মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৯+৭০
নাফিসা তাবাসসুম খান
বাহিরে সূর্যের তীর্যক আলো ছড়িয়ে পড়তেই আনাস্তাসিয়ার ঘুম ভাঙে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই সে বেশ অবাক হয়। রিকার্ডো তার সামনেই বসে ছিলো। সাধারণত এই সময় রিকার্ডো প্রাসাদে থাকে না। তবে আজ কি করছে?
আনাস্তাসিয়ার ঘুম ভাঙতে দেখেই রিকার্ডো তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে। আনাস্তাসিয়া বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” তুমি এখনো প্রাসাদে? আজকে রাজধানীতে কোনো কাজ ছিলো না? ”
রিকার্ডো বলে,
” সকাল সকাল উঠেই সব কাজ শেষ করে এসে তোমার ঘুম থেকে উঠার অপেক্ষায় ছিলাম। ”
আনাস্তাসিয়া অবাক হয়। কিছু বলতে পারে না সে। আপাতত বেশ দূর্বল লাগছে তার। রিকার্ডো নিজেই প্রশ্ন করে,
” ক্ষিদে পেয়েছে? ”
আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। রিকার্ডো সাথে সাথে নিজের হাত পেতে দেয় আনাস্তাসিয়ার সামনে। আনাস্তাসিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিকার্ডো বলে,
” আজকে প্রতি প্রহরেই আহার হিসেবে তোমাকে আমার রক্ত পান করতে হবে। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” হঠাৎ আজ? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কারণ একটা চমক আছে। আপাতত কথা না বলে তুমি পান করো। ”
আনাস্তাসিয়া আর কথা না বলে চুপচাপ রিকার্ডোর হাত টেনে রক্ত পান করা শুরু করে। এভাবেও তার প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছিলো। রক্তপান শেষ হতেই রিকার্ডো বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আনাস্তাসিয়াকে কোলে তুলে নেয়। আনাস্তাসিয়া সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
” আজকে তোমার কি হয়েছে বলো তো? ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কথার জবাবে কেবল হাসে সামান্য। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনাস্তাসিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়৷ আনাস্তাসিয়া সামনে ফিরে আয়নার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় অনেকটা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চমকে রিকার্ডোর দিকে তাকায় তো আবার আয়নার দিকে।
ফ্যাকাসেভাব অনেকটা কমে এসেছে তার চেহারায়। শরীরও অনেকটা কম শুকনো লাগছে তুলনামূলক। আনাস্তাসিয়া বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” কিভাবে সম্ভব? ”
রিকার্ডো ফিসফিসিয়ে আনাস্তাসিয়ার কানে কানে বলে,
” তোমার স্বামীর রক্তের জাদু। ”
আনাস্তাসিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকার্ডো বলে উঠে,
” এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমরা একটা জায়গায় যাবো। ”
আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” এই অবস্থায় আমি কোথায় যাবো? ”
” সেটা গেলেই দেখতে পারবে। কিন্তু আপাতত তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ”
বলেই রিকার্ডো চলে যায় আনাস্তাসিয়ার জন্য নিজের পছন্দ মতো গাউন বের করতে। আনাস্তাসিয়া আজকে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। সাধারণত তো রিকার্ডো তাকে বিছানা ছেড়েও নামার অনুমতি দেয় না তাহলে আজকে তার কি হলো?
রাজসভার বাহিরে দাঁড়িয়ে ম্যাথিউ প্রধান সেনাপতি স্টেফেনের সাথে কথা বলছে। তাদের কথার প্রসঙ্গ হচ্ছে আজ সকালে ঘটে যাওয়া ঘটানা। আজ সকালেই রাজসভায় সকলের সামনে রিকার্ডো চারজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অবশ্য কারণ আছে। বেশ কয়েকমাস ধরেই ম্যাথিউ এই বিদ্রোহীদের খবরাখবর রাখছিলো। অবশেষে গতরাতে এই বিদ্রোহের ঘটনার পর সে গোপন সূত্রে জানতে পারে যে এসব বিদ্রোহীদের উস্কানোর পিছনে রাজ্যের উচ্চপদস্থ কিছু মন্ত্রীদের হাত রয়েছে। খবরটা সে সর্বপ্রথম রিকার্ডোর কানে দেয়। তাই আজ সকাল সকালই রিকার্ডো তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু ম্যাথিউর ভয় হচ্ছে অন্য জায়গায়। তার মনে হচ্ছে এই বিদ্রোহ এতো সহজে দমবে না। হয়তো এই বিদ্রোহে আরো কোনো মন্ত্রীরাও জড়িত। সুযোগ বুঝে তারা আবার প্রজাদের বিদ্রোহের জন্য উস্কে দিবে।
ম্যাথিউ চিন্তিত সুরে স্টেফেনকে বলে,
” প্রধান সেনাপতি, আমাদের এখন ভালো করে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। কাউকেই সন্দেহ তালিকার বাহিরে রাখা যাবে না। ”
স্টেফেন মাথা নেড়ে বলে,
” তা অবশ্যই। কিন্তু আমাদের কি একবার কাউন্টকে আমাদের এই সন্দেহের বিষয়ে জানানো উচিত না? ”
ম্যাথিউ বলে,
” ভাইকে আমি অবশ্যই সবার আগে জানাতাম। কিন্তু ভাই কাউন্টেস আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। পাশাপাশি রাজ্যের হাজারটা চিন্তাও উনার মাথায় ঘুরঘুর করছে। এসবের মাঝে উনাকে অযথা বিরক্ত করা অনুচিত হবে। তারচেয়ে ভালো আমরা চোখ কান খোলা রাখি। ”
স্টেফেন এবার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়৷ কোনো এক কারণে রিকার্ডোর প্রতি তার এক অদৃশ্য ভক্তি এবং বিশ্বস্ততা কাজ করে। যদিও সে কাউন্ট লোনেলের শাষণামল থেকেই প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে৷ কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে সেই সময় রাজ্যে কি হারে অপরাধের পরিমাণ বেড়েছিল। তার কানে প্রায়ই খবর আসতো প্রিন্স ড্রাগোসের করা অনেক অপরাধের খবর। কিন্তু স্টেফেন কখনো মুখ খুলে সেই বিষয়ে কিছু বলে নি। কিছু প্রতিবাদ করলে তার পরিণাম কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে ধারণা ছিলো বিধায়ই সে আর সাহস করে নি। অথচ তখন রাজ্য একজন মানুষের শাসনে ছিলো। অতঃপর একদিন সেই রাজার মৃত্যু ঘটলো। স্টেফেন ভাবলো এখন তার ছেলে সিংহাসনে বসবে। রাজ্য আরো রসাতলে যাবে। কিন্তু তখনই দেবদূত হয়ে আগমন হলো এক পিশাচের। যেই পিশাচ একজন যোগ্য কাউন্টের ন্যায় রাজ্য পরিচালনা করে চলেছেন। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহারও করেন নি। প্রজাদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এসবের সামনাসামনি সাক্ষী হলো স্টেফেন। তাইতো সে রিকার্ডোর জন্য নিজের জীবন দিতেও কখনো পিছুপা হবে না। মাঝে মধ্যে তার মনে হয় মানুষ রূপী পিশাচদের তুলনায় এই পিশাচ রূপী দেবদূতও ঢের ভালো।
রিকার্ডোর হাত ধরে ফিটন ছেড়ে সাবধানে নেমে আসে আনাস্তাসিয়া। সামনে তাকাতেই সে বেশ অবাক হয়। সে এই মুহুর্তে তুষ দূর্গের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিকার্ডোর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,
” এটাই ছিলো তোমার সেই বিশেষ জায়গা? ”
রিকার্ডো মাথা নেড়ে বলে,
” হ্যাঁ। কেন তুমি খুশি হও নি? ”
আনাস্তাসিয়া হালকা গলা ভিজিয়ে বলে,
” এতো বড় দূর্গে কেবল আমরা দুজন? ”
রিকার্ডো মজা করে প্রশ্ন করে,
” ভয় পাচ্ছো? ”
আনাস্তাসিয়া মুখ ছোট করে বলে,
” আমি কাউকে ভয় পাই না৷ কিন্তু তোমার এই দূর্গ দেখতে ভয়ংকর। আমার ছোট বাচ্চাটা যদি এখানে ভয় পায়? ”
রিকার্ডো হো হো করে হেসে উঠে। আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে। রিকার্ডো সাধারণত কখনো শব্দ করে হাসে না৷ তবে আজ কি হলো? নাকি সে নিজেই বেশি ভাবছে? রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার পেটে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
” কি বাবা? তুমি ভয় পাচ্ছো? ”
পেটের ভেতর থেকে কোনো নড়াচড়া অনুভব না করে রিকার্ডো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” আমার ছেলে ভীতু না বুঝলে? ”
আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” তুমি কিভাবে জানো ও ছেলে? ”
রিকার্ডো বলে,
” আমাদের বাপ ছেলের কথা তোমাকে কেন জানাবো? ”
” যদি ও মেয়ে হয় আর রাগ করে তোমার উপর? ”
” উহু। ও ছেলেই। আর ওর সাথে আমার একটা গভীর সম্পর্ক আছে না? ”
আনাস্তাসিয়া ভেঙচি কেটে বলে,
” বাহ! পেটে রাখবো আমি আর সম্পর্ক গভীর তোমার সাথে? তাহলে তোমার ছেলে তুমি রাখো পেটে। ”
রিকার্ডো একইভাবে আবার হেসে উঠে। এবার সে হাসতে হাসতে বলে,
” যথেষ্ট হয়েছে। এবার ভেতরে চলো। ”
