মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৬

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৬
নওরিন কবির তিশা

আজ সকাল থেকেই এক অদ্ভুত ব্যস্ততা ঘিরে রেখেছে শিশিরকে। সাজিদের গায়ে হলুদ বলে কথা—মামা বাড়ি যেন রঙিন উৎসবে ভাসছে। ঘরের আনাচে-কানাচে সাজানো আলোকচ্ছটা, ছাদে ঝুলছে রঙিন ফেস্টুন আর হাসির ফোয়ারায় গমগম করছে চারদিক।
শিশির একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে। কোথাও এক প্যাকেট হলুদ কম, কোথাও অতিথিদের জন্য পানীয় তৈরি হচ্ছে না, কোথাও বা আলতা লাগাতে গিয়ে গন্ডগোল! তার সবখানেই চোখ, সবখানেই দৌড়। অথচ শিশিরের মুখে এক বিন্দু বিরক্তি নেই। বরং একটা শান্ত, নিবিষ্ট হাসি লেগে আছে ঠোঁটের কোণে।

মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের এই পুরনো বাড়িটা, শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে—শিশিরের প্রিয় এক টুকরো শৈশব। এখানে নেই মেট্রোর শব্দ, নেই গাড়ির হর্ন। ছোট ছোট গলিগুলো যেন এখনো আগের মতোই ধীরে বয়ে চলে, ঠিক যেমনভাবে শিশিরের স্মৃতিগুলো।
শিশির পাশের বাসার এক আন্টির সঙ্গে দাঁড়িয়ে হালকা হাসি-আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় পাশে থাকা আরেকজন মহিলা হাসিমুখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—
— “এই যে শুনি, তোর কি অবস্থা?বিয়ে-শাদি কিছু করবি না?”
শিশির হালকা হেসে কিছু একটা বলবে, এমন সময় পিছন থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এলো—
— “শিশির… মা কোথায়?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কণ্ঠটা যে কার—জানার জন্য ঘাড় ঘোরানোর প্রয়োজন পড়ল না। সেই কণ্ঠের গাম্ভীর্যেই শিশির বুঝে গেল—নাহিয়ান।
সে কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলল,
— “আমি তো আন্টিকে দেখিনি। আপনি একটু দেখুন, হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছেন।”
…নাহিয়ান আর কিছু না বলে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল। গায়ে ছিল ডিপ ওয়াইন কালারের একটি সিল্ক শার্ট, হাতার কফ ফোল্ড করে তোলা, গলায় হালকা খোলা বোতাম—চোখেমুখে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য, আর চোখে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস যা ভয় না, বরং কৌতূহল জাগায়।

তার হাঁটার ভঙ্গিতে এমন একরকম থিতু সৌন্দর্য—যেটা দেখলে মানুষ কথা বলা ভুলে যায়। কেবল শিশির না, আশেপাশের অনেকেই কিছুটা সময়ের জন্য থমকে তাকিয়ে রইল তার দিকে। যেন এক ফ্রেমে আটকে গেছে ছেলেটা। যেমনটা হয় না, সিনেমার নায়ক প্রথমবার পর্দায় প্রবেশ করলে?
শিশির তাকে দেখছিল না, কিন্তু অনুভব করছিল—পেছন ফিরে হেঁটে চলে যাওয়া মানুষটার একেকটা পদক্ষেপ তার বুকের ভেতর কতটা শব্দ তুলছে।
এই শান্ত মুহূর্তে হঠাৎই পাশের সেই মহিলার কৌতূহলী কণ্ঠ—

— “এই ছেলে টা কে রে? আগে তো কখনও দেখিনি। তোর বর নাকি? ভালই কিন্তু মানিয়েছে!”
শিশির থমকে গেল। চোখ একটু বড় হলো বিস্ময়ে, তারপর আলতো করে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “কি বলছো এসব আন্টি? উনি নওরিফা আন্টির ছেলে। নাহিন ভাই।”
তার গলায় অস্বস্তির এক গোপন টান, লজ্জার এক টুকরো পর্দা পড়ে রইল মুখে।
অন্যদিকে, নাহিয়ান তখনো হাঁটছে। কিন্তু কানে এসেছে সেই মৃদু লাজুক কণ্ঠ। সে হেসে ফেলল, চোখে একরাশ খেলা।
নিজের মনে, সে বলল—

