মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৬
নাবিলা ইষ্ক
সেদিন ভাঙা পা নিয়ে বাড়ি ফিরে সামনের চার দিন আর বাড়ি থেকে বের হওয়া হয়নি। বাকিরা প্রায় প্রতিদিনই শপিংয়ে গিয়েছেন। পায়ের ব্যথার উছিলায় আমার আর তাশরিক ভাইয়ার সম্মুখীন হতে হয়নি। যার জন্য আমি যেমন কৃতজ্ঞ তেমনভাবে হতাশও। কেনো সেই হতাশা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে অনুভব করছিলাম অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষার। ওদিকে আমার পা গত তিনদিন ধরে ফুলে ঢোল হয়েছিলো। গতকাল রাত থেকে বেশ কমেছে। আজ বেশ দিব্যি হাঁটতে পারছি। শুধু হঠাৎ হঠাৎ চিনচিন ব্যথা করে ওঠে। আগামীকাল শুক্রবার।
ভাইয়ার এংগেজমেন্টের দিন। আজ সন্ধ্যা থেকে বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়েছে। আমার মামা-মামি, মামাতো ভাইবোন, খালা-খালু, খালাতো ভাইবোনেরা আজই এসেছেন। তারা সবাই ঢাকাতেই আছেন। গাজীপুর থাকেন। দূর নয় আবার অনেক কাছেও নয়। আমার মেজো খালা ভীষণ বিনয়ী মানুষ। চমৎকার ব্যক্তিত্বের একজন। আমাকে খুব স্নেহ করেন। উনি বেড়াতে আসলে আমাকে নিয়েই মেতে থাকেন। চুলে তেল দিয়ে দিবেন, না-হয় আমার কাপড়চোপড় কাচতে উতলা হবেন। যেমন এইযে এখন নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন মাটন বিরিয়ানি। গাজীপুর থেকে নিজ হাতে রান্না করে এনেছেন আমার জন্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখন ড্রয়িংরুম জুড়ে আত্মীয়স্বজন দিয়ে ভরতি। এমনকি আমার সব কাজিনরা ফ্লোরে বসে হাসিঠাট্টা করছিলো। বাবা, চাচা, মামারা সবাই একসাথে ব্যবসা নিয়ে আলাপ করছিলেন। আমার খালার একটামাত্র ছেলে। নাম সজীব। আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়ো। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছে। ভীষণ মেধাবী। ভাইয়ার সাথে দেখা হয় বছরে একবার। আনুষ্ঠানিক কোনো আয়োজনে। সজীব ভাইয়া বসেছিলেন বাবার পাশে। তার পাশে আবার আমার খালু। হঠাৎ আমাকে খাইয়ে দিতে থাকা খালা ভরা মজলিশে বলে উঠলেন,
‘দুলাভাই, আমি আজ সবার সামনে বলে দিতেছি। ঘরের মাইয়া কিন্তু আমি অন্যের ঘরে যাইতে দিবো না। আদরকে আমিই নেবো। সজীবের জন্য।’
মুহূর্তে ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতা ভেঙে পড়ল। একটা টু-শব্দ হলো না কিছুক্ষণের জন্য। আমি নিজেও প্রায় আঁতকে উঠেছিলাম। ড্যাবড্যাব করে ফিরে তাকালাম বাবার দিকে। বাবা তখন দু-ভ্রু কুঁচকে আছেন। কী ভাবছিলেন কে জানে? কিন্তু তাকে ভীষণ অপ্রস্তুত দেখালো। মায়ের মুখে আর হাসি নেই। তিনি পরিস্থিতি দেখে কিছু হয়তো-বা বলতে চাচ্ছিলেন। হঠাৎ বেশ আশ্চর্যজনকভাবেই পরিচিত— আমার হৃদয়ে ঝড় তুলে দেয়া ওই মানুষটির আওয়াজ শুনতে পেলাম,
‘হ্যালো, এভ্রিওয়ান… হ্যালো, আন্টি। নাইস টু মিট ইউ। কার কথা বলছিলেন? আদরের কথা? আমার প্রিটি লিটল বেবির কথা হয়ে থাকলে জানাতে চাই, শি ইজ ওলরেডি এংগেজড টু মি… আই মিন, সুউউন টু বি।’