আনাস্তাসিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
” যাবো না। ”
রিকার্ডো আর আনাস্তাসিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। তারপর বিদ্রুপ করে বলে উঠে,
” নাসিয়া যাবে। নাসিয়ার ছেলেও যাবে। ”
দূর্গের ভেতর প্রবেশ করতেই আরো অবাক হয় আনাস্তাসিয়া। কালো রঙের পাথরের তৈরি এই দূর্গকে আনাস্তাসিয়ার কাছে প্রেতাত্মাদের আস্তানা মনে হতো। কিন্তু এখন এই দূর্গ ভেতর থেকে বেশ রাজকীয় ভাবে সাজানো। যে কেউ দেখলেই তাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় লাগবে দেখতে। আনাস্তাসিয়াকে অবাক করে দিয়ে তার সামনে হঠাৎ জোসেফ এসে দাঁড়ায়। মাথা নত করে সে বলে উঠে,
” স্বাগতম কাউন্ট। স্বাগতম কাউন্টেস। ”
আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” তুমিও এখানে? ”
জোসেফ মাথা নত রেখেই বলে,
” জ্বি কাউন্টেস। ”
রিকার্ডো জোসেফকে প্রশ্ন করে,
” সব ঠিকঠাক? ”
জোসেফ বলে,
” জ্বি কাউন্ট৷ কেবল আপনাদের অপেক্ষায়ই ছিলাম। ”
” আচ্ছা। ”
বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। আনাস্তাসিয়া ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,
” কিসের অপেক্ষা? ”
” তা তুমি গেলেই দেখতে পাবে। ”
এটুকু বলে রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে হলরুমের দিকে এগিয়ে যায়। জোসেফ পিছন থেকে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হলরুমে প্রবেশ করতেই আনাস্তাসিয়া দেখে একজন লোক ছবি আঁকার সরঞ্জাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বেশ ক্লান্ত। তবুও রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়াকে দেখতেই তিনি মুখে সৌজন্যতার হাসি ফুটিয়ে তাদের স্বাগতম জানায়৷ রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
” নাসিয়া, ইনি হলেন বিখ্যাত চিত্রকর সেভাস্টিন ডি’ সোজা। ”
আনাস্তাসিয়া হেসে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। ”
লোকটিও হেসে কুশল বিনিময় করে রিকার্ডোকে বলে উঠে,
” আপনার অনুমতি থাকলে আমরা শুরু করি কাউন্ট? ”
রিকার্ডো জবাব দেয়,
” জ্বি অবশ্যই। ”
রিকার্ডো এগিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসে৷ আনাস্তাসিয়া তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
” তুমি তোমার চিত্র আঁকাবে? ”
” আমার একার নয়। আমাদের তিনজনের। ”
কথাটুকু বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে টেনে নিজের কোলে উরুর উপর বসিয়ে দেয়৷ আচমকা রিকার্ডোর এরকম কাণ্ডে আনাস্তাসিয়া লজ্জা পায় বেশ। সে মাথা নত করে নিচে তাকিয়ে থাকে। রিকার্ডো ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” লজ্জাটুকু আমার জন্য জমিয়ে রাখো। আপাতত সামনে তাকাও। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর কথা মানে। চুপচাপ চোখ তুলে এবার সে সামনের দিকে তাকায়। চিত্রকর সেভাস্টিন হাসিমুখে বিশাল কাগজে রঙ ব্যবহার শুরু করে। সর্বপ্রথমই সে আঁকে দু জোড়া অদ্ভুত সুন্দর চোখ। নীলকান্তমণি এবং সবুজনেত্র৷
চিত্রকর্ম মোটামুটি শেষ হতেই রিকার্ডো সেভাস্টিন নামক লোকটাকে পৌঁছে দেওয়ার আদেশ দেয় জোসেফকে৷ বাকিটুকু চিত্রকর্ম তিনি সম্পূর্ণ করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে পৌঁছে দিবেন৷ এতক্ষণ বসে থেকে আনাস্তাসিয়ার খুব পা ব্যাথা করছে। এভাবেও তার পায়ে কিছুটা পানি জমে ফুলে আছে। রিকার্ডো আর আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে হলরুমে অপেক্ষা করে না। তাকে কোলে তুলে নিজের কক্ষে নিয়ে আসে। আনাস্তাসিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রিকার্ডোও তার সামনে বসে পড়ে। নিজের হাত আনাস্তাসিয়ার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
” তোমায় দূর্বল দেখাচ্ছে। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর হাত ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়েও থেমে যায়৷ একবার চোখ তুলে সে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” তোমার কষ্ট হয়না রিক? ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
” হয়। প্রচুর কষ্ট হয়। যখন তুমি কষ্টে থাকো তখন। ”
আনাস্তাসিয়া এখনও রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে। রিকার্ডো অপর হাত এগিয়ে আনাস্তাসিয়ার গালে রাখে আলতো করে। তারপর বলে উঠে,
” আমার সকল বাসনা তোমায় জুড়ে,
আমার সকল বেদনা তোমায় ঘিরে। ”
আনাস্তাসিয়ার চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তা দেখে রিকার্ডো তা পরম যত্নে মুছে দিয়ে বলে,
” আমার ছেলে আর ছেলের মা আপাতত ক্ষুদার্ত। তাড়াতাড়ি রক্তপান করে আমায় উদ্ধার করো। ”
রিকার্ডোর কথা বলার ভঙ্গি দেখে আনাস্তাসিয়া হেসে দেয়৷ চুপচাপ সে রক্তপান শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ পর রক্তপান শেষ হতেই রিকার্ডো নিজের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আনাস্তাসিয়ার মুখ মুছে দেয়। মুখ মুছে রিকার্ডো উঠে যেতে নিলেই আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কোথায় যাচ্ছো? ”
রিকার্ডো হেসে উত্তর দেয়,
” কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ছেড়ে। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো আলমারির সামনে এগিয়ে যায়৷ আলমারির দরজা খুলে সেখান থেকে কিছু জিনিস হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বসে আনাস্তাসিয়ার সামনে। আনাস্তাসিয়া প্রথম কিছুক্ষণ জিনিসগুলোর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলেও পরে হঠাৎ তার মনে পড়ে এগুলো তারই জিনিস। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে রিকার্ডোর দিকে তাকায়। রিকার্ডো হেসে আনাস্তাসিয়াকে বলে,
” মেসিডোনিয়ায় আমাদের প্রথম তিন সাক্ষাৎ শেষে তোমার ভুলক্রমে ফেলে যাওয়া কিছু জিনিস। ”
আনাস্তাসিয়া একবার তলোয়ার তো একবার খঞ্জরটা তো আবার নিজের চুলের সেই সোনালী ফিতেটা ধরে দেখছে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তাদের সেই আকস্মিক সাক্ষাৎগুলো। তখন আনাস্তাসিয়া কখনো কল্পনাও করে নি একদিন তার এই স্বপ্ন পুরুষের সাথে সে চিরজীবনের জন্য বাধা পড়বে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আনাস্তাসিয়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। সেই হাসিমাখা মুখ লক্ষ্য করে রিকার্ডোর মুখের হাসিও চওড়া হয়। আচমকা আনাস্তাসিয়া নিজের হাতের তলোয়ার একপাশে রেখে রিকার্ডোর শার্ট ধরে কিছুটা নিজের দিকে টেনে তার অধরে অধর মিলিয়ে দেয়। রিকার্ডো চমকায় না উল্টো সে দু’হাতে আনাস্তাসিয়াকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয়। আনাস্তাসিয়া কিছু মুহুর্তের জন্য একটু সরে এসে রিকার্ডোর মতো ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” আমার জীবনে আসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় রিক। ”
রিকার্ডো একইভাবে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” আর আমার মতো অধমকে ভালোবাসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় জংলী বিড়াল। ”
রিকার্ডোর জংলী বিড়াল সম্বোধনে আনাস্তাসিয়া রাগ হয় না আজ। সে উল্টো হেসে আবার রিকার্ডোর দিকে এগিয়ে যায়।
মধ্যরাত। সম্পূর্ণ নির্জন ট্রান্সেলভেনিয়ার গহীনে এই নিস্তব্ধ তুষ দূর্গে কেবল রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়া ছাড়া আর একটা কাকপক্ষীও নেই। আনাস্তাসিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ অনেকক্ষণ হলো। রিকার্ডো বিছানার পাশে মেঝেতে বসে আনাস্তাসিয়ার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। এতো নির্জন এক দূর্গে থেকেও আনাস্তাসিয়ার ঘুমন্ত মুখশ্রী জুড়ে কোনো চিন্তা কিংবা ভয়ের ছাপ নেই। একদম শান্তশিষ্ট বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সে। আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে রিকার্ডোর বুক মোচড় দিয়ে উঠে। আজীবন তার নাসিয়া এভাবেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে তো?