“ভাই… হুম… এখন তো বলতেই হবে।
কিন্তু কিছুদিন পর, যখন তুই আর কিছুই বলবি না,
আমি শুধু চোখে চোখ রাখলেই তুই বুঝে নিবি—
তোর ঠিকানা আমি,
আর তুই—আমার নামের আগে বসানো এক আশ্চর্য সুন্দরতম উপমা।”

“আগের দিন রেস্টুরেন্টের ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগলো না আয়ু? মনে হচ্ছিল না… একটু বিশেষ কেয়ার করতেছিল আমাদের প্রতি?”
রুচির ছিমছাম বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা আয়নার বড় বোন কথাটা বলতেই আনায়ার ধ্যান ভাঙে। সে তখনো অন্যমনস্ক হয়ে জানালার বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। প্রশ্নটা শুনে আঁতকে উঠে বলে উঠল—
“হুম? হ্যাঁ হ্যাঁ… আমিও তোকে ঠিক এটাই বলতে যাচ্ছিলাম।”
তাকে এমন অপ্রস্তুত দেখেই আপু কপাল কুঁচকে কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে ওঠে,
“সারাক্ষণ কী এমন গভীর চিন্তায় ডুবে থাকিস, হ্যাঁ? আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই তুই যেন হুট করে ছিটকে পড়িস বাস্তবতায়! কোথাও মনে থাকে না তুই!”
আনায়া হেসে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল—

“আরে না রে, তেমন কিছু না। আমি আসলে ভাবছিলাম প্রেজেন্টেশনের কথা। ভাবতেছিলাম স্যার কেমন মার্ক দেবে। তাছাড়া… সত্যি বলতে, আমি তোকে এই রেস্টুরেন্টের ব্যাপারেই বলতে যাচ্ছিলাম!”
“হ্যাঁ, আমিও সেই দিন থেকেই ভাবছি। রেস্টুরেন্টের পরিবেশ তো দারুণই ছিল, কিন্তু আমাদের প্রতি ওদের অতিরিক্ত যত্ন, বিশেষত তোর প্রতি, একদমই ন্যাচারাল মনে হয়নি! আমি তো অনেকবার গেছি ওখানে, কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি। এতটা প্রায়োরিটি?”

আনায়া নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। সেই দিনের স্মৃতি যেন একটু একটু করে ভেসে ওঠে মনে…
সেদিনের সেই ব্যতিক্রমী রেস্টুরেন্টে ওরা তিনজন—আনায়া, তার আপু এবং ভাইয়া অর্থাৎ আনায়ার আপুর হাজবেন্ড—খাবার অর্ডার দিয়ে তারা কথা বলছিল, আর তখনই আনায়ার সাথে দেখা হয় রিদিতের। কথা বলতে বলতে ঠিক তখনই আপু ডাক দেয়। আনায়া রিদিতকে ভদ্রভাবে বিদায় জানিয়ে টেবিলে ফিরে আসে।
কিন্তু এরপর থেকে শুরু হয় অদ্ভুত এক কেয়ারিং অটেনশন।

ওয়েটার যেন বারবার এসে তাদের দিকে তাকাচ্ছিল। অন্য টেবিলের তুলনায় ওদের টেবিলটিতে আলাদা মনোযোগ, আলাদা গ্লাস, স্পেশাল কাচের জগ, এমনকি কাস্টমাইজড ন্যাপকিনস পর্যন্ত! যেন মনে হচ্ছিল, তারা রেস্টুরেন্টের কোনো স্পেশাল গেস্ট। এমনকি, খাবার পরিবেশন করার স্টাইলটাও ছিল একধরনের ‘রয়াল ট্রিটমেন্ট’।
বিশেষত, আনায়ার দিকে কিছু ওয়েটারের দৃষ্টি ছিল এমনভাবে নিবদ্ধ, যেন তারা কোনও ইনস্ট্রাকশন ফলো করছে।
আরও বিস্ময় ছিল, যখন বিল দিতে এগোতেই, ওয়েটার বিনয়ের সঙ্গে জানাল—”ম্যাম, আপনারা যা অর্ডার করেছেন তার পুরো বিল ইতোমধ্যেই ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আপনারা আমাদের এক পরিচিত অতিথির পক্ষে অতিথি।”
তাদের চোখ কপালে! তারা প্রশ্ন করেছিল—”কে পেমেন্ট করেছেন?”

