মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১০
নাবিলা ইষ্ক
আমাদের জীবনে কিছু কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা থাকে। যা সারাজীবন মনে রয়। এটাও বোধহয় আমার জীবনে ঘটা অন্যতম আশ্চর্যের একটি। যা আমার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ সময় মনে থাকবে। আমার ভয়, চিন্তা—অস্বস্তি সব যেন এযাত্রায় কারণ ব্যতীত মনে হলো। কারণ তাশরিক ভাইয়া আমাকে কিচ্ছু বললেন না। কিচ্ছু না। চুপচাপ সামনে চেয়ে শুধু ড্রাইভ করে গেলেন। এমনকি আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাননি অবধি। এতে শুধু যে আমি আশ্চর্য হয়েছি তা নয়। আমি—আমি কোনো না কোনো ভাবে আহত হয়েছি। আমার কেমন যেন লাগছিলো। যা আমি ভাষায় বিশ্লেষণ করতে পারছিলাম না। গাড়িটা নীরবে এসে থামল খান বাড়ির ভেতরে। তখনো উনি চুপ করে থাকলেন। আমি নামলাম জুবুথুবু হয়ে। গাড়িটা টান দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম বাগানের সামনে দিয়ে যাওয়া সরু রাস্তাটায়। কানে ভেসে এলো সুফিয়ার ডাক। আয়োজন করা হয়েছে বাগানের পাশে। ইতোমধ্যে মেহেদি পরানো শুরু হয়েছে। গান বাজছে মৃদু আওয়াজে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে এগুলাম তাদের দিকে। অহনা আপু বসে আছেন কোলে বালিশ নিয়ে। তার দু-হাতে দু’জন আর্টিস্ট মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। অহনা আপু আমাকে ডাকলেন,
‘আমার পাশে এসে বোস। এদিকে আয়।’
আমি গিয়ে বসলাম আপুর পাশে। আপু মাথাটা কাছে এনে কানে ফিসফিস করে বললেন,
‘মুখটা এমন হয়ে আছে কেনো? ভাইয়া বকেছেন তোকে?’
আমি মাথা নাড়ালাম। আওড়ালাম, ‘না।’
জবাব শুনে অহনা আপু আশ্চর্য হলেন। চমকে বললেন, ‘কিছু বলেননি?’
আমি প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়ে বোঝালাম, বলেননি। অহনা আপু বিড়বিড় করলেন,
‘স্ট্রেঞ্জ! ভাইয়া তো রেগেমেগে বেরিয়েছিলেন। আমি ভেবেছি তোকে পেলেই চারটে ধমক মার বেন তুই আসিসনি বলে! তোর জন্য বুকে এনে রেখেছেন। তাজা ষোলো ধরনের ফুল দিয়ে বানানো বুকে। ভীষণ সুন্দর। দিয়েছেন তোকে?’
আমি আহত চোখে চেয়ে মাথা নাড়ালাম। অহনা আপু আশ্বস্ত করলেন, ‘পরে দেবেন বোধহয়। প্রিয়াঙ্কার দেয়া হয়ে যাবে। তারপর তুই বোস, কেমন?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি মাথা দুলিয়ে অল্প করে হাসার চেষ্টা করলাম। হাসি এলো না। উনি কী রাগ করলেন আমার ওপর? তখন আমি তাকে অপছন্দ করি বলতে চাইলাম বলে? আমি তো মায়ের সাথে জেদ ধরে বলতে নিয়েছিলাম। সত্যিকার অর্থে মিন করিনি। একটা সময় ছিলো যখন তার ওপর আমার আগ্রহ ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না। কারণ তাকে মাত্র দূর থেকে দেখা, জানা। সামনাসামনি কথাটুকুও হয়নি। যতটুকু জানি সবই ভাইয়া বা বাবার মুখ থেকে। যেমন অনেক আগে একবার বাবার থেকে শুনেছিলাম, উনি নিজের বাবার আদরে বাঁদর হওয়া একমাত্র দুলাল। এমনকি যখন তার চৌদ্দ বছর—সেসময়ে একবার নিজের বাবার সাথে জেদ ধরে তার দাদার কাছে চলে গিয়েছিলেন। সুদূর অস্ট্রেলিয়া! ওখানে তার দাদা স্থানীয় বাসিন্দা।