খোলা বিশাল জানালা দিয়ে এখান থেকেই স্পষ্ট আকাশের অর্ধচন্দ্র দেখা যাচ্ছে। রিকার্ডো সেদিকে নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। চাঁদটাও কেন আজকে এরকম অর্ধ রূপ ধারণ করেছে? তবে প্রকৃতিও কি রিকার্ডোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে? আনাস্তাসিয়ার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সেই রাতে রিকার্ডোর অনুভব হচ্ছিলো সব কিছু সেদিন তার সাথে এক মিষ্টি ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়েছে। আজ আবার একই জিনিস অনুভব করছে রিকার্ডো। তবে আজ আর মিষ্টি ষড়যন্ত্র নয় বরং এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র।
রিকার্ডোর বুক প্রবলভাবে কাঁপছে। আচমকা এলোমেলো ভঙ্গিতে সে অনেকটা দূরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেক দিয়ে বসে। বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া ঝড় তার নিঃশব্দে চোখ দিয়ে ঝড়ছে। তার দৃষ্টি এখনো আনাস্তাসিয়ার দিকে নিবদ্ধ। শান্ত স্বরে সে বলে উঠে,
” আমার নাসিয়া। ”
রিকার্ডোর চোখ যেন তার বিপর্যস্ত অন্তরের দহনের জানান দিচ্ছে। সাথে সাথে সে হাঁটুর উপর রাখা দু’হাতের বাধনের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে। এত পুড়ছে কেন অন্তর? রিকার্ডো তো কখনো কাপুরষ ছিলো না। তাহলে আজকে কিসের ভয় তাকে এতো কাঁদাচ্ছে?
রিকার্ডো আজকে প্রথমবারের মতো ভ্যাম্পায়ার হওয়ায় আফসোস করছে। ভ্যাম্পায়ার না হয়ে সে যদি ভাগ্য দেবতা হতো তাহলে কতোই না ভালো হতো? সে নিজ হাতে নিজেদের ভাগ্য লিখতো। তার, আনাস্তাসিয়ার এবং তাদের সন্তানের। যেই ভাগ্যের রেখার সূচনা আছে কিন্তু বিচ্ছেদ নেই। বেদনার গুঞ্জন যেখানে কখনো হানা দিতে পারবে না।
রিকার্ডো মুখ তুলে আবার তাকায় আনাস্তাসিয়ার দিকে। তার ঘুমন্ত চোখ, মুখ, গাল একবার দেখে নিয়ে ডুব দেয় অতীতে।
মেসিডোনিয়ায় রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়ার প্রথম সাক্ষাতের পর এক গভীর রাতের নিশিকথা। আনাস্তাসিয়া তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিঃশব্দে তার কক্ষের জানালা খুলে কক্ষে প্রবেশ করে রিকার্ডো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সে আনাস্তাসিয়ার বিছানার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। কিছুক্ষণ দু নয়ন ভরে আনাস্তাসিয়াকে দেখে নিয়ে রিকার্ডো একহাতে তার মুখের উপর এসে থাকা অবাধ্য সোনালী চুলগুলোকে সড়িয়ে দেয়। উন্মুক্ত হয় আনাস্তাসিয়ার ঘাড়। দপদপ করে রগ লাফাচ্ছে সেখানে। রিকার্ডো আকর্ষণ অনুভব করে। কিছুটা ঘোর মেশানো দৃষ্টি মেলে সে আনাস্তাসিয়ার ঘাড়ের কাছে মুখ নেয়৷ উষ্ণ অধর ছোঁয়ায় সেখানে। পরক্ষণেই অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
” নাসিয়া। ”
ঘোর কাটতেই রিকার্ডো চলে আসতে চায়। কিন্তু উঠতে নিলেই সে অনুভব করে আনাস্তাসিয়া তার একহাত জড়িয়ে তার উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। রিকার্ডোর আর সড়তে ইচ্ছে করে না। সে সারারাত সেভাবেই আনাস্তাসিয়ার পাশে মেঝেতে বসে তার দিকে তাকিয়ে থেকেই রাত পার করে দেয়। ভোরের আলো ফুটার আগে রিকার্ডো বাধ্য হয়ে আনাস্তাসিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
আনাস্তাসিয়ার অস্পষ্ট শব্দে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে রিকার্ডো। সামনে তাকিয়ে দেখে আনাস্তাসিয়া পেটে হাত রেখে সামান্য নড়ে উঠেছে। ক্লান্ত পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে আনাস্তাসিয়ার পাশে বসে রিকার্ডো। আলতোভাবে তার পেট ছুঁয়ে দিতেই অনুভব করে কারো নড়াচড়া। রিকার্ডো ধীর স্বরে বলে উঠে,
” বাবা তোমাদের জন্য সব করতে পারি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার কাছে শ্রেষ্ঠ বাবা না হতে পারলেও, তুমি তোমার মায়ের কাছে শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়ে দেখাবে তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ”
কথাটুকু বলেই রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার পেটে চুমু খায় একটা। তারপর মাথা তুলে আনাস্তাসিয়ার কপালে, মুখে, ঠোঁটে সময় নিয়ে চুমু খায়। ভাগ্যিস অন্তসত্তা হওয়ার পর থেকে আনাস্তাসিয়ার ঘুম গভীর হয়েছে। তাই সে টের পায়নি। শেষবারের মতো রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” আমার বিষণ্ণ সুন্দর তাপস্যা,
এটাই আমার শেষ ছোঁয়া।
আমার নিশি রাতের আরাধ্যা,
আর কোনো জনমেই হবেনা পাওয়া। ”
আজকের সূর্যের তীর্যকতা অন্য দিনের তুলনায় অধিক মনে হচ্ছে। ম্যাথিউ চিন্তিত ভঙ্গিতে পা ফেলে রিকার্ডোর কক্ষের দিকে যাচ্ছে। আজ সকালে রাজসভায় রিকার্ডোর অনুপস্থিতি সবাইকেই বেশ অবাক করেছে। কাল থেকে এই পর্যন্ত একবারো রিকার্ডোর সাথে ম্যাথিউর দেখা হয়নি। কাল রিকার্ডোর কক্ষের সামনে গেলে প্রহরী তাকে জানিয়েছিলো কাউন্ট কাউকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে। তাই ম্যাথিউ আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলে নি। তার মনে হচ্ছিলো রিকার্ডো এবং আনাস্তাসিয়ার একান্তে কিছু সময় পার করা দরকার। কিন্তু কাল সারাদিন পেরিয়ে আজও যখন রিকার্ডো বা আনাস্তাসিয়া কারো দেখা মিললো না তখন ম্যাথিউর কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠে।
কক্ষের কাছাকাছি যেতেই আরোণের সাথে দেখা হয় ম্যাথিউর। আরোণ ক্যামেলিয়াকে কোলে নিয়ে হয়তো রিকার্ডোর কক্ষের দিকেই যাচ্ছিলো। ম্যাথিউকে দেখতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। ম্যাথিউ প্রশ্ন করে,
” তুমিও যাচ্ছো? ”
আরোণ মাথা নেড়ে বলে,
” হ্যাঁ। কাল থেকে একবারও অ্যানা ক্যামেলিয়াকে দেখার বায়না করে নি ভাবতেই অবাক লাগছে৷ তাই ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি ও কেমন আছে। ”
ম্যাথিউ বলে,
” চলো। ”
কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাথিউ প্রহরীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” আমরা কাউন্ট এবং কাউন্টেসের সাথে দেখা করতে চাই। ”
প্রহরী মাথা নত করে বলে উঠে,
” তা সম্ভব নয়। ”
ম্যাথিউ কণ্ঠে রাগের সুর মিলিয়ে বলে,
” কেন? ”
” কারণ কাউন্ট এবং কাউন্টেস প্রাসাদে নেই। ”
ম্যাথিউ এবং আরোণ অবাক হয়। আরোণ প্রশ্ন করে,
” প্রাসাদে নেই মানে? কোথায় গিয়েছে তারা? কখন গিয়েছে? ”
প্রহরী মাথা নত করে বলে উঠে,
