মহাপ্রয়াণ শেষ পর্ব

মহাপ্রয়াণ শেষ পর্ব
নাফিসা তাবাসসুম খান

আনাস্তাসিয়া আরেকটু সামনের দিকে ঝুঁকতে নিবে তখনই তার ভ্রম কাটে৷ আনাস্তাসিয়া চোখ কুচকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। প্রাসাদের বাহির দিকে তাকাতেই সে দেখে অসংখ্য প্রজা প্রাসাদের বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। সবার মুখে একটাই কথা,
” আমরা কাউন্টকে দেখতে চাই৷ ”
আনাস্তাসিয়া শান্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রয়। তখনই হন্তদন্ত হয়ে ম্যাথিউ কক্ষে প্রবেশ করে। আনাস্তাসিয়াকে প্রথমে কক্ষে না দেখে সামান্য ঘাবড়ে গেলেও ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে পায় আনাস্তাসিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাথিউ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বলে,

” অনুমতি ছাড়া কক্ষে প্রবেশের জন্য মার্জনা করবেন কাউন্টেস কিন্তু প্রজারা হয়তো কোনোভাবে জানতে পেরেছে কাউন্ট আর নেই। এই সুযোগে বিদ্রোহীরা তাদের আরো উস্কে দিয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা নিচে সব সামলে নিবো। আপনি কেবল আপনার এবং প্রিন্স ইয়ানের খেয়াল রাখুন। ”
আনাস্তাসিয়া কোনো জবাব দেয় না ম্যাথিউর কথার। কেবল হালকা করে মাথা নাড়ে। ম্যাথিউ কক্ষ থেকে প্রস্থান করতেই আনাস্তাসিয়া কক্ষের দিকে ফিরে তাকায়। ইয়ান বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আনাস্তাসিয়া ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে রিকার্ডোর দেওয়া চিঠিগুলো তুলে নেয়। সন্তপর্ণে সে একবার চিঠিগুলোয় চুমু খায়। তারপর রিকার্ডোর টেবিলের কাছে গিয়ে একটা কাঠের বাক্সে খুব যত্নে চিঠিগুলো রেখে দেয়।
কক্ষের একপাশেই একটি খাপে রিকার্ডোর তলোয়ার রাখা ছিলো। সেই খাপ থেকে তলোয়ার বের করে হাতে নেয় আনাস্তাসিয়া। তারপর বিছানার কাছে গিয়ে আরেক হাতে ইয়ানকে কোলে তুলে নেয়। চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রাসাদের প্রধান ফটক পেরিয়ে ইতিমধ্যে প্রজারা প্রাসাদের আঙিনায় প্রবেশ করেছে। সকলের মুখেই একটা কথা তারা কাউন্টকে দেখতে চায়৷ স্টেফেন পরিস্থিতি সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কিন্তু প্রজারা এতো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে তারা কোনো কথাই কানে তুলছে না। ম্যাথিউ এসে এরকম পরিস্থিতি দেখে স্টেফেনকে বলে,
” আমাদের এখন জানিয়ে দেওয়া উচিত হয়তো। ”
স্টেফেন জবাবে বলে,
” পরিস্থিতি এখন এতো বাজে যে আমরা এই বিষয় জানালে উল্টো সকলে আমাদের উপরে চড়াও হব। প্রশ্ন তুলবে কাউন্টের মৃত্যু সম্পর্কে আমরা কেন লুকিয়েছি। ”
তাদের কথার মধ্যে একজন বিদ্রোহী আগুনের মশাল হাতে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। চিৎকার করে বলে উঠে,
” বিশ্বাস হলো ভাইয়েরা? কাউন্ট রিকার্ডো আর জীবিত নেই৷ ওরা আমাদের থেকে এতো বড় সত্যি লুকিয়ে প্রতারণা করেছে। মারো ওদের সবাইকে। ”

স্টেফেন সেনাদের নিয়ে প্রজাদের দিকে এগিয়ে যায়। জোরে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” তোমাদের শেষ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে৷ ফিরে যাও সকলে। এখানে কেউ অস্ত্র তোলার ভুল করবে না৷ এর পরিণাম খারাপ হবে। রাজপ্রাসাদের আঙিনা আমি তোমাদের রক্তে নোংরা করতে চাই না। ”
প্রজারা স্টেফেনের কথা কানে তুলে না। আগুনের মশাল এবং বিভিন্ন অস্ত্র হাতে তারা এগিয়ে আসে। সাথে সাথে স্টেফেন এবং সকল সৈন্যরাও তলোয়ার বের করে। কিন্তু সেই মুহুর্তেই প্রাসাদের প্রধান দরজা দু’দিকে খুলে যায়। ম্যাথিউ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দেখে আনাস্তাসিয়া ইয়ানকে কোলে নিয়ে তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসছে। আনাস্তাসিয়াকে এই অবস্থায় এভাবে আসতে দেখে ম্যাথিউ ভয় পায়। অস্ফুটে বলে উঠে,
” আনাস্তাসিয়া? ”
আনাস্তাসিয়া কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে আর আঙিনায় নামে না। জোরালো স্বরে সে ডাকে,
” প্রধান সেনাপতি? ”

