মাই লাভ মাই লাইফ শেষ পর্ব
নাবিলা ইষ্ক
তার গাওয়া গানগুলো মনে হয় তখনো হলে প্রতিধ্বনি তুলছিলো। আমার ভেতরেও কিছু একটা সমানতালে হচ্ছিলো। আমার অনুভূতি গুলো পুরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারপাশে। আমি বড্ড বাজেভাবে কিছু একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে আবব্ধ… তা বুঝতে পারছিলাম। স্কুল জীবনে একটা কথা ম্যাডামকে বলতে শুনেছিলাম –
‘ভালো মেয়েরা কিন্তু দুষ্টু ছেলেদের প্রতি উইক হয়। কারণ বিপরীত চরিত্র আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে।’
আমার বেলাতেও বুঝি তাই হলো? নাহলে ওমন একটা দুষ্টু লোকের প্রতি এমন অনুভূতি আসবে কেনো? এইযে আমি সারাটা সময় তাকে ঘুরেফিরে দেখলাম এইসব কীসের লক্ষ্মণ? প্রেমের তো! আমি বোধহয় প্রেমে পড়েছি।
বাজে ভাবে। আমাদের প্রোগ্রাম শেষের পথে। খাওয়াদাওয়ার পর কিছুক্ষণ বড়োদের মধ্যে কান্নাকাটি হয়েছে। আন্টি ভীষণ কেঁদেছেন ভাবীকে জড়িয়ে। একটামাত্র মেয়ে তো! কান্না করাই তো স্বাভাবিক। বিপরীতে ভাবী অবশ্য শব্দ করে কাঁদেননি। তার চোখ শুধু দুটো ছলছল করছিলো মাত্র। তাতেই যেন বিশ্বের বেদনা। অন্যদিকে আন্তরিকতার স্রোত বইছে বাবা আর আংকেলের মধ্যে। একে ওপরের দু-হাত ধরে আলাপ করছিলেন। ভাইয়া তাদের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছেন অসহায় ভাবে। তিনি হয়তোবা ভাবীর নীরব কান্না সহ্য করতে পারছিলেন না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই পর্যায়ে আংকেল ভাইয়ার কাঁধ ছুঁয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বললেন। আন্টিকে ছেড়ে ভাবী এবার তাশরিক ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে চুপ করে আছেন। কাঁদছেন না তবে তাকে বেশ আবেগপ্রবণ দেখালো। তাশরিক ভাইয়া কানের কাছে বেশ ধীরে কথা বলছিলেন। ওই সময়টায় না তাকে অত্যন্ত চমৎকার লাগছিলো। তিনি নিজে ভাবীকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভাইয়াও উঠে বসলেন ড্রাইভিংয়ে। তাদের গাড়ির পেছনে আরও ছয়টা গাড়ি। গাড়িগুলো ভাইয়ার বন্ধুদের দিয়ে ভরতি। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সবাই মিলে লং ড্রাইভে বেরুবেন। আমি মা-বাবার দিকে যেতে চাইছিলাম —তখুনি তাশরিক ভাইয়া উড়ে এলেন আমার পেছনে। বাবাকে মিষ্টি করে বললেন –
‘আংকেল, আমরা সবাই লং ড্রাইভে যাচ্ছি। তিনশো ফিট পর্যন্ত চক্কর দিয়েই ফিরবো। আদর সাথে চলুক, কেমন?’
মুহূর্তে আমি সচেতন হলাম। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকানোর আগেই বাবা হেসে হেসে বললেন –
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ যাও। তবে ওরা হচ্ছে নবদম্পতি। পুত্র বধূকে বাড়িতে ওঠানোর তো একটা নিয়ম আছে নাকি? তাড়াতাড়ি ফেরো।’
নিশু ভাইয়া গাড়ির ভেতর থেকে আশ্বস্ত করলেন। আমি দ্রুতো মুখ খললাম –
‘আমি যেতে চাচ্ছি না। বাসায় যাব….’
