মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৪

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৪
নওরিন কবির তিশা

সময় এক পলকে যেন গলে যেতে থাকা মোম। দেখতে দেখতে আরও একটা সপ্তাহ পার।
সেদিন বিকেলের ফ্লাইটে দেশে ফিরে এসেছেন শিশিরের বাবা-মা। আর শিশির, নওরিফাদের বাসায় না গিয়ে সোজা ফিরে গেছে নিজের বাসায়।
শিশিরের রুমটা তাদের বাসার দোতলার উত্তর পাশে কর্নার ঘর—যেখানে সকালের রোদের স্নিগ্ধতা প্রথম এসে পড়ে। আজও ঠিক তেমনই। সেই রোদ্দুরের মায়ায় ঘুম ভাঙে শিশিরের।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, সময় মাত্র ছয়টা পঞ্চান্ন।
শিশির হালকা হেসে নেয়।
এই সপ্তাহটা তার জন্য খুব স্পেশাল—ইলমা আপুর বিয়ে সাজিদ ভাইয়ের সাথে।
আজ তাকে ভার্সিটিতে তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তারপর আনায়াদের বাসা, পরে মামাদের বাসা। পুরো সপ্তাহটাই সে মামাদের বাসায় থাকবে।
এসব ভাবতে ভাবতে সে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রেডি হয়ে নিচে নামার আগে দরজা খুলতেই ফুফুর মুখোমুখি হয় শিশির।শিশির বিনয়ের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে,,
“কেমন আছো ফুপ্পি?”
কিন্তু ফুফু—শিরিনা শাহ—একটাও কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
শিশির ওদিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিচে নেমে আসে।
আগে হলে হয়ত কষ্ট পেত, এখন অনেক কিছুই অভ্যাস হয়ে গেছে।
নওরিফা আন্টি, যিনি একেবারেই রক্তের সম্পর্কের কেউ না, তিনিও তার সঙ্গে কেমন মিষ্টি ব্যবহার করেন! অথচ নিজের ‘ফুফু’ হয়েও শিরিনা শাহ যেন তাকে চিরশত্রু মনে করেন।
তবু শিশির বিনয় ধরে রাখে। এটাই তার ভদ্রতা।

“সপ্তাহের প্রথম ক্লাসটা কেন এই হিটলারেরই হয় রে? সপ্তাহের শুরুতে ওনার মুখ দেখে পুরো সপ্তাহটাই বরবাদ লাগে।”
পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে ক্ষোভে ফোঁস করে কথাগুলো বলে উঠলো ফারিন। কণ্ঠে বিরক্তি, মুখে স্পষ্ট অনীহা।
কিন্তু মুহূর্তেই নির্ঝরের শান্ত অথচ কঠোর কণ্ঠস্বর ছুঁয়ে গেল পুরো ক্লাসরুমটা—
“এই ক্লাস কারো পার্সোনাল অনুভূতি জানানো বা মনের ঝাল মেটানোর জায়গা না। যদি কারো গল্প করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে ক্লাসরুমের বাইরে যেতে পারেন। এখানে পড়াশোনা হয়, পিকনিক না।”
একটু থেমে চোখ ঘোরালেন চারপাশে, তারপর গলার স্বর আরও ধীর অথচ বিষের মতো:
“আর হ্যাঁ, কলেজ সবার জন্য না। কেউ কেউ মনে করে ক্যাম্পাসটা যেন সিনেমার সেট, আর ক্লাসরুম রোমান্সের মঞ্চ। যেখানে পারছে গোলাপ ছুঁড়ে দিচ্ছে, শিক্ষকের সম্মান ভুলে—নিজের সীমা পার করে যাচ্ছে।”
ফারিন চুপচাপ বসে রইল।

চোখের পলক ফেলতেও যেন সাহস হারিয়ে ফেলেছে।
সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে—এই তীর্যক কথার লক্ষ্য সে নিজেই।
কারণ কিছুদিন আগেই… সে-ই ছুঁড়ে ফেলেছিল সেই গোলাপ। যদিও সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না তবুও
কিছুদিন আগে🥀🥀🥀
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছিল সময়টা। ক্লাস শেষে ফারিন দুই তালার করিডোর দিয়ে হাঁটছিল। চোখে মুখে বিরক্তির ছায়া। হঠাৎই পেছন থেকে এক মেয়ে এসে তার হাতে একটি টকটকে লাল গোলাপ ও একটি ছোট্ট চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল—

