মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২২
নওরিন কবির তিশা
লোকেশন: যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিক্রেট অপারেশন রুম, ওয়াশিংটন ডিসি রাত ২:১৭ মিনিট
ঘরটা নিঃস্তব্ধ, চারদিকে আধো অন্ধকার।
দেয়ালের উপর বিশাল প্রজেক্টরে ভেসে উঠছে একের পর এক তথ্য—ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত স্কুলের ফুটেজ,হামলার ছবি, সন্দেহভাজনের blurry ফুটেজ, নিউজ ক্লিপিংস।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দুই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন অফিসার,একজন অভিজ্ঞ স্পেশাল অপারেটিভ—ইলিয়াস রহমান, আর তার পাশে সদ্য নিয়োগ পাওয়া সায়েদ ফারুক।
সায়েদ হঠাৎই কাঁপা গলায় , মুখ চিন্তায় ভারী করে বলল,,
— “২১ জন বাচ্চা নিখোঁজ, স্যার।
তা-ও আবার ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত প্রাইভেট স্কুল থেকে!
এটা কীভাবে সম্ভব?”
সাঈদের এমন কথায় ইলিয়াস গম্ভীর গলায়, ঠোঁটে চাপা বিরক্তি নিয়ে বললো,,
— “Wellington International Academy একটা সাধারণ স্কুল নয়, সায়েদ।
ওখানে পড়ে বিলিয়নিয়ারের সন্তান, সেনেটরের মেয়ে, আন্তর্জাতিক ভিআইপিদের উত্তরসূরি।
এই হামলা শুধু নিরাপত্তার ব্যর্থতা না—এটা সরাসরি আমাদের মুখে চপেটাঘাত।”
সায়েদ:— “আর সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টা জানেন কী, স্যার?যারা টাকা দিয়েছে, তাদেরও বাচ্চারা ফিরে আসেনি।”
স্লাইড বদলিয়ে, গলা গভীর করে ইলিয়াস বলে,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “তাই তো বলছি—এই কেস আমরা নিজেরা ম্যানেজ করতে পারছি না।FBI ব্যর্থ, Homeland ব্যর্থ… এমনকি আমাদের ব্ল্যাক অপারেটিভ টিমও কিছু করতে পারেনি।
এখন আমাদের দরকার এমন কাউকে,যার জন্য শত্রুরা এলাকা ছাড়ে।”
ভুরু কুঁচকে সামান্য ভাবুক হয়ে সায়েদ বলে,,
— “মানে?”
স্লাইডে ক্লিক করেন, ঝাপসা একটা মুখ ভেসে ওঠে—সাদা হুডি, সানগ্লাস, তীক্ষ্ণ চোয়াল সেদিকে তাকিয়ে ইলিয়াস বলে,,
— “এইজন্যই ওকে আনতে হয়েছে।A.R.(Alpha Reaper).”
ঘরের বাতাস হঠাৎ ঘন হয়ে ওঠে। নিস্তব্ধতা যেন কানে তালা লাগিয়ে দেয়।
সায়েদ ফিসফিস করে, নিঃশ্বাস আটকে বলে—
— “ওই নামটা শুনলেই… শরীর জমে যায় স্যার।
উনিই তো, যাকে নামানো মানেই… যুদ্ধের শেষ ঘোষণা?”
আরেকজন পাশ থেকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলে ওঠে,,
— “হ্যাঁ।’One man wipeout unit’।
ও কথা কম বলে, কাজ বেশি করে।
ওকে যারা চিনে, তারা আর দাঁড়ায় না।”
সায়েদ:— “কিন্তু স্যার, আপনি কি নিশ্চিত… ওনি এখনো মিশনে নামে?”
ইলিয়াস চোখ নিচু করে হালকা গলায় ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে বলে,,
— “ও কখনো ‘অবসর’ নেয় না, সায়েদ।
ও শুধু ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়।
আর ফিরে আসে তখনই, যখন দরকার হয় যুদ্ধ শেষ করার।
এবং হ্যাঁ—এই মিশনের ডাক ও গ্রহণ করেছে।
কারণ এটা শুধু অপারেশন না…
এটা একেকটা মায়ের বুকফাটা কান্না থামানোর মিশন।
এবং এখন, এটা শুধু কিডন্যাপ না—
এটা একটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সূচনা।”
ঠিক তখনই দরজাটা খুলে যায়।
একটা ছায়া ঢোকে ঘরে—চেহারার অর্ধেক ঢাকা, চোখে সানগ্লাস, গায়ে কালো জ্যাকেট।
সে কিছু বলে না—শুধু চারপাশে একবার তাকায়।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়।
প্রজেক্টরে লেখা ভেসে ওঠে:
Alpha Reaper
Clearance Code: RED-ZERO
Status: LIVE
Location: Washington D.C.
