মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ২

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ২
নাবিলা ইষ্ক

বাড়ির ভেতরে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল একমুহূর্তের মধ্যে। ভেতরে এসে থেমেছে চারটা গাড়ি। মনে হলো পানির মতন কলকল করে গ্রামের সব মানুষ যেন আমাদের মোল্লা বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বড়ো চাচার চার ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে, দুই ছেলে। ছোটো চাচার একটা মাত্র ছেলে। ফুপু দুজন এসেছেন। আরেকজন পরশু আসবেন। বড়ো ফুপুর ঘরে পাঁচজন ছেলেমেয়ে। মেজো ফুপুর দুজন মেয়ে। তাদের আবার ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়ও এসেছেন। সব মিলিয়ে একদম হৈচৈ লেগে গেল দুপুরের পর। ড্রয়িংরুমে বসবার জায়গা মাত্র নেই।

আজ মা হাসপাতাল যাননি, আগে থেকে তার বিরতিতে বিজ্ঞ ডাক্তার যোগ করা হয়েছে। বাবাও বাড়িতেই। তবে ড্রয়িংরুমে বসে একের পর এক ব্যবসায়িক কল রিসিভ করা থামেনি। দুজানার অতিথি আপ্যায়নের ত্রুটি না রাখার বেশ চেষ্টা চলছে। আমাকে বড়ো ফুপি টেনে পাশে বসিয়ে আহ্লাদ করছেন। মাথা ছুঁয়ে গালে দুটো চুমুও খেয়েছেন। আমি লাজে রাঙা হলাম। এইতো দিব্যি বড়ো হয়ে গেছি। এখন এমন চুমু খেলে লজ্জা লাগে না বুঝি? তবে আমি লাজে সরিনি, ফুপুর গালেও পাল্টা ঠোঁট ছুঁয়েছি। ফুপুদের মধ্যে আমি বড়ো ফুপুকে বেশি ভালোবাসি। আবার চাচাদের মধ্যে ছোটো চাচার প্রতি আমার অতিরিক্ত মায়া।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সব সম্পর্কেই আমার প্রিয় একজন থাকবেই। এইপর্যায়ে কাজিনদের টানাটানিতে ওদের সাথে দোতলায় চলে এলাম। সবকয়টা আমার ঘরের বিছানায় ঝাপিয়ে পড়েছে। আমার ঘরটা উত্তরমুখী। বড়োসড়ো খোলা বারান্দা যুক্ত। ভাইয়া নিজে থেকে এই ঘরের সব কাজগুলো করিয়েছেন। আমি বই পড়তে পছন্দ করি বলে বিশাল শেল্ফ বানিয়েছেন। মেঝেটা কাঠের রঙের তবে মার্বেল ফ্লোর। টিভির শেল্ফও বানানো। বেশ বড়ো একটা দেয়াল টিভি লাগানো আছে। বারান্দায় অনেকরকম ফুল গাছের সমারোহ। আমি যে ফুল গাছ খুব একটা পছন্দ করি বিষয়টা তেমন নয়। আবার অপছন্দও করি না। সৌন্দর্যের জন্যই মূলত ওদের সাজিয়ে রাখা। তবে দেখতে বেশ লাগে। রিপন, আদনান, জয় ভাইয়া বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছেন। আদনান ভাইয়া তো ঘুমিয়েই গিয়েছেন একমুহূর্তে। বাকিরা হাসিঠাট্টায় মশগুল। সুফিয়া একফাঁকে আমার খুব কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল,

