মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৫
নাবিলা ইষ্ক
হঠাৎ গিয়ে ফের মিনিটের মধ্যে অন্ধকার সরিয়ে আলো জ্বলে উঠলো। স্তব্ধ আমার চোখ তখনো বড়ো হয়ে আছে। শ্বাস আটকে আছে বুকে। মূর্তির মতো থমকে বসে থাকা আমার জ্ঞান ফিরতেও মিনিটখানেক লাগলো। চোখের পলকে আমার সাথে কী হলো বুঝতে মস্তিষ্ক কাজ করছে যেন! ঠোঁটের ভাঁজে তখনো উষ্ণ স্পর্শের ছড়াছড়ি। তাশরিক ভাইয়ার ঠোঁট কিছুক্ষণ আগের অন্ধকারে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে গেছে এতটুকুই যেন আমাকে সজাগ করে তুললো। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আচমকা। আমার আচানক দাঁড়ানোতে আন্টি প্রায় আঁতকে উঠলেন। উতলা হলেন জানতে –
‘কী হলো? ভয় পেলে?’
আমি দ্রুতো ঠোঁটে হাত দিলাম। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালাম আন্টির দিকে। আন্টি, মা-বাবা, আংকেল সহ সবাই আমার দিকেই চেয়ে আছেন। প্রশ্নবোধক চাহনি তাদের। তাশরিক ভাইয়া সহজসরল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বসে থাকা বাবার পাশে।ওদিকে কখন চলে গেলো? এইতো আমার পেছনে ছিলো। আমার ঘাড় ধরে….আমি মাথা দুলালাম। আমার হঠাৎ কী হয়েছে এই যেন তাশরিক ভাইয়ারও জানার বেশ আগ্রহ। তিনি চিন্তিত হয়ে প্রশ্নও করলেন
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘কী হয়েছে? ভূতের ভয় পেয়েছো?’
বাবাও তার মতন অসভ্য, দু-মুখো লোকের সুরে সুর মেলালেন –
‘মামণি, কী হয়েছে? ওমন দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আসো…বাবার কাছে এসো।’
আমি জবাবও দিতে পারলাম না। পুতুলের মতো ফের বসলাম চেয়ারে। সম্মোহিত হয়েছি এমনভাবেই আগাম অনেকটা সময় আমার অজানায় কেটে গেলো। হৃৎপিণ্ড, র ক্ত চলাচল সবই দ্রুতো বেগে ছুটছে। মস্তিষ্ক সব উদ্ভট চিন্তাভাবনা করে যাচ্ছে। যেমন- তখনকার ওই পাতলা ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে কীভাবে আমি বরফ হয়ে এলাম। কাছ থেকে তার করা প্রশ্ন! চেয়েও এসব অনেকক্ষণ মস্তিষ্ক থেকে গেলো না। কয়েকবার ঢোক গিললাম। না আমি ঘৃণা করিনি, অসহ্য অনুভব হচ্ছে না। রাগও হচ্ছে না! কিন্তু কেনো? আমার তো তার ওপর রাগ হওয়ার কথা অন্তত। এতো মানুষ এখানে! এমন একটা সময়ে…না এমন সময় তো দূর অন্য সময়ে এমন একটা কাজ তিনি কীভাবে করতে পারেন? আমাদের সামনাসামনি দেখা হচ্ছেই বা কতদিনের? এখানে আমার রাগ হওয়ার কথা। অথচ দিব্যি আমার ভেতরে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। ভনভন করছে মাথার ভেতর। সুফিয়া সামনে থেকে উড়ে উড়ে এলো আমার কাছে। আমার হাত টেনে উঠিয়ে কেমন রাগ নিয়েই বলল –
‘তুই কী বলতো, আদর? আমরা সবাই ওখানে আর তুই আন্টিদের সাথে বসে আছিস! আশ্চর্য! নাচবি না ঠিকাছে। তাই বলে একসাথে থাকবি না?’
