলেই থাকবে। একে সিংহাসনচ্যুত করতেই হবে। ”
কথাটা শেষ হতেই আবার বিদ্রোহীরা ক্ষীপ্ত হয়ে আক্রমণ করে। এবার আগের তুলনায় আরো জোরদার ভাবে। স্টেফেন, আরোণ, ম্যাথিউ তিনজনই ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। ভীড়ের মধ্যে একজন বিদ্রোহী বলে উঠে,
” এই পিশাচকে মেরে সবাই প্রাসাদের ভেতর থেকে এর স্ত্রীকে টেনে এনে জনসম্মুখে মেরে ফেলবে। নাহয় এই পিশাচের স্ত্রীর গর্ভের সন্তানও পিশাচ হয়ে এই দুনিয়ায় আসবে আমাদের শাসন করার জন্য। ”
কথাটা বলেই সেই লোকসহ আরো কয়েকজন বিদ্রোহী জোরালো ভাবে সেনাদের সুরক্ষা জাল পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু চোখের পলকেই একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যায়৷ সকলেই মূহুর্তে থেমে যায়।
সুরক্ষা জাল পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা তিনজনের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে নিচে। চোখের পলকেই রিকার্ডো তলোয়ারের সাহায্যে তিনটি দেহের এই হাল করেছে। সাথে সাথে রিকার্ডো মাথা তুলে তাকায় সামনের বিদ্রোহীদের দিকে। তার চেহারায় লেপ্টে আছে সদ্য খুন হওয়া তিনটি লাশের তাজা রক্ত। রক্ত মাখা চেহারায় হিংস্র দৃষ্টিতে রিকার্ডোকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে রিকার্ডো বলে উঠে,
” আমার নাসিয়া কোনো পিশাচের স্ত্রী নয়। আমার নাসিয়া সম্পূর্ণ পবিত্র। যেই পবিত্রতা পিশাচকে পাপ ছাড়তে বাধ্য করেছে। আর আমার সন্তানও কোনো পিশাচ নয়। সে নিষ্পাপ। সে পিশাচ হয়ে জন্মাবে না। সে নাসিয়ার পবিত্রতারও অংশ। ”
এটুকু বলেই সাথে সাথে রিকার্ডো ঢিল মেরে হাত থেকে তলোয়ারটা ছুড়ে ফেলে। চিল্লিয়ে বলে উঠে,
” আমার স্ত্রী সন্তানকে মারার কথা যে চিন্তাও করবে আজ তাদের সকলের লাশ দিয়ে এখানে সমাধি তৈরি করবো আমি আর তাদের রক্তে নিজের পিশাচ স্বত্তাকে স্নান করাবো। ”
কথাটুকু বলে রাগে ফোসফাস করতে থাকে রিকার্ডো। জোরে দু তিনবার শ্বাস নিয়ে সে বলে উঠে,
” আমি কাউন্ট রিকার্ডো আলবার্ট কথা দিচ্ছি রোমানিয়ান সাম্রাজ্য আজীবন পিশাচদের শাসনে চলবে না। আমার সন্তান পিশাচ হয়ে জন্মাবে না। ”
রিকার্ডোর কথা শুনে সকলেই তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ম্যাথিউ বুঝতে পারছে না তার ভাইয়ের কথার অর্থ। রিকার্ডো কি এটা কেবল পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য বলেছে? রিকার্ডোর এমন ভয়ংকর রূপ দেখে আর কেউ সাহস পায় না সামনে এগোনোর। সকলেই সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাওয়ার। তখনই রিকার্ডো আচমকা সকল সেনাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
” সকল সেনারা সুরক্ষা জাল ছেড়ে সরে আসো। ”
রিকার্ডোর কথার অর্থ কেউ বুঝতে পারে না। তবুও সেনারা তার আদেশ মোতাবেক সড়ে দাঁড়ায়। বিদ্রোহীরা চলে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরতেই আচমকা তাদের সকলের উপর বৃষ্টির ন্যায় একঝাঁক পানি এসে পড়ে। সকলেই হতবিহ্বল হয়ে উপরে তাকায়। প্রাসাদের বাহিরে দু দিকে উঁচু দুটি সেনা কেল্লা হতে কিছু সংখ্যক সেনা বিশাল পাত্র ভরে তাদের উপর পানি ঢেলে যাচ্ছে। সকল বিদ্রোহীরা ভিজে একাকার। কিন্তু মুহুর্তেই তারা উপলব্ধি করতে পারে এটা পানি নয় বরং কেরাসিন। সাথে সাথেই সকলের চেহারা ভয়ার্ত রূপ ধারণ করে। পালানোর জন্য উদ্যত হয় সকলে। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে পড়েছে।
