মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩১
নওরিন কবির তিশা
—”বললাম তো…বলবো না কবুল। যা ইচ্ছা করুন!”
কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় শিশির। বুকে বয়ে যাচ্ছে তীব্র ঝড় তবুও মুখে নির্লিপ্ততা। সে বসে আছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের উপকণ্ঠে, Petit-Saconnex অঞ্চলের এক শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ Mosquée de Genève এ।মসজিদের স্থাপত্যের অবস্থা শোচনীয়,কিন্তু তার দেয়াল বয়ে বেড়ায় এক শতাব্দীর ইতিহাস।সাদা দেয়ালের মাঝখানে গা-চেপে দাঁড়ানো ছোট্ট একটা দরজা,ফাটল ধরা দেয়াল,আর জানালার পাশে টানানো ফ্যাকাশে পর্দা।প্রায় অব্যবহৃত এই মসজিদে আজ বসে আছে নাহিয়ান,শিশির আর তাদের সামনের এক কোণায় একজন বয়স্ক পাকিস্তানি হুজুর,পরনে ধূসর পাঞ্জাবি,মাথায় পাগড়ি, মুখে মেহেদী রাঙ্গা ঘনদাড়ি।তাকে নিজের বাসভবন থেকে একপ্রকার তুলে এনেছে শেজাহানরা।হুজুর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,
—”বেটা,বেটা,দেখো ও কাবুল নাহি ক্যাহানা চাতিহে।তো ছোর দো না মুজকো।মে ক্যা কারু ইহাপে?মেরা বহত কাম হে,কুচ বাদ জাহার কা ওয়াকত হো গে মুজকো নামাজ পাড়না হে!”
—”ও কবুলও বলবে আর এখানে বিয়েও হবে।তাই কানের কাছে বেশি ঘ্যান ঘ্যান করবেন না।এতে ফল কিন্তু ভালো হবে না!”
নাহিয়ানের বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরির ন্যায় কন্ঠে ভয়ে জমে যায় হুজুর। তিনি পাকিস্তানি হলেও বাংলা কমবেশি ভালোই বোঝেন।এমনিতেই এই ভর দুপুরে তাকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে এনেছে কিছু অপরিচিত যুবক। তারউপর এসে থেকেই তাকে দেখতে হচ্ছে নাহিয়ানের রাগ আর শিশিরের জেদ।তিনি মনে মনে বললেন,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—”ইয়া আল্লাহ এ ক্যাছা মাছিবাত!”
নাহিয়ান শিশিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
—”কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না?বল কবুল।”
শিশির তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”বলব না!”
—”বলবি না?”
—”না”
নাহিয়ান এবার বাঁকা হেসে বলল,,
—”Then ready to take a super surprise darling!!”