‘এই, তাশরিক খান কি ভাবীর একমাত্র ভাই নাকি রে? দেখতে তো আগুন। আমি ফেইসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি।’
আমি আঁতকে উঠলাম। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে বললাম,
‘কী করেছিস?’
সুফিয়া গদগদ হলো, ‘রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। তাশরিক খান আইডির নাম। প্রোফাইলে সাদাকালো একটা ছবি। ফর্মাল থ্রি-পিস স্যুট পরনে। অস্ট্রেলিয়ার কোনো এক শপের সামনে বোধহয় পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিলো। চোখে সানগ্লাস। এমন একটা ছবিইতো প্রোফাইলে। ওটাইতো? আমার পুরো মুখস্থ ভাই।’
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। ভাষাহীন একপ্রকার। কী সাহস! কই আমিতো আজ পর্যন্ত রিকোয়েস্ট পাঠানোর সাহস করতে পারলাম না। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে একটু আইডিটা দেখতাম মাত্র। একাউন্টে তার ছবি কম। বেশিরভাগ ওই বন্ধুদের সাথে নাইলে কোথাও ঘুরতে গিয়েছে ওখানকার।

সেক্ষেত্রে আমার ফেইসবুকের একাউন্ট বেশ সাধাসিধে। নিজের কোনো ছবি দেয়া নেই। দিলে তো ভাইয়া আমাকে কাচাই খেয়ে ফেলবেন। ওই একটু হাতের ছবি, পায়ের ছবি, ফুলের ছবি, আকাশের ছবি অথবা কোনো জিনিসপত্রের ছবি দিই মাঝেমধ্যে। ওসবে ভাইয়া কিছু বলেন না। তবে চেনাপরিচিত ব্যতীত বাইরের কাউকে ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড করতেও দেননি। আমার প্রয়োজনও হয়নি। আমার বংশের মানুষ দিয়েইতো আইডিতে একশোর বেশি সদস্য। এরাই কমেন্ট করে ঘুরেফিরে। আমি ফিসফিস করে আনমনা শুধালাম,
‘রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে?’
‘না, করেনি। এই তোর সাথে অ্যাড নেই কেনো? তোর ভাইয়ার বন্ধু মানে তোরও ভাই। কীভাবে অ্যাড না থাকে? আশ্চর্য!’

আমি নিশ্চুপ হয়ে পড়লাম। কী উত্তর দেবো বুঝতেই পারছিলাম না।! অসহায় চোখে চাইতেই সুফিয়া অন্য ব্যাপারে আলাপ শুরু করল। ওর আবার কথার রোগ আছে। কথা বলতে নিলে বলতেই থাকে। আমি আবার ভালো শ্রোতা। শুনতেই থাকি। এসময়ে বাবা দুয়ারে এসে সবাইকে ডাকলেন খাওয়ার জন্য। সবাই যেহেতু বেশ ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে খেয়েদেয়ে রেস্ট নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। নিচের সবগুলো গেস্টরুম পরিষ্কার করা হয়েছে গতকালই। একমুহূর্তেই আমার ঘরটা খালি হয়ে গেল। খেয়েদেয়ে সারা বিকেল বেলাটা ওরা ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।
আমিও ভাবছিলাম একটু ঘুমাবো। হঠাৎ কোথা থেকে বাবা উড়ে আসলেন আমার ঘরের সামনে। তাড়া দিলেন,
‘মামণি, চটজলদি রেডি হও। আমরা এয়ারপোর্ট যাচ্ছি তোমার ভাইয়াকে রিসিভ করতে। ও বললেই কী ওর কথা শোনা লাগবে নাকি? চলো, চলো।’

আমি আশ্চর্য হতেও পারলাম না। বাবা যেভাবে এলেন সেভাবেই চলে গেলেন। কিছুক্ষণ থমকে পরমুহূর্তেই আমি বাবার কথামতো দ্রুতো তৈরি হয়ে নিচে নামলাম। ড্রয়িংরুম ফাঁকা। কেউই নেই। বাবাকে পেলাম বাগিচার সামনে। ইতোমধ্যে গাড়ি বের করা হয়েছে। আমি গিয়ে পেছনের সিটে উঠে বসতেই বাবাও উঠে বসলেন। ড্রাইভার চাচা গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছেন। আমরা বাবা-মেয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। রাস্তাঘাটে তেমন একটা জ্যাম নেই। ফাঁকা রাস্তা। কতদিন পর ভাইয়াকে সামনাসামনি দেখবো ভেবে আনন্দ হচ্ছিলাম আবার পরমুহূর্তেই একটু দমে যাচ্ছিলাম এই ভেবে যে তাশরিক ভাইয়াও থাকবেন। বাবা মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বড়ো বড়ো দুটো ফ্লাওয়ার বুকেও নিয়েছেন। একটা ভাইয়ার জন্য আরেকটা তাশরিক ভাইয়ার জন্য। দুটো বুকেই তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। আমাকেই নাকি দিতে হবে। কী আশ্চর্য! এই কেমন কথা? আমি দ্রুতো বললাম,