আমাকে টেনেটুনে এনে দাঁড় করালো সামনে। তাশরিক ভাইয়া কিছুটা দূরেই তার বন্ধুদের সাথে বসেছেন সোফায়। মধ্যে ভাইয়া আর ভাবী। এই পাশে আমরা। সামনে স্টেজ। ভাবীর পরিবার থেকে কেউ একজন নাচতে গেলো। সম্পর্কে তাশরিক ভাইয়ার চাচাতো বোন। ভাবীর বয়সীই হবেন সম্ভবত। তিনি চমৎকার একটা গানে নাচছেন। সেই নাচ দেখার মতন আত্মসুখ আমার নেই। আমি সুফিয়ার পাশে শুধু বসেই থাকলাম। ভাইয়া হঠাৎ সোফা থেকে উঠে এলেন আমার সামনে। আমি হকচকিয়ে চাইতেই তিনি চিন্তিত হয়ে কপাল ছুঁয়ে প্রশ্ন করলেন –
‘খারাপ লাগছে নাকি? মুখটা এমন হয়ে আছে কেনো?’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। ‘নাচ দেখছিলাম।’
ভাইয়া মাথা বুলিয়ে আওড়ালেন – ‘খারাপ লাগলে জানাবি।’
প্রত্যুত্তরে আমি মাথা দোলালাম। ভাইয়া গিয়ে বসতেই ভাবীও আমার দিকে ফিরে চোখে চোখে প্রশ্ন করছেন। আমি হেসে বোঝালাম কিছু না। ভুলেও তাকালাম না ওই অসভ্য, বেয়াদব, ইতর লোকটার দিকে। একটু আগে ওমন একটা ব্যাপার ঘটিয়ে দিব্যি নিজের কাজিন সিস্টারের নাচ উপভোগ করছে, হাসছে। কী সুখ! ঠিকই বলেছিলাম যা বলেছিলাম। প্লে-বয় কোথাকানাহলে ওমন একটা কাজ করে কেউ এমন নির্বিকার থাকতে পারে? সম্ভব? হঠাৎ কান টান খেয়ে কুঁকড়ে গেলাম। চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সুফিয়া আরও বড়ো করে চোখ রাঙালো –
‘তোর সমস্যা কী? ফিউচার হাজবেন্ড এখানে আছে বলেই কী এমন বিলাই সেজে আছিস? লজ্জা পাচ্ছিস? তুই তো এমনিতেও খুব শাই।’
আমি ভয়ংকর ভাবে চোখ রাঙালাম। দাঁতে দাঁত পিষে আওড়ালাম –
‘খবরদার ওই লোকের কথা আমার সামনে বলবি না।’
সুফিয়া আমার কথা বোধহয় শুনতে পায়নি। মিউজিকের আওয়াজে হল মুখরিত। সবাই কড়োতালি দিচ্ছে। আমি আড়চোখে একবার তাকিয়েই ফেললাম মিস্টার তাশরিক খানের প্লে-বয় রূপ দেখতে। তার ওই কাজিন সিস্টার নাচতে নাচতে যে তাকে বারবার দেখছে ও বুঝি কেউ দেখছে না? নিশ্চয়ই নিজেও ফ্লার্ট করছে? আমি গোপনেই তাকিয়েছিলাম। চোখে চোখ পড়বে তা কল্পনাও করিনি। তিনি চেয়ে আছেন। বেশ আরাম করে, গালে হাত দিয়ে। আমার ভেতরে ধুকপুক শুরু হলো আরও জোড়ালো ভাবে। দ্রুতো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। নাচ শেষ। অন্য একটি গ্রুপ গিয়েছে। এরপর সুফিয়া যাবে। ওর একার একটা নাচ আছে। এরপর ভাইয়ার বন্ধুরা বোধহয় গানও গাইবেন। গিটারিস্ট আনানো হয়েছে। আমি যতটুকু জানি, ভাইয়া…তাশরিক ভাইয়াও গিটার বাজাতে পারেন বেসিক ভাবে। তার বন্ধুরাও নিশ্চয়ই পারেন? সুফিয়া এরপরে নাচলো। ওর নাচটা আমি ভিডিও রেকর্ড করলাম। হাত কাঁপছিলো কেমন! অথচ হাতের থেকেও আমার ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। সুফিয়া নাচ শেষে নামতেই একটা ভোজপুরি গান লাগানো হয়েছে। ওমনি ভাইয়ার সব বন্ধুরা মিলে পাগলা ডান্স শুরু করলো। সেই কী এক বিশ্রী অবস্থা! তাশরিক ভাইয়াও আছেন তাদের মধ্যে। আমি আড়ে আড়ে দু-বার তাকালাম। গানটাও বেশ ইন্টারেস্টিং…
Toot jagi rajaji…
Toot jai raja ji palang saagwaan ke
Toot jaai raja jj palang saagwaan ke.