নাহিয়ানের কন্ঠ শীতল। ঠিক যেন কোনো ঝড়ের পূর্বে প্রকৃতির ভয়াল নিস্তব্ধতা।শিশিরের কেন জানি অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করল।যেই ছেলে সকালের সামান্য একটা কথার জন্য এতদূর আসতে পারে।সে শিশিরের এমন জেদ ভাঙ্গতে না জানি আরো কত কি করতে পারে! শিশিরের মনের খচখচানি এবার তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করলো।তার স্মৃতির পাতায় একে একে ভেসে ওঠল সকালের ঘটনাগুলো…
সকালে……
প্রায় মাসখানেক হলো শিশির তার মা-বাবাকে দেখেনি, এমনকি কণ্ঠটাও শোনেনি।হ্যারি যখন তাকে বন্দী করে রেখেছিল তখন তো যোগাযোগ অসম্ভব ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে যখন থেকে সে হাসপাতাল থেকে ফিরে নাহিয়ানের সাথে থাকছে তখন থেকে প্রতিদিনই সে নাহিয়ানকে বলছে বিডি ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু নাহিয়ানের এক কথা “তুমি অসুস্থ।এখন কোনো মতেই জার্নি করা যাবে না।”কি আর করার? আসলেও তো সে অসুস্থ।আর সবচেয়ে বড় কথা শিশিরের ফ্লাইট ফোবিয়া আছে তাই সে আর কথা বাড়ায়নি।কিন্তু সে বিগত কয়েকসপ্তাহ ধরেই সে নাহিয়ানকে বলছে অন্তত একবার বাবা মার কণ্ঠটা শুনিয়ে দিতে।
কিন্তু নাহিয়ান বারবার একটাই কথা বলছে—”এখন না, কিছু ঝামেলা আছে তাই এখন তার পক্ষে কথা বলানো সম্ভব নয়।আজ সকালেও সে যখন ফোনের কথা বলে তখন নাহিয়ানের ফের এমন নির্লিপ্ত জবাবে রাগ হয় শিশিরের। এই না বলাটা তার ভেতরটাতে চিড় ধরিয়ে দেয়। নিজকে সামলাতে না পেরে রুমে এসে অন্ধকারের মাঝে বসে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর একটা স্যুপের বোল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে নাহিয়ান। দু তিনবার টোকা দেওয়ার পরও যখন ভেতর থেকে শিশির কোন জবাব দেয় না তখন সে নিজ থেকে রুমে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করে নাহিয়ান দেখতে পায় রুমটাকে সম্পূর্ণ অন্ধকার করে রেখেছে শিশির। এমনকি আজকে সে ব্যালকনির সাইডের জালনার পর্দাও সরায়নি। যার ফলে রুমটি পুরোপুরি নিস্তব্ধ অন্ধকারে ডুবে আছে। নাহিয়ান নিঃশব্দে এসে স্যুপের বোলটা বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে তারপর বেলকনি সাইডের জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। যার ফলে ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধ কিরণ এসে পড়ে রুমে। কেটে যায় অন্ধকার। এবার নাহিয়ান পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার শিশিরবিন্দু মুখ গোমড়া করে বসে আছে। তাকে দেখে নাহিয়ান মুচকি হেসে বলে,,
—”রেগে আছেন?ম্যাম….”
শিশির কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নাহিয়ান পাশ থেকে স্যুপের বোলটা হাতে নিয়ে শিশিরের পাশে এসে বসে।শিশির তাকে পাশে বসতে দেখে কিছুটা সরে যায়। নাহিয়ান স্যুপ বোল থেকে এক চামচ স্যুপ হাতে নিয়ে তাতে ফুঁ দিতে দিতে বলে,,
—”ওকে, আর এক সপ্তাহ দিন। আমি ব্যবস্থা করবো, কথা দিচ্ছি।এই সপ্তাহের মধ্যেই।দেখা গেল হয়তো আজকে রাতেও আপনার ইচ্ছা পূরন হতে পারে!”
শিশির পাশ ঘুরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই হাত লেগে অসাবধানতাবশত ছিটকে পড়ল স্যুপের বোল,একটা টুকরো শব্দ তুলে ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল সিরামিকের বোলটা।নাহিয়ান চুপচাপ মেঝের দিকে তাকাল।তার চোখে ছিল একরাশ নরম আশ্রয় কিন্তু পরক্ষণেই সেই নরম আশ্রয় পরিনত হয় এক জলন্ত অগ্নিকুন্ডে শুধু মাত্র শিশিরের বলা কিছু কথায়,,
—”কে হন আপনি আমার?কেন শুনতে যাব আমি আপনার কথা?কেন আপনি আমায় যা বলবেন আমাকে তাই মেনে নিতে হবে?আমি বাংলাদেশ যাব মানে যাবই। আপনি আমার উপর জোর দেখানোর,অধিকার দেখানোর কে ?”