ভাবী ট্রেনের গতিতে জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। যেন এখুনি আমাকে খেয়ে ফেলবেন। ফরফর করে বলে গেলেন –
‘এই তোর ভালোবাসা, আদর? আমি যেখানে তুই ওখানে থাকবি না? আশ্চর্য! তাড়াতাড়ি আয়।’
আমি মিইয়ে গেলাম। আংকেল হেসে হেসে বললেন – ‘যাও, ঘুরে এসো..মামণি। ভালো লাগবে।’
আমি আড়চোখে একবার তাশরিক ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি সবাইকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন। আমি এগুলাম ভাইয়া-ভাবীর গাড়ির দিকে। পেছনের দরজা খুলে উঠে বসবো, এমন সময় তাশরিক ভাইয়া পেছন থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন শব্দ করে। আওড়ালেন,
‘এটা নয়। পাশেরটায় উঠে বসো.. বেবিগার্ল।’
ইতোমধ্যে ভাইয়ার গাড়িটা একটানে বেরিয়ে গেলো। আমাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাশরিক ভাইয়াই হাত ধরে বসিয়ে দিলেন তার গাড়িতে। আমার কেমন সংকোচবোধ হচ্ছিলো। লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছিলাম। আনচান করছিলো হৃদয়। এরমধ্যেই তাশরিক ভাইয়াও উঠে বসলেন ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টার্ট করলেন। সব গাড়ির পেছনে বেরুলো আমাদের গাড়িটা। রাতের তখন একটা বিশ। পুরো শহর নিস্তব্ধতার গান গাইছে। কুকুরের ঘেউঘেউ আর দু-একটা গাড়ির শব্দ ব্যতীত আর কোনো কোলাহল নেই। সব গুলো গাড়ি আগে-পিছে..পাশাপাশি ছুটছিলো। ভাইয়ার বন্ধুরা চিৎকার করে গান গাইছেন। আমাদের গাড়িটা একসময় ভাইয়ার গাড়ির পাশাপাশি চলে এলো। ভাবী হাত নাড়ছেন। কোনো একটা গান গাইছিলেন বোধহয়। আমি দ্রুতো ফোন তুলে তার আর ভাইয়ার একটা ভিডিও করলাম। কী মধুর দেখতে লেগেছিলো! একসাথে তাদের কী যে চমৎকার লাগছিলো। ওই ভিডিওতে তাশরিক ভাইয়াও এলেন। আড়চোখে একবার তাকালাম পাশে। তাশরিক ভাইয়া ড্রাইভ করছেন চুপচাপ, ভদ্রভাবে। এতে আমি একটু আশ্চর্য হলাম বটে। তাকে এমন চুপচাপ দেখে অভ্যস্ত নই বলেই হয়তোবা। আমার দিকে না চেয়েও বুঝি তিনি আমাকে পড়তে পারলেন? সামনে চেয়েই কেমন করে বলে বসলেন –
‘Trying to be a gentleman for you, My little girl.’