উনাদের ওমন হুড়োহুড়ি নাচে বাকিরাও যোগ হয়েছে। যেমন একপর্যায়ে নীরব ভাইয়া বাবা আর আংকেলকে টেনে নিয়ে গেছেন। তারা বাচ্চাদের ইশারায় ওই একটু ঢুমকো নাচিয়ে হাসতে হাসতে সরে এসেছেন। আমার চোখ ঘুরেফিরে তাশরিক ভাইয়ার দিকেই যাচ্ছিলো। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। অনেক রকম আলোর নিচে বন্ধুদের সাথে উল্লাস করা তার চুল এলোমেলো। হাসতে থাকা ওই পাতলা ঠোঁট জোড়া…আমি দ্রুতো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। সুফিয়া আমার কানে কানে এসে আওড়ালো –
‘মামা, তোর ফিউচার উড বি তো পুরাই একটা মাল।’
আমি চোখ গরম করে তাকাতেই ও সেরেন্ডার পোজ দিলো। এতে ফের আমার তাশরিক ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। এই বদমায়েশ লোকও তো এমন করেছিলো। আরে, ইতর রে! দু-দিনের চেনা মেয়েমানুষকে চুমু খাওয়! তাও আবার..ঠোঁ টে!! তোকে আমি মরিচ খাওয়াবো বেলেহাজ পুরুষ মানুষ। অসভ্য! নিজের মনে শতাধিক গা লি দেওয়া নির্লজ্জ আমি আবার ঘুরেঘুরে উনাকেই দেখছিলাম। আশ্চর্য! হোয়াট’স রং উইদ মি? ওরে ভাই, আবার ইংরেজিও মনে মনে বলছি। এই লোক তো আমাকে বাজেভাবে ইনফ্লুয়েন্স করছে। নিজে তো ইংরেজদের বংশধরের পরিচয় দিচ্ছে, আবার আমাকেও ওই দলে নিতে চাচ্ছে! জীবনেও সম্ভব না। আমি ইয়াসিন মোল্লা আদর খাঁটি বাঙালি কন্যা। আর উনি একজন ব্রিটিশ লম্পট! হুম!
‘আদর!’
ভাবীর ডাকে আমি মিষ্টি করে হেসে তাকাতে চাইলাম। ভাবী বিড়বিড় করলেন –
‘কী বকছিস আপনমনে?’
আমি মিথ্যেটাই বললাম সানন্দেই – ‘গান গাইছিলাম।’
‘চমৎকার! শোন, এখন তোর ঘনঘন গান গাওয়ার সময়। ভাইয়ার জন্য হৃদয়ে এই গানটাও গাস……
তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এই মওওওন….’