স্টেফেন সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা তুলে তাকায়। প্রজাদের সকলের দৃষ্টিও এখন আনাস্তাসিয়ার দিকে। সকলেই নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। আনাস্তাসিয়া চোখের ইশারা দিতেই স্টেফেন সৈন্যদের বলে তলোয়ার নামাতে। সাথে সাথে সকল সৈন্য তলোয়ার নামায় কিন্তু প্রজাদের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায় না তারা।
আনাস্তাসিয়া একবার শান্ত দৃষ্টিতে সকলকে পরখ করে নেয়। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” কাউন্ট রিকার্ডো আলবার্ট আর নেই। ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়া ইয়ানের মুখের দিকে একবার তাকায়। তারপর আবার মাথা সোজা করে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,

” আপনাদের সকলের নতুন কাউন্ট হবে আমার এবং কাউন্ট রিকার্ডোর সন্তান ইয়ান আলবার্ট। ”
প্রজাদের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করে উঠে,
” কাউন্ট রিকার্ডো কিভাবে মারা গেলেন? আর উনার মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়নি কেন? আর নতুন প্রিন্সের জন্মের সুখবরও সম্পূর্ণ রাজ্যে কেন ঘোষণা করা হয়নি? ”
বাকিরাও একইসাথে সুর মিলায়। আনাস্তাসিয়া শক্ত স্বরে বলে উঠে,
” আজ থেকে সাতদিন পূর্বে সূর্য গ্রহণের ঠিক আগ মুহুর্তে কাউন্ট রিকার্ডো নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। তিনি এই সাম্রাজ্যকে অভিশাপ মুক্ত করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আমার এবং আমাদের সন্তানের জীবন বাঁচাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ভ্যাম্পায়ারদের সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সেদিন সূর্য গ্রহণের সময়ই প্রিন্স ইয়ানের জন্ম হয়। আপনাদের জানানোর মতো পরিস্থিতি তখন ছিলো না বিধায় জানানো হয় নি। কিন্তু এজন্যই এখন এই মুহুর্তে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি৷ ”

একজন প্রজা প্রশ্ন করে,
” তারমানে ভ্যাম্পায়ারদের অস্তিত্ব আর নেই? প্রিন্স ইয়ানের শরীরে ভ্যাম্পায়ারের রক্ত নেই? ”
আনাস্তাসিয়া জবাব দেয়,
” না। ভ্যাম্পায়ারদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রিন্স ইয়ান ভ্যাম্পায়ার নয়। ”
আনাস্তাসিয়ার এক পাশেই সারি করে দাঁড়িয়ে ছিলো মন্ত্রীরা। এদের মধ্যে যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিলো তারা আনাস্তাসিয়ার এই কথা শুনে মনে সাহস পায়। একজন মন্ত্রী এগিয়ে এসে ঠাট্টার ছলে প্রজাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
” তারমানে আমাদের সাম্রাজ্য এখন পিশাচদের শাসন থেকে মুক্ত হলো। কিন্তু এখন আমাদের কাউন্ট হবে কে? এই শিশু? এখনো মায়ের দুগ্ধ পান করা শিশু কিনা গোটা রোমানিয়ান সাম্রাজ্য শাসন করবে? ”
এই কথাটা বলেই লোকটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তার সাথে তাল মিলিয়ে আরো কিছু মন্ত্রী এগিয়ে আসে। আরেকজন প্রজাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

” নাকি সাম্রাজ্য এখন একজন নারী চালাবে? আমার কাছে আরো ভালো প্রস্তাব আছে। কেননা কাউন্টেসকে আমি বিবাহ করে সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেই। এতে কাউন্টেসের কষ্ট কিছুটা কম হবে। ”
এটুকু বলেই আবার কয়েকজন মন্ত্রী একসাথে হাসিতে ফেটে পড়ে। ম্যাথিউর ক্রোধ হয়। রাগে তার মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে এগিয়ে আসতে নিলেই তখন একটা আকস্মিক ঘটনা ঘটে। আনাস্তাসিয়া হঠাৎ করেই পাশে ফিরে এক কোপে সেই মন্ত্রীর মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। সাথে সাথে রক্ত ছিটে এসে লাগে তার মুখে এবং সাদা গাউনে। মন্ত্রীর গলায় তলোয়ার চালানোর সময় আনাস্তাসিয়ার চোখে মুখে এক অদ্ভুত হিংস্রতা ফুটে উঠে। সেই হিংস্রতা দেখে উপস্থিত সকলেই ভয় পায়। ম্যাথিউর পা জোড়া থেমে যায়। সে আর সামনে আগাতে পারে না। আনাস্তাসিয়া চেঁচিয়ে সৈন্যদের ডাকে। বাকি যেই মন্ত্রীরা এতক্ষণ তাকে কটাক্ষ করে কথা বলছিলো তাদেরকে দেখিয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