” কালকেই তারা গিয়েছেন। আমাদের জানাতে নিষেধ করেছিলেন কাউন্ট। ”
ম্যাথিউ আর আরোণ অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এতো লুকোচুরি করে কোথায় গেলো ওরা? তাও আনাস্তাসিয়ার শরীরের এই অবস্থায়? পাশ থেকে আরেকজন প্রহরী ম্যাথিউর দিকে একটি খাম এগিয়ে দিয়ে বলে,
” কাউন্ট এটা আপনাকে দিতে বলেছেন। ”
খাম দেখে ম্যাথিউ এবং আরোণ দুজনের ভ্রু জোড়াই কুচকে উঠে। ম্যাথিউ কাঁপা কাঁপা হাতে খাম খুলে ভেতর থেকে চিঠি বের করে। চিঠির কাগজটা খুলতেই ম্যাথিউর শরীর তিরতির করে কাঁপতে থাকে। ম্যাথিউকে দেখে আরোণের ভয় করে। সে প্রশ্ন করে,
” কি লেখা আছে চিঠিতে? ”
ম্যাথিউ কোনো মতে জবাব দেয়,
” তুষ দূর্গে যেতে হবে আমাদের এই মুহুর্তে। ”
আরোণ ম্যাথিউকে হাত ধরে থামায়। বলে,
” দাঁড়াও। তুমি এই অবস্থায় বের হতে পারবে না। বাহিরে সূর্যের তাপ দেখেছো? ফিটন ছাড়া পৌঁছাতে পারবে না। ”
ম্যাথিউ রাগে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
” কিসের অপেক্ষা করছো? জলদি গিয়ে বলো ফিটন তৈরি করতে। ”
প্রহরী আদেশ পেতেই একপ্রকার ছুটে যায়৷ আরোণ নির্দিষ্ট করে জানে না কি হচ্ছে তবে এতটুকু আঁচ করতে পারছে বড় কোনো বিষয় ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। সে দ্রুত ম্যাথিউকে বলে,
” তুমি গিয়ে তাড়াতাড়ি ক্লক পড়ে নাও যাতে রোদ গায়ে না লাগে আমি গিয়ে হান্নাহকে ডেকে আনছি। অ্যানা ওখানে এভাবে। যদি কোনো প্রয়োজন হয়? ”
ম্যাথিউ মাথা নেড়ে দ্রুত চলে যায়। আরোণও তাড়াহুড়ো করে যায় হান্নাহর কাছে।
ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বসে আনাস্তাসিয়া। তার ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় দিনের প্রথম প্রহর শেষ হওয়ার পালা হয়ে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে বসেই আনাস্তাসিয়া চারিদিকে একবার চোখ বুলায়। তারপর আনমনে হেসে পেটের উপর হাত রেখে বলে,
” তোমার বাবা হয়তো আমাদের জন্য অন্য কোনো চমকের প্রস্তুতি নিতে গিয়েছে। এভাবেও কালকে থেকে আমাকে একটু পর পর চমকে দিচ্ছে। ”
কথাটুকু বলতে বলতেই আনাস্তাসিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। সাথে সাথে তার চোখ পড়ে বালিশের ভাজের পাশে গোল করে মোড়ানো একটি চিঠির দিকে। আনাস্তাসিয়া মুচকি হেসে বলে,
” বাহ! সকাল সকাল চিঠি? ”
কথাটুকু বলতে বলতেই আনাস্তাসিয়া হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয়। সাথে সাথে সে লক্ষ্য করে চিঠির পাশে একটি ছোট চিরকুটও আছে। আনাস্তাসিয়া সিদ্ধান্ত নেয় সে চিরকুটটা আগে খুলে পড়বে। তাই হাসি হাসি মুখে সে চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করে।
” এই চিঠি ভুলেও এখন পড়তে যাবে না। আমাদের সন্তান আসার পর কেবল এই চিঠি পড়বে তুমি। আমি চাইনা এই অবস্থায় তুমি কেঁদে তোমার শরীর আরো খারাপ করো। ”
ব্যস। এট্টুক কথা। কিন্তু আনাস্তাসিয়ার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। সে বার দুয়েক আবার পড়ে চিরকুটটা। কি এমন আছে এই চিঠিতে যে রিকার্ডো তাকে এটা এখন পড়তে নিষেধ করলো? ভাবতে ভাবতে আনাস্তাসিয়া চিঠিটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। জোরে জোরে ডাকতে থাকে রিকার্ডোর নাম ধরে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না৷
আনাস্তাসিয়া দরজা খুলে কক্ষ থেকে বের হয়। ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে ধরে সে এগিয়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। তার ব্যাকুল দৃষ্টি জোড়া খুঁজে চলেছে রিকার্ডোকে। নিচ তলায় নেমেও সব জায়গায় খুঁজে আনাস্তাসিয়া। কিন্তু রিকার্ডোকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আনাস্তাসিয়ার শরীর বেশ ক্লান্ত লাগছে। হাপিয়ে উঠেছে সে। দাঁড়িয়ে দু দণ্ড জোরে জোরে শ্বাস নেয় সে। পেটেও মৃদু ব্যাথা অনুভব করছে।
আনাস্তাসিয়ার হঠাৎ খেয়াল হয় হয়তো বাহিরে থাকতে পারে রিকার্ডো। এটা ভেবে আনাস্তাসিয়া ধীরে ধীরে প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসতেই এক চিলতে রোদ এসে পড়ে আনাস্তাসিয়ার মুখে। আনাস্তাসিয়া একহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। তারপর সময় নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকায় সে৷ আবার জোরে জোরে রিকার্ডোর নাম নিয়ে চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে ও। হঠাৎ আনাস্তাসিয়ার চোখ আটকে যায় দূর্গের আঙিনার ডান পাশে। রিকার্ডো ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে দেখতেই আনাস্তাসিয়ার ভ্রু কুচকে আসে। এই রোদের মধ্যে রিকার্ডো এভাবে কেন বেড়িয়েছে? ভাবতে ভাবতে আনাস্তাসিয়া জোরে ডাক দেয়,
” রিক? ”
রিকার্ডোর দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ৷ রোদের আলোয় ইতিমধ্যে তার হাত, মুখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আনাস্তাসিয়া আবার রিকার্ডোর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দূর্গের সিঁড়ি পেরিয়ে আঙিনার দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ আনাস্তাসিয়ার পা থমকে যায়। রিকার্ডো নিজের শার্টের বোতাম খুলছে এক এক করে। আনাস্তাসিয়ার মস্তিষ্ক মুহুর্তেই শূন্য হয়ে পড়ে। সে বুঝে উঠতে পারছে না সামনে কি হচ্ছে। আনাস্তাসিয়া যতক্ষণে বুঝতে পারে রিকার্ডো কি করতে চলেছে ততক্ষণে রিকার্ডো তার শার্ট খুলে একপাশে ফেলে দিয়েছে। আনাস্তাসিয়া তড়িৎ গতিতে দৌঁড়ে এগিয়ে যেতে নেয় রিকার্ডোর দিকে। কিন্তু তখনই তাকে কেউ একজন হাত ধরে বাঁধা দেয়। আনাস্তাসিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জোসেফ তার একহাত ধরে আছে৷ আনাস্তাসিয়া নিজের হাত ছাড়ানোর অপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। সে এবার চিৎকার করে বলতে থাকে,
” রিক! এমন করছো কেন? সরে আসো সেখান থেকে। তুমি রোদ সহ্য করতে পারো না। ”
রিকার্ডো খালি পায়ে দু কদম আরো রোদের দিকে এগিয়ে আসে। দু চোখ বুজে সে দু হাত মেলে সূর্যের উত্তাপ সহ্য করতে থাকে। ইতিমধ্যে সূর্যের তাপে তার সম্পূর্ণ শরীর থেকে একপ্রকার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আনাস্তাসিয়া আর্তনাদ করে। জোসেফকে অনুরোধের সুরে বলে উঠে,
” দয়া করে জোসেফ আমায় যেতে দাও। তোমার কাউন্টকে থামাতে হবে। ও সূর্যের উত্তাপ সহ্য করতে পারবে না। ”