আমার চোয়াল ঝুলে এলো। তিনি আর জেন্টালম্যান? আমি ফ্যালফ্যাল করে পাশে তাকালাম। এতে তিনি ্নিঃশব্দে সামান্য হাসলেন। গাড়ির আলোতে সেই হাসি কী চমৎকার দেখতে লাগলো! হাসির তালে কাঁপলো তার গলার অ্যাডাম’স অ্যাপল। উঁচু নাক, পাতলা ঠোঁট, তীক্ষ্ণ চোয়াল। চোয়াল জুড়ে ছাটা ছাটা দাড়ি। আমি বোধহয় তাকে অনেক্ষণ ধরে দেখছিলাম। তিনি লক্ষ্য করলেন। তাকালেন আচমকা। আমি থতমত খেয়ে সোজা হয়ে বসে আমার পাশের জানালার দিকে তাকালাম। বাইরে চমৎকার আবহাওয়া। আকাশে দারুণ একটা চাঁদ। মিষ্টি বাতাস। আনমনা চাঁদের গায়ে চাইতেই কেমন তাশরিক ভাইয়ার মুখটা ভেসে উঠলো। তখুনি তার কণ্ঠও ভেসে এলো কানে –
‘আই লাভ ইউ।’
আমি চমকালাম, থমকালাম। শ্বাস আটকে এলো। শব্দ করে হৃৎপিণ্ড বিট করছিলো। ফিরে তাকালাম পরমুহূর্তেই। তাশরিক ভাইয়া তখনো তাকিয়ে আছেন সামনে। আমি ভ্যাবলার মতন চেয়ে ছিলাম তার মুখের দিকে। অবিশ্বাস যেন চেহারায় লেখা আমার। নিজের কানকেই বিশ্বাস হলো না। তিনি বলে গেলেন –
‘সেদিন ভীষণ বাজেভাবে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আংকেল তোমাকে নিয়ে আটকে ছিলেন চৌরাস্তার মোড়ে। তোমাদের গাড়ি ব্রেকফেইল করেছিলো। তার ওপর টায়ার পাঞ্চার, খারাপ ওয়েদার, নেটওয়ার্ক প্রব্লেম। নিশু তখন আউট ওফ সিটি। আংকেল আমাকে কোনোরকমে কল করে জানালেন এই অবস্থার কথা। আমি মুহূর্তে বাইকে করে ছুটলাম ঝড়বৃষ্টির মধ্যে। পৌঁছে দেখলাম নীরব, অন্ধকার রাস্তা। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে আংকেল অসহায় চোখে তাকিয়ে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখছিলো। আমিও ওই প্রথম তোমাকে খেয়াল করেছিলাম। নিশুর বোন হিসেবে নয়। অজানা একটা মেয়ে হিসেবে। তুমি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে হাসছিলে। কী সুন্দর দেখতে সেই হাসি! ঝলমল করছিলে তুমি। যেমন অন্ধকার আকাশে নক্ষত্ররা করে? তেমন। এরপর এরপর সবসময়ই তোমাকে মনে পড়তো। তোমার মুখ চোখে ভাসতো, তোমার হাসি…তোমার চোখ, ঠোঁট সব…’
আমি সম্মোহন হওয়ার মতো তাকিয়েই থাকলাম। আমি যে কাঁপছিলাম, আমি যে সমুদ্রে ভাসলাম তা হয়তো-বা অদেখা। ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুকের ভেতরে অজানা এক আনন্দের স্রোত বয়ে গেলো। মনে হলো আমি মেঘে ভাসছি। বাঁধভাঙা খুশিতে গলা রোধ হয়ে এলো। চোখ দুটো ভিজে উঠলো। শুধু কানে বাজছিলো তার বলা সেই তিনটি শব্দ সহ প্রত্যেকটা শব্দ। তখুনি আমাদের সামনে দিয়ে জোরসে বাদবাকি গাড়িগুলো যাচ্ছিলো। ভাবী আমাকে শব্দ করে ডাকলেন। আমি সেই ডাক শুনতে অনেকটা সময় নিলাম বোধহয়। ভাবী কেমন বিরক্তি নিয়ে চ্যাঁচালেন –
‘কীরে…আদওওঅঅঅঅর। কানে শুনছিস না?’
আমি থতমত খেলাম। অন্যমনস্ক হয়ে তাকালাম – ‘জি, জি ভাবী!’