নাহিয়ান রেগে গিয়ে শিশিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
—”তোকে নিজের কাছে রাখার জন্য আমার কোনো লোক দেখানো so called সম্পর্কের প্রয়োজন নেই।কিন্তু তুই যেহেতু আমাকে সম্পর্কের,অধিকারের কথা বলছিস তাহলে চল আজকে তোকে সেই অধিকারনামার মাধ্যমে আমি আপন করব যেখান থেকে কেউ কোনোদিন তোর থেকে আমাকে আলাদা করতে পারবে না। শুধু ইহকালে নয় পরপারেও না।আর সেই অধিকারনামায় তোকে সাক্ষর করাতে যদি আজকে দুই—চারটা লা*শও ফেলতে হয় তাতেও এই নাহিয়ান চৌধুরী পিছুপা হবে না।
God promise!”
কথাগুলো মনে পড়তেই নিঃশ্বাস আটকে আসলো শিশিরের।যদি সত্যি সত্যি নাহিয়ান আবার কোনো খু*ন করে!ঠিক তখনই নাহিয়ান শেজাহানকে জোরে ডাক দিল,,,
—”শেজাহান”
বাইরে থেকে শেজাহান দ্রুত জবাব দিল,,
—”Yes sir!”
—”come in”
শেজাহান আগে থেকেই জানত তাকে কি কি করতে হবে তাই নাহিয়ানের আদেশ শোনার সাথে সাথে সে দ্রুত মসজিদের ভেতর প্রবেশ করল।তাকে দেখে নাহিয়ান বলল,,
—”show her the photo…. please…”
শিশির নাহিয়ানের কথার কিছু না বুঝলেও শেজাহান
ঠিকই বুঝে যায় তাকে কি করতে হবে।সে নিজের ফোন হাতে নিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে তা খুলে গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে শিশিরের দিকে এগিয়ে যেতে গেলেই নাহিয়ান তাকে সর্তকতার স্বরে বলল,,
—”কোথায় যাচ্ছ?এখান থেকে দেখাও!”
নাহিয়ানের এমন হঠাৎ ধমকে কিছুটা কেঁপে উঠল শেজাহান।
—”ই….ই…ইয়েস স্যার!”
সে সেখানে দাঁড়িয়েই কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা সামান্য উঁচু করে ধরল।শিশির প্রথমে সেদিকে না তাকালেও পরক্ষণে এক ঝলক সেদিকে তাকাতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার,হাত-পা হঠাৎই বাজেভাবে কাঁপতে শুরু করল।কোনো মতে নিজের কাঁপা হাতে মুখ চেপে অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠলো,,
—”বা…বা…বাবা.. আ..আমার…বাবা!”
চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল।ছবিতে তার বাবা ইউনাইটেড হাসপাতালের এক কেবিনের বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে।মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ব্যাস এইটুকু দেখতে পায় সে।তারপরই নাহিয়ান শেজাহানের হাত থেকে দ্রুত ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে বলে,,
—”দেখলে তো তোমার বাবার অবস্থা।তাই বলছি আমার কথা মানো এতে তোমারই লাভ।নাহলে হয়তো নিজের বাবাকে নিজের সামনে শেষবার আর কখনো……!!”
—”না…আআ…
শিশিরের পুরো দুনিয়া কেঁপে ওঠে।সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,
—”আমি মা..মানবো,মানবো আমি,আপনার সব কথা মানবো।ব..ব..বলুন…বলুন কি করতে হবে!”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,
—”That’s like my girl.বেশি কিছু না শুধু এই রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে হবে আর…”
সে হুজুরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”হুজুর..আর জানি কি করতে হবে?”