জোসেফ নির্বাক ভঙ্গিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জোসেফের এরকম নির্লিপ্ততা দেখে আনাস্তাসিয়া আশাহত হয়। সে আবার রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে,
” রিক। আমাদের সন্তানের দোহাই লাগে তুমি এরকম করো না। ”
এতক্ষণ রিকার্ডো চোখ বুজে দাঁত খিচে সূর্যের তাপ সহ্য করছিলো। কারো ডাক কিংবা আর্তনাদ তার কানে পৌঁছাচ্ছিলো না। কিন্তু আচমকা আনাস্তাসিয়ার ডাকা রিক নামটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছায়। সে চোখ মেলে তাকায়।
আনাস্তাসিয়ার এতক্ষণের চিৎকার, আর্তনাদ সবকিছু রিকার্ডোর দৃষ্টি দেখে থেমে যায়৷ রিকার্ডো যতটা শক্ত মস্তিষ্কে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, আনাস্তাসিয়ার অশ্রুমাখা আকুতিভরা দৃষ্টি দেখে এখন তার হৃদয় ততটাই পুড়ছে। আনাস্তাসিয়া ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকার্ডোর দিকে। মৃদু বাতাসে রিকার্ডোর কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে। শান্ত, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনাস্তাসিয়ার দিকে। কিন্তু এই শান্ত দৃষ্টি চিড়ে আনাস্তাসিয়া দেখতে পায় এক মাতোয়ারা প্রেমিককে।
আনাস্তাসিয়া পা দিয়ে মাটি খুড়তে থাকে। রিকার্ডোর কাছে দৌঁড়ে যাওয়ার চেষ্টায় কাতর সে। তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে দেখতে পায় রিকার্ডোর সম্পূর্ণ দেহ আগুনের ফুলকির ন্যায় হয়ে যাচ্ছে। সকল চেষ্টায় ব্যর্থ আনাস্তাসিয়া এই দৃশ্য সইতে না পেরে চিৎকার করে বলতে থাকে,
” ঈশ্বর মেঘ দাও। বৃষ্টি দাও। আমার রিক পুড়ে যাচ্ছে। ”
আনাস্তাসিয়ার আহাজারি দেখে রিকার্ডোর বুক হু হু করে কেঁদে উঠে। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। কারণ এই মৃত্যুই হবে তার তরফ থেকে আনাস্তাসিয়া এবং তার সন্তানের জন্য উপহার। কথাটুকু ভাবতেই রিকার্ডোর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ফুটে উঠে।
দূর্গের দরজার বাহিরে আচমকা ঘোড়া এবং ফিটনের আওয়াজ পেতেই জোসেফ চমকে পিছনে তাকায়। এই সুযোগেই আনাস্তাসিয়া জোসেফকে ধাক্কা মেরে ফেলে দৌঁড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রোদ থাকলেও বাহিরে বাতাস আছে প্রচুর। বাতাসের দমকে আনাস্তাসিয়ার চুল উড়ছে। এতো ভারী শরীর নিয়ে সে স্বাভাবিক ভাবে এতো জোরে দৌঁড়াতে পারছে না৷ তবুও দৌঁড়াচ্ছে৷ দৌঁড়ে রিকার্ডোর কাছাকাছি আসতেই আনাস্তাসিয়া হাত বাড়িয়ে দেয় রিকার্ডোকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু যেই ছুঁতে যাবে সাথে সাথে দেখে রিকার্ডো আগুনের ফুলকির ন্যায় বাতাসে মিশে যাচ্ছে৷ আনাস্তাসিয়া ব্যাকুল হয়ে ডাকে,
” রিক। ”
না। তার সামনে কেউ নেই। এতক্ষণ তার সামনে যেখানে রিকার্ডো দাঁড়িয়ে ছিলো সেই জায়গাটা এখন শূন্য। আনাস্তাসিয়া ছুঁয়ে দেখার আগেই রিকার্ডো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। আনাস্তাসিয়া উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে চোখ বুলায়। কেউ নেই৷ আনাস্তাসিয়ার বুকে একদলা বেদনা সমুদ্রের ঢেউর ন্যায় আছড়ে পড়ে। আনাস্তাসিয়া আর্তনাদ করে উঠে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সে ডাকতে থাকে রিকার্ডোকে। কোথাও থেকে রিকার্ডোর জবাব পায় না সে।
ম্যাথিউ, আরোণ, হান্নাহ, ক্যামিলো, জোসেফ দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছে। ক্যামিলো ততক্ষণে কান্না করছে বসে। হান্নাহ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এইমাত্র চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ম্যাথিউ শব্দ করছে না তবে কাঁদছে। তার বুঝতে বাকি নেই সকালের ওই চিঠিতে রিকার্ডো কেন তাকে ক্যামিলোর খেয়াল রাখতে বলেছিল।
সামনে ওদেরকে দেখে আনাস্তাসিয়া উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসে তাদের দিকে। এসে সে সর্বপ্রথম আরোণের হাত ধরে বলে উঠে,
” ভাই? ভাই? রিক কোথায়? ও মাত্র আমার চোখের সামনে ছিলো। কোথায় ও? ”
আরোণ কোনো জবাব দিতে পারে না। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আনাস্তাসিয়ার দিকে। এই ব্যথা আরোণের নিত্যদিনের সঙ্গী। সে উপলব্ধি করতে পারছে আনাস্তাসিয়ার অবস্থা। আরোণের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আনাস্তাসিয়া ক্যামিলোর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
” মা? রিক? ও কোথায় গেলো? ”
ক্যামিলো কাঁদছে কেবল। কোনো জবাব দিতে পারে না। আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর সামনে গিয়ে তার হাত ধরে ঝাকিয়ে বলতে থাকে,
” ম্যাথিউ? তোমার ভাই? খুঁজো ওকে৷ রিককে খুঁজে এনে দাও। আমার রিক কোথায়? ”
কথাটুকু বলে আনাস্তাসিয়া আবার দূর্গের আঙিনার ডান পাশের দিকে ছুটে যায়। বাস্তব দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে সে৷ ঘুরতে ঘুরতে সে এবার কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না চারিদিকে। আনাস্তাসিয়া শেষ বারের মতো চিৎকার করে ডাকে রিকার্ডোকে। এরপর আর শব্দ করতে পারছে না সে। তার গলা স্তব্ধ হয়ে এসেছে চিৎকার করতে করতে। রিকার্ডো কিছুক্ষণ আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে আনাস্তাসিয়া। দু’হাতের মুঠোয় কিছুটা মাটি টেনে তুলে সে কাঁদতে কাঁদতে।
আনাস্তাসিয়াকে এই অবস্থায় দেখে হান্নাহ বিচলিত গলায় বলে উঠে,
” ওকে থামাও। এরকম করতে থাকলে ওর আর বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যাবে। ”
ম্যাথিউ আর ক্যামিলোও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তাই আরোণ নিজে এগিয়ে যায় আনাস্তাসিয়ার দিকে। আনাস্তাসিয়ার পাশে বসে সে হাত ধরে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। লাভ হয়না৷ আনাস্তাসিয়া আরোণকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” যাবো না। যাবো না। ”
আরোণ চাইলেও আনাস্তাসিয়াকে জোর করে টেনে তুলতে পারছে না। তাই সে নরম গলায় বলে,
” অ্যানা। এরকম করে না। বাচ্চাটার কথা ভাবো। ”
আনাস্তাসিয়া জবাব দেয় না। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আরোণ আবার আনাস্তাসিয়াকে তোলার জন্য হাত ধরতেই আনাস্তাসিয়া এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে আরোণের দিকে ক্ষুদ্ধ বাঘিনীর দৃষ্টিতে তাকায়। চিল্লিয়ে বলে উঠে,
” আমি বলেছি না আমি যাবো না? ”