এক হাতে ধনুক এবং অন্য হাতে তিনটি তীর নিয়ে রিকার্ডো আদেশের সুরে বলে উঠে,
” আগুন। ”
সাথে সাথে একজন সেনা আগুনের মশাল হাতে রিকার্ডোর পাশে এসে দাঁড়ায়। রিকার্ডো আগুনে তীর তিনটা জ্বালিয়ে নিয়ে একসাথে ধনুকে রেখে বিদ্রোহীদের দিকে তাক করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিকার্ডো তীর ছুড়ে। সাথে সাথে সকল বিদ্রোহীদের দেহে আগুন ধরে যায়। যে দু তিনজন পালানোর জন্য দৌঁড় দিতে নেয় তাদেরকে তাক করে উপর থেকে সেনারা তীর ছুড়তে থাকে। রিকার্ডো তীক্ষ্ণ স্বরে স্টেফেনকে ডাকে। স্টেফেন দৌঁড়ে পাশে এসে দাঁড়াতেই রিকার্ডো বলে উঠে,
” রাজ্যের প্রতিটা কোণে পৌঁছে দেওয়া হোক এদের পরিণতির খবর। সকলেই যেন বুঝতে পারে কাউন্ট রিকার্ডোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ”
স্টেফেন মাথা নেড়ে বলে উঠে,
” যা হুকুম কাউন্ট৷ ”
রিকার্ডো আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। প্রাসাদের ভেতর হাঁটা ধরে সে।
নিজের কক্ষে ঢুকার আগে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে এসেছে রিকার্ডো। যেন আনাস্তাসিয়া তার কিছুক্ষণ আগের ভয়ংকর রূপ না দেখে। নিজের মুখভঙ্গি যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে সে কক্ষে প্রবেশ করে। আনাস্তাসিয়াকে যেভাবে রেখে গিয়েছিলো এখনো একইভাবে বসে আছে আছে সে৷ কেবল মাথা নিচু করে রেখেছে৷ রিকার্ডো প্রবেশ করার সাথে সাথেই আনাস্তাসিয়া প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে না বসায় বেশ অবাক লাগে রিকার্ডোর। তবুও স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠে,
” বিদ্রোহ শেষ। সকলে উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে গিয়েছে। আর রাত জেগো না। ঘুমিয়ে পড়ো তুমি৷ ”
কথাটুকু বলতে বলতে শার্টের উপরের ব্রীচ কোটটা খুলে ফেলে রিকার্ডো। তখনই আনাস্তাসিয়ার শান্ত স্বর শুনা যায়।
” ওরাও আমার বাচ্চাটাকে পিশাচ বললো? ”
রিকার্ডো থমকায়। আনাস্তাসিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। আনাস্তাসিয়া মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। রিকার্ডোর বুকে গিয়ে বিঁধে সেই অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি। মুখ ফুটে সে বলে,
” তোমাকে বলেছিলাম কক্ষ ছেড়ে না বের হতে। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” তোমার কি মনে হয়? আমি কক্ষ থেকে বের না হলেও বাহিরে কি চলছে তা খবর নিতে পারবো না আমি? ”
রিকার্ডো থমথমে গলায় বলে উঠে,
” সকলে নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। ”
আনাস্তাসিয়া অবজ্ঞার সুরে বলে উঠে,
” ওদের আর কি দোষ দিবো বলো? যেখানে আমার বাচ্চার বাবা নিজেই বাচ্চাটাকে পিশাচ বলে বেড়াচ্ছে। ”
রিকার্ডো জবাব দিতে পারে না। চুপ করে রয়। আনাস্তাসিয়া নিজেই বলে উঠে,
” এটা কেমন ভালোবাসা রিক যেখানে তুমি আমাদের ভালোবাসার অংশকেই স্বীকার করতে পারছো না? ”
রিকার্ডো একইভাবে নিশ্চুপ রয়। কিছু বলতে পারে না সে। আনাস্তাসিয়া আবার বলে উঠে,