তাশরিক ভাইয়ার দাদির জন্ম বাংলাদেশ হলেও, তিনি বড়ো হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া। তাশরিক ভাইয়াও চার-পাঁচ বছর দেশের বাইরে তার দাদার কাছেই ছিলেন। এমনকি তার দাদা-দাদির জন্য অস্ট্রেলিয়ায় তার যাতায়াত লেগেই থাকে। আমি কমবেশ তার সবটাই জানি। শুধু আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম তার হঠাৎ আগমনে। তার হঠাৎ এমন রূপে। আমি তো এসবের সাথে পরিচিত নই। আমি– আমি একটু এড়াতে চেয়েছিলাম। ভালোভাবে ভাবতে চেয়েছিলাম। নিজের মনকে বুঝতে চেয়েছিলাম। আমার যদি তাকে অপছন্দই হতো তাহলে তো যখন জানতে পারলাম পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়ে দিতে চাইছেন সবাই, তখুনি সোজা দ্বিমত প্রকাশ করতাম। জানাতাম, এই বিয়ে আমি করবো না।
আমি তো তেমনটা করিনি, আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। তিনি অদ্ভুত, ওই অদ্ভুত মানুষটাকেই তো আমি একটু একটু করে চিনতে চাচ্ছিলাম, জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু— কিন্তু এইযে কটা দিন ধরে আমাকে এমনভাবে তার আচরণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে পাল্টে যাবার মানে কী! আমি সারা সন্ধ্যা আনমনা, অন্যমনস্ক হয়েই কাটালাম। গানবাজনা, হৈ-হুল্লোড়, এই আনন্দের কিছুই আমাকে ছুঁতে পারলো না। আমি একতরফা শুধু ভেবে গেলাম, দুয়ারের দিকে চেয়ে গেলাম। দেখা পেলাম না মানুষটার। উনি সে রাতে বুঝি আসেননি? একপর্যায়ে আমি অহনা আপুকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম। কিন্তু লজ্জায় পারলাম না। আমার এতো লজ্জা, এতো অস্বস্তির জন্যই তো এমন হলো।
ইতোমধ্যে আমার দু-হাতের মেহেদি শুকিয়েছে। ভালোভাবে ডিজাইনও দেখা হয়নি। এবারে একটু দেখার চেষ্টা করলাম। চোখ কপালে উঠে গেলো। তালুর একটা ডিজাইনের ভেতর স্পষ্ট করে লেখা ইংরেজিতে।
‘Tashrik.’
আমি দ্রুতো হাত লুকোতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। সুফিয়া দ্রুতো আমাকে সহ আমার হাতের জোরপূর্বক ছবি তুলে ফেললো। ঘন মেহেদি ডিজাইনের মধ্যে তার নামটা ফুটে আছে। ওই ছবিটা সুফিয়া হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠালো। আমি লজ্জায় আঁতকে উঠলাম। মিইয়ে গেলাম। এই কাজ কখন করল? কে দিলো বুদ্ধি? সুফিয়া আমার কানের কাছে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,
‘জানিস আজ কী দেখলাম? তাশরিক ভাইয়ার ফোনের ওয়ালপেপারে তোর ছবি, ভাই। পাকা দেখা দেখাদেখিতে যেই ড্রেস পরেছিলি? ওই ড্রেসের। হাতে ভাইয়ার দেয়া প্রথম বুকে। কী সুন্দর!’
আমার বুকটা ধক করে উঠল। মনে পড়ল হঠাৎ করে সেদিন ভাইয়া আমাকে বাগানে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলেছিলেন কিছু। আমি তখন ওত কিছু ভাবিনি।
রুমি আপু আওড়ালেন,
‘রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার। কিন্ত– কিন্তু…আজ ভাইয়া কোথায়? কোথাও দেখলাম না যে? তোকে দিয়েই চলে গেলেন? ফিরবেন না?’
