মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৬
নওরিন কবির তিশা
যুক্তরাষ্ট্র, ওয়াশিংটন ডিসি Langley CIA Headquarters
ছয়তলা নিচে স্থাপিত Strategic Shadow Division Hall আজ অতিরিক্ত গম্ভীর আলোয় আলোকিত। সাদা দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একাধিক হাই প্রোফাইল অপারেটিভ, রাষ্ট্রদূত, এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা। কাঁচের দরজা দিয়ে ঢুকলেন সেই পুরুষ—যাকে অনেকেই চেনে এক নামে: A.R. (Alpha Reaper)।চলতি সপ্তাহে আফ্রিকার নাইজার, কেনিয়া ও কঙ্গো থেকে অপহৃত ২১ জন শিশুকেই উদ্ধার করেছেন তিনি ও তার ইউনিট। সেই সাথে এরেস্ট করেছে অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী চক্রকে।
ডেভিড রিড—CIA এর শ্যাডো অপারেশন হেড, হালকা চশমার আড়ালে এক কড়া গলায় বললেন,
— “Ladies and Gentlemen, I present to you the man who doesn’t follow shadows—he becomes one. The Alpha Reaper.”
সবার সামনে এসে দাঁড়ালেন নাহিয়ান। পরনে সাদা শার্ট, ওপরে গাঢ় নেভি ব্লু ব্লেজার। চোখে যুদ্ধজয়ের ক্লান্তি, কিন্তু মাথা উঁচু। তাকে দেয়া হলো Merit of Global Tactical Bravery পদক। চারদিক মুখরিত হলো করতালির শব্দে।
ডেভিড কাছে এসে হালকা গলায় বললেন,
— “You’re the only one I trust with what comes next… We need to find Davil King.”
নাহিয়ান জবাবে কিছু বললেন না। শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘণ্টাখানেক পর
Hay-Adams Hotel – Private Suite, Washington DC
মিশন শেষে আজ প্রায় ছয় দিন পর নিজের হোটেল রুমে আসলো নাহিয়ান। ল্যাম্পের হালকা আলোয় চারপাশ জড়ানো নিঃস্তব্ধতা, জানালার পাশের ছোট টেবিলে রাখা ফোনটা যেন অনুচ্চ শব্দে জীবনের এক ধাক্কা দিয়ে জানান দিল তার উপস্থিতি—
টুং…একটা ক্ষীণ আলোর ঝলক।সে থমকে দাঁড়ায়। মিশন চলাকালে, বিশেষ করে যেসব অপারেশন আন্তর্জাতিক স্তরের চক্রান্ত জড়ানো, সেখানে মোবাইল, স্মার্টওয়াচ, ল্যাপটপ—সব রকম ব্যক্তিগত ইলেকট্রনিক ডিভাইস বহন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কারণ, সামান্য একটি সিগন্যাল—পুরো মিশনকে ফাঁস করে দিতে পারে।তাই ল্যাঙ্গলিতে ঢোকার আগে তাকে তার সমস্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র হস্তান্তর করতে হয়েছিল সুরক্ষিত সিস্টেমে।সে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয় কিন্তু.. পরক্ষণেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল
১৫৪০টি মিসড কল।
প্রায় সবই—বাংলাদেশের নম্বর। তার ফ্যামিলি,শিশিরের মা-বাবা এমনকি আনোয়ার সাহেব, তাছাড়া তার বাংলাদেশি সব এজেন্ট আর CID-এর বাংলাদেশ সেকশন থেকেও একাধিক কল।তার বুকের ভেতর মুহূর্তেই ধসে পড়ল সব কিছু।আঙুল কাঁপতে কাঁপতে “মা” নামে সেভ করা নাম্বারে কল করল।ফোন ধরতেই ওপাশে শোনা গেল ভেঙে পড়া এক নারীকণ্ঠ—
“আমার মেয়ে… আমার মেয়েকে ফেরত দাও! কেউ ওকে এনে দাও প্লিজ!”