হুজুর: কাবুল ক্যাহেনা হে বেটা।
নাহিয়ান: হ্যাঁ কবুল বলতে হবে।
মসজিদের ঘরে বাতাস যেন হঠাৎ থেমে গেছে।
পিছনের জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে সোনালি দুপুরের আলো, তাতে শিশিরের মুখটা আরও বেশি ক্লান্ত, অভিমানী, আর ভীতু লাগছে।নাহিয়ান তার চোখের সামনে রাখা রেজিস্ট্রি পেপার খুলে রাখল সাদা টেবিলের উপর। পেপারের উপর শুধু একটি লাইন, যেখানে স্বাক্ষর করলেই এই সম্পর্ক আর কেবল আবেগে বাঁধা থাকবে না, বাঁধা থাকবে আইনের শিকলেও।শিশির কাঁপা হাতে কলমটা নেয়।নাহিয়ান পাশে বসে ফিসফিস করে বলে—
—”এটা কোনো বাধ্য করা নয়। এটা শুধু তোমার একটা প্রতিশ্রুতি, যে তুমি আজ নিজেকে আমার বলছো… তোমার ভাষায়, নিজের মতো করে।”
শিশির চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টানে।তার বুকটা ফেটে চিৎকার করতে চাইছে—কিন্তু সে শুধু নিচু গলায় বলে—
—”যদি আজ বাবার মুখটা না দেখতাম, তাহলে হয়তো এই স্বাক্ষর কখনো হতো না।”
নাহিয়ান মৃদু হেসে মনে মনে বলে,,
—”তুমি বুঝতে পারছো না… তোমার হাতের এই কাঁপুনি আমার গোটা শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।”
শিশির কলম চালিয়ে দেয়।রেজিস্ট্রি পেপারে তার নামের নিচে উঠে আসে স্বাক্ষরের আঁচড়—ভেজা চোখে লেখা এক অসমাপ্ত কবিতার শেষ চরণ।নাহিয়ান পেপার হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় হুজুরের সামনে।হুজুর ততক্ষণে দরুদ পড়া শেষ করেছেন।তিনি চোখে চশমা তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন—
—“বেটি, তুম কেহ দো… কেয়া তুমহে ইয়ে নিকাহ কাবুল হ্যায়?”
শিশির কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তার চোখ বেয়ে পড়ে এক বিন্দু জল।তারপর নিচু গলায়, কিন্তু পরিস্কার উচ্চারণে বলে—
—”হ্যাঁ… কাবুল… আমি কবুল বলছি… আমি কবুল করছি…”
হুজুর একবার নাহিয়ানের দিকে তাকান, তারপর প্রশ্ন করেন—
—“আওর তুম, বেটা? তুমহে ইয়ে নিকাহ কাবুল হ্যায়?”
নাহিয়ান এক সেকেন্ডও না ভেবে চোখে দৃষ্টি রেখে বলে—
—“বেহিসাব কাবুল হ্যায়… জান দে কাবুল হ্যায়… সব কুছ হে কাবুল।”
হুজুর এবার তৃতীয়বার বলেন—
—“দোনো তরফ সে নিকাহ কাবুল হো গয়া। আল্লাহ তুমহে দুনিয়া ও আখিরাত মে সুখি রখে।”
তার কথার সাথে সাথে যেন মসজিদের দেয়ালজুড়ে বাতাস হালকা কেঁপে ওঠে।শিশির আর নাহিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ—কেউ কিছু বলে না।নাহিয়ান আস্তে আস্তে শিশিরের দিকে এগিয়ে আসে, তার হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়।
—”তোমার হাত আজও কাঁপছে। কিন্তু আমি জানি, এই কাঁপুনি আমার পাশে থাকলে একদিন থেমে যাবে। কারণ এখন থেকে আমরা একসাথে… শুধু এই জন্মে নয়, বরং—এই ভালোবাসা থামবে না…সেই মৃত্যুর পরেও।”
শিশির কিছু বলে না।শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে—এই মানুষটাকেই সে একদিন ঘৃণা করতে চেয়েছিল।আজ তাকেই সে চোখের জলে কবুল বলে দিয়েছে।আর সেই পুরনো, শোচনীয় মসজিদের কোলঘেঁষে লেখা হয়ে যায় এক নিষিদ্ধ ভালোবাসার বৈধতা।