অহনা আপু পাখির মতন হাসছিলেন – ‘রাজি হয়ে যা। আমার ভাইয়ার মতন লাভার বয় কিন্তু দ্বিতীয় কাউকে পাবি না। বলে দিচ্ছি।’
আমার সময় লাগলো তার কথার মানে বুঝতে। তারমানে আজ যে তাশরিক ভাইয়া তার মনের কথা আমাকে বলবেন সেসম্পর্কে ভাবীও জানতেন? আর কে? আমি ফের তাকালাম তাশরিক ভাইয়ার দিকে। তিনি ফিরে তাকাননি। তবে একহাতে স্টিয়ারিং সামলে অন্য হাতে আমার একটা হাত টেনে ধরলেন নিজের হাতের মুঠোয়। তার হাতের উষ্ণতায় আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। দিশেহারা লাগলো সবকিছু। তিনি মাথাটা নুইয়ে হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আমি শক্ত করে চোখ বুজে ফেললাম। কেঁপে উঠলাম তার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে। তিনি হাতে দুটো চুমু খেয়ে হাতটা শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে রাখলেন। কী বড়ো তার হাতটা! ওই হাতটা আশ্চর্যজনক ভাবে আমার কাছে স্বস্তির মনে হলো, সুরক্ষার মনে হলো। আমি স্বপ্ন দেখার মতোই তাকে দেখে গেলাম। তিনি হঠাৎ ফিরে চেয়ে ঝলমল করে হেসে ফেললেন –
‘What’s wrong with you my sweetest little fairy?’
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে বিড়বিড় করলাম –
‘কিছু না তো।’
তাশরিক ভাইয়া আরও শক্তি দিয়ে ধরলেন আমার নরম হাতটা। আওড়ালেন –
‘Will you marry…’
তখুনি তাশরিক ভাইয়ার ফোনে কল এলো। আমি তার অর্ধেক কথাটি বুঝে ফেলেছিলাম। আমার তখন এলোমেলো অবস্থা হয়েছিলো অনুভূতির জোয়ারে ভেসে। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিলো। ফোনটা ফের বাজলো। তিনি ধরলেন না। ফোন বেজেই যাচ্ছে, তাশরিক ভাইয়াকে কথাই বলতে দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে আমিই আওড়ালাম –
‘ই-ইম্পরট্যান্ট হতে পারে।’
এতে কাজ হলো। তিনি আমার হাত ছেড়ে ফোনটা তুলে নিলেন হাতে। স্ক্রিনে বাবার নাম। মনে পড়লো আমি ফোন আনিনি। আর নিশু ভাইয়ার, ভাবীর ফোনও বোধহয় ওফ। তারা নীরব সময় পাড় করতে চাইছিলেন। তাশরিক ভাইয়া কল রিসিভ করে লাউডে দিয়েছিলেন। ওপাশ থেকে ঘনঘন গাড়ির আওয়াজ। বাবা চিৎকার করছেন –
‘তোমরা কতদূর? কোথায়? তাড়াতাড়ি ফেরো। নিশুর গাড়ি কতদূর? ওর ফোন বন্ধ কেনো? ওকে ফেরাও। সামনে যেও না। দ্রুতো দ্রুতো……’
আমি ধড়ফড়িয়ে উঠলাম বাবার ওমন আর্তনাদে। তাশরিক ভাইয়াও সতর্ক হলেন – ‘আংকেল, কী হয়েছে? আমরা তিনশো ফিটের রাস্তায়!’
বাবা প্রায় কেঁদেই ফেললেন। শব্দ করে কেঁদে উঠেছেন। আংকেলের আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। ওপাশ থেকে এবারে আংকেল বললেন –
‘গাড়ি ঘোরাও তাশরিক। নিশুর ওপর আক্র মণ হবে। ওই স্কাউন্ড্রেল সজীব লোক দিয়ে ট্রাক ভাড়া করিয়েছে। এখুনি ওর মা ফোন করে সতর্ক করলো। ওই ছেলে একটা সাইকো। দু-একটা আর্গুমেন্ট ধরে কেউ এমন ইনহিউম্যান কাজ করতে পারে? ওর ব্যবস্থা পরে করবো। বাবা, আমার বাবা তুমি…তুমি ফিরে আসো। তাড়াতাড়ি করো। শিশুদের গাড়িকেও ফিরতে আদেশ দাও। আমরা আসছি…. আসছি….’
