মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৩ (২)
নওরিন কবির তিশা
— “তিন দিন তুই ভার্সিটিতে আসিসনি। কী হয়েছিল রে?”
লিমার প্রশ্নে শিশির একটু হেসে তাকাল তার দিকে।
— “আরে, তেমন কিছু না! নওরিফা আন্টি একটু অসুস্থ ছিলেন। তাই ওনার বাসায় ছিলাম।”
পাশ থেকে আনায়া জিজ্ঞেস করল,,
—”এখন আন্টির অবস্থা কেমন? সুস্থ হয়েছেন?”
শিশির:“কিছুটা ভালো। তবে… উনার অসুস্থতার আসল কারণটাই ছিল ওই গোমড়ামুখোটা। হুট করে চলে গেল, আর আন্টির কান্নায় মাথাব্যথা, জ্বর সব মিলে গেল।”
শিশিরের কথায় সাইফ যেন হাল্কা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলে উঠল,
— “তুই আবার নাহিয়ান ভাইকে গোমড়ামুখো বলছিস? বেচারা তো সেদিন তোর জন্য প্রেজেন্টেশনের পুরোটা সময় জুড়েই কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল ।”
সাইফের এমন কথায় শিশির মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
— “উনি কি আমার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন না কি? সেদিন বাসায় কেউ ছিল না, তাই হয়তো টাইম পাস করছিলেন।”
সাইফ হেসে ফেলল।
— “আহা রে বোকারাম! নিজে টাইম পাস করতে কেউ রোদের মধ্যে এসে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে থাকবে, ঢাকা শহরে কি রেস্টুরেন্ট পার্ক এসবের অভাব পড়েছে না কি যে ভাইয়া টাইম পাস করার জন্য আমাদের ভার্সিটি ক্যাম্পাসের এই কাঠ রোদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে?”
শিশির বিরক্ত হয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “আরে,বিরক্তি!সেই সময় থেকে ওই গোমরামুখোর কথা বলেই চলছিস,বলেই চলছিস থামবি নাকি আমিই চলে যাব?”
তাদের এমন কথাবার্তার কিছুই না বুঝে লিমা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল,
— “কি সেই সময় থেকে নাহিয়ান ভাই,গোমড়া মুখো এসব করছিস? কে সে?”
সাইফ হেসে বলল,
— “আরে তুই জানিস না? ও তোকে তো বলা হয় নাই? শিশিরের এক আন্টির ছেলে।”
ক্লাস শেষে তারা সবাই হেঁটে যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের বাইরে। হাসি-মজায় মেতে ছিল সবাই, কেবল আনায়া যেন নিজের মনে ডুবে ছিল। শিশির সেটা বুঝতে পেরে বলল,
— “আয়ু, এত চুপচাপ কেন?”
হঠাৎই যেন কোন এক গভীর চিন্তায় জগৎ থেকে বের হয়ে আসলো আনায়া। তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
— “আরে না, কিছু না। তোরা বল, কি বলছিলি?”
শিশির আনায়ার চিন্তার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারলেও, সাইফ আর লিমার সামনে কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করল। তাদের কথা, হাসিঠাট্টা, সব পেছনে ফেলে, চারজন ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের বাইরের দিকে।ঠিক তখনই এক মেয়ের কণ্ঠে ছেদ পড়ল সেই ছন্দে।
— “শিশির, তোমাকে ওই ভাইয়াটা ডাকছে।”
সবাই একসাথে তাকাল মেয়েটির দৃষ্টিপথ ধরে। দূরে, পুরনো অশ্বত্থ গাছটার নিচে ফুয়াদ দাঁড়িয়ে আছে, পাশে তার সেই চেনা দলবল। তার ঠোঁটে বাঁকা এক হাসি, চোখে হালকা উপহাস। দুই আঙুল তুলে ইশারা করল শিশিরের দিকে—একেবারে যেন ডাকছে নিজের চেনা খেলার পুতুলকে।
সাইফ ও লিমা থমকে গেল। আনায়া চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু মুখে একটুও ভয় নেই। কারন সে খুব ভালো করেই জানে শিশির যোগ্য জায়গায় যোগ্য জবাব দিতে পারে।শিশির ব্যাগটা আনায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল নিঃশব্দ পায়ে। ফুয়াদের সামনে এসে সামান্য ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”কি হয়েছে?”