‘ভাইয়াকে আমি দেবো। তাশরিক ভাইয়াকে তুমি দাও। আমি পারবো না।’
বাবা যেন হোঁচট খেলেন। কেমন আঁতকে উঠে বললেন, ‘কেনো মামণি? তাশরিক কী করেছে? তাকে তুমি পছন্দ করো না?’
পছন্দ, অপছন্দের কথা আসছে কেনো? আর এতো অবাক হওয়ার কী আছে! উনিতো আমার আপন ভাইয়া নন। আমি মিনমিন করে বললাম,
‘অপছন্দ না। আমার ভাইকে আমি দেবো। তারও তো বোন আছে। তাকে তার বোন দিবে। নাইলে তুমি দাও।’
‘তুমি নিশুকে দেবে, আর পাশে থাকা তাশরিককে দেবে না? ওর খারাপ লাগবে না বলো? দুজনকেই দিও কেমন? এতে কীইবা আর হবে বলো? একটা বুকেইতো মামণি।’

আমি বুঝলাম না ব্যাপারটা। আমাকেই কেনো দিতে হবে? বাবাই তো দিতে পারেন। কিন্তু বাবার কথার বিপরীতে আর অমত করতে ইচ্ছে হলো না। চুপচাপ বসে থাকলাম। কিন্তু আমার মন চুপ নেই। শোরগোল, হট্টগোল করছে। আমি কীভাবে বুকে দেবো? এও সম্ভব? বাবা একটা কল অ্যাটেন্ড করেছেন। সারারাস্তা তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি তার একমাত্র মেয়ের মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে অক্ষম। ঘণ্টাখানেকেরও কম লাগল আমাদের এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে। ভাইয়ারা দু নাম্বার গেইট দিয়ে বেরুবেন। আমরা ওখানে গিয়েই দাঁড়ালাম। আমি রীতিমতো ঘামছি, কাঁপছি। একবার চেষ্টা করলাম বাবার হাতে বুকে একটা ধরিয়ে দেবার। বাবা তখন আদুরে চোখে চেয়ে শুধালেন,

‘কী হয়েছে মামণি? খারাপ লাগছে?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথাটা দুলিয়ে বোঝালাম কিছু না। বাবা আমাকে বোধহয় কোনো এক ভুলের শাস্তি এভাবে দিচ্ছেন। আমাদের অপেক্ষা করতে হলো বিশ মিনিটের মতন। ট্রলি ঠেলে আসতে দেখা গেল ভাইয়াকে। আমি আনন্দে সব ভুলে গেলাম। হাত উঠিয়ে নাড়ালাম। পরমুহূর্তেই হাতটা দুর্বল হয়ে পড়ে গেল আপনাআপনি। আমার ভাইয়ার পাশে তাশরিক ভাইয়া। একহাতে ট্রলি ঠেলে এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকেই। আমি তাকাতে পারলাম না আর। মাথাটা নুইয়ে ফেললাম। পরপরই বাবাকে বলতে শুনলাম,
‘আদর, মামণি…দাও বুকে তোমার ভাইয়াকে। এতো কষ্ট করে কিনেছো!’