” সবকটাকে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করো। এদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবে। কাল সকালে এদের সবগুলোর দেহ যেন কৃষ্ণ সাগরের অতলে থাকে৷ ”
মন্ত্রীগুলো ভীত হয়ে পড়ে। হাত জোর করে আনাস্তাসিয়ার সামনে ক্ষমা চাইতে থাকে। কিন্তু আনাস্তাসিয়া সেদিকে তোয়াক্কা করে না। সৈন্যরা তাদের টেনে হিচড়ে সেখান থেকে নিয়ে যায়। সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া ঘুরে সামনে প্রজাদের দিকে তাকায়। আনাস্তাসিয়াকে এই অবস্থায় দেখে প্রজাদের আত্মা কেঁপে উঠে। আনাস্তাসিয়ার মুখ অনেকটাই রক্তে ঢাকা। তার একহাতের তলোয়ারের মাথা বেয়ে টুপটুপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার পায়ের কাছেই পড়ে আছে এইমাত্র কাঁটা মন্ত্রীর গর্দান। আনাস্তাসিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” কারো কিছু বলার আছে আর? ”

কোনো প্রজা মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পায় না। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনায় সকলেই বেশ ভীত হয়ে পড়েছে। চারিদিকের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে আনাস্তাসিয়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে,
” আমি আনাস্তাসিয়া। জন্মেছি গ্রীকের এক ছোট দ্বীপে। বেড়ে উঠেছি আনাস্তাসিয়া অ্যালভেজ পরিচয়ে। গ্রীক হতে এই রোমানিয়ায় পৌঁছানোর যাত্রায় আমি আমার সম্পূর্ণ পরিচয় হারিয়েছি। সকলকে হারিয়ে এসে আমি রিকার্ডোকে পেয়েছি। আপনাদের ভাষ্যমতে সে একজন পিশাচ ছিলো। তাই তো? সেই পিশাচকে আমি ভালোবেসেছি। সকল নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এই বিবাহবন্ধনে আমি এক নতুন পরিচয় পেয়েছি। আনাস্তাসিয়া অ্যালভেজ থেকে আনাস্তাসিয়া আলবার্ট হয়েছি। কেবল কাউন্ট রিকার্ডোর স্ত্রী নই আমি। রোমানিয়ান সাম্রাজ্যের কাউন্টেসও। এটা সত্যি যে কাউন্ট রিকার্ডো আর নেই। কিন্তু আমি এখনো জীবিত আছি। আর আমি জীবিত থাকতে কেউ আমার সন্তানের দিকে চোখ তুলে তাকানোর দুঃসাহসিকতা দেখালে তার চোখ তুলে নিবো আমি। এই সিংহাসনের উপর কেবল প্রিন্স ইয়ান আলবার্টের অধিকার আছে। সে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নিজের সকল দায়িত্ব বুঝে নিতে পারবে সেদিন আমি নই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে কাউন্ট ইয়ান আলবার্ট। ”

এটুকু বলে আনাস্তাসিয়া শান্ত হয়। তার চোখেমুখে কোনো অস্থিরতা কিংবা ভয় নেই। সে নির্লিপ্ত। আনাস্তাসিয়ার কথার পিঠে আর কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। স্টেফেন সর্বপ্রথম তার এক হাঁটু গেড়ে বুকের বামপাশে একহাত রেখে বসে পড়ে। তার দেখাদেখি বাকি সৈন্যরাও একই কাজ করে। প্রজারাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তারাও মাথা নত করে। আনাস্তাসিয়া শীতল চোখে এবার ইয়ানের দিকে তাকায়। ইয়ানও আনাস্তাসিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আনাস্তাসিয়া আলতো করে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলে উঠে,
” ভয় নেই। রিকার্ডো আলবার্টের উৎসর্গের ফল তুমি। কোনো অশুভ শক্তি তোমাকে কখনো হারাতে পারবে না। ”