ফুয়াদ চেনা ভঙ্গিতে বলল—
— “আরে সিস্টার! এত রাগ কেন? আমি তো শুধু হাই-হ্যালো করতেই ডাকলাম। কিন্তু তোমার চোখ দেখেই তো মনে হচ্ছে, গিলে খাবে আমাকে। যদিও আমি তো অনেক আগেই ডুবে গেছি ওই চোখের মায়ায়। গানটা শুনেছো না—
“ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়…”
শিশির চুপ। চোখে তীব্র ধিক্কার। ফুয়াদ বলেই চলে,,
— “এখন তো সাঁতার না জানার কারণে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। ভাবলাম, তুমি যদি একটু টেনে ধরো, বাঁচি…”
শিশির ঠোঁট বাঁকিয়ে কটাক্ষভরা স্বরে বলল,,
— “তাহলে এবার আপনাকে মরতেই হবে। আমি কাউকে বাঁচানোর জন্য জন্মাইনি। আর আমি নিজেও সাঁতার জানি না।”
ফুয়াদ মেকি অবাক ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করল,
— “উফ রে, এবার তো আমি সত্যি মরেই যাব!”
শিশির চোখ সরাল না। ঠান্ডা গলায় বলল,
— “তো আমি কি করতে পারি?”
— “আরে না না, মরলে হবে নাকি! এখনো তো বিয়ে করিনি, বাবা হলাম না—কমসে কম তিন-চারটা বাচ্চা না হলে মরার প্রশ্নই আসে না!”
ফুয়াদের গলা যেন তামাশার সুরে কাঁপছিল।শিশিরের ভ্রু কুঁচকে গেল। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
এক ধাক্কায় এক কদম সামনে এগিয়ে গেল শিশির। গলার স্বর নেমে এলো ধাতব কঠিনতায়।
— “আপনার এত নিম্নমানের রসিকতা নিজেই শুনে হাসলে ভালো করবেন। আমি না আপনার বন্ধু, না পরিচিত কেউ। আপনি কে, কী করেন, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমার সময়টা আমার, সেটাকে আপনি আপনার রসিকতার বাজার বানাতে পারবেন না। আর একটা কথা—আপনি যদি আবারও আমার সামনে এভাবে এসে দাঁড়ান, মনে রাখবেন, এবার শুধু কথায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
ফুয়াদের চোখে এক মুহূর্তের জন্য সত্যিকারের স্তব্ধতা। শিশির বলেই চলে—
— “একটা মেয়েকে আপনি চোখে চোখে রেখে অপমান করবেন, বাজে ইঙ্গিত দেবেন, তারপর বলবেন এটা ‘হিউমার’? আপনার মতো পুরুষেরা নিজেদের ছোট করে আমাদের তেজকে পরীক্ষা করে দেখতে আসে। কিন্তু আপনি ভুল মানুষ বেছে ফেলেছেন, মিস্টার ফুয়াদ আহমেদ।”
এই বলে শিশির আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। সামনে এগিয়ে গিয়ে আনায়ার কাছ থেকে ব্যাগটা টেনে বলল,,
— “চল, আয়ু। বেশি বাজে গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
তার কণ্ঠে ছিল না অভিমান , না ভয় —ছিল শুধুই অবজ্ঞা।অন্যদিকে, ফুয়াদ এখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে। যেন চোখে বন্দী করে নিতে চায় সেই দৃঢ় চোখজোড়া, সেই অচল ভাষার উত্তাপ। শিশির চলে গেলেও, তার চেহারার অভিব্যক্তি, ঠোঁটের বাঁক, উচ্চারিত শেষ কথাগুলো এখনো যেন বাতাসে রয়ে গেছে—ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
হঠাৎই পাশ থেকে ফুয়াদের গ্যাং-এর একজন বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলে উঠল—
— “বা…বা! কি সাহস! ভাইয়ের সাথে এভাবে
কথা বলে!আরো একটা মেয়ে হয়ে!”
