মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৯
নাবিলা ইষ্ক
আমি আমার এতটুকু জীবনে উনার মতন অসভ্য, নির্লজ্জ ছেলেমানুষ দুটো দেখিনি। লজ্জায় রীতিমতো রাগ লাগছে আমার। উনি কী এধরনের কথাবার্তা নিজের কা্নে শুনতে পান? কতটা বেয়ারা শোনায়, জানেন? তাশরিক ভাইয়া যেন আমার মনের কথাগুলো চোখমুখ পড়ে বুঝে নিয়েছেন। প্রত্যুত্তরে কেমন হাসছেন। হাসছেন! তার হাস্যজচোখের ভাষা জানাচ্ছে, ‘মাই বেবিগার্ল, সুযোগ এখনো আছে। লুফে নাও।’ অসহ্য। আমি বিড়বিড় করলাম,
‘নিজের কথাগুলো রেকর্ড করে একদিন কেনো শুনে দেখেন না!’
তাশরিক ভাইয়া সামনে চেয়ে ছিলেন। আমার বিড়বিড় করা কথাগুলো শুনে পাশ ফিরে তাকালেন। বেশ সাবলীলভাবে পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন। তারপর দেখলাম ফোন মুখের সামনে নিয়ে বললেন,
‘My whole body is free for you, baby girl. You can sit wherever you want.’
আমার কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। কথাটুকু রেকর্ড করে তিনি ছাড়লেন রেকর্ডটা। তার কণ্ঠ ফোন থেকে বেজে উঠলো। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে পুরো কথাটুকু শুনে পাথর হওয়া আমার দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন,
‘ভালোই তো শুনতে লাগলো। আরও কিছু বলে আরেকটু শুনবো? আপনি যা বলবেন তাই করবো, বেবিডল।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনার পাশে আমি আর এক সেকেন্ড বসবো না। উত্তর দিকে মা বসে আছেন কিছু আন্টিদের সাথে। আমি তার কাছে গিয়ে, তার পাশেই বসলাম। এংগেজমেন্টের বাদবাকি সময়টা জুড়ে তাকে এড়ানোই আমার প্রধান লক্ষ্য ছিলো। ভুলেও চোখে চোখ রাখার মতন দুর্ঘটনাও হতে দিলাম না। সারাটা সময় মা-বাবা অথবা কাজিনদের পাশেপাশে থাকলাম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তারপরও তার বলা ওমন অসভ্য কথাগুলো পিছু ছাড়ছিলো না। তাড়া করে চলেছে আমাকে। এংগেজমেন্টের আয়োজন শেষ হলো রাত একটা ত্রিশে। আমি ভাইয়ার পেছন-পেছন গাড়িতে উঠে বসেছি বেশ দ্রুততার সাথে। বাবা-মা, চাচারা, মামারা তখনো ও বাড়ির মানুষদের সাথে বিদায়ের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে বিদায় নিয়ে উঠে এলো ভাইয়া। বাকি গাড়িগুলোতেও সবাই চড়ে বসেছে। আমাদের আগে অহনা আপুদের গাড়িটাই বেরুলো। এরপর আমাদের। এরমধ্যে আমি আর তাশরিক ভাইয়াকে দেখতে পেলাম না। অহনা আপুদের গাড়ির ড্রাইভিংও তো দেখলাম না। হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন?
