মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৯
নওরিন কবির তিশা
ছাদের কোণে একটা পাথরের তৈরি বেঞ্চে বসে ছিল রিদিত। তার ঠিক অপরপাশে শিশির। চারপাশে হালকা বাতাস বয়ে চলেছে, যেন সব আবেগগুলোকে একটু একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। দূরে ঢাকার শহর আলোয় জ্বলছে, কিন্তু এই ছাদের এক কোণ যেন আবছা, গভীর—ঠিক যেমন আনায়ার অতীত।
শিশির বলতে শুরু করল। গলা নরম, শব্দগুলো যেন নিজের ভারে ভারাক্রান্ত।
— “আনায়া ওর বাবা-মায়ের ছোট মেয়ে, ভাইয়া। খুব আদরের। ছোটবেলায় ওর মুখের জেদ মানেই ছিল বাবা-মায়ের কাছে অর্ডার। আমরা তখন প্রাইমারিতে পড়ি, একসাথে। এক রকম সারা দিন সঙ্গী ছিল ও—আমার ছায়া। ওর গ্রাম বরিশালে হলেও, ঢাকাতেই বড় হয়েছে বাবার চাকরির কারণে।”
রিদিত মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝেমাঝে শিশিরের কণ্ঠ কেঁপে উঠছে, যেন নিজের কথা বলছে।
— “ওর বড় বোন ইনায়া আপুর বিয়ে ঠিক ছিল ছোটবেলা থেকেই। ওদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে।সেই সম্পর্কের সূত্রে ওদের সাথে পরিবারটার ঘনিষ্ঠ হয়। ঘন ঘন আসা-যাওয়া, আত্মীয়তার ভেতরে মিশে যাওয়া সম্পর্ক। সবকিছুই যেন গল্পের মত চলছিল। তারপর, একদিন, আনায়ার জন্যও সেই পরিবারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে…”
শিশির থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তারপর চোখ নামিয়ে বলে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “ছেলেটা তুহিন। ছেলেটা ভালো স্টুডেন্ট তারপর পারিবারিক সহায় সম্পত্তিও অনেক। আর তাছাড়া ইনায়া আপুর যে বাড়িতে বিয়ে হবে সেখানে বিয়ে হওয়া মানে তো আনায়ার ভাগ্য নিজের বোনকে জা হিসেবে পাবে। দুই বোন দুইজন জা ফলে বাবা মার চিন্তাও কমবে। এইসব কথা ভেবেই আনায়ার বাবা-মা তাকে বিয়ে দিতে রাজি হয়। ছেলেটার দৃষ্টিতে প্রথমে ছিল মাধুর্য, মিষ্টি আচরণ, দায়িত্বশীলতার ছাপ। এমন একজন, যাকে আনায়া বিশ্বাস করেছিল অন্ধভাবে। একটা ছোট মেয়ের মন কী চাই? একটু ভালোবাসা, একটু আশ্রয়। তুহিন সেই আশ্বাসে ওর বিশ্বাস গড়েছিল, যেন প্রাসাদের ভিত।আর ঠিক তখনই প্রাসাদে ভূমিকম্প এলো!”
রিদিত অবাক হয়ে বলল,,_
“মানে?”
শিশির মলিন হেসে বলতে থাকে
—“তুহিনের আসল চেহারা ধরা পড়ে একদিন, হঠাৎই। অন্য একটা মেয়ের সাথে গভীর সম্পর্ক—শুধু সেই মেয়ে নয়, আরও অনেক… ভার্সিটির মেয়েদের সাথে, ইন্টারনেট জুড়ে ছড়ানো তার নোংরা খেলাগুলো। আনায়া যেন চোখের সামনে নিজের বিশ্বাসের কবর দেখে ফেলল।”
রিদিত এবার গভীর কণ্ঠে বলে—
— “তারপর?”
শিশির এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে—
— “ভেঙে পড়েছিল, ভীষণভাবে। ওর চোখে সব পুরুষ একই রকম। বিশ্বাস ভেঙে গেলে মানুষের আত্মাও ভেঙে যায় ভাইয়া। ইনায়া আপু আর মাহিন ভাইয়া চেষ্টা করেছিল সব ঠিক করতে। তুহিন নিজের ভুল স্বীকার করেছিল, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত ডিলিট করেছিল। কিন্তু… বিশ্বাস কি কেবল কথা দিয়ে ফিরে আসে?”