সাল ১৬৩৬,
এ বছর অন্যবছরের তুলনায় বেশি শীত পড়েছে। তীব্র তুষার পাতের ফলে সম্পূর্ণ রাজ্য যেন বরফের চাদরে ঢাকা পড়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউই ঘড় থেকে বের হচ্ছে না। একদম হাড় কাঁপানো শীত। এই শীত উপেক্ষা করেও আরোণ বেরিয়েছে বাসকোভ প্রাসাদ থেকে। গায়ে বেশ লম্বা ক্লক জড়িয়ে রেখেছে সে। গন্তব্য তার প্রিয় জায়গা। প্রিয় মানুষের কাছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আরোণ পৌঁছে যায় তার প্রিয় জায়গায়। ক্লকের হুড নামিয়ে সে চারিদিকে একবার চোখ বুলায়। একই জলপ্রপাত, একই পাহাড়, সেই একই ক্যামেলিয়া এবং জেসমিন ফুলের বাহার। সমভূমিতে বরফকুচি ভেদ করে ফুটে আছে অসংখ্য স্নো ড্রপ এবং ক্রোকাস ফুল। অতিরিক্ত কিছু থাকলে তা হচ্ছে ডাফনে, গ্লোরি অফ দ্যা স্নো এবং ভিওলা ফুলের সমারোহ। এসব ফুলগাছ আরোণ নিজে এনে এখানে লাগিয়েছে। এ জায়গাটাকে আরো মনোরম করে সাজানোর উদ্দেশ্যে।

আরোণ এগিয়ে গিয়ে ক্যাথরিনের কবরের পাশে বসে। বরফে আচ্ছাদিত ফলকটা একহাত বাড়িয়ে পরিষ্কার করে। তারপর আরাম করে বসে বলে,
” আমার কথা জানতে চাইবে না তবুও নিজ থেকে বলছি তুমি যেমন রেখে গিয়েছো তেমনই আছি। আজ একাই আসতে হলো কারণ ক্যামেলিয়া কাল রাতেই ঘোড়া নিয়ে বুখারেস্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। ওকে প্রাসাদ এবং এই জঙ্গলের মধ্যে বেঁধে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেরায় ও। কিন্তু আমার ভয়ও হয় এজন্য। কি করবো বলো? আমার শেষ সম্বল একমাত্র ও। ওকে আঁকড়েই তো টিকে আছি। ”
কথাটুকু বলে সামান্য হাসে আরোণ। বলে,

” গত পরশু তোমার মেয়ে কি করেছে জানো? নিজের প্রিয় খঞ্জর হারিয়ে ফেলেছিলো ও। আমার সম্পূর্ণ পালকে দিয়ে সারা সিবিউ অরণ্য তন্নতন্ন করে খুঁজিয়েছে। বলে হয়তো জঙ্গলেই কোথাও পড়ে গিয়েছে। সবাই যখন সম্পূর্ণ অরণ্য খুঁজেও কোথাও ওর খঞ্জর পেলো না তখন রাজকুমারীর মনে পড়লো ওর খঞ্জর তো ও বুখারেস্ট প্রাসাদে ওর কক্ষেই ফেলে এসেছে। পুরো পালের নাকে দম করার জন্য ও একাই যথেষ্ট। এতো কিছুর মধ্যে আমি বুঝতে পারি ও তোমার অভাব খুব অনুভব করে। আমি আমার সবটুকু ভালোবাসা ওকে দিয়েছি৷ কিন্তু আমি তো কখনো তোমার জায়গা নিতে পারবো না ওর জীবনে। তোমার অভাব কেবল আমাকে না ক্যামেলিয়াকেও পোড়ায়। কিন্তু কখনো প্রকাশ করে না ও। ”
মলিন মুখে কথাটুকু বলে আরোণ। তারপর একহাত মাথার নিচে দিয়ে বরফের উপর নিজের গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজে অনুভব করতে থাকে প্রতিটি তুষার কণা।

” ইয়ান কোথায় জোসেফ? ”
প্রশ্নটা শুনতেই কাচুমাচু করে জোসেফ। সে কিভাবে উত্তর দিবে যে ইয়ান তাকে না জানিয়েই প্রাসাদের বাহিরে চলে গিয়েছে? তবুও মিনমিনে স্বরে সে উত্তর দেয়,
” রাজমাতা। কাউন্ট তো রাজসভা শেষেই প্রধান সেনাপতি কেভের সাথে বেরিয়ে পড়েছে খবর পেয়েছি৷ ”
আনাস্তাসিয়া গরম চোখে তাকায় জোসেফের দিকে। তারপর রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করে,
” আর ইয়ান যখন কাউকে না জানিয়ে প্রাসাদের বাহিরে চলে যাচ্ছিলো তখন তুমি কোথায় ছিলে? ”
এই প্রশ্নের উত্তর জোসেফ দিতে পারে না। সে কিভাবে বলবে যে তখন তার প্রকৃতির ডাক এসেছিলো। জোসেফ মনে মনে রাগ হয় ইয়ানের উপর। সে সামনে থেকে এক মুহুর্তের জন্য আড়াল হয়েছে আর সাথে সাথে ইয়ান প্রাসাদ থেকে পালালো। আনাস্তাসিয়া আবার বলে উঠে,
” তোমাকে আমি বলি নি ইয়ান প্রাসাদ থেকে বের হলে সবার আগে আমাকে খবর দিবে? আর ছেলেটা একটা সৈন্যও সাথে নেয়নি। এখন আমি কিভাবে জানবো ও কোথায় আছে? ”
জোসেফ মনে মনে বলে,