এই যাত্রায় আমার কেনো যেন বেশ খারাপ লাগতে লাগলো। অথচ লাগার কথা তো নয়। আমি তো এড়িয়েছি তার নিজের নির্লজ্জের জন্যই। ওমন উলটপালট কথা বলল কেনো! ভাইয়া আড়চোখে দু-বার আমাকে দেখলেন। তবে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। আওড়ে বললেন, মাথাটা সিটে এলিয়ে চোখ বুজতে। আমার কোলে তখনো তাশরিক ভাইয়ার দেয়া ফুলের তোড়াটা। আমি চেয়ে রইলাম, ছুঁলাম…থমকালাম। জানালার কাচটা নামানো। বাইরে আকাশ ভরা তারা, অর্ধখণ্ডিত চাঁদ হাসছে। শিরশিরে বাতাস বইছে। সেই বাতাস যেন আমার অন্তর ছুঁয়ে গেল। অনুভব করলাম আমার কিছু একটা হয়ে গেছে। আমার বোধহয় সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাশরিক নামক সর্বনাশ।
আগামী শুক্রবার আমার ভাইয়ার বিয়ে্। দুদিন পর গায়ে হলুদ। আমাদের কয়েকবার করে শপিং যেতে হচ্ছে। হটাৎ করেই লিস্ট হাতে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে অবেলায়। আজ ঘরোয়া মেহেদি অনুষ্ঠান অহনা আপুদের বাড়িতে। আপু কল করে বলে দিয়েছেন, সব বোনদের ওখানে বিকেলের আগে উপস্থিত থাকতে। তারা বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ মেহেদি আর্টিস্ট বুক করেছেন। আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সত্য বলতে, তাশরিক ভাইয়ার সামনে পড়তে হবে ভাবলেই আমার অস্থির লাগে। মাথা ভনভন করে। সেই কী এক যন্ত্রণা! উনি সামনে নেই এতেই আমার এই অবস্থা! সামনাসামনি হলে তো আমি বেশিদিন বাঁচবো না। দমবন্ধ হয়ে মা রা যাবো নিশ্চিত। এরচেয়ে ভালো দূরে দূরে থাকা। এড়িয়ে চলা। আমি বাসায় জানিয়ে দিলাম, আমি যাবো না ও বাড়ি। আমার মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বমিবমি পাচ্ছে—এধরনের বাহানা দিলাম। এসব শুনে আর কেউ আমায় সাধলো না। বাবা আদুরে গলায় বললেন,
‘তাহলে রেস্ট নাও।’
সুফিয়া, রুমি আপু—তারা সবাই বিকেলের দিকে রওনা দিলেন ও বাসার উদ্দেশ্যে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম উবুড় হয়ে। ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। ফেইসবুকের নিউজফিড ঘাঁটছিলাম। অনেকটা আনমনা হয়ে। এমন সময় হঠাৎ করে হোয়াটসঅ্যাপে অজানা নাম্বারে মেসেজ এলো। অজানা নয় ঠিক। নাম্বারটা আমি এক দেখাতেই চিনে নিয়েছি। একপ্রকার মুখস্থ। আমার বুকটা ধক করে উঠলাম। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। মেসেজটা সংক্ষিপ্ত,
‘Ador!’
অথচ তার এমন ছোটো নাম ডাকা মেসেজটা পড়ে আমার রীতিমতো ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলো। উনি তো এমনভাবে আমার নাম ডাকার মানুষ নয়। আমি অভ্যস্তও নই। উনি তো আমাকে নানান নামে ডাকেন। আমার ভাবনার মধ্যে দ্বিতীয় মেসেজটি এলো তাশরিক ভাইয়ার,
‘You have five minutes to get ready. I’m coming to pick you up.’
আমি দ্রুতো দু’হাতে ফোন ধরে কম্পিত হাতে ছোটো করে জবাবে লিখলাম,
‘আসবেন না। আমি অসুস্থ। যেতে পারবো না।’
তার রিপ্লাই এলো সময় নিয়ে। তবে সেই একই একরোখা কথাবার্তা,
‘Oh, We’ll see that. Personally.’
আমার হাত-পা আসার হয়ে এলো। এক অন্যরকম ভয়ে। আমি অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি শুরু করলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটায়। তৈরি হওয়া নিয়েও দ্বিধান্বিত। উনি এলে নিশ্চয়ই বাবা বলবেন আমি অসুস্থ? আমাকে দেখতেই তো পারবে না। ঘরের দরজা আটকে রাখা আছে। উনাকে নিশ্চয়ই খালি হাতে ফিরে যেতে হবে। হ্যাঁ, সেটাই। কী বা করবেন? আমাকে পাবেনই তো না। আমি নিজেকে বুঝিয়েশুঝিয়ে শান্ত করলাম। আবার বিছানায় শোবার পায়তারা করছিলাম। কিন্তু কোনোভাবে পারছিলাম না। বারবার মেসেজ তিনটা দেখে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে থাকলো। কেমনভাবে নাম ডেকে মেসেজ করল! আমি না গেলে উনার সমস্যাটা কী? আবার নিতে আসছে! ধমকাচ্ছেও কেমন! আমি অসহ্য হয়ে বসলাম বিছানায়।
