মাই লাভ মাই লাইফ গল্পের লিংক || নাবিলা ইষ্ক

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১
নাবিলা ইষ্ক

আমার বড়ো ভাইয়ার বয়স একত্রিশ ছুঁইছুঁই। আমাদের ভাইবোনের মধ্যে এগারো বছরের ব্যবধান। আমি যদি হই ময়ূরপঙ্খী আমার ভাইয়া শেয়াল। ভীষণ মেজাজী মানুষ। আমাদের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধান সবদিক দিয়ে। আমি মায়ের মতন দেখতে হয়েছি। ভাইয়া হয়েছেন হুবহু বাবার মতন। আমরা দুটো ভাইবোন মাত্র। আগেপাছে আর ভাইবোন নেই। বাবার এই অত্যাধিক ধনসম্পত্তির আমরা দু’জন ভাগিদার মাত্র। বেশ আয়েশে আমার বড়ো হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি আমার এই পোড়া কপালের জন্য অর্থাৎ আমার এই বড়ো ভাইয়ের জন্য।

বাবার চেয়েও অতিমাত্রায় শাসনে বড়ো করেছেন। আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের চেয়ে তারই যেন মাথা ব্যথাটা বেশি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই বোধহয় আমার বাবা তৌফিক মোল্লা। কখনো একা স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারিনি। সাথে আমার বড়ো ভাইয়া থাকতেন। এরপর যখন নিউ টেনে উঠলাম, তখন একদিন বাবা জানালেন ভাইয়া শীঘ্রই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন পড়াশোনার জন্য। কী যে খুশি হয়েছিলাম! ভেবেছিলাম এই বুঝি আমি পাখির মতন উড়তে পারবো। আর কেউ আমাকে শাসনে অতিষ্ঠ করবে না। কিন্তু না, আমি ভুল। আমার ভাইয়া, সোহেব মোল্লা নিশু— আমার জন্য প্রাইভেট গাড়ি, প্রাইভেট ড্রাইভার গুঁছিয়ে রেখে গেছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার কথা আমি বাসা থেকে কলেজ যাবো, কলেজ থেকে বাসা—ব্যস, এতটুকু। এর আগেপিছে কোথাও যাওয়া যাবে না। আমি অবশ্য একবার ভেবেছিলাম, ভাইয়া ওই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে তো আর আমাকে দেখতে পারছেন না! লুকিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু ঘুরলে কীভাবে জানবে? সেই ভেবে একদিন বোকার মতন ঘুরতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমাকে কল দিয়ে আহাজারি শুরু করলেন। ভাইয়া নাকি তাকে ফোন করে শাসিয়েছে। তিনি যদি আমাকে গুছিয়ে, দেখেশুনে না রাখতে পারেন— তাহলে ভাইয়া দেশে ফিরে আসবেন যতটা দ্রুত সম্ভব। পড়াশোনার নাকি তিনি গুল্লি মার বেন। আমি কী ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম! বাসায় ফিরে শ্বাসও ফেলতে পারিনি ভাইয়া ভিডিও কল দিয়েছিলেন ল্যাপটপে। ল্যাপটপ স্ক্রিনের ওপাশে আমার ভাইয়া চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছিলেন। যেন কেউ তার কোটি টাকা মে রেছে। আমি তো তখন ভয়ে কাঁপছিলাম। ভাইয়ার নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকা আমাকে আরও ঘাবড়ে দিচ্ছিলো। ভীষণ ভয় পেতাম কি-না! এরপর ভাইয়া ভারী গম্ভীর গলায় বলেছিলেন,