” খা খা। আমার জীবনটা ত্যানাপ্যানা করে খা। পুরো জীবন তোর ভ্যাম্পায়ার বাপ আমার জীবন ত্যানাপ্যানা করেছে। তারপর তোর জংলী বিড়াল মা আমার জীবন ত্যানাপ্যানা করেছে। এখন তাদের ছেলে মহামান্য কাউন্ট আমার জীবন ত্যানাপ্যানা করে যাচ্ছে। এর থেকে তো ভালো ছিলো আমি ত্রিশ বছর আগে কৃষ্ণ সাগরে ডুব দিয়ে মরে যেতাম। ”
কথাটুকু ভাবতে ভাবতেই সেখানে ম্যাথিউ উপস্থিত হয়। হাসি হাসি মুখে বলে উঠে,
” চিন্তা করো না আনাস্তাসিয়া। ইয়ানকে নিয়ে অযথা চিন্তা করছো তুমি। ওকে এখনো বাচ্চা মনে করো তুমি তাই ভয় হচ্ছে৷ ”
ম্যাথিউকে দেখতেই জোসেফ সুযোগ বুঝে সেখান থেকে কেটে পড়ে। আনাস্তাসিয়া চিন্তিত সুরে বলে,

” ওকে আমি বাচ্চা মনে করি না ম্যাথিউ। ইয়ান কতটা সাহসী এবং যোগ্য কাউন্ট তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। আমি কেবল আশেপাশের কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। এই সাম্রাজ্যে বিশ্বাসঘাতক এবং প্রতারকের অভাব নেই৷ তুমিও তা ভালো করে জানো। এই জিনিসটা নিয়েই আমার ভয় হয়৷ ”
ম্যাথিউ আনাস্তাসিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
” চিন্তা করো না। ইয়ান বিচক্ষণ হয়েছে ভাইয়ের মতো। ও কাউকে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ দিবে না কখনো। ”
আনাস্তাসিয়া হেসে বলে,
” নাওমি কোথায়? সকাল থেকে আজ একবারো ওকে কোথাও দেখলাম না। ”
” কক্ষে আছে ও। জ্বর এসেছে কাল রাত থেকে। ”
আনাস্তাসিয়া চিন্তিত সুরে বলে উঠে,

” জ্বর এসেছে আমাকে জানাও নি কেন? চিকিৎসক এসে দেখে গিয়েছে ওকে? ”
ম্যাথিউ জবাব দেয়,
” মাঝরাতে শুধু শুধু তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি। চিকিৎসক এসে দেখে গিয়েছে। বলেছে আবহাওয়ার কারণে কেবল। সেড়ে যাবে। ”
” এখন ও একা আছে? ”
” না। স্যাফিরা ওর পাশে আছে। আমি সাধারণত জানতাম মেয়েরা পিতাভক্ত বেশি হয়। কিন্তু আমার বেলায় উল্টো ঘটলো। নাওমি আমার থেকে বেশি মা ভক্ত। ”
আনাস্তাসিয়া হেসে বলে,
” আমি এখন লঙ্গরখানায় যাচ্ছি। প্রাসাদে ফিরে নাওমিকে দেখতে আসবো। ”
ম্যাথিউ হেসে বলে,
” অবশ্যই। ”

আনাস্তাসিয়া প্রস্থান করে। ম্যাথিউ আনাস্তাসিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে জেদ ধরে যদি সে মায়ের কথায় আনাস্তাসিয়ার পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে না করতো তাহলে হয়তো এই পরিবারের সুখ গুলো তার কাছে কখনোই ধরা দিতো না। না পেত স্যাফিরার মতো এতো চমৎকার স্ত্রী আর না পেত নাওমিকে নিজের সন্তান হিসেবে।

গভীর জঙ্গলে ঘোড়ার হ্রেষা বেশ তীক্ষ্ণ শোনাচ্ছে। প্রধান সেনাপতি কেভ বলে উঠে,
” কাউন্ট সন্ধ্যা নেমে আসবে একটু পর। চলুন ফিরে যাই। ”
ইয়ান মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,
” তুমি কি ভয় পাচ্ছো কেভ? ”
কেভ জোরালো গলায় জবাব দেয়,
” এই ট্রান্সেলভেনিয়ার জঙ্গলে একা ঘুরে বেড়াতে তো যেকোনো মহাবীরও ভয় পাবে। সেখানে আমি তো সামান্য এক সেনাপতি। ”
ইয়ান ঘোড়া থামিয়ে বলে উঠে,
” তারমানে আমার বাবা একজন মহাবীর ছিলো। ”