চিৎকার করে কাঁদছিল শিশিরের মা, যেন কান্নার ঢেউ ফোনের তার বেয়ে বেরিয়ে এসে নাহিয়ানের বুক চিরে যাচ্ছে।নাহিয়ান অবাক—পাথরের মতো নিঃশব্দ। গলার স্বর বেরোচ্ছে না। সে কোনোমতে ঢোক গিলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
— “আন্টি… বলুন, শিশির কোথায়?”
ওপাশ থেকে এবার শিশিরের বাবার ব্যাকুল কণ্ঠ শোনা গেল,,
— “নাহিয়ান… ওকে পাওয়া যাচ্ছে না… পাঁচদিন… পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ… মেঘনা বিচে গিয়েছিলো ডে-আউটে… তারপর…”
তার আর বাক্য শেষ হলো নাএক ঝটকায় যেন কারেন্ট খেলে গেল নাহিয়ানের শরীরজুড়ে।সে হঠাৎ যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল।এক ঝটকায় ফোন ছুড়ে ফেলে দেয় দেয়ালের দিকে। ফোনটা এক পাশে পড়ে থাকে—টুকরো হয়ে। তার বিশাল দেহ পেছনে গিয়ে দেয়ালের গায়ে ঠেকে, দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে সে ছিঁড়ে ফেলে নিজের মাথার মুঠো মুঠো চুল।ঘুষি মারে নিজের বুকের মাঝখানে।চোখ রক্তিম, নিঃশ্বাস গরম। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে যেন চিৎকার আটকে রাখতে চাইছে কিন্তু… হঠাৎ এক প্রচণ্ড চিৎকারে গর্জে ওঠে সে,,,
— “Noooooooooo!!”
তীক্ষ্ণ এক চিৎকার ছিঁড়ে গেল কক্ষে নেমে আসা সমস্ত নিস্তব্ধতা।
সে ছুটে গেল সাইড টেবিলের দিকে,এক ঝটকায় পুরো টেবিল উল্টে দিল সে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সজোরে এক ঘুষি মারল,গ্লাস টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, হাত রক্তে রঞ্জিত হলো।পারফিউম, ঘড়ি, ডায়েরি, ছবি… সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে নাহিয়ান ধীরে ধীরে হাঁটছে রুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।তার চোখ এখন আর চোখ নেই— তা যেন একজোড়া অগ্নিঝরা অগ্নিকুণ্ড।দাঁতের ফাঁকে ঠোঁট চেপে ধরা, যেন দুঃখ আর ক্রোধ একসাথে গিলে ফেলছে তাকে।হঠাৎ সে থেমে গেল। ডান হাত বাড়িয়ে ফোনের পাশ থেকে একটি ডিভাইস তুলল—এক্সক্লুসিভ লিঙ্কড স্যাটেলাইট ফোন।ডায়াল করল এক বিশেষ নাম্বারে। ওপাশে রিসিভ করল এক বাংলাদেশি যুবক—নাহিয়ানের নিযুক্ত লোক, যে ঢাকায় শিশিরের উপর নজর রাখছিল।
— “হ্যালো ভাই… ভাই… আমি… ভাই প্লিজ মাফ করে দিবেন ভাই… আমি… আমি জানি না ভাই…”
তার কণ্ঠ কাঁপছিল। আতঙ্ক যেন গলা শুকিয়ে দিয়েছে।
নাহিয়ানের কণ্ঠটা জ্বলে উঠল—
— “তুই কিসের জন্য ছিলি ওর পাশে রে শু*রের বাচ্চা! বল!আমি তোকে রেখেছিলাম ওকে পাহারা দিতে, আর তুই করছিলি কী?পাঁচটা দিন, পাঁচটা দিন ও নিখোঁজ আর তুই এখন বলিস—‘জানি না’?!”