ধরনী আজ আলোকিত পূর্ণিমার আলোয়।চাঁদ যেন খেলা করছে মেঘের আড়ালে-অন্তরালে কখনো লাজুক, কখনো বা আবেশে নত হয়ে।ছড়িয়ে দিচ্ছে রুপালি কিরণ।ব্রেঞ্জ লেকের স্বচ্ছ নীল পানিতে চাঁদের সেই রুপালি আলো প্রতিফলিত হয়ে তৈরি করছে অপার্থিব মুগ্ধতা,
যেন রাতের বুকেই খোদাই করা কোনো স্বপ্নপুরী।দূর রথোন পাহাড়ের চূড়া থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ সেই সাথে কটেজের বাইরের পাহাড়ি বুনো ফুলের এক অদ্ভুত মিষ্টি সুভাস।
রাত প্রায় ৮ টা। নিজের রুমের মেঝেতে দুই হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে শিশির।হঠাৎ হঠাৎ গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠছে সে,চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।সে বিশ্বাসই করতে পারছে না মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার সাথে কি কি হয়ে গেল।জানলার পর্দা ভেদ করে চাঁদের রুপালি কিরণের এক চিকন রশ্মি এসে পড়ছে তার দুধে আলতা শরীরে। হঠাৎই তার পাশে ফোন বেজে উঠল। অন্ধকার রুমে হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দ আর ক্ষীন আলোয় শিশির মুখ তুলে চাইল। মেঝেতে এখনো সেই ভাঙ্গা সিরামিকের স্যুপ বোলটা,আর তার ঠিক পাশেই পড়ে আছে নাহিয়ানের ফোন—যা থেকে আসছে রিংটোনের শব্দ। সকালে শিশিরকে জোর করে জেনেভায় নিয়ে যাওয়ার সময় নাহিয়ানের ফোনটা মেঝেতে পড়ে যায়,যা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। শিশির এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে রাগে,ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু ফোনটা বারবার বাজতেই থাকল।শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই শিশির হতভম্ব। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে,,
Incoming video call from Rodela aunty.
রোদেলা—তার মা। শিশির বুঝতে পারল না এটা কি সত্যি নাকি তার অবচেতন মনের কল্পনা।সে দ্রুত উঠে রুমে আলো জ্বালিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আবার ফোনের স্ক্রিনে তাকালো, কিন্তু না এটা কল্পনা নয় সত্যি।সত্যিই তার মা কল করছে। শিশির খুশিতে কি করবে বুঝতে পারল না।ফোন তখনও বেজেই যাচ্ছে। শিশির নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরল। ফোন ধরতেই তার মা তাঁকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,,
—”নুয়া!”
শিশির আবেগী কণ্ঠে বললো,,
—”মা!”
রোদেলা জামান:”বাবা কতকাল পর আমাকে ফোনে মা বলে ডাকলি?আমি তো জানতাম ফোন করলে আমি মিসেস সিকদার শাহ হয়ে যাই।যাই হোক তুই আজ এখনো ঘুমাসনি?এখন কি সুস্থ লাগছে?”
মায়ের এমন কথায় বেশ অবাক হয় শিশির।তার মাকে সে কতদিন পর দেখছে। কিন্তু মায়ের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে যেন প্রতিদিনই তাকে তার মা দেখেছে,তার সাথে কথা হয়েছে।সে বিস্মিত কন্ঠে বলল,,
—”মানে?”
রোদেলা জামান:”মানে আর কি? যখনই নাহিয়ান এখানে কল দেয় তখনই তো ঘুমানো থাকিস।তাই..”