আমি বাবাকে চোখ রাঙানোর সময়টুকুও পেলাম না। ভাইয়াকে বুকে এগিয়ে দিলাম। ভাইয়া আলগোছে আমাকে জড়িয়ে নিলেন বুকের একপাশে। মাথা ছুঁয়ে বেশ গর্বের সাথে বললেন,
‘লম্বা হয়েছিস একটু। আগে পড়তি বুকেরও নিচে। এখন আমার বুকে মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে।’
আমি হাসলাম জোরপূর্বক। পাশে তাকাতে পারলাম না। তবে বুকেটা দাঁতে দাঁত চেপে কম্পিত হাতে এগিয়ে ধরলাম পাশে। পাশের মানুষ বেশ নির্বিকার। আমোদেই বুকেটা নিলেন। যেন এটা সাধারণ একটা ব্যাপার। জনমজনম ধরে হয়ে আসছে। তার গম্ভীর গলায় সবসময় এক উজ্জ্বলতা থাকে। আজও তাই। তবে কথাগুলোর মধ্যে মোটেও ভদ্রলোকের ‘ভ’টুকুও ছিলো না।

‘স্মল বেইবি থেকে বিগ বেইবিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ওয়ান্ডার—ফুল।’
এতটুকু বলে থেমে ফের বললেন, ‘একশো আটান্ন সেন্টিমিটার থেকে একশো বাষট্টি সেন্টিমিটারে ট্রান্সফার করেছে। উইচ ইজ নট দ্যাট ব্যাড।’
আমার মুখটা আরও নুইয়ে গেল। লজ্জায় গাল ধরে যেন গলাও লাল হতে চাইলো। এগুলো কোনো ভদ্রলোকের কথাবার্তা হতে পারে? বন্ধুর বোন ছোটো হলেও তার তো আর আপন বোন নয়। এমন বিশ বছরের মেয়েকে কোন মুখে বেইবি ডাকে? কথাবার্তার কোনো ধাঁচ নেই, লাগাম নেই। আমি ভাইয়ার হাত ধরে বাকিটা পথ হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। বসার সময় হলো ঝামেলা। বসেছিলাম ভাইয়ার পাশে। কোথা থেকে তাশরিক ভাইয়া আমার পাশে এসে দরজা খুলে বললেন,

‘বেইবি গার্ল, চাপো ওদিকে। লেট মি সিট।’
আমি আকাশ থেকে জমিনে পড়লাম। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না এইমুহূর্তে। পরপর অন্তর কাঁপল, কাঁপল আমার শিরা-উপশিরা। উনি কী পাগল হয়ে গেলেন? এসব বলে আমার বড়ো ভাইয়াও জীবনে ডাকেননি। কথা নেই বার্তা নেই সারাবছর। উনি কী আদতেও আমাকে চেনেন? আমি পাশে তাকালাম। ভাইয়া ফোনে ব্যস্ত। বাবাও তাই। অগত্যা আলগোছে একেবারে ভাইয়ার দিকে চেপে বসলাম। তাতেও উপায় হলো না। দুজানাই সুঠাম দেহের লম্বাচওড়া পুরুষ। মধ্যে এক ছোটোখাটো আমি। তাশরিক ভাইয়ার হাতে তখনো আমার দেয়া বুকেটা। উনি ওটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছেন। এযাত্রায় বললেন,

‘থ্যাংকস ফর দিস বিউটিফুল বুকে।’
উনার পরনে শুভ্র রঙা লুজ জিন্স, গায়ের শুভ্র রঙা লুজ শার্ট জড়ানো। সোনালি রঙের হাত ঘড়িটা জ্বলজ্বল করছে। আমি আরেকটু ভাইয়ার দিকে চাপতেই ভাইয়া আমার কাঁধ ধরে কান থেকে ফোন সরিয়ে বললেন,
‘কী?’
‘কিছু না।’
ভাইয়া কী বুঝলেন কে জানে! হঠাৎ বললেন,
‘জ্বালাবি না ওকে।’

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১

তাশরিক ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন। গাড়ির ভেতরে বয়ে চলা সেই হাসির শব্দে আমার ভেতরটায় যেন ভাঙচুর শুরু হলো। তিনি বেশ অলস ভঙ্গিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসতেই আমার ঊরু ছুঁয়ে গেল। তার হাতটা বেশ সাবলীলভাবে আমার পেছনের সিটের ওপর রাখলেন। আমি যেন পারছিলাম না আমার ভাইয়ার কোলে উঠে বসতে। উনার মাথাটা কী গেছে একেবারে?

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৩