ওয়েটার কিছুটা রহস্যঘেরা গলায় বলেছিল—”দুঃখিত ম্যাম, আমাদের কাস্টমার পলিসি অনুযায়ী উনার নাম বলা যাবে না। তবে উনি বলেছিলেন আপনারা যেন ভালো সার্ভিস পান।”
তারা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি, শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল—এটা কে হতে পারে?
আর এখন, এতদিন পরে সেই ভাবনা ফের একবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আনায়া জানে না—কার নির্দেশে ওভাবে ট্রিট করা হয়েছিল, কিন্তু তার মন বলছে… হয়তো কোনো একজন আছেন, যিনি নিঃশব্দে নজর রাখছেন।

“যদি মুখ না খোলে—তাহলে ওকে শেষ করে দাও। তবে এমনভাবে মারবে, যেন যারা বেঁচে থাকবে, তারা প্রতিটা নিঃশ্বাসে মৃত্যুর ছায়া অনুভব করে। ভয় হবে তাদের নতুন নাম।”
নাহিয়ানের কণ্ঠে তখন আগুন আর বরফের মিশেল—এক ধরনের শীতল হুমকি, যেখানে শব্দগুলো অস্ত্র হয়ে ঝরে পড়ছে।
ফোনের ওপাশ থেকে এক কণ্ঠ বলে,
— “কিন্তু স্যার, যদি এটাকে মেরে ফেলি, তাহলে আর মাত্র দুজন থাকবে। বাকি দুজনকে দেখে তো মনে হচ্ছে না ওরা কিছু স্বীকার করবে।”
নাহিয়ান শান্ত স্বরে বলল,

— “কে থাকবে, কে মরবে সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমি বলেছি স্বীকার করাতে হবে। আর যদি না করে—তাহলে একে একে সবাই চলে যাবে, এমনভাবে, যেন মরার ভয়টাও কাঁপে তাদের সামনে।”
নাহিয়ান ফোনে কথা বলছিল এমন সময়‌ই তার রুমে কড়া নাড়ল কেউ একজন। নাহিয়ান দ্রুত কল কেটে কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলল,,
-কে.?
ঔপাশ থেকে একটা মেয়েলী তবে শক্ত কণ্ঠ ভেসে আসলো,,
— “আমি… শিশির।”
নাহিয়ান স্বর গম্ভীর করে বলল,
— “কি দরকার?”
— “আমার নিজস্ব কোন দরকার নেই। আপনাকে সবাই নিচে ডাকছে। সাজিদ ভাইয়ার গায়ে হলুদের জন্য।”
— “তুই যা, আমার এসব নাটক ভালো লাগে না।”
নাহিয়ানের কথা শুনে শিশির মুখ বেঁকিয়ে বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“তা ভালো লাগবে কি করে?? বিদেশে থেকে থেকে তো হয়ে গেছেন তো একটা বিদেশী হনুমান। দেশের কিছুই তো ভালো লাগবেনা। বিয়ের মত একটা দেশী অনুষ্ঠানেও বিদেশীদের মতন ফরমাল গেট আপে।মনে হচ্ছে যেন বিদেশী হনুমান কোনো বিদেশি মিশনে এসেছেন।”
তবে পেছন ফিরে হাঁটা দেওয়ার আগেই এক নিমগ্ন কণ্ঠ তার নাম ধরে ডাকে—
— “শিশির।”
আচমকা থমকে যায় সে। চোখ বড় হয়ে যায়, মুখ শুকিয়ে আসে। ভেবে পায় না, সে কি শুনে ফেললো?বহু কষ্টে নিজেকে ধাতস্থ করে শিশির শান্ত কণ্ঠে বলে,,