ঘরের ভেতর জ্বলছিল একটিমাত্র নরম আলো,যেন নিঃশব্দে জেগে থাকা কোনও স্বপ্নের টুকরো।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজের চুলে আলতো করে আচড় দিচ্ছিল শিশির।
চুল আচড়ানো শেষ হলে, হিজাব আনতে ধীরে পাশের আলমারির দিকে এগিয়ে গেল সে।
আলমারির দরজা খুলতেই তার চোখ আটকে গেল ডান পাশে।সেখানে যত্ন করে সাজানো ছিল হিজাবের রঙিন কম্বো।নীল, মেরুন, খয়েরি, হালকা ধূসর… একেকটা যেন একেকটি মুঠোভরা গল্প।একেকটা নীরব স্মৃতি।
শিশির থমকে দাঁড়ায়।
তার স্মৃতির মানসপটে ভেসে ওঠে একটি স্নিগ্ধ সুন্দর বিকেলের প্রতিচ্ছবি…
যেদিন নাহিয়ান তাকে জোর করে এক বুটিকে নিয়ে গিয়েছিল, কিনে দিয়েছিল হিজাবের রাজ্য।
একটা-দুটো নয়—বুটিকে থাকা সব কালারের সব মডেলের হিজাব।তখন শিশির একরকম জেদ করেছিল—হিজাব সে পরবে না।কিন্তু সেই জেদ শেষমেষ গলতে বাধ্য হয়েছিল নাহিয়ানের মিষ্টি ধমকের কাছে।সেদিনই প্রথম, শিশির বাইকে করে ঘুরে বেড়িয়েছিল ঢাকা শহরের অলিগলি—
খোলা বাতাসে উড়ছিল চুল,
আর মনের গোপনে জমে উঠছিল অচেনা এক অনুভব।
সেই স্মৃতির ছায়া এসে ছুঁয়ে যায় শিশিরের মুখে।
ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত সুন্দর চাপা মুচকি হাসি।
তারপর নেভি ব্লু রঙের হিজাবটা হাতে তুলে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফিরে এসে হিজাবটা গুছিয়ে বাঁধতে শুরু করে সে।
প্রায় এক সপ্তাহ পর কলেজে প্রবেশ করল ফারিন।
তবে কলেজে ঢুকেই বাধল এক বিপত্তি।
আর মাত্র দুই দিন পরেই কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আর সেখানে একটি রবীন্দ্রসংগীতের ডুয়েট পারফর্মেন্সে ফিমেল সিঙ্গার হিসেবে রাখা হয়েছে তাকে।
অথচ সে নিজে কিছুই জানত না!আর বিষয়টা এসেছে সরাসরি প্রিন্সিপাল স্যারের নির্দেশে।
প্রিন্সিপাল স্যার ফারিনের বাবার পুরনো বন্ধু—তাই তাকে বরাবরই একটু বাড়তি স্নেহ দিয়ে থাকেন।
এমনকি প্রথমদিকে তাকে নিজের বাসায় থাকার সুযোগটাও দিয়েছিলেন।রবর্তীতে কলেজ আর টিউশনির দূরত্বের কথা ভেবে নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন, যদিও সেটা ফারিন গ্রহণ করেনি।
তাই পরে তার থাকার জন্য আলাদা বাসার ব্যবস্থা করে দেন।এই সব কিছুর জন্য প্রিন্সিপাল স্যারের প্রতি ছিল অশেষ শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা।তাই তার কথা অমান্য করা মানে শুধু স্যারের অসম্মান নয়, নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করাও।তাই আর কিছুই করার নেই ফারিনের।শেষমেশ চুপচাপ মেনে নিতে হয় ফারিনকে।ক্লাস শেষে ফারিন আর নেহা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিল।হঠাৎ নেহা ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তাহলে কি সিদ্ধান্ত নিলি? পারফর্ম করবি?
দেখ, তুই তো বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলি।
একটু প্র্যাকটিসও করিসনি।
এভাবে তিন দিনে কি আদৌ সম্ভব?”
ফারিন সেদিকে তাকিয়ে বলে,
— “কি আর করবো বল তো? প্রিন্সিপাল স্যার তো আমাকে অনেক স্নেহ করেন, জানিসই।
উনি তো নিজে নিজের বাসায় থাকতে দিয়েছিলেন।
টিউশনি দূর হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজের গাড়ির ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন, যদিও আমি নিইনি।
পরবর্তীতে আমার জন্য আলাদা বাসা ঠিক করে দিয়েছেন।
তাহলে এখন উনার কথার অবাধ্য হওয়া মানে তো নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করা, তাই না?”
তার কথা শুনে নেহা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে,
— “সেটা ঠিক, কিন্তু তুই তো অসুস্থ ছিলি? এর আগে যারা এই পারফরম্যান্সটা করত, তারা অনেক আগে থেকেই প্র্যাকটিস করত শুনেছি। সেখানে তুই তো গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস অনেক আগেই। তার ওপর আবার প্র্যাকটিস ছাড়া পারবি কি?”