কেভও ঘোড়া থামিয়ে কপালে ভাজ নিয়ে ইয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আপাতত এই জঙ্গলে ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। ইয়ানের কথার অর্থ তাই সে বুঝতে পারে না। ইয়ান নিজেই বলে উঠে,
” আমার বাবার জন্ম এই ট্রান্সিলভেনিয়ায়। পুরো জীবন তিনি এই জঙ্গলে একা ঘুরে বেড়িয়েছে। অথচ আমাকে দেখো। ট্রান্সিলভেনিয়ায় জন্মেও আমার এখানে আসার অনুমতি নেই। ”
কেভ বলে উঠে,
” ট্রান্সিলভেনিয়ায় অসংখ্য ভূত প্রেত বসবাস করে কাউন্ট। এজন্যই আপনার এখানে আসা নিষেধ। আমাদের উচিত এখনই ফিরে যাওয়া। ”
কেভের কথায় ইয়ান কিছুটা বিরক্ত হয়। চোখ কুচকে সে বলে উঠে,
” আমি যেই উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি তা পুরো হওয়ার আগে আমি ফিরবো না। ”
” আপনি বুঝতে… ”

কেভের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। গাছের ডাল নড়ার শব্দে ইয়ান এবং কেভ দুজনেই সতর্ক হয়ে যায়। তারা চোখ বুলিয়ে একবার চারিদিকে তাকায়। হঠাৎ একটা নেকড়ের ডাকের আওয়াজ কাছ থেকে ভেসে আসে। কেভ ভয়ে কিছু বলতে নিবে সাথে সাথে ইয়ান তাকে ইশারা করে চুপ থাকার জন্য। তখনই আচমকা তাদের সামনে একটি নেকড়ে এসে দাঁড়ায়। নেকড়েটা হিংস্র রক্তিম দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেভের জান যায় যায় অবস্থা হলেও ইয়ান বেশ স্বাভাবিক আছে। সে চোখ কুচকে বলে,
” ক্যামেলিয়া। তুই এখানেও চলে এলি? ”
সাথে সাথে নেকড়েটা হিংস্র গর্জন করে মানুষের রূপ ধারণ করে। নীল রঙের গাউন পড়া বাদামী চোখের ক্যামেলিয়া হেসে বলে উঠে,

” আমার প্রাণপ্রিয় ভাই আর তার একমাত্র গাধা যেখানে, আমিও সেখানে। ”
ক্যামেলিয়ার বলা কথা শুনে কেভ বলে উঠে,
” এখানে কি আমাকে গাধা বলা হলো? ”
ক্যামেলিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কেভের দিকে। তারপর বলে উঠে,
” আমাদের ভাই বোনের কথার মধ্যে বিরক্ত করবে না। ”
ইয়ান প্রশ্ন করে উঠে,
” তুই কিভাবে জানলি আমি এখানে? ”
ক্যামেলিয়া বলে উঠে,
” বুখারেস্ট প্রাসাদে গিয়েছিলাম। অ্যানার থেকে জানতে পারি তুই আজ সকাল থেকে গায়েব তোর গাধা নিয়ে। তাই অনুমান করি যে সম্পূর্ণ রোমানিয়ায় কোন জায়গার প্রতি তোর আগ্রহ সবথেকে বেশি। ব্যস! পরে এখানে পৌঁছে গেলাম। ”
ইয়ান বলে,

” এসেছিস। বেশ করেছিস। এখন এই গাধার সাথে তুই থাক। ও অনেক ভয় পাচ্ছে৷ আমি আরেকটু সামনে যাবো। ”
ক্যামেলিয়া মাথা নেড়ে বলে,
” তুই নিশ্চিন্তে যা। আমি আছি। ”
ইয়ান ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে সামনে চলে যায়। কেভ পিছন পিছন যেতে নিলেই ক্যামেলিয়া তাকে ধমকে উঠে,
” এই ছেলে! কোথায় যাচ্ছো? ”
কেভ পৃথিবীতে দুটো জিনিসকে বেশি ভয় পায়৷ এক হলো প্রেতাত্মাদের। এবং আরেক হলো এই নেকড়েদের লুনা ক্যামেলিয়া রদ্রিগেজকে। কেভ কিছু বলবে তার আগেই ক্যামেলিয়া বলে,
” নিজে চুপচাপ ঘোড়া থেকে নামবে নাকি আমি হেঁচড়ে টেনে নামাবো? ”
কেভ চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো নেমে যায়। এই মুহুর্তে সে প্রাণভয়ে ব্যকুল। ক্যামেলিয়া এবার কেভের সামনে এসে কমোরে হাত রেখে প্রশ্ন করে,