শিশির:”মানে উনি তোমার সাথে আগেও কথা বলেছেন।”
রোদেলা জামান:”হ্যাঁ, শুধু আমার সাথে কেন?সবার সাথেই কথা বলে।কালকেও তো কথা হলো।
শিশিরের সামনে এবার সবটা পরিষ্কার হলো। তার মানে নাহিয়ান প্রতিদিনই যখন সে ঘুমায় তখন তার বাবা-মার কাছে কল দেয়। কিন্তু যখন শিশির কল দিতে বলে তখন দেয় না। কিন্তু কেন?
রোদেলা জামান:”কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?
মায়ের কন্ঠ ধ্যান ভাঙ্গে শিশিরের।সে মায়ের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল,,
—”আচ্ছা মা,বাবা কোথায়?”
—”এইতো একটু ওয়াশ রুমে গেল।চোখে মুখে পানি দিতে তার নাকি আজ খুব ঘুম পাচ্ছে আর এদিকে তোকে আজ এখনো দেখেনি তাই আমাকে বলল কল দিতে আর সে গেল ওয়াশ রুমে।
তাদের কথার মাঝে হঠাৎই রোদেলা জামানের পিছন থেকে সিকদার শাহ বলল,,
—”কে ফোন করেছে রোদ?”
রোদেলা জামান:”তোমার মেয়ে। নাও কথা বলো।”
সিকদার শাহ:”কিন্তু নুয়া তো এই টাইমে ঘুমায়।”
শিশির:”বাবা!”
সিকদার শাহ দ্রুত রোদেলা জামানের কাছ থেকে ফোন নিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”মামনি”
শিশির:”কেমন আছ বাবা।এখন সুস্থ আছ তো?”
সিকদার শাহ:”অবশ্যই মামনি যাও অসুস্থতা ছিল তাও আজ তোমার সাথে কথা বলতে পেরে সেরে গেছে, তোমার কি অবস্থা?”
শিশির:”আমার কথা বাদ দাও তুমি আগে বল হসপিটাল থেকে আসলে কখন?আর…”
তাকে কথার মাঝে থামিয়ে সিকদার শাহ বললেন,,
—”হয়েছে হয়েছে আমার মা!থামো এবার!আমি একদম ফিট আছি।”
শিশির:”তুমি মায়ের কাছে দাও।আমি একদম বিশ্বাস করি না তোমায়।”
সিকদার শাহ রোদেলা জামানের দিকে ফিরে বললেন,,
—”নাও কথা বলো আমার মায়ের সাথে।সে তো আবার আমার কথা বিশ্বাস করছে না।”
রোদেলা জামান হেসে বললেন,,
—”তোমার মেয়ে তো তোমার মতোই হবে তাই না!?”
তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”বল কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
শিশির:”মা তোমরা বাবাকে হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছ কেন?”
রোদেলা জামান:”ওমা সুস্থ মানুষ হসপিটালে কি করবে?”
শিশির:”মানে,বাবা তো…?”
রোদেলা জামান:”তোর বাবা তো স্টক করেছিল, কিন্তু সেটাও তোর হারিয়ে যাওয়ার সময়টাতে।পরে যখন নাহিয়ান তোকে খুঁজে পেল তখন থেকেই তো সে সুস্থ।”
শিশির:”স্টক!”
রোদেলা জামান:”হুম, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে এখন সুস্থ। আচ্ছা নাহিয়ান কোথায় রে?”