আকাশটা বুঝি আমার মাথার ওপরে ধ্বসে পড়ল। আমার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু একা আমার নয়। বাবা-মা, ভাইয়া ব্যতীত সবার মাথার ওপরেই বোধহয় আকাশটা ভেঙে পড়েছে। কাঠের পুতুলের মতন বড়ো বড়ো চোখে তাকালাম দুয়ারের দিকে। এবেলায় বাবা হেসে উঠে দাঁড়ালেন তাশরিক ভাইয়াকে আপ্যায়ন করতে। তাশরিক ভাইয়া সবেমাত্র দুয়ারে এসে পৌঁছেছিলেন। কথাটুকু বলতে বলতে ধীর কদমে হেঁটে আসছেন ভেতরে। কালো রঙের টি-শার্ট পরে আছেন সাদা জিন্সের সাথে। হাতা ছোটো হওয়াতে বাহুর পেশিগুলো কাঁচের মতো পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ছে। এলোমেলো চুল। হাত ঘড়ি পরিহিত হাতে একটা ছোটো ব্যাগ। সম্ভবত কোনো কাজের জন্য এসেছেন। সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে তিনি বললেন কী? আর বাবা-মা, ভাইয়াকে আশ্চর্য হতে দেখা যাচ্ছে না কেনো? আমি কী কিছু অজানা? ভাইয়া বসেছিলেন সোফায়। তিনি উঠে গিয়ে তাশরিক ভাইয়ার পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে শাসালেন,
‘এইভাবে, এইধরনের কথা বলবার সময় এখন?’
তাশরিক ভাইয়া চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন আমার চোখে। আমি তখুনি ধড়ফড়িয়ে মাথা নুইয়ে ফেললাম। কুণ্ঠিত হলাম। শুনতে পেলাম তার উজ্জ্বল গলার স্বর,
‘না এলেতো আমার কপাল পুড়তো। তোরা যদি আমাকে ফাঁকি দিয়ে আমার পাখি উড়িয়ে দিতি, তাহলে? আমি বাঁচতাম কী করে?’
বাবা শব্দ করে হেসে ফেললেন। তাশরিক ভাইয়াকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁরে বান্দর… এই চিনিস আমাকে তুই? আচ্ছা, এসব বাদ। আয় বোস। কোনো সমস্যা হলো?’
মা ছুটেছেন রান্নাঘরে। যাওয়ার সময় আমাকে ডাকলেন। আমি উঠে চললাম মায়ের পিছু। আঁড়চোখে দেখলাম তাশরিক ভাইয়া গিয়ে বসেছেন আমার বসবার যায়গাতেই। হাতের ব্যাগটা ভাইয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ওর এংগেজমেন্ট রিং চলে এসেছে। মাপটা চেইক করতে এলাম। নে…ধর। পরে দেখ।’
বাকি কিছুই আর শুনতে পেলাম না। রান্নাঘরে এলাম। মা তাড়াহুড়ো হাতে অরেঞ্জ জুস বানাচ্ছেন। আমি তখনো এক ভ্রমে। গলা রোধ হয়ে আসছে। অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী করবো, মা?’
মা উৎসাহের সাথে বললেন, ‘জুসটা বানিয়ে দিচ্ছি তাশরিককে দিয়ে আয়।’
আমি ইতস্তত করলাম। মন দিয়ে ভাবতে চাইলাম ড্রয়িংরুমে বলা লোকটার কথাগুলো। আমার ভেতরে অবিশ্বাস্য উত্তেজনা বইছিলো তখন। কেমন আমার সত্ত্বা সহ কাঁপছিলো বিশ্রীভাবে। এমনকি আমার হাত-পাও বেশ দুর্বল লাগছিলো। মরুভূমির মতো খাঁখাঁ করা গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে ফিসফিস করে আওড়ালাম,
‘মা! তাশরিক ভাইয়া ওসব কী বললেন? কীসের এংগেজমেন্ট?’