আমি শুধু নিজের হাত দুটোর দিকে চেয়ে থাকলাম। এক হাতে তার নাম আরবিতে লেখা। অন্য হাতে ইংরেজিতে। দেখতে দেখতে রাতের একটা বাজবে বলে। ভাইয়া এসেছেন আমাদের বাসায় নিতে। আমি চতুর্দিকে তাকালাম। তাশরিক ভাইয়াকে কোথাও দেখলাম না। এমনকি অহনা আপুর বলা ওই ফুলের তোড়াও দেননি। আমি এবারে নিশ্চিত তিনি আমার ওপর রেগে আছেন। গাড়িতে ভাইয়া আমাকে কিছু একটা বলতে নিয়েও আর বললেন না। সেদিন বাসায় ফিরেও আমি অস্থির হয়ে থাকলাম। হঠাৎ করে যেন আমার দুনিয়ায় বিষাদ নেমে এলো। আমি বারবার ফোন চেক করতে থাকলাম। সবাই গ্রুপে মজা করছিলো।
অথচ তাশরিক ভাইয়ার কোনো মেসেজ নেই। এমনকি সুফিয়ার মেনশনের প্রত্যুত্তরও দেননি। আমি ঘুরেঘুরে তার দেয়া ফুলের তোড়া দুটো দেখছিলাম। ফুল গুলো শুকিয়ে গেছে। অথচ আমি যত্নের সাথে রেখে দিয়েছি। ওই তোড়া দুটো যে কতোবার ছুঁলাম। আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। এইতো তিনি ওমন দুষ্টু কথাবার্তা বলায় অপ্রস্তুত হতাম, এড়াতে চাইতাম। আর এখন? কেনো এমন অনুভব করছি তবে? এতো অসহ্য লাগছে। আমি ওই রাত আর ঘুমোতে পারলাম না। অশান্তিতে কী ঘুম হয়? পরদিন সকাল বেলা যখন নাস্তায় বসলাম তখনো আমার চোখজোড়া লাল। কজ গায়ে-হলুদের জন্য কিছু শপিং করতে হবে। ও বাড়ি থেকে অহনা আপু আসবেন। আমি ভেবেছিলাম তাশরিক ভাইয়াও আসবেন। কিন্তু আসেননি। এসেছিলো অহনা আপু আর আন্টি। অহনা আপু একবার আমায় কিছু একটা বলতে নিয়েও বললেন না। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তর পেলাম না।
সেদিনটাও তাশরিক ভাইয়ার কোনো খোঁজ নেই। এমনকি এরপর দিনও না। সে যেন আমার জীবন থেকে মুছে গেছে। কোনো অস্তিত্বই যেন নেই। আমি তখন দিশেহারা, দিশেহারাই বলা যায়। কয়েকবার করে তার আইডি ঘাটলাম, ছবি দেখলাম। বারবার হাত হাসি হাসি মুখটা ভাসছিলো। তার একেকটা কথা কানে বাজছিলো। আমি কী অনুশোচনা করছি? আমার আচরণের জন্য? নাকি আমার এড়ানোর জন্য? নাকি সেদিন মাকে বলতে নেওয়া অসমাপ্ত কথাটুকুর জন্য? আমি জানি না। এতটুকু জানি, আমি ভালো নেই। ভীষণ বাজে ভাবে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিলাম ভেতরে। ভাংচুর চলছিলো, কাচ ভাঙার মতন আমার হৃদয় ভাঙছিলো। আমার হাত দুটো তখনো র ক্ত ক্ত রঙে রাঙানো। এতো গাঢ় রং এসেছে। উনার নামটা রীতিমতো কালো হয়ে ফুটে আছে। আমি ভ্যাবলার মতন শুধু হাতটাই দেখলাম। এইযে উনার নাম লেখা আমার হাতে। এটা তো উনি দেখলেন না। নিশ্চয়ই দেখতে পেলে অসভ্য রকমের কিছু বলতেন? আমার এযাত্রায় চোখ ভিজে এলো।