রিফাত প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল—
— “ভাই, আমরা তো ওইদিন পর্যন্ত মেঘনাতেই ছিলাম ভাই… ভাবলাম ভাবি হয়তো পরে ফিরবেন… ভাই, আমি ভেবেছিলাম ভাবি গ্রুপে থাকছে—ভাই, প্লিজ… আমি…”
নাহিয়ান রাগে এক ঝটকায় সেই ফোনটাও ছুড়ে মারল দেওয়ালে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে।ঠিক তখনই দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল শেজাহান।
— “Sir?! Sir, what happened?!”
কিন্তু নাহিয়ান থেমে নেই। সে সোজা এগিয়ে এসে গর্জে উঠল—
— “What happened?! You tell me, Shezahan!
তুমি কি জানো না যে আমার জীবনের একমাত্র কারণটা হারিয়ে গেছে?তুমি জানো না—আমি তাকে রাখতে চেয়েছিলাম নিরাপদে…আর তোমরা… তোমরা সবাই শুধু অসহায় দর্শক!”
শেজাহান হতভম্ব।নাহিয়ানের রক্তাক্ত হাত দেখে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শব্দ বের হচ্ছিল না।
— “Sir, আমি… আমি কালকেই জেনেছি আর কালকেই এক মুহূর্ত দেরি না করে খোঁজ লাগিয়েচ্ছি। আপনি ছিলেন না বলে আপনাকে জানাতে পারিনি। বাংলাদেশ CID, লোকাল টিম, স্পট ইনফো সব জায়গায় খবর পাঠানো হয়েছে।কিন্তু… madam কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, Sir… কোথাও না।”
নাহিয়ান ওর কলারে গিয়ে হাত রাখল। টেনে তুলল তাকে।
—”শু*রের বাচ্চা!তোকে আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভেবেছিলাম!ও আমার প্রাণ ছিল… তুই বুঝিস না—ওর চোখে আমার পৃথিবী… আর আজ… আজ সে নেই!”
তার হাতের চাপ এতটাই তীব্র, শেজাহানের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।ঠিক তখনই দরজার কাছে এসে দাঁড়াল তনয়া।
— “A.R.! ছাড়ো ওকে! ছাড়ো এখনই!!”
তনয়ার গলার চিৎকারে যেন ঘুম ভাঙল নাহিয়ানের।
সে ধীরে ধীরে হাতটা ছেড়ে দিল, একটু দূরে হেঁটে গেল জানালার দিকে। চোখে জল নেই, কিন্তু বুক ফাটছে।
তনয়া এগিয়ে এসে বলল—
— “A.R., please… calm down… তুমি নিজেই তো আমাদের শেখাও—ক্রাইসিসে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো, তাহলে শিশিরকে কে উদ্ধার করবে?”
নাহিয়ান পেছনে ফিরল। তার কণ্ঠে ছিল না কোনো শব্দ—শুধু একটা নিরব প্রতিজ্ঞা।
—“She’s not just a case file to me… she’s my soul.আর আমি আমার আত্মাকে খুঁজে বের করব, পৃথিবীর শেষ কোণ থেকেও।”
এদিকে…
চতুর্দিকে নিস্তব্ধতা এমন, যেন প্রকৃতিও নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।পুরনো, কাঠ আর পাথরের তৈরি একটি কটেজ—যার ছাদে রোদ পড়ে না, আর জানালায় আলো নামে না। সুইজারল্যান্ডের ঘোস্ট ভ্যালি নামক জনমানবহীন এক অঞ্চল—ভ্যাল ভ্যালিনো উপত্যকার,একটি পাথুরে কটেজ,যেখানে শতবর্ষ আগেও ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ইতিহাস হয়ে ছড়িয়ে আছে। আর সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে এখানে এখনো পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা নেই।সেই নির্জন কটেজের ভূগর্ভস্থ রুমে বসে আছে শিশির।চারপাশটা অন্ধকার নয়,কিন্তু তেমন আলোকিতও নয়। মাথার উপরে কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো, দেয়ালে ছায়া পড়ছে শিশিরের মুখের। তার চোখদুটি স্থির—ভয়ের গভীরে নয়, বরং রাগ আর প্রশ্নে জর্জরিত।