মা তখন ব্লেন্ডারে কমলাগুলো দিয়েছে্ন ব্লেন্ড করতে। ফিরে তাকালেন একমুহূর্তের জন্য। প্রত্যুত্তরে বেশ স্বাভাবিকভাবেই হাসছেন। আমার কেমন অসহ্য লাগছিলো সবকিছু। ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। মায়ের কামিজের ওড়না টেনে ফের জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিছু বলছো না কেনো? তোমরা কী লুকোচ্ছো আমার থেকে?’
মা এবারে শব্দ করে হাসলেন। বললেন, ‘কী লুকাবো, মা? তোর দেখি কিছু মনে নেই। তুই না বলেছিলি তাশরিককে দেখতে রাজকুমারের মতন লাগে? বড়ো হলে ওমন রাজকুমার বিয়ে করতে চাস? তোর বাবা তাইতো ওই রাজকুমার ধরে রেখেছে তোর জন্য। কেনো, রাজকুমার এখন আর পছন্দ হচ্ছে না?’
আমার মুখটা হা হয়ে এলো। কিছুক্ষণ ভাষা হারিয়ে বসলাম। লজ্জায় মুষড়ে গেল আমার মেয়েলি হৃদয়। কোনোরকমে নিজেকে সামলে সরাসরি মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্যাকুল কণ্ঠে জানতে চাইলাম,
‘আমি কবে বলেছি ওসব কথা?’
মা জুসের গ্লাসটা ছোটো ট্রেতে রেখে আমাকে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে তাড়া দিলেন, ‘বলবো পরে। আগে দিয়ে আয় জুসটা। ও আবার চলে যাবে।’
আমি করুণ মুখে তাকালাম মায়ের চোখে। লজ্জায় আমার দিশেহারা অবস্থা। দমবন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। ‘আম–আমি যাবো না, মা। তুমি দিয়ে এসো।’
মা অন্য এক কাজের বাহানা দিয়ে বললেন, ‘আহা, যা না দ্রুতো। ছেলেটা চলে যাবে।’
আমি অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িংরুমে তখনো আলাপ চলছে। তবে খালা-খালু, সজীব ভাইয়া আর নেই সেখানে। সুফিয়া, রুমি আপু ওরা আমাকে দেখতেই শেয়ালের মতো নজর দিয়ে রাখলেন আমার ওপর। যেন যেকোনো সময় আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়বেন। তাশরিক ভাইয়া কথা বলছিলেন বাবা-চাচার সাথে। আমি আর মাথা তুলতে পারলাম না। মাথাটা নুইয়ে শ্বাস বন্ধ করে এগিয়ে এলাম তার সামনে। বাড়িয়ে ধরলাম ট্রে। তিনি বোধহয় আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি অনুভব করতে পারছিলাম। জুসের গ্লাস নিতে নিতেই জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
‘পায়ের অবস্থা কেমন এখন? আর ইউ ফিলিং এনি বেটার, লিটল গার্ল?’