— “জ্বী?”
ভেতর থেকে নাহিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল,
— “মাকে দেখেছিস?”
শিশির হাফ ছেড়ে বাঁচে।
— “না।”
— “তাহলে একটু ভেতরে আয়।”
শিশির এই ভেবে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল—নাহিয়ান কিছু শুনতে পায়নি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল, কারণ নাহিয়ান তাকে ভেতরে ডাকছে!
একটু দ্বিধা, একটু ভয় নিয়ে দরজার হাতলে হাত রাখে শিশির। ধাক্কা দিয়ে খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তার সমস্ত অনুভূতি গুলিয়ে যেতে লাগল।রুমে ঢুকতেই সে‌ একটা তীব্র ঝাঁঝালো অথচ অভিজাত পারফিউমের গন্ধ পায়।
আর…
নাহিয়ান!

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরুষটার দিকে তাকিয়ে শিশির এক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
হালকা হলুদ রঙের, কটন সিল্কের ঝলমলে পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। বুক পর্যন্ত খোলা বোতাম থেকে উঁকি দিচ্ছে গায়ের হালকা গাঢ় ছায়া। হাতার কফ ফোল্ড করা, ঘাড়ের রেখায় চোখে পড়ছে হালকা তীক্ষ্ণতা। ফর্সা গায়ের রঙে হলুদের ছটা এক অপার্থিব আভা ছড়িয়ে দিয়েছে তার চারপাশে।
এই সেই লোক, যাকে সে কিছুক্ষণ আগেও ‘বিদেশী হনুমান’ বলে ব্যঙ্গ করছিল?
শিশিরের চোখ আটকে গেল তার দিকে। বুকের ভেতর কিছু একটা থেমে গেল যেন। একটা মুহূর্ত শুধু তাকিয়েই রইল সে—নীরব, নিথর, নিঃশব্দ।
শিশিরের চোখ আটকে যায়। শিশিরকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাহিয়ান মুচকি হেসে মনে মনে বলে,,
“আমি চাই তুমি আমার দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকো সারাজীবন। ঠিক এভাবেই।”
তারপর মুখ গম্ভীর করে বলে,

— “এভাবে হ্যাংলার মতন তাকিয়ে কী দেখছিস?”
নাহিয়ানের এমন কথায় ধ্যান-ভাঙে শিশিরের। সে বুঝতে পারে নাহিয়ান বুঝে গেছে যে সে এতক্ষণ নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল মাটি ফেটে গেলে এক লাফে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু সে তো শিশির—নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য বেশি সময় লাগে না তার। গলার স্বর শক্ত করেই মুখে বিরক্তির ছায়া টেনে সে বলে ওঠে—
— “কে তাকাচ্ছিল আপনাদের দিকে? আপনি কী ভাবেন নিজেকে? শাহরুখ খান? যে সবাই আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে?”
নাহিয়ান এবার হাসল। সেই ধীর, আত্মবিশ্বাসী হাসি।

— “শাহরুখ খান কিনা জানি না। তবে… তুই আমার দিকে হা করে তাকিয়েছিস, এটা আমি চোখ বন্ধ করেও বুঝি। চোখ তো শুধু তাকিয়েছিল, তোর হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শুনেছি আমি।”
শিশির এবার ঠোঁট চেপে রাখে, গলা তবু শক্ত—
— “কি জন্য ডেকেছেন আপনি? এসব ফালতু কথা বলার জন্য । এই বোকা বোকা ডায়লগ শোনার সময় নেই আমার।”
“আমি ফালতু কথা বলছি। শুধু শুধু কি তোকে আমি অন্ধ বলি। দেখতে পাচ্ছিস না আমার পাঞ্জাবির বোতাম টা খুলে গেছে। আর নতুন পাঞ্জাবিও নেই।”
নাহিয়ানের কথা শেষ করার আগেই শিশির বলে ওঠে,,
“তো আমি কি করতে পারি?”