সে জানে, কেউ তাকে ধরে এনেছে। কিন্তু এখনো তার শরীরে কোনো ক্ষতি করা হয়নি। তবুও সে বুঝে নিয়েছে—এই নীরবতা, এই গা শিউরে ওঠা অন্ধকার—সবটাই পরিকল্পনার অংশ।দরজা খোলার শব্দ হয়। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামছে একজন—তার বুটের শব্দ যেন ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিধ্বনির মতো।একজন লোক প্রবেশ করে রুমে।
উচ্চতা ছ’ফুটের কাছাকাছি, দেহের গঠন সুগঠিত ও ধারালো। শেভ করা গাল, নীলচে চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে ঠান্ডা হাসি। গায়ে গাঢ় রঙের ক্যাজুয়াল জ্যাকেট, চোখে নির্লিপ্তি।তার চলাফেরা, কথাবার্তা, পোশাক—সবকিছুতেই ফুটে ওঠে সে ব্রিটিশ ঘরানার। খুব সম্ভবত আগে হয়তো মিলিটারি ট্রেনিংও ছিল তার—হাঁটার ভঙ্গি, ধৈর্য ধরে তাকানো, আর ভয়ের জায়গায় রসিকতা করার ভঙ্গি—সবই বলছে সে “প্রফেশনাল।”
লোকটা সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে।একটু তাকিয়ে দেখে শিশির এখনো ঠিকমতো চেয়ার থেকে সরে যায়নি, চোখে ভয় নেই, মুখে ভাঙা ভাঙা শ্বাস।লোকটা একবার হেসে বলে—
— “Still fire in your eyes… good.
But, “I don’t know how long the fire will last.”
শিশির চুপ। মুখে একটুকরো ঘৃণার ছায়া, কিন্তু সে চোখ নামায় না।লোকটা একটু নিচু হয়ে বলে—
—“Do you know… what happens here?
Ghost Valley is not on Google Maps anymore.
No one comes here. No one leaves from here… alive.”
নিশ্বাস ফেলে শিশির বলে—
—“তোমার কথা শুনে ভয় পেলে, তাহলে তো জীবনটাই বৃথা।তোমার মতো বাঁদরকে ভয় পেতে শিখলে, আমি নিজেকে মানুষ ভাবা বাদ দেবো।কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন…তুমি আমাকে এখানে কেন আনলে? What’s the relation between us? I think I don’t know anything about you.”
লোকটা এবার হেসে ওঠে। একটা নিঃশব্দ, ধীর, শীতল হাসি।চোখের কোনায় খেলে যায় এক অসম্ভব রহস্য।
তার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি জমে ওঠে
“The relation between you and me… is so secret,
even the truth itself is not allowed to speak of it.”
শিশির তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে।বলার মতো কিছু যেন গলার কাছে এসে থেমে যায়।সে জানে, এই যুদ্ধটা কেবল শরীরের নয়—এটা মন, সাহস আর ধৈর্যের।লোকটা এবার উঠে দাঁড়ায়। ধীরে পেছনে ফিরতে ফিরতে বলে—
—“Rest well.
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৫
Tomorrow, you’ll understand why silence is deadlier than scream.”
তার কণ্ঠের রেশ যেন ঘরের বাতাসে হিম হয়ে ঝুলে থাকে।
দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে সে দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়।আঁধারটা আরও গাঢ় হয়ে আসে। শিশিরতাকিয়ে থাকে সেই বন্ধ দরজার দিকে—ভিতরে ভিতরে কাঁপলেও, মুখে তার কোনো ভয় নেই।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে—একটা চাপা শ্বাস,যা কারও শোনার কথা নয়।