আরোণ ভয় পায় কিছুটা। দিনের বেলায়ও আনাস্তাসিয়ার এরকম বিপর্যস্ত অবস্থা এবং ক্ষুদ্ধ রূপ দেখলে যে কেউ ভাববে তার উপর অশরীরী ভর করেছে৷ তাছাড়া তার গায়ের এই সাদা গাউন দেখে মনে হচ্ছে তার এই বিপর্যস্ত রূপকে পূর্ণতা দিতেই এটা পড়েছে আনাস্তাসিয়া। ম্যাথিউ দূর থেকে দেখে এই সম্পূর্ণ দৃশ্য। তার মনে পড়ে যায় সকালের লেখা সেই চিঠিতে রিকার্ডোর বলা আরেকটা কথা।
” আমার নাসিয়ার কোনো ক্ষতি হতে দিবি না। ও নিজের কোনো ক্ষতি যেন না করতে পারে সেই খেয়াল রাখবি। ”
ম্যাথিউ নিজের চোখ মুছে নেয়৷ সে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,
” আনাস্তাসিয়া উঠে দাঁড়াও। ”
আনাস্তাসিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে একইভাবে বসে কাঁদছে। ম্যাথিউ সাথে সাথে আনাস্তাসিয়ার একহাত ধরে একটানে তাকে দাঁড় করায়। আনাস্তাসিয়া আবার ক্ষুব্ধ হয়। রাগে সে ম্যাথিউর গালে একটা চড় বসায়। হিংস্র স্বরে ফোসফাস করতে করতে সে বলে উঠে,
” আমাকে কেউ ছুঁবে না। আমি রিকের। কোথাও যাবো না আমি৷ অপেক্ষা করবো। আমার রিক ফিরবে…”
কথাটুকু বলতে বলতে আনাস্তাসিয়া পেটে হাত রেখে আর্তনাদ করে উঠে। ম্যাথিউ, আরোণ দুজনেই চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? ”
আনাস্তাসিয়া জবাব দিতে পারে না। তার যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে। সে আরো জোরে আর্তনাদ করতে শুরু করে। ক্যামিলো, হান্নাহ, জোসেফ আনাস্তাসিয়ার কাছে এগিয়ে আসে দ্রুত। হান্নাহ বলে উঠে,
” কাউন্টেসকে দ্রুত কক্ষে নিয়ে যাও। ”
ম্যাথিউ আগ বাড়িয়ে আনাস্তাসিয়াকে ধরতে নিয়েও আর ধরে না। সে আরোণকে বলে যেন আনাস্তাসিয়াকে কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আরোণ সাথে সাথে আনাস্তাসিয়াকে পাজাকোলে তুলে দূর্গের ভেতর তার কক্ষে নিয়ে যায়। হান্নাহ জোসেফকে বলে গরম পানি এবং কিছু পরিষ্কার কাপড়ের ব্যবস্থা করতে। জোসেফ কিছুক্ষণের মধ্যেই সব নিয়ে ফিরে আসে। হান্নাহ সেগুলো নিয়ে কক্ষের ভেতর যেতে নিলেই জোসেফ পকেট থেকে একটি ছোট কাঠের বাক্স বের করে হান্নাহর হাতে দিয়ে বলে,
” আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হবে। ঠিক সূর্য গ্রহণের সময় এটা কাউন্টেসকে খাইয়ে দিবে। ”
আরোণ, ম্যাথিউ এবং হান্নাহ তিনজনের ভ্রুই কুচকে আসে। হান্নাহ প্রশ্ন করে,
” এর ভেতর কি আছে? ”
জোসেফ উত্তর দেয়,
” প্রতিকার। ”
সকলেই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে জোসেফের দিকে। কক্ষের ভেতর ক্যামিলো আনাস্তাসিয়ার সাথে আছে। জোসেফ নিজ থেকেই বলে উঠে,
” এর ভেতর ভ্যাম্পায়ারের মানুষ হওয়ার প্রতিকার রয়েছে। কাউন্টের রক্ত দিয়ে তৈরি এই প্রতিকার। কাউন্টের উৎসর্গের বিনিময়ে এই প্রতিকার কাজ করবে। ভ্যাম্পায়াররা মানুষ হতে পারবে। এর ভেতর যতটুকু প্রতিকার আছে সেটা ঠিক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় কাউন্টেস, কোভেন ক্যামিলো এবং কোভেন ম্যাথিউকে খাওয়াতে বলেছেন কাউন্ট। ”
সকলের কাছে এতক্ষণে স্পষ্ট হলো যে রিকার্ডো কেন নিজেকে উৎসর্গ করেছে। নিজের স্ত্রী, সন্তানকে বাঁচাতে। নিজের ভাই এবং মাকে আরেকবার মানুষ হওয়ার সুযোগ দিতে। ম্যাথিউ ব্যথিত সুরে বলে,
” ভাই আমাদের জন্য এতো বড় এক সিদ্ধান্ত নিলো? ”
জোসেফ বলে উঠে,
” কাউন্টের ত্যাগ কেউ বিফলে যেতে দিয়েন না। আপনারা সঠিক সময় এই প্রতিকার গ্রহণ করবেন দয়া করে। ”
হান্নাহ আর কোনো কথা না বলে কক্ষের ভেতর গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ম্যাথিউ দরজার বাহিরে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে। সে সম্পূর্ণ জীবন যাকে নিজের এই পিশাচ জীবনের জন্য দায়ী ভেবে ঘৃণা করলো সেই কিনা নিজেকে উৎসর্গের বিনিময়ে ম্যাথিউকে আবার স্বাভাবিক মানুষের জীবনে ফেরার সুযোগ করে দিলো? নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ম্যাথিউর। ঘোর অপরাধী! আরোণ ম্যাথিউর পাশে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিলো।
নিদারুণ যন্ত্রণায় আনাস্তাসিয়া কাতরাচ্ছে। সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসছে তার। ক্যামিলো তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আনাস্তাসিয়ার এক একটা চিৎকারে সম্পূর্ণ তুষ দূর্গ কেঁপে উঠছে। হান্নাহ বাধ্য হয়ে একটি কাপড় আনাস্তাসিয়ার মুখে গুজে দেয়। কারণ এভাবে চিৎকার করতে থাকলে আনাস্তাসিয়ার জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা আছে। আর জ্ঞান হারিয়ে ফেললে হান্নাহর জন্য দু’জনকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।
আচমকা হান্নাহ লক্ষ্য করে বাহিরে এতক্ষণ যে সূর্যের আলো ছিলো তা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। ভালো করে বুঝার জন্য সে জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পায় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহন শুরু হয়েছে। হান্নাহ সাথে সাথে দৌঁড়ে আসে আনাস্তাসিয়ার কাছে। সেই কাঠের বাক্স খুলতেই দেখতে পায় ভেতরে রয়েছে একটা ছোট কাঁচের শিশি। তার ভেতর লাল জাতীয় কিছু একটা পানীয়। হান্নাহ আনাস্তাসিয়ার মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে তাকে কোনো মতে সেখান থেকে কিছুটা পান করায়। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়ার চিৎকারের মাত্রা বাড়ে। ক্যামিলো ঘাবড়ে যায়। প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? ”
হান্নাহ ক্যামিলোর হাতে সেই শিশিটা দিয়ে বলে,
” আপনি বাহিরে যান। ম্যাথিউকে এটা পান করান এবং নিজেও পান করুন। জলদি যান। দেরি করবেন না। ”
ক্যামিলো কোনো কথা না বলে সেটা হাতে নিয়ে বের হয় কক্ষ থেকে। জোসেফ তাড়া দিয়ে বলে,
” পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি পান করুন। ”
প্রথমে ম্যাথিউ সেই প্রতিকার পান করে তারপর বাকিটা ক্যামিলো পান করে। পান করার সাথে সাথেই তাদের শরীরে অদ্ভুত রকম যন্ত্রণা শুরু হয়। দুজনেই ছটফট করতে থাকে। তাদের এই অবস্থা দেখে আরোণকে চিন্তিত দেখায়। আরোণকে উদ্দেশ্য করে জোসেফ বলে উঠে,
” সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