গায়ে হলুদের আয়োজন আমাদের বাগানের অনেকটা জায়গা জুড়ে করা হলো। ভাইয়াকে হলুদ লাগানো হয়েছে। গানবাজনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একপর্যায়ে ও বাড়িতে হলুদের ডালা নিয়ে যেতে হবে। বাবা চাচা-চাচি, কাজিনদের সাথে আমিও যাবো। আমরা রওনা হলাম সাতটার দিকে। ও বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা প্রায়। খান বাড়ি রাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছিলো লাইটিং দিয়ে। গানের শব্দ ভেসে আসছিলো। গাড়ি থেকে আমি চারদিকে তাকালাম। স্টেজ বাগানে করা হয়েছে। মেহমান এসেছেন অনেক। আমাদের নিয়ে হুড়োহুড়ি লাগলো। আমি আড়চোখে তাশরিক ভাইয়াকেই খুঁজে গেলাম। একপর্যায়ে দেখতে পেলাম। আমার শ্বাস বন্ধ হলো, পৃথিবী থমকে গেলো। চারিপাশে যেন একটা জাদু হলো। উনি মনে হয় বিরক্ত। চোখমুখ কুঁচকে কাকে যেন বকছেন। বাসার পোশাক পরে আছেন। হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট। পকেটে রাখা হাতটা যখন বের করলেন আমার হৃদয় কেপে উঠল। ডান হাতের পাতা ব্যান্ডেজ করা। এসময়ে অহনা আপু আমাকে ডাকলেন। ডাক শুনে তাশরিক ভাইয়াও তাকালেন। সেই দৃষ্টি গম্ভীর। উনি কী আমার চোখ দেখে কিছুই বুঝতে পারলেন না? হয়তোবা চেষ্টা করেননি। আমি নীরবে এসে দাঁড়ালাম আপুর পাশে। কথাবার্তার একসময় আমি ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
‘ভা–ভাই…উনার হাতে কী হয়েছে?’
অহনা আপু চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এবারে বললেন,
‘গাড়ির কাঁচ ভেঙেছেন ঘুষি দিয়ে।’
আমি চমকে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে শুধালাম, ‘কোন দিন?’
‘মেহেদি অনুষ্ঠানের দিন। তোরা যাওয়ার আধঘন্টা পরই ভাইয়া ফিরেছিলেন র ক্তাক্ত হাত নিয়ে। গতকাল পর্যন্ত তার হাই ফেভার ছিলো। আজই কমেছে।’
আমি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম। শক্ত করে ধরলাম স্টেজ। আমার হাত পা কাঁপছিলো। কাঁপছিলো হৃৎপিণ্ড। আমি ঘুরে তাকালাম ওদিকে। তাশরিক ভাইয়া ওদিকেই দাঁড়িয়ে আছেন, থাকলেন। এদিকে এলেন না। ভেতরেও যাননি। উনি..উনি কী আমার ওপর রাগ করে এমন করলেন? অহনা আপু উঠে এলেন আমার কাছে। আমার অবস্থা দেখে কাঁধ ধরে আওড়ালেন,
‘শান্ত হো। কী হয়েছে? ভাইয়ার সাথে ঝামেলা? শোন না, চিন্তা করিস না। ভাইয়া একটু এমনই। ভীষণ বদরাগী, জেদি। তবে একটা কথা কী জানিস?’
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৯
আমি চোখ তুলে তাকালাম। অহনা আপু হাসলেন। আমার গাল ছুঁয়ে বললেন,
‘তোকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসেন। তোর চিন্তাচেতনার বাইরে। দেখলি না, তোকে কতভাবে এপ্রোচ করে যাচ্ছিলো? তার ধারণা এভাবেই তুই তার প্রেমে পড়বি। কিন্তু তাকে কে বোঝাবে যে তোর মতন ফুলদের প্রেমে ফেলতে শুধু ফুল দিলেই হয় না, যত্নের সাথে একজন জেন্টালম্যানও হতে হয়। যেটা তিনি নন। উজবুক বনে বসে আছেন।’
আমি শুধু বুঝতে পারলাম আমার ভেতর ভাংচুর হচ্ছে। আমি ঘামছি, কাঁপছি। অস্বস্তিতে নয়। যন্ত্রণায়। তার হাতের ব্যথা যেন আমার হৃদয়ে মিশে গেছে।