নাহিয়ান নামটা শুনতেই রাগে গা জ্বলে উঠলো শিশিরের।একটা মানুষ এতোটা খারাপ,মিথ্যাবাদী কি করে হতে পারে?এটা ভেবেই ঘৃনায় গা ঘিনঘিন করে উঠলো শিশিরের। সে কিছুটা থমথমে স্বরে বলল,,
—”আমি জানি না।”
তখনই পিছন থেকে নাহিয়ান বলল,,
—”আন্টি এইতো আমি।”
শিশির পিছন ফিরে দেখল দরজার পাশে এক হাত ট্রাউজারের পকেটে রেখে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান। পড়নে সাদা শার্ট যার বুকের দিকের দুইটা বোতাম সবসময়ের মতো খোলা আর সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে তার প্রশস্ত লোমশ বুক। সাধারণের দৃষ্টিতে তার বর্তমান লুকই যথেষ্ট একটা মেয়ের ফিদা হওয়ার জন্য কিন্তু ফিদা তো দূর বরং তাকে দেখে তীব্র অসন্তোষের সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল শিশির। নাহিয়ান তা দেখে মুচকি হেসে তার পাশে এসে বসল। বাবা-মার সামনে শিশির তাকে কিছু বলতে না পারলেও তাকে মিথ্যা বলে জোর করে বিয়ে করার জন্য মনে মনে হাজারটা গালি দিতে ভুলল না।
কথা বলা শিশির নাহিয়ান এর পাশ থেকে উঠে যেতে গেলেই নাহিয়ান হঠাৎ করে ওর কব্জি চেপে ধরে।নাহিয়ানের এমন হঠাৎ স্পর্শে কিছুটা কেঁপে উঠে শিশির তারপর নাহিয়ানের দিকে ঘুরে তাকায় চোখে দাউ দাউ আগুন, ঠোঁট শক্ত, মুখে থেমে থাকা তীব্র অভিমান।
—”হাত ধরলেন কেন? ছেড়ে দিন!”
শিশিরের কণ্ঠে কাঁপুনি, কিন্তু চোখে বুনো বৃষ্টির মতো একরাশ ক্ষোভ।নাহিয়ান এগিয়ে আসে ধীরে, খুব ধীরে ।
তার চোখের দৃষ্টি এতটাই স্থির যে, চোখে চোখ পড়তেই শিশির শ্বাস আটকে যায়।
—”এখন কী সমস্যা, বেগম?”
গভীর, স্তরবদ্ধ কণ্ঠে নাহিয়ান বলে ওঠে,
—”ভুলে গেলেন? একটু আগেই তিনবার ‘কাবুল’ বলে আপনি আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।আমি এখন আর বাহিরের কেউ না,আমি সেই মানুষ—যার ছায়ায় আপনার নাম বাঁধা… এখন আর আপনাকে ছোঁয়ার আগে আমার অনুমতির দরকার হয় না।”
শিশির একদম স্তব্ধ হয়ে যায় নাহিয়ানের এমন কথায় আসলেও সে তো সারা জীবন বলে এসেছে তার জীবনের একমাত্র হালাল পুরুষই তাকে স্পর্শ করতে পারবে। কিন্তু নাহিয়ান কি আসলেও তার জন্য হালাল পুরুষ? সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,,
—”হা-হা… মিথ্যে! নাটক! জোর করে একটা কাগজে সই করিয়ে বলছেন আপনি আমার স্বামী? এই সম্পর্কের মানে জানেন আপনি?”