“একজন সিনিয়র ভাইয়া আপনার জন্য দিয়েছে।”
মেয়েটি কিছু বুঝতে না দিয়েই চলে যায়।
ফারিন হতভম্ব হয়ে কিছু বলার আগেই, ফুলটা তার হাতে ধরা পড়ে।
সে চিরকুটটা না খুলেই সোজা নিচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
মাথা গরম ছিল—আচরণও ছিল সেইরকম তীব্র।
অথচ সে খেয়াল করেনি—নিচে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের সবচেয়ে গম্ভীর, নীতিবান আর কাঠখোট্টা শিক্ষক—নির্ঝর স্যার।
গোলাপটা সোজা গিয়ে পড়ে তার পায়ে, আর চিরকুটটা আঙুলে লেগে মাটিতে পড়ে যায়।
নির্ঝর কিছুটা অবাক হয়ে সেটি তুলে নেন। চিরকুটে বড় করে লেখা—

“I Love You”
তিনি একটু ওপরে তাকান।
ফারিন দাঁড়িয়ে, চোখ-মুখে হতচকিত ভয়ের ছায়া।
তাদের চোখাচোখি হয় এক মুহূর্ত।
এরপর ফারিন পেছন ঘুরে দ্রুত সরে পড়ে। সে ভেবেছিল পরে ক্ষমা চেয়ে নেবে কিন্তু পরে আর নির্ঝরের কোন ক্লাস না থাকায় তার সাথে দেখা হয়নি ফারিনের।

বর্তমান
ক্লাস শেষ।
শব্দহীনতা গায়ে মেখে নির্ঝর বেরিয়ে যাচ্ছে।
পিছন থেকে এক কণ্ঠ থামিয়ে দেয় তাকে—
একটা কাতর, লাজুক কণ্ঠ,,
“স্যার!”
পায়ে ধীরে থেমে যান তিনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান।
চোখে না রাগ, না আশ্চর্য—শুধু একধরনের অবিচল শীতলতা।
“বলো?”
ভরাট গলা। সংক্ষিপ্ত অথচ ওজনদার।
ফারিন একপা এগিয়ে এসে বলে—
“আমি… আসলে সেদিন যা হয়েছিল, সেটা অনিচ্ছাকৃত ছিল স্যার। আমি আপনাকে দেখিনি নিচে। তাই ওইভাবে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম।”

নির্ঝর চোখ তুলে একবার তাকালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন—
“তুমি যাকে লক্ষ্য করেছিলে না, সে তো ঠিকই লক্ষ্য করেছিল তোমাকে।
উপহার ছোঁড়ার পেছনে যদি রাগ থাকে, ক্ষমার পেছনে কি থাকে জানো?”
ফারিন একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।
কি বলবে বুঝতে পারে না।
নির্ঝর ধীরে বলেন—
“ক্ষমা তখনই অর্থ রাখে, যখন তা সময়মতো আসে।
তবে যেহেতু এখন বলছো, ধরে নিচ্ছি তুমি বুঝেছো—অন্তত কিছুটা।”
ফারিন একটু সাহস করে বলে—
“আমি সত্যিই দুঃখিত, স্যার। এমন কিছু আর কখনো হবে না।”
নির্ঝর এবার সোজা দাঁড়িয়ে বলেন—
“তোমার ব্যবহার কারো কাছে ভালো না লাগতে পারে।
তবে নিজের সম্মান নিজে ভাঙা—এটা অনেক বড় ভুল।
পরের বার, আবেগ ঠান্ডা হলে তবেই কাজ করবে।
ক্লাসের মেয়ে বলে ছাড় দেবো—তা ভাববে না কখনো।”
তারপর তিনি আর কিছু না বলে সামনে হাঁটতে থাকেন।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ফারিন, ভেতরে একরাশ লজ্জা, আর একরাশ চিন্তা নিয়ে।

বিবাহিত সম্পর্কের এক সপ্তাহ পার হলেও, রাকিব আর সাবিহার মাঝে গড়ে ওঠেনি কোনও বিশেষ বোঝাপড়া।
একই ছাদের নিচে তারা থাকে ঠিকই, কিন্তু সম্পর্ক—তা যেন শুধুই সামাজিক চুক্তির মতো। তবুও এই সাদামাটা দৈনন্দিনতায় এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পায় রাকিব। অন্তত এখন, তার অসুস্থ মায়ের পাশে একজন আপনজন আছে—এই ভাবনাই তাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়।
অবাক করার মতোভাবে, সাবিহা আর রাকিবের মায়ের সম্পর্কটা দিনে দিনে গাঢ় হয়ে উঠেছে। যেন দুই প্রজন্মের দুই নারী নয়, বরং দুই ভাঙাচোরা হৃদয়ের নিঃশব্দ বোঝাপড়া। সাবিহা নিজেই গিয়ে ওষুধ খাওয়ায়, মায়ের পায়ের ম্যাসাজ করে, কখনও বা চুপিচুপি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাকিবের প্রতিবন্ধী ছোট বোনটাকেও সাবিহা যেন চোখে চোখে রাখে, আপন করে নিয়েছে মেয়েটিকে।
রাকিব কখনও দূর থেকে দেখে—মা হেসে উঠছে, ছোট বোন সাবিহার হাত ধরে বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছে। আর তখনই তার মনে হয়—যাক, সংসারটা হয়তো এখনও পুরোপুরি শূন্য হয়ে যায়নি।
সাবিহাকে সে আজও পুরোপুরি পায়নি—এই কথাটা বুকের ভেতরে খচখচ করলেও, মা আর বোনের মুখের সেই প্রশান্ত হাসিটুকু দেখে রাকিব যেন হেরে গিয়েও জিতে যায়।