” এবার বলো। কি প্রশ্ন করছিলে? তোমাকে গাধা বলেছি নাকি তাই তো? ”
কেভ ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলে,
” দেখুন লুনা আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। আপনি যা ইচ্ছা আমাকে ডাকেন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে যেতে দেন। কাউন্ট একা একা গিয়েছে। যদি উনার সমস্যা হয় কোনো? ”
ক্যামেলিয়া শীতল দৃষ্টি মেলে কেভেরর দিকে তাকায়। তারপর এক পা দু পা করে কেভের দিকে এগোতে থাকে। কেভ ভয়ে পেছাতে পেছাতে এক গাছের সাথে গিয়ে ঠেকে। ক্যামেলিয়া একহাত কেভের পাশ দিয়ে নিয়ে গাছে ঠেক দিয়ে তার দিকে সামান্য ঝুঁকে। তারপর শান্ত স্বরে বলে,

” ইয়ান আলবার্ট নিজেকে ভালোই সামলাতে জানে। কিন্তু তুমি কি নিজেকে সামলাতে জানো প্রধান সেনাপতি? ”
কেভ ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সে বুঝে না তার থেকেও আট বছরের ছোট এই মেয়েকে ভয় পাওয়ার কি আছে? তখনই তার মনে পড়ে যে এই মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। নেকড়ে মানবী সে। কেভ কোনমতে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠে,
” আপনি অনেক কাছে এসে পড়েছেন লুনা। ”
ক্যামেলিয়া মৃদু হেসে রহস্যময়ী গলায় জবাব দেয়,
” আজ টের পেলে? ”

অবশেষে কৃষ্ণ সাগরের তীরে আসতে পেরে ইয়ানের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠে। এই জায়গা সম্পর্কে সে জোসেফের কাছে শুনেছে। তার বাবা তার মাকে ঠিক এখানে এনেই বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলো। ইয়ান একবার চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নেয়৷ সে জানেনা কেন জানি ট্রান্সিলভেনিয়ার বাতাসে সে তার বাবাকে অনুভব করতে পারে। এখানকার বাতাসেই তো তার বাবা মিশে আছে।
ইয়ান ঘোড়া থেকে নামে। কিছুটা এগিয়ে যায় তীরের দিকে। দু’হাত মেলে দিয়ে সে চোখ বুজে রয়। সমুদ্রের তীরে তীব্র বাতাস। এই বাতাসে ইয়ানের কপাল জুড়ে থাকা সোনালী চুলগুলো দুলছে। আচমকা পানির ঝাপটানোর শব্দে ইয়ান চোখ খুলে তাকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সে দেখে একটা অবয়ব সাতার কেটে তীরে আসছে। ইয়ানের ভ্রু কুচকে আসে। একেতো এতো ঠান্ডা। তার ওপর তীব্র বাতাস। এই অবস্থায় কে এখানে সাতার কাটতে আসবে? ইয়ান যতদূর জানে ট্রান্সিলভেনিয়ায় মানুষের বসবাস নেই। তাহলে এটা কে?

ইয়ান কিছুটা কৌতূহলি দৃষ্টি মেলে সামনে এগোয়। কাছাকাছি আসতেই সে দেখতে পারে একটা মেয়ে। কালো অর্ধ ছেড়া গাউন ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে একদম। কালো কোমর সমান লম্বা চুলগুলো চিকন চিকন অসংখ্য বেণী করে বাধা। মেয়েটা সামনে ইয়ানকে দেখতে পেয়েই ঘাবড়ে যায়। দু কদম পিছে পানির দিকে চলে যায় সে। ইয়ান এখনো মেয়েটার চোখে আটকে রয়েছে। কালো বড় বড় চোখে কি মেয়েটা কাজল দিয়ে রেখেছে? মেয়েটা ভীত গলায় প্রশ্ন করে,
” কে তুমি? ”
মেয়েটার কণ্ঠ শুনে আরো একবার ধাক্কা খায় ইয়ান। মেয়েটার কণ্ঠও সুমধুর। ইয়ান শান্ত গলায় বলে উঠে,
” এন্ড্রু। ”