চাঁদ, সূর্য এবং পৃথিবী যখন একই অক্ষে একেবারে সঠিক জায়গায় এসে পৌঁছায়, তখন সূর্য পুরোপুরি ঢেকে যায়। তখনই মূলত সূর্যের পূর্ণগ্রাস হয়। যা প্রায় কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বাহিরে ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ম্যাথিউ এবং ক্যামিলোর শরীরের যন্ত্রণাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ঠিক সেই মুহুর্তে কক্ষের ভেতর হতে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। সম্পূর্ণ তুষ দূর্গের প্রতিটি দেয়াল যেন শিশুটির কান্নার শব্দে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। এই কান্না কি তার আগমন বার্তা নাকি মাতৃগর্ভে পিতা হারানোর কান্না তা কেউই বুঝতে পারছে না। ক্যামিলো এবং ম্যাথিউ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সকলেই মুখিয়ে আছে দরজার দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে হান্নাহ। কোলে তার ফুটফুটে একটা শিশু। হান্নাহর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সে ঠোঁটের কোণে এক দীর্ঘ হাসি এঁকে বলে উঠে,
” রোমানিয়ান সাম্রাজ্যে প্রিন্সের আগমন ঘটেছে। ”
আরোণ, ম্যাথিউ, ক্যামিলো, জোসেফ সকলেই অবাক দৃষ্টিতে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়তা কাটিয়ে ম্যাথিউ প্রশ্ন করে,
” কাউন্টেস আনাস্তাসিয়া? ”
হান্নাহ হাসি হাসি মুখে বলে,
” কাউন্ট রিকার্ডোর উৎসর্গ বিফলে যায়নি। কাউন্টেস জীবিত আছে। আর প্রিন্সও তার মায়ের মতো মানুষ হয়ে ভূমিষ্ট হয়েছেন। উনি ভ্যাম্পায়ার নন। ”
হান্নাহর কথা শুনতেই ম্যাথিউর খেয়াল হয়। সে সাথে সাথে নিজের চোয়ালের সূচালো দাঁত বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। ম্যাথিউ বিস্মিত। সে তীব্র বেগে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে স্বাভাবিক মানুষের গতি ছাড়া দৌঁড়াতে পারছে না। ম্যাথিউ বিস্মিত সুরে বলে উঠে,
” আমি মানুষে রূপান্তর হয়েছি? ”
ক্যামিলো এই দৃশ্য দেখে কেঁদে দেয়। আরোণ এবং জোসেফের চোখও ছলছল করছে। ম্যাথিউ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে। অস্ফুটে বলে উঠে,
” আমার ভাই আমার অভিশপ্ত জীবনের কারণ ছিলো না কখনো। কিন্তু আমার ভাই আমার অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির একমাত্র কারণ। ”
আজ সম্পূর্ণ সাত দিন হয়েছে রিকার্ডোর মৃত্যুর। এই সাতদিনে আনাস্তাসিয়া এবং তার সন্তানকে প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছে। রাজ্যে এখনো কিছু ঘোষণা করা হয়নি। কারণ আনাস্তাসিয়া এই সাতদিনে মুখ ফুটে কারো সাথে কথা বলে নি। কাঁদেও নি। চুপচাপ সারাক্ষণ অন্য এক জগতে হারিয়ে থাকে। রাজ্যের সকলকে রিকার্ডোর মৃত্যু সম্পর্কে জানাতে হলে আগে আনাস্তাসিয়াকে স্বাভাবিক হতে হবে। কারণ তাকেই সব সামলে নিতে হবে এখন। প্রজাদের সম্মুখীন করতে হবে।
ছেলেকে যখন প্রথম আনাস্তাসিয়ার কোলে দেওয়া হয় তখন ফ্যালফ্যাল করে আনাস্তাসিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সেই একই সবুজ নেত্র। একই গম্ভীরতা ছেলের মধ্যে দেখতে পায় সে। কেবল মাথার চুলগুলো আনাস্তাসিয়ার মতো পেয়েছে। সোনালী। ছেলেকে দেখে আনাস্তাসিয়া হালকা স্বরে বলেছিলো,
” ইয়ান আলবার্ট। ”
এই নামটা আনাস্তাসিয়া এবং রিকার্ডো মিলে ঠিক করেছিলো রিকার্ডোর মৃত্যুর আগের রাতে। নামের অর্থ তাদের দুজনের বেশ পছন্দ হয়েছিলো। ঈশ্বরের উপহার।
সেই থেকেই রাজ পরিবারের সবাই আনাস্তাসিয়া এবং রিকার্ডোর ছেলেকে প্রিন্স ইয়ান নামেই সম্বোধন করছে।
নিস্তব্ধ রাত। সবাই যে যার কক্ষে চলে গিয়েছে। ইয়ানও বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে ঘুমিয়ে পড়েছে। আনাস্তাসিয়া চুপচাপ শোয়া থেকে উঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে বের করে রিকার্ডোর দেওয়া সেই চিঠিটা। এই সাতদিন কেউ তাকে এক দণ্ডের জন্য একা ছাড়ছিলো না। তাই আনাস্তাসিয়া আর চিঠিটা পড়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু আজ সুযোগ পেতেই সে চিঠি নিয়ে বসে পড়লো। গোল করে মোড়ানো কাগজটা আনাস্তাসিয়ার চুলের সেই সোনালী ফিতে দিয়ে বাঁধা। আনাস্তাসিয়া ফিতের বাঁধনটা খুলে। ভেতরে বেশ কয়েকটি কাগজ একসাথে মোড়ানো। আনাস্তাসিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রমানুসারে প্রত্যেকটা পাতা পড়তে শুরু করে।
” নাসিয়া। আমার প্রিয়তমা, আমার স্ত্রী, আমার জংলী বিড়াল, আমার সন্তানের মা। মনে আছে একদিন এই আমি তোমাকে চিঠির শুরুতে প্রিয় লিখে সম্বোধন করবো নাকি তা নিয়ে কতটা সংশয়ের মাঝে ছিলাম? অথচ আজ দেখো কি নিঃসংকোচে আমি তোমায় নিজের বলে সম্বোধন করছি। নাসিয়া আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে এমন কোনো কাজই করি নি যার জন্য পুরষ্কার সরূপ তোমার মতো জীবনসঙ্গী পাবো। তবুও দেখো ঈশ্বর তোমাকে আমার প্রাপ্তির খাতায় তুলে দিলো। এর জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। তুমি আমার জীবনের সবথেকে সুন্দরতম সপ্ন। এই সপ্ন যেন কখনো না ভাঙে তার জন্য আমি চির নিদ্রায় সায়িত হতেও দ্বিমত পোষণ করবো না কখনো। আমি পিশাচের মতো তোমায় ঘৃণা দিয়েছি, তুমি তবুও আমায় ভালোবেসেছো। আমি অধমের মতো তোমায় মৃত্যদণ্ড দিয়েছি, তুমি তা সাদরে মাথা পেতে নিয়েছো। আমি যতবার তোমায় নিজ থেকে দূর করার হাজারো ফন্দি পরিকল্পনা করেছি, ততবারই তুমি আমার দিকে আরো কয়েক কদম এগিয়ে এসেছো। আমার তোমাকে দেওয়া প্রতিটা কষ্টের জন্য তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারলেও আমি কখনোই পারবো না নিজেকে ক্ষমা করতে। তোমাকে এতো কষ্ট দেওয়ার জন্য নিজের কাছেই ঘৃণিত আমি।
মেসিডোনিয়ায় তোমার সাথে তিনবার সাক্ষাতের পর যখন আমি ট্রান্সিলভেনিয়ায় ফিরে আসি তখন আমি বুকে একধরনের চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতাম। বারবার মনে হতো পিছনে খুব দামী কিছু ফেলে এসেছি৷ কিন্তু মনে মনে আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। ঠিক করেছিলাম কখনো পিছনে ফিরে তাকাবো না। ভেবেছিলাম আর কখনো আমাদের দেখা হবে না। কারণ আমাদের দুজনের পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু আমাদের দেখা হলো। অলৌকিকভাবে ঈশ্বর তোমাকে আমার অন্ধকার জগতে পৌঁছে দেয়। তোমাকে প্রথমবার নিজের দূর্গে দেখে আমার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়৷ আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। কিন্তু সেই হলরুমে উপস্থিত সকল ভ্যাম্পায়ারদের তোমার প্রতি লোলাপু দৃষ্টি দেখে আমি বিশ্বাস করি তুমি আমার সামনে। রাগ হয় আমার। ক্রোধে ফেটে পড়ি। তোমার সামনে একজন দাসের রক্তপান করি। তোমার ভীত দৃষ্টি আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলে। কিন্তু আমি বাধ্য ছিলাম। আমি চাইছিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করো। তুমি বা আমি কেউ কারো প্রতি দূর্বল তা অন্য কেউ টের পেলে বিপদ হতো। আর সেই সম্পূর্ণ বিপদ তোমার উপর দিয়ে যেতো।