” আর কয়দিন আছি আমি পৃথিবীতে? এই কয়দিন আমি আর আমার সন্তান কেন তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি? ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” কিছু হবে না তোমার। অযথা চিন্তা বাদ দাও। ”
” সত্যটা তুমিও জানো রিক। আমি কি মরার আগে অন্তত একবার তোমার চোখে আমার সন্তানের জন্য ভালোবাসা দেখতে পারবো না? কালকে তুমি ওকে পিশাচ বলছিলে, আজ পুরো পৃথিবী ওকে পিশাচ বলে বেড়াচ্ছে অথচ আমার বাচ্চাটা এখনো পৃথিবীর আলোই দেখলো না। ওর কি অপরাধ আমাকে বলতে পারো? কেন এতো ঘৃণা পাচ্ছে ও? কেন ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারছো না কেউ? আমি তো আমার বাচ্চাটাকে রেখে শান্তিতে মরতেও পারবো না। কারণ আমার বুঝা হয়ে গিয়েছে আমি যাওয়ার পর কেউ আমার বাচ্চার ঢাল হবে না। কেউ ওকে বুকে আগলে রাখবে না। ”
বলতে বলতে কান্না করে দেয় আনাস্তাসিয়া। রিকার্ডো বিচলিত হয়। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে আনাস্তাসিয়ার সামনে বসে। দু’হাতে আনাস্তাসিয়ার চোখের পানি মুছে দেয়। উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠে,
” ও পিশাচ না। ও তোমার অংশ। আর তোমার অংশ কখনো পিশাচ হতে পারে না। ওর ঢাল হিসেবে কাউকে প্রয়োজন নেই। রিকার্ডো আর আনাস্তাসিয়ার সন্তানের ঢাল হিসেবে কারো প্রয়োজন নেই। ও নিজেই নিজের ঢাল হবে। আর তোমরাও কিচ্ছু হবে না। আমি হতে দিবো না। ”
আনাস্তাসিয়া কথা বলতে পারে না। কাঁদতে থাকে। রিকার্ডো এবার আনাস্তাসিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়। বলে উঠে,
” শেষবারের মতো তোমার রিকের উপর ভরসা রাখো৷ আমি সবটা সামলে নিবো। ”
আনাস্তাসিয়া কথা বলতে পারে না। চুপচাপ কাঁদতে থাকে। আচমকা সে আহ বলে আর্তনাদ করে উঠে। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বিচলিত সুরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে নাসিয়া? খারাপ লাগছে? ”
আনাস্তাসিয়া কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে রিকার্ডোর হাত ধরে। তারপর তা আলতো করে নিজের পেটের উপর নিয়ে রাখে। রিকার্ডোর বিচলিত চোখজোড়া মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায় আচমকা। সে অনুভব করে আনাস্তাসিয়ার গাউন দ্বারা আবৃত পেটের ভেতর একটি প্রাণের নড়াচড়া। রিকার্ডো বাকরুদ্ধ হয়ে রয়। আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। রিকার্ডো হঠাৎ আলতো করে মাথা নামিয়ে আনাস্তাসিয়ার পেটে চুমু খায়। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” বাবাকে মাফ করে দিও। বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ”
বাচ্চাটা আবার কিছুটা নড়াচড়া করে। তা অনুভব করেই রিকার্ডো মৃদু হাসে। সোজা হয়ে বসে আনাস্তাসিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে। তারপর বলে উঠে,
” তোমাকেও ভালোবাসি অনেক। ”
মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৫+৬৬
আনাস্তাসিয়া কিছু না বলে দু’হাতে রিকার্ডোর গলা জড়িয়ে ধরে। এই দিনের এই মুহুর্তের অপেক্ষায়ই ছিলো সে। এখন মরে গেলেও আর কোনো আফসোস থাকবে না তার। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার মাথায় চুমু খেয়ে বলে উঠে,
” তোমাদের উপর আসা সকল বিপদ রিকার্ডোর বুকে এসে বিনাশ হোক। কোনো কালো ছাঁয়া তোমাদের ছোঁয়ার আগেই আমার হাতে তার মৃত্যু হোক। ”