সে ইচ্ছে করেই বানিয়ে একটা নাম বলে। অপরিচিত কাউকেই নিজের আসল নাম কিংবা পরিচয় সে জানায় না কখনো। সে চায় না অপরিচিত কেউ জানুক সে এই সাম্রাজ্যের কাউন্ট। মেয়েটাকে প্রশ্ন করে,
” তোমার নাম? ”
মেয়েটা ভীতসন্ত্রস্ত গলায় কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠে,
” মাহশা। ”
নামটা শুনে ইয়ানের ভ্রু কুচকে আসে। মেয়েটা নিজেই বলে উঠে,
” আমি তুরস্ক থেকে এসেছি। আমাকে অপহরণ করে অন্য দেশে নিয়ে যাচ্ছিলো সমুদ্র পথে। কিন্তু জাহাজ রোমানিয়ান সাম্রাজ্যের কাছাকাছি আসতেই আমি সুযোগ বুঝে সবার চোখের আড়ালে জাহাজ থেকে ঝাপিয়ে পড়ি নিজেকে বাঁচাতে। অনেক কষ্টে সাঁতরে এখানে এসে পৌঁছেছি। ”
ইয়ান বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে,
” তুমি মুসলিম? ”

মেয়েটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ইয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করে। ঠান্ডায় সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। ইয়ান নিজের গায়ের ক্লকটা খুলে মাহশার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
” এটা পড়ে নাও। আমাদের এখনই এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে। বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবেনা। ”
কথাটুকু বলে ইয়ান ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পিঠে চড়ে বসে। মেয়েটাও গায়ে সেই ক্লকটা জড়িয়ে এসে ঘোড়ার পাশে দাঁড়ায়। মাহশাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইয়ান শান্ত স্বরে বলে উঠে,
” আমাকে ভরসা করা যায়। তোমার ক্ষতি হবে না। ”
মাহশা ডাগর ডাগর চোখ মেলে কিছুক্ষণ ইয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত উঠিয়ে বলে উঠে,
” এটা দেওয়া যাবে? ”

ইয়ান মেয়েটার হাতের ইশারা লক্ষ্য করে দেখে তার গলার কালো কাপড়টার দিকে তাক করা। ইয়ান কোনো কথা না বলে কাপড়টা গলা থেকে খুলে মাহশার দিকে এগিয়ে দেয়। মাহশা কাপড়টা দিয়ে নিজের মাথা এবং বুক ভালো করে ঢেকে নেয়। নীরব দৃষ্টিতে তা দেখে ইয়ান। তারপর এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
” যাবে? ”

মাহশা মাথা নেড়ে একহাত বাড়িয়ে ইয়ানের হাতে রাখে। সাথে সাথে ইয়ান তাকে টেনে নিজের সামনে তুলে বসায়৷ মাহশা ঘাড় ঘুরিয়ে ইয়ানের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ইয়ানের চোখের রঙ সবুজ। এই জিনিসটা এতক্ষণ মাহশা লক্ষ্য করে নি। অথচ এই চোখের দিকে তাকিয়ে সে এইমাত্র একটা বিষয় আড়াল করলো। তা হলো নিজের আসল পরিচয়। অপরিচিত কাউকে নিজের পরিচয় জানানো মাহশারও নীতির বিরুদ্ধে পড়ে। তাই সে আর এই বিষয়ে কিছুই বলে নি। এসব ভাবতে ভাবতেই মাহশা দেখে সে অনেকক্ষণ ধরে ইয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। খেয়াল হতেই সাথে সাথে সে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। কোনো পুরুষের দিকে বেশিক্ষণ সময় বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকাও তার নীতির বিরুদ্ধে পড়ে। রোমানিয়ায় এক বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছে সে। সেই উদ্দেশ্যই আপাতত তার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু।

গভীর নিস্তব্ধ রাত। প্রাসাদের প্রতিটি মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু যে ঘুমায় নি সে হলো আনাস্তাসিয়া। নিজের কক্ষে তার আর রিকার্ডোর চিত্রের দিকে তাকিয়ে আছে সে। রিকার্ডো চিঠি পড়ার পর আজ পর্যন্ত আর কাঁদে নি সে। সাহসিকতার সাথে রিকার্ডোর সকল স্বপ্ন পূরণ করেছে। একাহাতে সব দায়িত্ব সামলেছে। কিন্তু এখন সে দায়িত্ব মুক্ত। আগের মতো এতো দায়িত্বের বোঝা তার কাধে নেই এখন। ইয়ান এখন কাউন্ট হয়েছে। সবকিছু সেই সামলায়।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৬৯+৭০

আনাস্তাসিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে রিকার্ডোর টেবিলের দিকে তাকায়। টেবিলের উপর রিকার্ডোর সেই বেহালাটা রাখা আছে। আনাস্তাসিয়া চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে বেহালাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে।
বারান্দার রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে রিকার্ডোর শেখানো সেই ধ্বনি বাজানো শুরু করে। বেহালার সুর এবং মাতাল হাওয়ায় সে অস্ফুটে বলে উঠে,
” তুমি না চাইলেও প্রত্যেক জনমেই আনাস্তাসিয়া কেবল রিকার্ডোকেই ভালোবাসবে। ”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here