— “না,”—রিদিত ধীরে বলে,—“বিশ্বাস ফেরাতে সময় লাগে… মনের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়।”
শিশির মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,
—“আর বিশ্বাস ফেরানোর আগেই… ইনায়া আপু আর মাহিন ভাইয়ের বিয়ের দুই দিন আগে, তুহিন বিয়ে করে ফেলে তার মামাতো বোনকে। জানেন ভাইয়া, আনায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি দেখেছি ভাঙা স্বপ্নের টুকরো কীভাবে কারও হৃদয়কে রক্তাক্ত করতে পারে।”
চারপাশে হঠাৎ গা ছমছমে নীরবতা। বাতাসটা যেন কাঁপছে। রিদিত সেই নিঃশব্দতা ভেঙে বলে—
— “তুমি জানো, শিশির? আমি আয়নিনের চোখে এখনো কোনদিন আগুন দেখিনি, দেখেছি ছায়া। একটা গভীর কালো ছায়া—যা আড়াল করে রাখে ওর সত্যিকারের নিজেকে। কিন্তু আমি জানি, সেই ছায়ার আড়ালে আছে এক পৃথিবী আলো।”
শিশির তার দিকে তাকায়। মুখে নিঃশব্দ হাসি।
— “তবে জানেন ভাইয়া, আমার কখনোই আপনাকে ওই ছেলের মত মনে হয়নি। আপনি যদি ওকে সত্যিই ভালবাসেন, তাহলে আপনাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, জানেন তো?”
রিদিত চোখে একরাশ দৃঢ়তা নিয়ে বলে—
— “আমি আয়নিনকে শুধু ভালোবাসি না, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি। আর আমি প্রমাণ করবো—সব পুরুষ এক রকম নয়। ওর ছায়ায় আমি আলো আনবো… ধৈর্য, সময় আর সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়ে।”
শিশির এবার চোখ নামিয়ে কাঁপা গলায় বলে—
— “তাহলে আমি আছি আপনার পাশে। কিন্তু কথা দিচ্ছেন তো ভাইয়া, ওর হৃদয়ে আর কোনোদিন কেউ যেন আঁচ না কাটে, তা আপনি নিশ্চিত করবেন?”
রিদিত উঠে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে বলে—
— “এই ছাদ, এই শহর, এই আকাশকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আয়নিনকে আগলে রাখবো, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যতক্ষণ আমার নিঃশ্বাস থাকবে।”
হঠাৎ বাতাসটা যেন একটু নরম হয়ে আসে। আকাশে একফালি চাঁদ বেরোয় মেঘের আড়াল থেকে। শিশির মনে মনে ভাবে—হয়তো ছায়ার দিন শেষ হতে চলেছে। একটা নতুন আলো অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
“আরে ওয়েটার আঙ্কেল, চলে যাচ্ছেন যে? আপনাদের বাড়ি আসলাম, কথা বলবেন না?”
নিঝুমের কণ্ঠে টিপিক্যাল ইয়ার্কি, মুখে চেনা সেই খোঁচামারা হাসি।
সৌজন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
— “দেখো মেয়ে, তোমার সাথে আমি ঝগড়া করতে চাই না। সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বললে কিন্তু আমার হাতে থাপ্পড় খাবে।”
নিঝুম মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— “উমমম… আইছে! সাহস থাকলে একবার টাচ করে দেখো না। তোমার পুরো খবর করে দিব!”
ঠিক তখনই উপরে থেকে ভেসে এল ভারী কণ্ঠস্বর
“সৌজন্য!”
সাথে সাথেই নিঝুম চুপ! যেন এক মুহূর্তেই ভদ্রতার মূর্তি!
সৌজন্যের মা নামছেন সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নেমে এসে একবার তাকালেন নিঝুমের দিকে। তার মুখে স্নেহভরা হাসি।
— “কি হয়েছে মা? ঘুমাতে যাওনি?”
নিঝুম মাথা নিচু করে ভদ্রভাবে বলে—
— “না আন্টি, ঘুম আসছিল না তো। একটু হেঁটে নিচে এলাম। আপনি কেন নামলেন? কোন দরকার?”