ফুয়াদ কিছু না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়।পাশ থেকে সাবির চাপা কণ্ঠে বলে ওঠে—
— “শুধু সাহস? মেয়ের তেজও ষোলোআনা। ভাই, মনে আছে তো প্রথম দিন কি করেছিল? বাবারে…!”
ফুয়াদ এবার ধীরে ধীরে মাথা ঘোরায় সাবিরের দিকে। তার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা।
দিনটা শিশিরের জীবনের অন্যতম বিশেষ দিন। তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু, নতুন চ্যালেঞ্জ। তবু তার মনে সাহস, পাশে আছে তার ছায়াসঙ্গী, প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আনায়া।প্রথম ক্লাস শেষে ঘোষণা আসে, নতুনদের নিয়ে এক ‘ওরিয়েন্টেশন সেশন’ হবে কার্জন হলের একটি সেমিনার রুমে। এমন সেশন নতুনদের জন্য পরিচিত, যদিও এর প্রকৃত অর্থ সবাই জানে—সিনিয়রদের র্যাগিং।
শিশির ও আনায়াসহ সবাই সেই সেমিনার রুমে প্রবেশ করল। রুমটা ভরপুর, বাতাসে একটা চাপা উত্তেজনা। কিছুক্ষণ পর দরজা দিয়ে ঢুকল ৫-৬ জনের একটি সিনিয়র গ্যাং। তাদের চোখেমুখে সেই চেনা দম্ভ, ঠোঁটে পরিহাসের অদৃশ্য রেখা।শুরু হল পরিচয় নেওয়ার পালা, আর তার সঙ্গে আজব সব ‘টাস্ক’। কারো নিজের এলাকার নাম অভিনয় করে বলতে বলা হচ্ছে, কারো আবার গানের সঙ্গে নাচতে। এসব ছিল র্যাগিংয়ের মোড়কে ছদ্ম বিনোদন।এক সময় সেইছেলেগুলো শিশির আর আনায়ার সামনে এসে দাঁড়াল।শিশিরকে দেখে তাদের মধ্যকার একটা ছেলে বলল,,
—”আরে এতো দেখি আগুন সুন্দরী! তা সুন্দরী নামটা কি তোমার শুনি,”
ছেলেটার এমন কথা শুনে গা গিনগিন করে উঠল শিশিরের সে দাতে দাঁত চেপে বলল,
—”শিশির..শিশির শাহ।”
—”ওওও, শিশির নাইস নেম। আই লাইক ইট। আচ্ছা আগুন সুন্দরী…”
—”আমার নাম শিশির।”
—”ওও হ্যাঁ শিশির,কিন্তু তোমার সাথে আগুন সুন্দরী নামটাই যায়। যাই হোক যেহেতু তুমি পছন্দ করছ,না তাই থাক আর বললাম না।তবে..তোমার চুল তো দারুণ, স্বর্ণালী রঙ যেন সূর্যরশ্মির ঢেউ! একটু খোলো তো, দেখি ঠিক করে…”
শিশির চোখে রাগের ঝিলিক নিয়ে বলল—
— “চুল খুলবো মানে?মামাবাড়ির মোয়া পেয়েছেন নাকি? আমি এখানে অভিনয় করতে আসিনি। আপনি পরিচয় চেয়েছেন, দিয়েছি। কিন্তু এতটাও অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি।”
ছেলেটার চোখ রাঙা করল। পাশ থেকে সুজন নামের আরেকজন ছেলেও হেসে উঠল,
— “বাহ, মেয়েটার তো দেখি যথেষ্ট তেজ! কিন্তু এই তেজ এখানে কোনো কাজে আসবে না। যা বলা হচ্ছে, সেটা করো। চুল খোলো।”
শিশির নির্বিকার স্বরে বলল—
— “খুলব না।”
সুজন কণ্ঠ আরও কঠিন করল—
— “শোনো মেয়ে, এখানে তোমার ইচ্ছে বা তেজের কোনও দাম নেই। আমরা যা বলব, সেটাই শেষ কথা। ভালোয় ভালোয় চুল না খুললে, আমরাই খুলে দেব।”
শিশির ঠান্ডা গলায় জবাব দিল—
— “কি করবেন আপনারা? করুন। দেখি কিভাবে করেন।”
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো ভয় , বরং অদ্ভুত এক চ্যালেঞ্জের ছায়া। এই দুঃসাহসই তখন রুমের বাতাস থমকে দিল। অন্যদিকে শিশিরের এমন অনড় উত্তরে খানিকটা রেগে গেল সুজন। এগিয়ে গিয়ে শিশিরের চুল থেকে কাটা সরিয়ে দিতে যাবে ঠিক তখনই
ঝপাৎ!