আমি এযাত্রায় আর হাসিটুকু ঠোঁটে রাখতে পারলাম না। থমথমে মুখে ভেংচি কেটে ফেললাম –
‘বয়েই গেছে আমার।’
ভাবী মুহূর্তে সতর্ক হলেন – ‘চেতে আছিস কেনো? এই ভাইয়াটা না কোনো কাজের না। রিলেশনশিপের শুরুতে ভদ্র গিরগিটি সেজে থাকতে হয়। পরে না আমার মতন আসল রূপ বের করতে হতো। তখন তো ইতোমধ্যে প্রেমেই পড়ে গেছে। আসল রূপ দেখালেই বা কী করার আছে?’
আমি দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করলাম – ‘একেই বলে র ক্তের সম্পর্কের ভাইবোন।’
ভাবী মিষ্টি করে হেসে ফের ব্যস্ত হলেন বাকিদের দুষ্টুমি দেখতে। নাচানাচি শেষ করে সবাই বসে ঠান্ডা খাচ্ছে। কেটারিংওয়ালারা ট্রেতে করে সার্ভ করছেন। তখন ভাইয়ার বন্ধুরা টুংটাং শব্দ করছেন গিটারে। সম্ভবত গানবাজনার পরই খাওয়াদাওয়া করে আমরা ভাবীকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। তাদের বন্ধুদের একজন হঠাৎ গিটারটা তাশরিক ভাইয়াকে ধরিয়ে দিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললেন-
‘আমার ফিউচার ভাবীর জন্য একটা গান হয়ে যাক!’
ফিউচার ভাবী বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে তা আর জানার অপেক্ষা রাখে না। সবাই হৈচৈ ফেলে আমাকেই গুঁতিয়ে হাসছে, মজা নিচ্ছে। লজ্জায় আমার মাথাটা কয়েকাংশে নুইয়ে এলো। আল্লাহর ওয়াস্তে এই লোক যেন গিটারটা ফেরত দিয়ে একটা বাহানা বানিয়ে ফেলে না গাওয়ার জন্য। কিন্তু তা হলো না। তাশরিক ভাইয়া খালি গলায় গান ধরলেন। ওইযে তিনি তো আবার ইংরেজদের একজন উত্তরাধিকার। ইংরেজি গানই গাইতে শুরু করেছিলেন….
‘ Even though we’re going through it,
And it makes you feel alone…
Just know that I would die for you,
Baby I would die for you, yeah…’
কিন্তু দ্রুতো তাকে বন্ধুদের একজন থামিয়ে দিয়েছেন বিরক্ত ভঙ্গিতে। নাকমুখ কুঁচকে ঝাঁজালো গলায় বললেন –
‘আরেহ ব্যাটা…একটা বাংলা গান গা। বাংলা গানই হচ্ছে প্রেমের প্রতীক। গা.. গা…দ্রুতো।’
আমার ভেতরে তখনো সমানে ধুকপুক হয়ে চললো। শ্বাস গলায় রোধ হয়ে থাকলো। গিটারে্র সুর বেজে উঠলো। সবাই নীরব। পিনপতন নীরবতা বয়ে গেল পুরোটা সময় জুড়ে….
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৪
‘জীবন দিয়ে চাই তোমায়,
সহেনা যাতনা কী করি বলোনা…
যতনে রেখেছি তোমাকে কতোনা।
তুমি কি জানো না তুমি কী বোঝো না,
তোমারই বিহনে এ মন জ্বলে…
তুমি কী জানো না তুমি কী বোঝো না,
তোমারই কথা এ হৃদয় বলে…
ওহ যদি বাসো ভালো আমাকে,
তবে কেনো থাকো দূরে দূরে…
সহেনা যাতনা কী করি বলোনা,
যতনে রেখেছি তোমাকে কতোনা…..’
গান শেষ হতেই এতো এতো হৈচৈয়ের শব্দ আমার কানে পৌঁছালো না। আমার কানে শুধু তার কণ্ঠ বেজে যাচ্ছিলো…..