নাহিয়ান আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না।সে ঝটকা দিয়ে শিশিরকে নিজের বুকের উপর টেনে নেয়।তাদের শরীর একে অপরের স্পর্শে তোলপাড় করতে থাকে।নাহিয়ানের বুকের দিকের সাদা শার্টের খোলা বোতাম ভেদ করে শিশিরের কপাল স্পর্শ করে তার গরম ত্বক।শিশির স্থির, পুরোপুরি অসাড়, দৃষ্টি হিম হয়ে গিয়েছে তার দৃষ্টি নাহিয়ান নিঃশ্বাস ফেলল, আর সেই নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে গেল শিশিরের কপাল।
—” কথাগুলো মিথ্যে ছিল হয়তো …কিন্তু আমার চোখ, আমার ভালোবাসা,আমার তীব্র বাসনার তীব্র চাওয়ার….এক বিন্দুও মিথ্যে ছিল না। তুমি কি বোঝোনা তোমার ছায়াও আমাকে পাগল করে তোলে? তোমার না বলা শব্দগুলোও আমায় ধ্বংস করে দিতে পারো…আর আমি সেই ধ্বংসেই আশ্রয় খুঁজি।”
নাহিয়ান সামান্য নিচু হয়ে শিশিরের কপালে দীর্ঘ এক চুমু এঁকে দিল। শিশির চোখ বন্ধ করে নিল। সে বুঝলো না সেটা কি ঘৃণায় নাকি অন্য কিছুর কারণে?এরপর নাহিয়ান শিশিরকে হঠাৎই কোলে তুলে নিল। তারপর পা বাড়ালো নিজের রুমের উদ্দেশ্য।
সকালের স্নিগ্ধ রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে মুখ ভেসে লাগতেই ঘুম ভাঙলো শিশিরের। ঘুম ভাঙতেই সে দেখতে পেল সে নাহিয়ানের রুমে। তারপর তার মনে পড়ল কালকে রাতে নাহিয়ান তাকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছিল। দ্রুত বিছানা থেকে উঠতে যেতেই সে টের পেল নাহিয়ানের হাত এখনো তার এখনও তার কোমর জড়িয়ে রেখেছে। সে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে দ্রুত নেমে পড়ল বিছানা থেকে। বিছানা থেকে নামতেই সে টের পেল তার শরীর থেকে ভেসে আসছে তীব্র পুরুষনালীর ঘ্রান সে বুঝতে পারল এটা নাহিয়ানের পারফিউমের ঘ্রান।রাগে ঘৃণায় তার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। সে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
কিছুক্ষণ পর
গোসল সেরে কাপড় পাল্টে সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে শিশির।কোমরের নিচু ছুঁই ছুঁই লম্বা চুল থেকে এখনো টপটপ করে গড়িয়ে বলছে জল বিন্দুরা। ওয়াশরুম থেকে রুমে প্রবেশ করতেই সে দেখতে পায় বিছানার উপর আধা শোয়া হয়ে বসে আছে নাহিয়ান। শিশিরকে দেখে সে বাঁকা হেসে বলল,,
—”এত সকাল সকাল গোসল? কাল রাতে কোনো কিছু হয়েছিল নাকি? আমার তো মনে পড়ছে না!”
নাহিয়ানের কথার মানে বুঝতে পেরে শিশিরের ঘিন ঘিন করে উঠলো।সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
—”নির্লজ্জ বেহায়া মিথ্যুক লোক!”
নাহিয়ান:”নির্লজ্জ বেহায়া মিথ্যুক যাই বলো না কেন? সব কিছুই তোমার জন্য।তাই আমি যদি এসব কারণে দোষী হই তাহলে তার দশ গুণ বেশি দোষ তোমার।”
শিশির:”আমার?”
নাহিয়ান:”হ্যাঁ তোমার।”
শিশির:”আচ্ছা ধরুন তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম আমি দোষী তো আমার বাবাকে নিয়ে মিথ্যা কথা,আর পরিবারের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সত্ত্বেও আমাকে না বলার কারণটা কি জানতে পারি?”
নাহিয়ান:”অবশ্যই।কারণটা তানিম”
শিশির:”তানিম ভাই।উনি আবার এসবের মধ্যে কেন?”
নাহিয়ান:”এসবের মূলেই ও”
শিশির:”ও আচ্ছা তাই নাকি?কিন্তু আমার তো মনে হয়…”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩০
শিশির আর কিছু বলার আগেই নাহিয়ান দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ওর গোলাপী ঠোঁটে নিজের কর্নিষ্ঠা আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঠোঁট দিয়ে উসসস শব্দ করে বলল,,
—”তোমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু আমারই বিচরণ হবে….আমি ব্যাতিত কেউ সেখানে প্রবেশের সামান্যতম চেষ্টা করলেও…এই নাহিয়ান চৌধুরী তার অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেবে…I repeat ধ্বংস করে দেবে।