আমি আঁতকে উঠতেও পারলাম না। সুদূরে থেকে ধেয়ে আসতে দেখা গেলো হলুদ রঙের ট্রাকটাকে। বিশাল সেই ট্রাক। হাইস্পিডে ছুটে আসছে পাগলের মতন। তাশরিক ভাইয়া ফোনটা ফেলে স্পিড বাড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে একমুহূর্তের জন্য গাড়িটা স্লো করে আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিলেন। একপলক তাকালেন। আওড়ালেন –
‘ভালোবাসি।’
এরপর গাড়িটা এক টানে সামনে নিয়ে গেলেন। আমি অঝোরে কেঁদে ফেললাম। চিৎকার করে ডাকতে থাকলাম। গাড়িটা থামেনি। নির্ভয়ে হাইস্পিডে সামনে এগুচ্ছে ভাইয়ার গাড়ির দিকে। চোখে ভাসলো সদ্য বিয়ে করা ভাইয়ার মুখ, হাসতে থাকা ভাবীর মুখ, কিছুক্ষণ আগে আমার হাতে চুমু খাওয়া তাশরিক ভাইয়ার মুখ। তাদের মধ্যে একটা কারো কিছু হলে আমি মানতে পারবো না। আমি আমি বোধহয়… আমি একঝটকায় উঠে, দু-হাতে লেহেঙ্গা তুলে ছুটলাম গাড়ির পেছনে। হলুদ ট্রাকটা ধেয়ে যাচ্ছিলো নিশু ভাইয়ার গাড়ির দিকে। সেই কী নৃ শংস দৃশ্য। এরচেয়েও নৃ শংস দৃশ্য ছিলো —তাশরিক ভাইয়ার গাড়িটা চোখের পলকে হাওয়ার বেগে ছুটে সোজা নিশু ভাইয়ার গাড়ির সামনে গিয়ে ব্রেক কষতেই, হলুদ ট্রাকটা সজোরে তাশরিক ভাইয়ার গাড়িতে ধ্বসে পড়ে। সেই শব্দে ভূমি সহ কাঁপে। চোখের পলকে, একমুহূর্তে তার গাড়িটা উল্টে গিয়ে থেতলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। দাউদাউ করে আগুন ধরে ওঠে পুরো গাড়িতে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।
সবকিছু চোখের সামনে অন্ধকার লাগে। কিন্তু পা জোড়া থামে না। আমি ছুটছিলাম পাগলের মতন, অন্ধের মতো। আমার মাথা কাজ করছিলো না। আমি কিছুই অনুভ করতে পারছিলাম না। শুধু শুধু মস্তিষ্ক একটা কথা জানাচ্ছে, ওই আগু ন ধরে ওঠা গাড়িটা তাশরিক ভাইয়ার। ভেতরে তিনি আছেন। একটু আগে তিনি হাসছিলেন। গাইছিলেন, আমাকে ডাকছিলেন, বেবিগার্ল। তার বেবিগার্ল। আমাকে হাজারো উদ্ভট নামে ডাকা মানুষটাকে আমি যে হারাতে পারি… আমি তখনো জানতাম না। জানতাম না, এই দিনটাই ছিলো আমার জীবনে তার শেষ দিন। তার মুখ থেকে বেবিগার্ল ডাক শোনা এই জীবনের জন্য যে এখানেই সমাপ্ত, আমি তখনো বুঝতে পারিনি। পাগলের মতো শুধু ওই আগুনের দিকে ছুটছিলাম। এতো এতো মানুষ জমলো কেউ তৎক্ষণাৎ পারেনি ওমন ভয়াবহ আগুনের ভেতর থেকে মানুষেটাকে উদ্ধার করতে। ভাইয়ার পাগলামো, ভাবীর চিৎকার কিছুই আমাকে ছুঁলো না। আ- আমি ছুটে ওই আগুনে ঢুকে তাকে বাঁচাতে চাইছিলাম। ত..তিনি… আমার চোখের সামনে আমি তাকে পুড়ে ম রতে দেখেছি। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ, আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম ভালোবাসাকে আমি চোখের সামনে একপলকে হারিয়ে যেতে দেখেছি।