আমি লজ্জায় কুণ্ঠিত হলাম। ছোটো করে বললাম, ‘অ-অনেকটা ভালো।’
ভাইয়া ডাকলেন, ‘এদিকে আয়, আদর। দেখ কেমন হয়েছে।’
ভাইয়ার ডাকে আমি এগিয়ে গেলাম ওদিকে। ভাইয়ার আঙুলে ডায়মন্ডের আংটি। খুব সাধাসিধে। চিকন। অর্ডার করে বানানো। বেশ চমৎকার লাগছে দেখতে। আমি কেনো যেনো জোরপূর্বকও হাসতে পারলাম না। এড়াতে পারলাম না দুরুদুরু কাঁপতে থাকা হৃৎপিণ্ডের তাড়না। কোনোরকমে মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘ভালো লাগছে।’
ভাইয়া আমাকে টেনে পাশে বসালেন। তাশরিক ভাইয়া চুপ করে আছেন। আমি মনের আগ্রহ দমাতে পারিনি। একফাঁকে একটু তাকালাম তার দিকটায়। মুহূর্তেই চোখে চোখ পড়ল। মিইয়ে গেলাম। চোখ ফেরালাম। তাশরিক ভাইয়া উঠে দাঁড়ালেন এবারে। বললেন,
‘এবার আমাকে যেতে হবে আংকেল। নাহলে আপনার বন্ধু ব ন্দুক নিয়ে হাজির হবেন আমাকে গু লি করতে। অনেক কাজ ফেলে এসেছি।’
বাবাও হেসে উঠতে ফের বসে পড়লেন। কেমন অসহায় গলায় বললেন, ‘কোমরটা ব্যথা করছে আমার। আদর, মামণি.. যাও তাশরিককে একটু এগিয়ে দিয়ে আসো।’
আমার চোখের সামনে যেন এখন অনেক কিছু পরিষ্কার হলো। আমি তাকালাম বাবার দিকে। বাবা মিষ্টি করে হাসছেন। যেন কিছুই হচ্ছে না। ভাইয়া ফোনটা বের করে কথা বলার ছুতোয় সরে গেলেন। আমি আশ্চর্য, বাকরুদ্ধ। বাবার ডাকে এবারে পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ালাম। তাশরিক ভাইয়া হাঁটছেন সামনে। আমি তার পেছনে। তার গাড়িটা বাগিচার দিকে দাঁড় করানো। বাগিচার কাছাকাছি আসতেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়লন। ওমনি আমার এলোমেলো শ্বাস গলায় আটকালো। তাশরিক ভাইয়া ফিরে দাঁড়ালেন। হঠাৎ করে ঝুঁকলেন আমার সামনে। মুখটা বিশ্রীভাবে কাছে আনায় আমি একটু সরে গেলাম। মুখ ফসকে বলেও ফেললাম,
‘আপনি এতো অভদ্র কেনো!’
তাশরিক শব্দ করে হেসে উঠলেন। যেন বেশ মজার কথা বলেছি। আমার মাথাটা আরও নুইয়ে গেল। গলাটা শুকিয়ে এলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
‘ইউ শিয়র, বেইবি গার্ল? আমি তো এখনো কিছুই করলাম। বেশ জেন্টালম্যান হয়ে আছি। জে- ন্টাল -ম্যান… তাশরিক খান। দেখো কতো ভদ্রভাবে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি এখনো। চেয়েও তোমাকে সেভাবে ছুঁইনি। অথচ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কারফিউ জারি হয়েছে তোমাকে দুষ্টু ভাবে ছুঁয়ে দেবার।’
আমি শক্ত করে চোখ বুজে ফেললাম। শ্বাসপ্রশ্বাস গলায় আঁটকে থাকলো। তিনি বলে গেলেন সাবলীলভাবে,
‘আমাকে তুমি এখনো জানো না, এক বিন্দুও চেনো না। আমি —তাশরিক খান নিজের ইচ্ছেদের, আকাঙ্ক্ষাদের পূর্ণতা দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করি না। আমার ত্রিশ বছরের এই জীবনে, আমি আমার সব ইচ্ছে এক মুহূর্তে পূরণ করেছি। শুধুমাত্র একটি বাদে। ওই ইচ্ছে আমাকে পুড়িয়েছে, অসহ্য করে তুলেছে—তবুও আমি তিন তিনটে বছর ধরে সংযত, অপেক্ষারত হয়ে আছি কেনো, হুম? তুমি আমার প্রিয় বন্ধু নিশুর আদুরে ছোটো বোন বলে। বন্ধুর এমন আদুরে বোনকে নিজের করতে আগে বন্ধুকে পটাতে হয়েছে, এরপর বন্ধুর বাবাকে তারপর… মাকে। এতো কিছুর ধার ধারতে না হলে এতক্ষণে….’
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৫
তিনি থামলেন। আওড়ালেন, ‘বাকিটা বলা লাগবে? নাকি করে দেখাবো?’
আমি আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না। ছুটলাম অনেকটা অন্ধের মতন। এতো বড়ো দুষ্টু লোক আমি আমার জীবনে দুটো দেখিনি।