‘দূরে আছি তাই আমি চাচ্ছি না তোকে বকাঝকা করতে, আদর। বুঝতে পেরেছিস? আমার অ্যাবসেন্সে ভদ্রভাবে থাক। একদম ওই বাজে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশবি না। ঘোরাফেরা যা করার করিয়েছি না? কক্সবাজার যেতে চাইছিলি, নিয়ে গিয়েছিলাম তো। সেন্টমার্টিন ঘুরতে চেয়েছিস, নিয়ে গিয়েছি। এইসব লোকাল এলাকা ঘোরার কী আছে? গাড়ি, ড্রাইভার তো আছে। চাচাকে বললেইতো ঘুরিয়ে আনে। আড্ডাবাজির ধান্দা বাদ দে। বাদবাকি যা ঘোরার জামাই নিয়ে ভবিষ্যতে ঘুরবি। তখন আটকাবো না। প্রয়োজনে টাকাপয়সা যা লাগবে দেব। বুঝেছিস?’
আমি ছলছল চোখে লক্ষ্মী মেয়েটির মতন মাথা দুলিয়েছিলাম।

ভাইয়াকে খুব বদমেজাজি, রাগী ভাবলেও —ভীষণ ভালোবাসতাম। আমার বাবা-মায়ের চেয়েও যেন ভাইয়া অনেক বড়ো কিছু। আমার বাবা বড়ো ব্যবসায়ী। বছরের তিনশো পয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশো দিনই তিনি কাজের জন্য বাড়ি থেকে দূরে থাকতেন। মাঝেমধ্যে দেশও ছাড়েন। আমার মা আফরোজা মজুমদার পেশায় একজন ডাক্তার। হৃদরোগের স্পেশালিষ্ট। তিনিও আমাদের দু-ভাইবোন রেখে কাজের জন্য ব্যস্তই থাকতেন সবসময়। আমি এই বড়ো ভাইয়ের ছায়ার তলাতেই বড়ো হয়েছি। এরজন্যই হয়তোবা আমার ভাইয়ার প্রতিই বেশি মায়া। ভাইয়া রাগ করে চোখমুখ অন্ধকার করে রাখলে আমার খারাপ লাগতো। আমি জানি তিনিও আমায় খুব ভালোবাসেন, আদরে রাখেন। শুধু ওই একটু অতিমাত্রায় শাসন করেন। বাবার থেকে শুনেছিলাম আমার ডাক নামটা ভাইয়া নিজে রেখেছিলেন। বাবা যখন ছোটো নিশু ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

‘ছোটোবোনকে কী বলে ডাকতে চাও, বাবা?’
ভাইয়া নাকি খুব উল্লাস করে বলেছিলেন, ‘আদর। ওকে আদর বলে ডাকবো। আমার আদুরে বোন।’
তখন থেকে আমার নাম আদর। আদর নাম দেওয়া আমার নিশু ভাইয়া..অন্যভাবে বলতে গেলে আমার জম শীঘ্রই দেশে ফিরছেন। ফেরার বড়ো একটি কারণ আছে। ভাইয়ার বিয়ে। আমার বাবা তৌফিক মোল্লা ভাইয়ার বিয়ের আয়োজন ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন বেশ আয়োজনের সাথে। পাত্রী আমার বাবার বন্ধু, শামসুল খানের ছোটো মেয়ে। অন্যভাবেও আরেকটা পরিচয় দেয়া যায়। আমার ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছোটোবোন। শুনে আমি তো দারুণ আশ্চর্য হয়েছিলাম। আশ্চর্য না হয়ে উপায় আছে বলুন? ভাইয়া কি-না নিজের বন্ধুর ছোটোবোনকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন? সবসময়ইতো অহনা আপুকে দেখলেই ধমকাতেন, বকতেন।

একদিন তো চড়ও মেরেছিলেন। নিজের বোনের মতো —আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ওই অহনা আপুকেও বড্ড শাসন করেছিলেন। দিনশেষে তাকেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন? আজব তো। আর ভাইয়ার বন্ধু, ওই তাশরিক খান —উনি কীভাবে রাজি হলেন? আমার ভাইয়ার এই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে, তাশরিক ভাইয়াকে নিয়ে আমার আসলেই বলার মতন ভাষা জানা নেই। এই ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে গুনেগুনে এসেছেন। তাও আমার অনুপস্থিতিতে। আমার সাথে তার দেখাসাক্ষাৎও হাতেগোনা মাত্র। এই ধরুন কোনো অনুষ্ঠান অথবা দাওয়াতে দু-পরিবারের সাক্ষাতেই যা একটু দেখা হতো। তবে আমার না কিছু ধারণা আছে উনাকে নিয়ে।