ফোনটা ছুঁড়ে ফেললাম বিছানার ওপর। আমার পরনে বাড়ির কাপড়চোপড়। নিজের দিকে একবার চেয়ে এবেলায় উঠে দাঁড়ালাম। আমার মন বলছে, আমাকে যেতেই হবে। দোনামোনা করা যাবে না। বাবাও মনে হয় না আমার টান টানবেন। উনি তার বন্ধুর ছেলের কথাই শুনবেন। আমি অবগত। কদিন ধরেইতো দেখছি তাদের কাণ্ডকারখানা। যতোই মুখে বলুক না কেনো আমি যা বলবো তাই হবে! তারা তো ইতোমধ্যে পারছে না এখুনি তাশরিক ভাইয়াকে মেয়ে জামাই বানিয়ে ফেলতে। হুম! ঘরোয়া মেহেদি আয়োজনের জন্য ড্রেস কোড ছিলো সবুজ রঙের কামিজ। সেলোয়ার-কামিজটা সবুজ। ওড়নাটা লাল। জামার হাতাটা ছোটো। সেলোয়ার প্লাজু ধাঁচের। লাল রঙের সাথে মেলানো জুতি। লাল চুড়ি, লাল ছোটো টিপ। আমি কাপড়চোপড় পরে চুলটা স্যাট করে নিলাম। হালকা মেক-আপ করে নিলাম। ঠোঁট লাইনার দিয়ে লাইন করতে নিতেই হুড়মুড়িয়ে এলেন মা। তিনি সকালের শিফটে হাসপাতাল ছিলেন। বিকেলে ফিরেছেন। গোসল নিয়েছেন মাত্র। চুল ভেজা। ভেতরে ঢুকে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘তাশরিক এসেছে তোকে নিতে। হয়েছে রেডি হওয়া? চল..তাড়াতাড়ি চল। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।’
তার আগ্রহ, তাড়া দেখে আমার রাগ হলো। অসন্তুষ্ট গলায় বললাম, ‘আমি বলেছিলাম না, আমি অসুস্থ? উনি কেনো এসেছেন নিতে? বাকিরা তো গিয়েছে।’
মা যেন আরও উৎসাহিত হলেন, ‘বাকিরা আর তুই এক হলি নাকি?’
আমি সরু চোখে চেয়ে থাকাতে মা অপ্রস্তুত হলেন। এদিক-ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আওড়ালেন, ‘তোর কী ওকে পছন্দ না?’
আমি এবারে মিইয়ে গেলাম। পছন্দ-অপছন্দের কেউই ছিলেন না তিনি আমার। একটা আগ্রহ কাজ করতো। একদম নতুন, অন্যরকম, অনন্য এক চরিত্র বলে মনে হতো। তারপর..তারপর ওই আগ্রহ কীভাবে যেন এতোটা লজ্জায় পরিণত হলো আমার জানা নেই। আমি যে পছন্দের চেয়েও বেশি কিছুতে এগিয়ে বসে আছি তা অল্প হলেও বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি বলেই তো এড়াতে চাইছি। কিন্তু ওই লোক দিলে তো? আমি মিনমিন করলাম,
‘জানি না।’
মা বড়ো করে হাসলেন। কেমন গর্বের সাথে বললেন, ‘জানতাম। তাশরিককে অপছন্দ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অসম্ভব!’
মুহূর্তে আমার অনুভূতির পরিবর্তন ঘটল ঘূর্ণিঝড়ের মতন। বিরক্তি নিয়ে শুধালাম, ‘ওহ, তাই নাকি? তা তোমার তাশরিক কী স্বর্ণ দিয়ে বানানো? যে তাকে কারো অপছন্দ হবে না? তাহলে শুনে রাখো। আমি তাকে….’
ভরাট কন্ঠের প্রশ্ন এলো অদূর থেকে, ‘আমাকে কী?’
আ্মি দ্রুতো মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। তাশরিক ভাইয়া এসে দাঁড়িয়েছেন দুয়ারের সামনে। কালো রঙের সিল্কের লুজ প্যান্ট পরে আছে, হাতা কাটা কালো রঙের গেঞ্জি দিয়ে। অগোছালো চুল। হাতে গাড়ির চাবি। ভ্রু তুলে আমার দিকেই চেয়ে আছেন। আজ আর ঠোঁটে হাসি নেই। ফাজলামোর ‘ফ’টুকুও নেই। কেমন গম্ভীর চোখমুখ! আমি মাথা নোয়ালাম। মা আমাকে তাড়া দিয়ে তাশরিক ভাইয়াকে বললেন,
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৮
‘আসো বাবা। ওর হয়ে গেছে। এখুনি নামবে।’
আমি ভুলেও আর চোখ তাকালাম না। তাশরিক ভাইয়া চলে গেলেন। আমি বড়ো করে শ্বাস ফেললাম। কান্না আসছে, কিন্তু চোখে পানি নেই। আমার তো এখন যেতেই ইচ্ছে করছে না। কেমন গা শিরশির করছে। উনাকে কিছুদিন ওমনভাবে দেখে এখন এমন গম্ভীরভাবটা মেনে নিতে পারছি না। ভয় হচ্ছে।