— “পারতেই তো হবেই”।জানি, অন্য বারের মতো এবার হয়তো খুব সুন্দর হবে না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারি।
তুই শুধু বল, আমার সাথে মেল সিঙ্গারটা কে?”
— “সেটা তো জানিনা। হবে হয়তো কোনো সিনিয়র, অথবা আমাদের ক্লাসমেট।কিন্তু ক্লাসমেট হলে তো জানতাম।”
নেহার এমন কথা শুনে ফারিন ছোট্ট করে বলে,
— “ওহ।”
তখনই পিছন থেকে ফারিনের মাথায় জোরে একটা থাপ্পড় বসায় ইমন।
ফারিন মাথায় এমন আঘাত পেয়ে হাত রেখে পিছনে তাকায়—দেখে, ইমন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
ইমনের এমন হঠাৎ থাপ্পড়ে সে কটমট করে তাকিয়ে বলে,
— “তোকে কতবার বলেছি, আমার মাথায় থাপ্পড় দিবি না!তোর কারণেই,আমার মাথায় ব্যথার সমস্যা হয়েছে !”
ইমন সেদিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,
— “হাহ্, শুনলাম তোর শরীর অসুস্থ হলে নাকি কারো মনে ব্যথা হয়!এইজন্যই তো যে কিনা কারো খোঁজখবর রাখে না,সে-ই আবার সামান্য জ্বরে পড়লেও তোকে দেখতে যায়!
বাব্বা…!”
ইমনের কথায় অবাক হয়ে ফারিন বলে,
— “মানে…??”
ইমন ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “নাটক কম কর, পিও।
নেহা আমাকে সবই বলেছে।
শুনলাম, আমাদের নির্ঝর স্যার—মানে, তোর হিটলার—নাকি তোকে দেখতে গিয়েছিল!”
ফারিন এক ঝলক নেহার দিকে তাকায়।নেহা তখনও মুচকি মুচকি হাসছে।তারপর ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আরে, সেরকম কিছুই না।
উনি শুধু ওনার গণিতের টেস্টের কথা বলতে গিয়েছিলেন।
এইজন্যই তো আজকে আসলাম, না হলে কে আসতো?”
— “ও ওওও… তার মানে এই জন্যই আপনি অসুস্থতা সত্ত্বেও আজ টেস্ট দিতে এসেছেন!”
— “মেজাজ গরম করা কথা বলিস না ইমন।
সেরকম কোনো কথা না।
আজকে শরীরটা ভালো লাগছিল, এইজন্য এসেছি।
না হলে আসতাম না—সেটা গণিতের টেস্টই হোক, আর আদার্স সাবজেক্টের।”
ইমন সেদিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসির ঝলক টেনে বলল,
— “হ্যাঁ, সেটা তো ভালো করেই জানি।
আদার্স সাবজেক্টে তো আর নির্ঝর স্যারের মতো স্মার্ট, হ্যান্ডসাম স্যার নেই।ওগুলোর সময় তুই ঠিকমতো আসতিস কিনা, তা-ও সন্দেহ আছে!
আফটার অল, নির্ঝর স্যার তো পুরো কলেজের মেয়েদের ক্রাশ!তার ক্লাস আর টেস্ট কেউ মিস দেয় নাকি?”
ফারিন এবার ইমনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— “একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না!
আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন,
উনি আর সবার ক্রাশ হলে কী হবে, আমার কাছে উনি একজন নাক-উঁচু, গম্ভীর হিটলার!যার রক্তে পড়ে আছে হিটলারগিরি!মনে হয় হিটলারেরই কোনো দূরসম্পর্কের ভাই!”
ফারিনের এমন কথায় নেহা আর ইমন দুজনেই হেসে উঠল।
তারপর নেহা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— “তোরা কি এখানে দাঁড়িয়েই এসব বলবি, নাকি বাসায় যাবি?
আর ফারিন, তোর না প্রোগ্রাম আছে?
প্র্যাকটিস করবি না? চল, এখনই বাসায় চল!”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২১
ফারিন মুখ ভার করে হাঁটা ধরল, আর পেছন পেছন হাসতে হাসতে এগিয়ে চলল ইমন আর নেহা।
অন্যদিকে, কলেজ ভবনের দ্বিতীয় তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে, পুরোটা দৃশ্য লক্ষ্য করছিল নির্ঝর।
তার চোখে ফুটে উঠেছিল এক অদ্ভুত রকমের হাসি—নিঃশব্দ, নরম অথচ ব্যাখ্যাতীত।
নির্ঝর নিজেও বুঝলো না সে কেন এমন হাসল।
তবে এটা ঠিকই বুঝল—সে আর আগের মতো নেই।
হয়তো… ভেতরে ভেতরে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে।