মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২১
নওরিন কবির তিশা
ঢাকার আকাশটা আজ একটু বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন। অথচ এখন বসন্তকাল—তবুও ভোরের আলো যেন কেমন ধূসর ধূসর লাগে। আযানের ধ্বনি বাতাসে ভাসে, আকাশের একটা কোণ একটু একটু করে সোনালি হতে শুরু করেছে।
ভোর পাঁচটা।
নাহিয়ান বেরিয়ে পড়েছে। সকাল ৬ টায় ফ্লাইট—তাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে এক ঘণ্টা আগেই রওনা হয়েছে। তার গাড়ি ছুটছে শহরের নিস্তব্ধ সড়ক ধরে। শহরের কোলাহল এখনো জাগেনি।
এই যাত্রাটা অন্য যেকোনো যাত্রার চেয়ে আলাদা। কারণ, এবার যে সে ফিরে যাচ্ছে, তার পিছনে রয়ে যাচ্ছে কিছু না বলা কথা, কিছু অপূর্ণ স্পর্শ, কিছু মায়াময় চাহনি।
কিন্তু তার এই ফেরা—আনন্দময় নয়। বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক আন্তর্জাতিক আতঙ্ক।
দুই দিন আগে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যতম প্রাইভেট ও রিজার্ভড স্কুল “Wellington International Academy”–তে ঘটে যায় এক ভয়ংকর হামলা।
এই স্কুলটা কোনো সাধারণ স্কুল নয়। আমেরিকার নামকরা বিলিয়নিয়ার, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক শিল্পপতি এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সন্তানরা পড়ে এখানে।
সেই স্কুল থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়২১টি শিশু। সকালবেলা ক্লাস শুরুর আগে, ঠিক যখন সবাই জিম ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল—তখনই ঘটে হামলা। নিখোঁজ হওয়া শিশুদের মধ্যে রয়েছে সিনেটরের মেয়ে, আরব শেখের ছেলে, এবং এক নামকরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরী।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স এবং ইউএস সিআইডি—মিলে কাঁপছে পুরো প্রশাসন।
কিন্তু কেসটি এতটাই জটিল যে, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা পড়া কয়েকজন অপরাধী জবানবন্দিতে নাম নিচ্ছে এমন একজনের, যার সম্পর্কে কিছুই স্পষ্ট নয়।
এই অবস্থায়—বিশেষ এজেন্টদের একটি হাই-প্রোফাইল টিম গঠন করা হয়েছে। সেই টিমের অন্যতম মূল সমন্বয়কারী, সিক্রেট অপারেশন চিফ— নাহিয়ান চৌধুরী।
তার উপস্থিতি এখন বাধ্যতামূলক।
এটা শুধুই একটি মিশন নয়—এটা একেকজন মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ থামানোর অপারেশন। নিখোঁজ শিশুদের মা-বাবাদের কাছে এসেছে অজানা নাম্বার থেকে কল, যেখানে বলা হয়েছে:
“যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ মিলিয়ন ডলার না পাঠাও, তাহলে বাচ্চাদের কোনো হাড্ডিও পাবে না।”
আর সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হলো—
“ যারা টাকা দিয়েছে, তাদের বাচ্চারাও এখনো ফেরেনি।”
এই মিশন, এখন আর শুধু কিডন্যাপ কেস নয়—এটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ভয়ানক মোড়ে গড়াচ্ছে।
আজ খুব ভোরে, নাহিয়ান দীর্ঘ সময় ধরে বসেছিল মায়ের পাশে। মায়ের চোখে জল।
তবুও নাহিয়ান বারবার বলছিল—
“মা, আমি না গেলে আরও অনেক মা তাদের বাচ্চাদের ফিরিয়ে পাবে না। আমি একজন সন্তান, তাই জানি মায়ের বুক কেমন পোড়ে… তুমি শুধু আমায় দোয়া দাও, আমি যেন সফল হয়ে ফিরে আসতে পারি।”
নাহিয়ান এর কথা নওরিফা খানম প্রথমে রাজি না থাকলেও বাচ্চাদের কথা শোনার পর তিনি আর আপত্তি করলেন না।শেষমেষ তিনি মাথা নিচু করে বলেছিলেন,
— “যাও বাবা, আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।”
গাড়ির পিছনের সিটে বসে, হালকা আলোয় চোখ বুজে ছিল নাহিয়ান। তারপর ধীরে ধীরে শরীর এলিয়ে বসল।চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক চেহারা।
হিজাবে মোড়ানো মুখটা।
শিশির।
সে তার ছোট্ট ভালোবাসা, বিন্দু বিন্দু যত্নে গড়া একটা অনুভবের নাম।গাড়ি থেমে গেল। পেছনের কাঁচ ভিজে উঠল হালকা কুয়াশায়।
সকালের স্নিগ্ধ আলো তখনো শহরের কোলাহলকে পুরোপুরি জাগিয়ে তুলতে পারেনি। জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশিরেরা আজ যেন একটু বেশিই অভিমানী। এমন নিস্তব্ধতায় হঠাৎ করেই দরজার কলিংবেলের শব্দ ফারিনের কানে একরাশ অস্বস্তি নামিয়ে আনে।
আধো ঘুমে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার ছিটকিনি ঘোরায় সে। সামনে একগাদা শপিং ব্যাগ হাতে ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে পড়ে নেহা,যেন দীর্ঘ পথ পেরোনোর ক্লান্তি ভর করেছে তার শরীরে।বিছানায় ধপ করে বসে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে
“উফফ! অবশেষে শান্তি!”
পরক্ষণেই তার চোখ পড়ে ফারিনের অবিন্যস্ত মুখের দিকে। এক ঝলকে যেন দুষ্টু রোদের মতন ঝিকিমিকি খেলে যায় ওর চোখে।
— “জানিস তো ফারু, আগের দিন তোর সেই হিটলার—মানে আমাদের নির্ঝর স্যার তোর খোঁজ নিচ্ছিল!”
ফারিন বিরক্ত মুখে, মাছি তাড়ানোর মতন হাত নাড়িয়ে বলে,,
— “তো? তাতে আমি কী করব? নাচব নাকি?”
নেহা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
— “তুই একটা আস্ত গাধী। বুঝতে পারছিস? নির্ঝর স্যার যে স্যার কোনো স্টুডেন্ট সারা বছর কলেজের না গেলেও খোঁজ করে না—সে কিনা তোর খোঁজ নিচ্ছে! That’s rare, ফারু!”
ফারিন মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ নেহার চোখ পড়ে টেবিলের উপর রাখা ফল আর ওষুধে। এক লাফে উঠে গিয়ে তা হাতে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল—
— “কী ব্যাপার? ওষুধ? তুই সত্যি সত্যি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিস? আমি তো তোকে এই কয়দিন ধরে বারবার বলেও নিতে পারিনি!”
— “আরে, আমি কি এমনি এমনি এনেছি? নির্ঝর স্যারই তো…”
কথা মুখ ফসকে বের হতেই মুহূর্তেই জিভ কামড়ে চুপ হয়ে যায় ফারিন।
নেহা এবার ক্রাইম সিরিজের গোয়েন্দাদের মতো চোখ
সরু করে বলে,,
— “নির্ঝর স্যার মানে? খুলে বল ফারু। সত্যি সত্যি বল।”
গতকাল সন্ধ্যা🌆🌆
গণিতের টার্মের সব গাণিতিক ক্লান্তি নিয়ে সবেমাত্র বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল ফারিন। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে এক অচেনা নম্বর। নিতে ইচ্ছে করছিল না, তবু শেষমেশ ভাবল, হয়তো মা নতুন নম্বর থেকে কল করছে।
কল রিসিভ করতেই ভেসে এলো চেনা অথচ অসাধারণ গম্ভীর কণ্ঠ—
— “কতক্ষণ ধরে তোমাকে ফোন করছি। এখনই নিচে এসো।”
ফারিন হতবাক।
— “কে আপনি?” জিজ্ঞেস করার আগেই আবার কণ্ঠস্বর
— “আর কোনো কথা নয়। যা বলেছি করো। এক্ষুণি।”
ফোনটা কেটে যায়। একটু দ্বিধায় থাকলেও নেমে আসে সে। নিচে নেমেই যা দেখে তাতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে কিছুক্ষণের জন্য।
নির্ঝর স্যার!
নিজের গাড়ির পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে, চোখে সেই চিরচেনা কাঠিন্য।
— “এখন কেমন লাগছে জ্বরটা?”
ফারিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে বলে,
“স্যার, আপনি এখানে!?”
নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেন,
“বেশি কথা না বলে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও।”
“জি স্যার, কমেছে।
নির্ঝর কোনো আবেগ না দেখিয়ে কেবল ব্যাগ এগিয়ে দেন, যাতে ছিল কিছু ফল আর কিছু ওষুধ। তা দেখে ফারিন বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে বলে,
“স্যার, এগুলো!?”
নির্ঝর আবারও কিছুটা বিরক্তির সাথে বলেন,
“হ্যাঁ, এগুলো। যা দিচ্ছি এক্ষুনি নাও, আর ওষুধগুলো সময়মতো খাবে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা একদমই ভেবো না যে আমি অনুশোচনা থেকে এটা করছি। আমি এটা করছি কারণ আর দুদিন পর আমার ক্লাস টেস্ট। এমনিতেই তো গণিতের ‘গ’-ও বোঝো না তুমি, তার ওপর এতগুলো ক্লাস মিস দিয়েছ। আর সবচেয়ে বড় কথা, সবাই তোমার এই ক্লাস মিস দেওয়ার জন্য আমাকেই দায়ী করছে। ফর দিস রিজন, এই ওষুধগুলো আর ফলগুলো নিয়ে সময়মতো খেয়ে নেবে, আর দুদিন পর ঠিক সময়ে যেন কলেজে দেখি।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নির্ঝর গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকেই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যান।
ফারিন তখনো হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে, হাতে ব্যাগ, চোখে বিস্ময়। তার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।
বর্তমান 🌼
নেহা হাঁ করে শোনে। তারপর এক ফুঁয়ে বলে—
— “দোস্ত! আমার মনে হয় না উনি শুধু ক্লাস টেস্টের কথা ভেবে এটা করেছেন। আমার তো মনে হয় অন্য কারণে। মানে….
তার কথা শেষ করতে না দিয়েই ফারিন ব্যঙ্গভরে বলে—
— “হাহ! নাটক। উনি বুঝে গেছেন যে তারই অপমানেই আমি জ্বরেও পড়েছিলাম।তাই এখন দায়মুক্তির জন্য দয়া দেখাচ্ছেন।”।”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২০
নেহা থেমে যায়। মুখে আর তর্ক নেই। সে জানে, এই মেয়েটা যতটা রেগে থাকে, তার চেয়েও বেশি কাঁদে।
সে জানে, নির্ঝর স্যারের সেই থাপ্পড়ের দিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে জ্বর এসেছিল ওর।