ভার্সিটির ক্লাস শেষে শিশির সবে রুম থেকে বেরিয়েছে। আর তখনই সামনে একটা কালো বাইক এসে থামে। হেলমেট খুলতেই দেখা যায়—নাহিয়ান। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
শিশির এক পা এগিয়ে গিয়ে অবাক চোখে বলে,
“আপনি এখানে? কোন দরকার?”
নাহিয়ান শুধু একটুখানি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“তুই একা?”
“হ্যাঁ, আনায়া আজকে আসেনি। সম্ভবত অসুস্থ।”
“ওহ। বাইকে ওঠ।”
শিশির ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বাইকে উঠে আমি করবটা কি? আনুচু আসবে। আমি ওনার সাথেই চলে যাব।”
নাহিয়ান এবার ঠাণ্ডা অথচ ধৈর্যচ্যুত কণ্ঠে বলে,
“তোর আনুচু আজ আসবে না।”
“কেন?”

এবার আর না থেমে সোজা গলা চড়িয়ে বলল,
“কারণ আমি বলেছি তাই। বাইকে ওঠ।”
শিশির তবু থেমে যায় না,
“কিন্তু আমি তো আনায়াদের বাসায় যাব।”
নাহিয়ান এবার একদম ধৈর্য হারিয়ে বলে,
“আনায়াদের বাসায় তোর যাওয়া লাগবে না। মা আর রোদেলা আন্টি গিয়েছে। এখন তুই সরাসরি আমাদের বাসায় যাবি। That’s final।”
শিশির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনাদের বাসায়? আমি?”
“হ্যাঁ, আমাদের বাসায়। আর একটা কথা বললে তোর নামই ভুলে যাবো আমি। চুপচাপ ওঠ।”
এইবার আর বেশি কিছু না বলে শিশির বাইকে উঠে পড়ে।

নাহিয়ান বাইক চালাচ্ছে, শিশিরের হাত আপনা-আপনিই ওর কাঁধে এসে ঠেকে—না চাইলেও একটা স্পর্শের সংযোগ, নীরব কিছু অনুভূতির লুকোচুরি।
বাসায় পৌঁছে কলিং বেল বাজতেই নওরিফা খানম দরজা খোলে।
“আগের দিন তুই হুট করে কেমন চলে গেলি রে? একবার আমাকে দেখাও করলি না…”
শিশির কিঞ্চিত সংকোচে বলে,
“না আসলে, আন্টি… বাবা-মাকে অনেকদিন পর দেখলাম তো, এজন্য সরাসরি ওদের সাথেই চলে গেছিলাম। সরি আন্টি।”

“উমম আবার সরি আন্টি, আচ্ছা থাক ঠিক আছে”
“আচ্ছা আন্টি আজকে আবার আসতে বললে।”
নওরিফা খানম এবার একটুখানি হাসি নিয়ে বলে,
“তোর বাবা-মা তো ইলমাদের বাসায় গিয়েছে। কি সব আলাপ আছে। আর তুই যেভাবে হুট করে চলে গেলি… একটুও দেখা করলি না, এই জন্যই তো নাহিয়ানকে বললাম তোকে নিয়ে আসতে।”
শিশির এবার চোখ ছোট করে নাহিয়ানের দিকে তাকায়, ঠোঁটে খেলে যায় এক টুকরো বিদ্রুপ।
“ওহ! তাই বুঝি? এই জন্যই গোমড়ামুখোটা বলছিল যে আনুচু আসবে না!”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৩

শিশির কথাটা আস্তে বললেও নাহিয়ান ঠিকই তা শুনে ফেলল,সেভেতরে ভেতরে হেসে ফেলে, কিন্তু মুখে কিচ্ছু প্রকাশ করে না। কেবল মনে মনে বলে ওঠে—
“তুই এখন চোখ তুলে তাকাচ্ছিস, ইচ্ছেমতো কথা বলছিস… আর আমি চুপচাপ সহ্য করছি।
তবে মনে রাখিস, একদিন আসবে—তুই আমায় দেখবি ঠিক যেমন আমি চাই…
তুই বলবি ঠিক যেমন আমি শুনতে চাই।”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৫