আদর থামে। বড়ো করে শ্বাস টেনে নেয় ভেতরে। পুরনো ব্যথাগুলো জীবন্ত হলো ফের। র ক্তাক্ত হলো হৃদয়। সূক্ষ্ণ ভাবে যেন তীর এসে বিঁধে ছে। কিন্তু ওপরে এখন ও নিজেকে এখন নির্বিকার রাখতে জানে। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে গেলেও যে কেউ ধরতে পারবে না। বুঝতে পারবে না। নীরবতার চোখ দুটো ছলছল করছিলো। ও একেক করে ছবিগুলো দেখছিলো। ছবিগুলো পনেরো বছর আগের। নিশু আর অহনার বিয়েতে তোলা। সবাই হাসছে। কী চমৎকার একটা ফ্যামিলি ফটো! পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন সুদর্শন, লম্বা দেখতে পুরুষটি আদরের পাশে দাঁড়িয়ে আদরের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলো। আদর লজ্জায় মুখ নুইয়ে রেখেছে ছবিটিতে। নীরবতা ছবিতে হাত বুলিয়ে আওড়ালো,
‘তাকে কতো জীবন্ত লাগছে।’
আদরের হাত থামে। ও একটা স্কেচ আঁকছিলো। বয়স এসে ছুঁয়েছে পঁয়ত্রিশে। এখন আর ওই বাচ্চা আদরটি সে নয়। নারীত্বের ছাপ এসে ছুঁয়েছে। কতো অতীত ভুলেছে। শুধু ভুলতে পারেনি তাশরিক নামক ওই বেপরোয়া পুরুষটিকে। যে তাকে নিয়মিত ফুলের তোড়া দিতো। আদর করে ডাকতো নানান নামে। যে ঘনঘন ইংরেজি বলতো। একদম আপদমস্তক একজন বেয়ারা, প্লে-বয় ধাঁচের ছিলো। যে আদরের প্রথম চুমুটা আচমকাই এক অন্ধকারে কেড়ে নিয়েছিলো। কেড়ে নিয়েছিলো আদরের নরম হৃদয়, তার প্রেম তার ভালোবাসা। আনমনা হয়েই আদর আওড়ায় –
‘তিনি আমার কাছে জীবন্তই।’
নীরবতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছলছল চোখ দুটো মুছে চায় আদরের ভাবুক মুখপানে –
‘তাই বলে কী বিয়ে করবি না? কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না, আদর। তিনি অতীত। তোকে এগুতে হবে তো। নিশু ভাই, ভাবী..আন্টি-আংকেল সবাই তোকে নিয়ে চিন্তিত। তার আর কতোটা পু ড়বেন বলতো? আন্টি আমাকে সেদিন ধরে কাঁদছিলেন জানিস। তিনি সহ সবাই চায় তোর সুখ। তুই হাসিখুশি থাকবি এটাই তাদের একমাত্র চাওয়া এখন।’
আদর নরমভাবে মাথা নাড়িয়ে হাত দুটো পরিষ্কার কাপড়ে মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। এযাত্রায় কথা বলতে গিয়ে ওর কণ্ঠ সামান্য কাঁপে –
‘আমি…আমি আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না রে। আমার পক্ষে তাকে ভোলা সম্ভব না।’
নীরবতা হাল ছাড়ে। তাকায় দেয়ালে। ওখানে ম রে যাওয়া ফুলের অনেক গুলো ওয়াল আর্ট সাজানো। ফুলগুলো সম্ভবত ওই লোকটির দেয়া ফুলগুলোই। নীরবতার ভেতরটা কেমন ভারী লাগলো। দমবন্ধ হয়ে এলো ওর। কী এক বিশ্রী পীড়া! ওখানে চেয়েই ও আওড়ায় –
মাই লাভ মাই লাইফ শেষ পর্ব
‘কতকাল?’
আদর প্রত্যুত্তরে নীরব। তবে ভেতরে তার উত্তরটা স্পষ্ট।
‘অনন্তকাল।’
সে যে শুধু ওর প্রথম ভালোবাসা না… ওর জীবনও!