নাহিয়ান এবার মুখে একটুও ভাবান্তর না এনে বলে,
— “বোতামটা কি একটু লাগিয়ে দিতে পারবি।”
— “বোতাম? আমি কেন লাগাব?”
— “সামান্য কাজটা পারিস না?”
শিশির যেন চ্যালেঞ্জের গন্ধ পেয়ে যায়। বলে,
— “বারবার আমার যোগ্যতা নিয়ে কথা বলবেন না। আর আপনাকে কে বলল যে সামান্য বোতাম আমি লাগাতে পারব না। পাঞ্জাবি টা খুলে দিন আমি এক্ষুনি লাগিয়ে আনছি।”
— “খুলতে পারবো না। এভাবেই লাগা। যদি পারিস—তাহলে বোঝা যাবে তোর যোগ্যতা।”
শিশির ভেতরে কিছুটা থমকে গেলেও, মুখে সে ভাব আনলো না একটুও। তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে—এখানে হার মানলে চলে না। সে তো আর কারও চোখে দুর্বল হয়ে থাকতে পারে না। মুখটা কড়া করে পাশের রুমে গিয়ে দ্রুত ফিরে আসে—সুচ আর সুতা হাতে।
কিন্তু ঠিক যখন কাজ শুরু করতে যাবে, তখনই বিপত্তি।

নাহিয়ান শিশিরের চেয়ে অনেকটাই লম্বা। তার পাঞ্জাবির গলার বোতাম ছিঁড়ে গেছে যেখানে সেই জায়গায়, শিশিরের হাত পৌঁছাতেই যেন হিমশিম খেতে হয়। সে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টায় পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বোতামটা ধরতে চায়, কিন্তু শরীরের ভারসাম্য যেন বারবার তার সঙ্গে খেলতে শুরু করে।
নাহিয়ান এই দৃশ্য চুপচাপ উপভোগ করে, চোখে একরাশ প্রশ্রয় আর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি নিয়ে। এরপর তার পায়ের পাশে রাখা ছোট একটা কাঠের টুল শিশিরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে—
— “তোর হাইট তো দেখি একদম রেগুলার বেবি সাইজ। এই টুল না দিলে তো দেখি তুই আমার গলা পর্যন্ত সারাদিনেও পৌঁছাতে পারবি না।”
শিশির তার এমন কথা শুনে মুখ শক্ত করে রাখলেও, ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু না বলে সে নিঃশব্দে টুলে উঠে দাঁড়ায়। তার আঙুলে সুচ আর সুতোর খেলা শুরু হয়—যত্নে, নিঃশব্দে। যেন এক নিখুঁত শিল্পকর্ম চলছে।

কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়।
এই অদ্ভুত নৈকট্যে শিশির প্রথমবার উপলব্ধি করে নাহিয়ানের গায়ের তীব্র, অথচ মাদকতা মেশানো পারফিউমের ঘ্রাণটা। অচেনা এক ঘূর্ণি যেন তার চারপাশে তৈরি হতে থাকে। কাঁপছে না কেবল হাত, কাঁপছে বুকের ভিতরটাও। একটা নিঃশ্বাস নিতে চায়, অথচ মনে হচ্ছে—এই ঘ্রাণে আটকে যাচ্ছে শব্দ, হারিয়ে যাচ্ছে সাহস।
নাহিয়ান সেটা লক্ষ্য করেও কিছু না বলে শুধু বলে,
— “তোর হাত কাঁপছে শিশির। এই সাহস নিয়ে আমার সঙ্গে তর্ক করিস?”
শিশির এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

— “হাত কাঁপছে মানে এই না যে আমি দুর্বল। আর আপনি যদি ভাবেন আপনার এক চাহনিতে আমি গলে যাবো—তাহলে আপনি ভুল। আমি সেই ‘শিশির’—যে রোদ্দুরে তীব্র জ্বলেও নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে।”
নাহিয়ান এবার এক ধাক্কায় থেমে যায়। চোখ সরু করে তাকায় শিশিরের দিকে।
তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে ফিরে আসে সেই তীক্ষ্ণ হাসি।
— “তুই শিশির ঠিকই…

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৫

কিন্তু আমি হচ্ছি সেই প্রখর রোদ,
যার ছোঁয়া তোর শরীরে পড়লে,
তুই গলে যাবি না,
বরং… আলো হয়ে উঠবি আমারই চারপাশে।
তুই আমার নামের আগের সেই উপমা…
যার ব্যাখ্যা দেয়া যায় না—শুধু অনুভব করা যায়।”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৭