তারপর দিন যখন হলরুমে সবার সামনে আমি তোমার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেই তখন আমার হৃদয়ে পাহাড় ধ্বসে পড়ার মতো যন্ত্রণা অনুভব করি আমি। আমার সামনে যখন তোমার গলায় দড়ি রাখা হয় তখন আমি অনুভব করছিলাম আমার গলা জ্বলছে। তোমার দৃষ্টির অনলে আমি জ্বলে যাচ্ছিলাম। সহ্য হচ্ছিলো না। তাই চোখ সরিয়ে ফেলি। কিন্তু সেদিন ঈশ্বর আমার মনের ডাক শুনে। ম্যাথিউকে আমার জন্য দেবদূত রূপে পাঠায়। ও বাঁচিয়ে দেয় আমাদের।
ভালোবাসা আমাকে প্রথমবারের মতো ভয়ের অনুভূতির সাথে পরিচয় করায়। তুমি যেদিন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলে সেদিন প্রথম বারের মতো আমি অনুভব করি আমি ভয় পাচ্ছি। তোমাকে হারানোর ভয়। জীবনে প্রথমবারের মতো সেদিন আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে আমি কি পরিমাণ যন্ত্রণা অনুভব করেছি তার একাংশও আমি তোমাকে এই চিঠিতে লিখে বুঝাতে পারবো না। বুঝাতে চাইও না। ”
এটুকু পড়তে পড়তে আনাস্তাসিয়ার চোখ জ্বলতে থাকে উত্তাপ অশ্রুতে। সে চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার পরের পাতা পড়া শুরু করে।
” আমি যেদিন বুঝতে পারলাম তুমি অন্তসত্তা সেদিন আমি এক জোতিষ্যীর কাছে গিয়েছিলাম। সেদিন তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। যেই অভিশাপের শুরু আমার জন্ম দিয়ে সেই অভিশাপের ইতি কেবল আমার হাতেই ঘটবে। সেদিন আমি সেই জোতিষ্যীর কথায় পাত্তা দেই নি। প্রাসাদে ফিরে আসি। বুকে পাথর রেখে তোমাকে বলি আমাদের সন্তানকে মেরে ফেলতে। সেই মুহূর্তে আমি কেবল তোমার কথা ভাবছিলাম। তোমাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় আমার মাথায় আসছিলো না। কিন্তু তুমি রাজি হও নি। আমাদের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তুমি আমাদের বাচ্চাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নাও। কিন্তু আমার মাথায় কেবল ঘুরছিলো তোমাকে বাঁচানোর চিন্তা। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে বাঁচাতে চাইতাম।
এর জন্যই আমি প্রায় রাতে সেই জোতিষ্যীর কাছে যেতাম। অবশেষে উপায় পাওয়া গেলো। ওরিয়নের দিয়ে যাওয়া সেই ডায়েরি যেটা রাজ জোতিষ্যী ভারতান লিখেছিলেন সেই ডায়েরিতে কিছু সংকেতিক চিত্র আঁকা ছিলো। সেসব দেখে জোতিষ্যী ফিলিক্স আমাকে জানান যে একমাত্র আমার নিজেকে উৎসর্গের মধ্য দিয়েই এই সকল অভিশাপ কাটবে। আমার রক্ত দিয়ে উনি একটি প্রতিকার তৈরি করেন। সেই প্রতিকার একজন ভ্যাম্পায়ারকে মানুষে রূপান্তর করতে সক্ষম। কিন্তু সেই প্রতিকারের কাজ করার বিনিময়ে তার প্রয়োজন উৎসর্গ। একমাত্র আমার উৎসর্গই পারবে আমাদের সন্তানকে ভ্যাম্পায়ার হওয়া থেকে বাঁচাতে। একমাত্র আমার উৎসর্গই পারবে মা এবং ম্যাথিউকে আবার মানুষের জীবন দিতে। একমাত্র আমার উৎসর্গই পারবে তোমাকে বাঁচাতে।
এই উৎসর্গে আমার কোনো ধরনের আফসোস নেই নাসিয়া। বরং আমি খুশি। আমার থেকে বেশি খুশি এই মুহুর্তে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমি নিশ্চিন্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারবো। কারণ আমি জানি আমার নাসিয়া সব সামলে নিবে। আমার সাম্রাজ্য, আমার পরিবার, আমার সন্তান সব সামলে নিতে পারবে। কিন্তু এতসব কিছুর মাঝে কেবল আমার একটা অনুরোধ রাখো। আমার নাসিয়াকেও সামলে নিও তুমি। যেই নীলকান্তমণির প্রেমে আমি মাতোয়ারা হয়েছিলাম সেই চোখের যত্ন নিও৷ যেই বাধনছাড়া হাসিতে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই হাসি কখনো মলিন হতে দিও না। যেই সাহসী, নির্ভীক নাসিয়া আমার হৃদয় জুড়ে বিচরণ করে তাকে কৃষ্ণ সাগরের অতলে হারিয়ে যেতে দিও না।
আমি যখন এই চিঠি লেখছি তখন তুমি ঘুমে বিভোর। তোমার ঘুমন্ত মায়া মাখা মুখখানা দেখে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে সময় থমকে যাক। তোমাকে দুচোখ ভরে আরেকটু দেখে নেই। কিন্তু আজকের রাত যেন অন্য দিনের তুলনায় খুব দ্রুত পার হচ্ছে৷ প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর। আমাদের একসাথের পথচলা এই পর্যন্তই ছিলো। বাকিটা পথ তোমাকে একা চলতে হবে।
নাসিয়া, আমার মায়াদেবী। তোমার প্রেমানল আমায় প্রতি মুহুর্তে দগ্ধ করেছে। কখনো তোমাকে পাওয়ার সুখে তো কখনো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার দুঃখে। আর এজন্যই আমি চাইবো আর কোনো জনমেই আমাদের দেখা না হোক। আমি চাইনা আর কোনো জনমে তুমি আমার অন্ধকার জগতের অংশ হয়ে আমার থেকে কেবল
কষ্ট পাও। কারণ তোমাকে দেওয়া কষ্ট আমায় প্রতি মুহুর্তে মৃত্যু যন্ত্রণা দেয়। এই জনমের ভালোবাসা দিয়ে আমি অনায়াসে বাকি সবগুলো জনম পার করে দিতে পারবো।
শেষবারের মতো বলছি, এপার ওপার সবখানেই রিকার্ডো কেবল আনাস্তাসিয়াকেই ভালোবাসে। ”
আনাস্তাসিয়া চিঠির পাতাগুলো কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয় একবার প্রাণভরে। তারপর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। তখনই আচমকা বাতাসে তার কক্ষের বারান্দার দরজা খুলে যায়। এক দমকা বাতাস এসে লাগে আনাস্তাসিয়ার গায়ে। কিন্তু সে থমকায় যখন সে শুনতে পায় রিকার্ডোর ডাক।
” নাসিয়া। ”
মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৭+৬৮
আনাস্তাসিয়া চমকে বারান্দার দিকে তাকায়। কেউ নেই। সে হাতের চিঠিগুলো রেখে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। তার ভ্রম হচ্ছে এই মুহুর্তে। মনে হচ্ছে রিকার্ডো তাকে ডাকছে। আনাস্তাসিয়া বারান্দায় পা রাখতেই আরেকবার শুনতে পায় রিকার্ডোর ডাক। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে বারান্দার রেলিঙের কাছে যায়৷ সে সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে আছে এই মুহুর্তে। বারান্দার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াতেই আনাস্তাসিয়ার মনে পড়ে যায় রিকার্ডোর সাথে পাড় করা সকল মুহুর্ত। তার মুখের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে দু’হাত মেলে সামনের দিকে ঝুঁকে। তার মনে হচ্ছে এখান থেকে একবার পড়ে গেলেই সে রিকার্ডোর কাছে যেতে পারবে। রিকার্ডো তার অপেক্ষা করছে।