একটা বজ্রসম চড় এসে পড়ল সুজনের গালে। মুহূর্তটা যেন জমে গেল বরফের মতো। ঘরে থাকা সকলে হতবাক। কেউ ভয়ে, কেউ অবিশ্বাসে চেয়ে রইল।
একটি মেয়ে হতবাক হয়ে ফিসফিস করল,
— “তুমি কি করলে! এরা ফুয়াদ আহমেদের গ্রুপ…”
শিশির রক্তচক্ষুতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তো আমি কি করতে পারি? আমি কি ভয় পাই? এই ছেলেটার জায়গায় যদি ওই ফুয়াদ আহমেদও থাকতো না তাহলে তাকেও আমি ঠিক এভাবেই থাপ্পড় মারতাম।”
অন্যদিকে এতক্ষণ রুমের বাইরে দাড়িয়ে সবটা লক্ষ্যপাত করছিল ফুয়াদ। শিশিরের এমন আচরণে আর কথায় সে বেশ অবাক হয়ে বলল,,
—”আমাকেও থাপ্পড় মারতা? ইন্টারেস্টিং তো!তাহলে তো তোমাকে একবার বাজিয়ে দেখতেই হচ্ছে!”
এদিকে সবার সামনে এমন থাপ্পর দেওয়ার উত্তর হিসাবে সুজন কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে দরজার ফ্রেম ছাড়িয়ে ভেতরে এল ফুয়াদ।
— “কি হচ্ছে এখানে?”
সুজন গলা নামিয়ে বলল,,
— “ভাই, মেয়েটা আমাকে চড় মেরেছে।”
সবার ভাবনা ছিল এবার শিশির বোধহয় বড়সড় বিপদে পড়বে। কিন্তু তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ফুয়াদ ঠাণ্ডা গলায় হেসে বলল—
— “ওর জায়গায় আমি থাকতে আরো একটা থাপ্পর এক্সট্রা মারতাম শালা গবেট।”
তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল—
—”তোমরা যাও সিস্টার, আর ডোন্ট ওয়ারী ওরা আর তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না—সে ব্যাবস্থা আমি করব।”
শিশির কিছুমাত্র বাক্য না খরচ করে আনায়া ও অন্যদের নিয়ে রুম ছেড়ে চলে গেল। ফুয়াদের মুখে এক অদ্ভুত হাসিপিছনে থাকা সবাই বিস্ময়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল।
সুজন ফিসফিস করে বলল—
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৩
— “ভাই, এত সহজে ওকে ছেড়ে দিলেন?”
ফুয়াদ তাকিয়ে হাসল। ঠোঁটে যেন বুনো হাওয়া খেলা করছিল।
— “সবাইকে একবারেই ধরা যায় না, কিছু মানুষকে ধরা লাগে আস্তে আস্তে… যাতে তারা ছুটে পালাতে না পারে। মেয়েটার তেজটা দেখলি? পুরো আমার ফিমেল ভার্সন। আমি তো এমন কাউকেই খুঁজছিলাম…I like her attitude.”