লোকটা একটু প্ল্যাবয় ধাঁচের বলেই আমার মনে হয়। তবে তেমন কিছু চোখে পড়েনি বা শুনিওনি। তাও আমার তাকে প্ল্যাবয় বলেই মনে হয়। চালচলন, কথাবার্তায় একটা বেয়ারা ভাব আছে। ছন্নছাড়া, অগোছালো তবে দেখতে ভারী সুদর্শন। উনার মায়ের মতন গায়ের রং, চেহারার গড়ন পেয়েছেন। আমি তো চোখ তুলে কখনো সেভাবে তাকাতে পারিনি। ফটো দেখে যতটুকু বুঝতে পেরেছি। লোকটা এতো দাম্ভিক একটা ভাব রাখেন মনে হয় যে একেবারে কী না কী একটা এই দেশের। অবশ্য ভাগ্য ভালো তিনি শামসুল খানের বড়ো ছেলে। শামসুল খান এই দেশের একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। বিত্তশালী বাপের বড়ো ছেলে বলে কথা। বেয়ারা না হয়ে উপায় আছে? ভাইয়ার সাথে নিশ্চয়ই এই লোকও ফিরছেন? দুজনে তো একসাথেই গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। তার ওপর দু’পরিবারের মধ্যে এতো বড়ো একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। সম্ভবত এবার থেকে আমাদের অনেক দেখাসাক্ষাৎ হবে। এতে আমি একটু বিচলিত। এরও কারণ আছে। কারণটা…..

‘মামণি, এদিকে আসো। ওখানে জুবুথুবু মেরে বসে দিনদুনিয়া ভুলে মুরব্বিদের মতন মুখ করে ওত কী ভাবছো শুনি? আসো বাবাকে খুলে বলো।’
বাবা বা’পাশের সোফায় গা এলিয়ে বসেছেন। এখনো ফর্মাল গেটাপে আছেন। অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছেন। বেশ ক্লান্ত লাগছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম চটপট। কোলে থাকা বইটা মেঝেতে পড়লো শব্দ করে। বইটা তুলে সোফায় রেখে এগিয়ে গেলাম। চোখমুখ ছোটো করে বাবার পাশে বসে বললাম,
‘আমাকে তুমি মুরব্বি ডাকলে?’

আমি যেন হাসির কিছু বললাম। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,
‘ওমন গম্ভীরমুখে বসেছিলে বলেইতো বললাম। কী ভাবছিলে তা বলো! কথা ঘুরিও না। এতো কীসের ভাবনা তোমার? কীসের কমতি রেখেছি? নাকি একটা রাজকুমার এনে দেবো?’
আমার বয়স এখন মাত্র বিশ। এই বয়সে রাজকুমার? ও মাই গড! বাবা কী আমার জন্য ছেলে দেখছেন? আমি চোখ বড়ো বড়ো করে চাইতেই বাবা আরও জোরে হাসলেন,
‘না না, ভুল ভাবছো তুমি মামণি। এতো দ্রুতো ছেলেটেলে দেখছি না। আমার একটামাত্র মেয়ে তুমি। এমন দ্রুতো বিয়ে দেয়ার কথা কীভাবে ভাবি? দেরি আছে।’
যাক, শান্তি পেলাম। স্বস্তি নিয়ে বললাম, ‘ভাইয়ার বিয়ের কথা ভাবছিলাম। ভাইয়া আগামীকাল আসছে তো? কখন আসবেন?’

‘বলল তো বিকেলের দিকে চলে আসবে। গাড়িটাড়ি পাঠাতে নিষেধ করল। ওর সাথে তাশরিক সহ আরও বন্ধুরা আছে। ওরা ঘুরেফিরে বাসায় ফিরবে সম্ভবত। বেশ রাত হবে। আগামীকাল তোমার ফুপু-চাচ্চুরাও আসছে। তোমার সব কাজিনরাও।’

কাজিনদের মধ্যে আমার কমবেশ সবার সাথেই সখ্যতা আছে। বিশেষ করে আমার বড়ো চাচার ছোটো মেয়ের সাথে। আমার বাবারা ছয় ভাইবোন। তিন বোন, তিন ভাই। আমার বাবা মেজো। বড়ো চাচা, আর ছোটো চাচা খুলনা থাকে। আমাদের গ্রামের বাড়ি খুলনা। ফুপুদের বিয়েও হয়েছে সবার খুলনাতে। ভাইবোনের মধ্য শুধু আমার বাবাই ঢাকায়। আমার, এবং আমার ভাইয়ের জন্মও ঢাকায়। সেক্ষেত্রে চাচা-ফুপুদের সাথে বছরে দু-একবার দেখা হয় মাত্র। এবারে সবাই একসাথে হবো। কাজিনরা একসাথে হবো, আড্ডা দেবো, আনন্দ করবো —ভাবতেই আমার ভেতরে এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে।

আমাদের কাজিনদের একটা ইতোপূর্বে মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিলো। তবে গত পরশু নতুন একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে। গ্রুপের নাম ‘নিশু ভাইয়ার বিবাহের আয়োজন।’ এই গ্রুপে আমরা সব কাজিনরা আছি। অহনা আপুকেও আজ সকালে অ্যাড করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ ভাবী বলে কথা! বেশ আড্ডা হচ্ছে এখনো। সুফিয়া কিছুক্ষণ পরপর সবাইকে ডেকে ডেকে নোট করছে, পছন্দের-অপছন্দের রং নিয়ে। একটা রং ফাইনাল করা হবে এনগেজমেন্টের জন্য। আমার মনে হয়, আমাদের সবার ওইদিন কালো পরা উচিত। ভাইয়া-আর ভাবী পরবেন সাদা। পারফেক্ট কম্বিনেশন। আমি আমার ভাবনা বলতেই হৈচৈ পরে গেল গ্রুপে। আমার মতামত সবার পছন্দ হয়েছে। এমনকি কম কথা বলা আমার বড়ো চাচার মেয়ে রুমিও সংক্ষিপ্ত করে মেসেজ করল,

‘Darun combination hobe. Let’s try it guys. adorer ta final kor please.’
আমি আত্মহারা তখন। বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে এনগেজমেন্ট নিয়ে আরও ভাবনা জাহির করতে থাকলাম। বেশ আলোচনা চলছিলো। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম গ্রুপে এক নতুন সদস্যকে যোগ করা হয়েছে। তাশরিক খান! আমি কেমন যেন স্তব্ধ হলাম। হওয়ার কারণটা একটু অদ্ভুৎ। ঠিক কী অদ্ভুৎ তা এখনো ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছি না। তবে তার নাম, তার কোনো কিছুর সম্পর্কে কিছু শুনলেই আমার বেশ অদ্ভুত লাগে।

অথচ লাগার কারণ মাত্র নেই। আমাদের দেখা হয়েছেই বা কদিন? তারপরও আমার কাছে কিছু একটা কেন যেন ঘাপলা লাগে। আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে এমন মনে হয়। ওই লোকতো ভাইয়ার বয়সী। আমার চেয়ে কতো বড়ো! আমি কখনো উনাকে ভালোভাবে সামনাসামনি দেখিনি অবধি। তাহলে এতো অস্থিরতা কেনো? আমার এতো আনন্দ, উচ্ছ্বাস মুহূর্তে ম্লান হলো। তার মানে আমাদের এখন থেকে অনেক দেখা হবে। অনেক।

মাই লাভ, মাই লাইফ পর্ব ২