সৌজন্যের মা নিঝুমের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলেন—
— “না মা, এমনি… ঘুম ভেঙে গেল তাই ভাবলাম নিচে একটু দেখি।”
— “জ্বী, একদম ঠিক আছি।”
নিঝুম আবারো একবার নিষ্পাপ হাসি দিয়ে চলে গেল। সৌজন্যের মা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলে,,
-“কি ভদ্র মিষ্টি একটা মেয়ে!”
তারপরই তিনি সৌজন্যের দিকে তাকালেন কড়া চোখে।
— “তুই আবার কী করছিস নিচে দাঁড়িয়ে? নিশ্চয়ই আবার কোনো বাদরামি করছিলি!”
সৌজন্য গলা নিচু করে বলল—
— “তোমার চোখে তো আমি-ই একমাত্র বাঁদর। বাড়ির ভেতর আরও বড় বাঁদরিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে— যারা আবার তোমার চোখে ‘মিষ্টি মেয়ে’!”
সৌজন্যের মা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,,
— “মানে?”
— “কিছু না মা। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।”
এটুকু বলেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় সৌজন্য।সে জানে তার মায়ের চোখে নিঝুম এখন কোকিল-কণ্ঠীর প্রতীক!
উপরে গিয়ে সে দেখে, নিঝুম তখনো দাঁড়িয়ে, দরজা খুলে রাখা। সৌজন্যকে দেখে মুখে বাঁকা হাসি
“কেমন লাগল, ওয়েটার আংকেল? মায়ের বকা তো খুব ‘সুইট’ না? আরে আসেন আসেন, আরেকটু ঝগড়া করি, আমার তো মনই ভরছে না!”
এই বলে মুখ ভেংচিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।
সৌজন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসে উঠে,
“এইটুকু মেয়ের এত সাহস? দাঁড়াও, মজা তো আমি তোমায় একটু পরেই দেখাব…”
ছাদ থেকে অনেক আগেই নিচে নেমে গিয়েছে রিদিত।
কিন্তু শিশির এখনো দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশ ধরে—নীরব শহরের আলো-আঁধারিতে হারিয়ে গেছে তার মন।
দূর আকাশের দিকেই তার দৃষ্টি, অথচ ভাবনারা অনেক কাছে—আনায়ার চোখের বিষণ্ণতা আর রিদিতের নিশ্চিন্ত দৃঢ়তা মিলেমিশে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিয়েছে তার হৃদয়ে। মনে মনে বলল,
“হয়ত এবার শেষ হবে আনায়ার অন্ধকার অধ্যায়, শুরু হবে নতুন এক আলোর গল্প…”
তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক নরম তৃপ্তির হাসি।
কিন্তু…
সে কি জানত, তার সেই প্রশান্ত মুহূর্তে—অপর পাশে কেউ সাজাচ্ছিল ঘৃণা, প্রতিশোধ আর হিংস্রতা ঘেরা পরিকল্পনার মঞ্চ?
দূরে… ছায়ায় ঢাকা একটি গলি।
নীরব রাতের আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক Black Mercedes GLS SUV-এর জানালার গ্লাস ধীরে নামতে থাকে।
আর তার আড়াল থেকে দেখা যায় একজোড়া নিস্পৃহ, তীক্ষ্ণ, বরফশীতল চোখ।
সেই চোখে যেন আগুন লুকিয়ে আছে…
চোখে প্রতিশোধ, আর ঠোঁটে জ্বলছে একটি Marlboro Gold।
আঁধার গলির নিস্তব্ধতাকে চিরে, সেই মানুষটি হালকা ধোঁয়ার কুণ্ডলি ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৮
“You smile too early, Miss Shah… You have no idea what’s coming.”
তার কণ্ঠে ছিল এমন এক আত্মবিশ্বাস, যা প্রমাণ করে—ওই মুহূর্তের প্রান্তে দাঁড়িয়ে শিশির যেমন নির্ভার, ঠিক তেমনি অদূরে অপেক্ষা করছে এমন কিছু, যা তার জীবনের ছায়াকে চিরতরে রঙ বদলে দিতে সক্ষম।
সিগারেটের শেষ কণাটি সে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে নিভিয়ে ফেলল। তারপর মাটির দিকে চোখ রাখল না—চাইলও না।
সে শুধু হেঁটে চলে গেল অন্ধকার গলির গভীরে,
ফেলে গেল এক অদৃশ্য আতঙ্ক… এক অনাগত ঝড়ের পূর্বাভাস।