মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৭

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৭
নওরিন কবির তিশা

কেটে গেছে আরও তিন দিন।সময় যেন সোনালি পাখার ঝাপটায় ভেসে যাচ্ছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে অপ্রকাশিত কিছু অনুভব,‌উড়ে চলেছে হৃদয়ের অজানা পথ বেয়ে। আর মাত্র চার দিন পর নির্ঝরের বিয়ে। শিশিররা, তার মামার বাড়ির লোকজন আর নওরিফা খানমরা আজ খুলনা যাবে। যদিও দুদিন আগেই রওনা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইমতিয়াজ চৌধুরী আর সিকদার শাহ’র ব্যবসায়িক এক জটিলতার কারণে বিলম্ব হলো।
নাহিয়ান মঞ্জিল থেকে একে একে বের হচ্ছে গাড়ির বহর। বাড়ির সব গুরুজনেরা বাড়ির গাড়িতে গিয়েছে,ইলমার কমফোর্ট এর জন্য ‌সৌজন্য,সাজিদ,ইলমা তিনজন মিলে একটা গাড়িতে গিয়েছে। তবে এখনো বাসায় নাহিয়ান আর শিশির। শিশিরের রেডি হতেই একটু দেরি হয়ে গেছে।

সবাই বের হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ হলো ‌নাহিয়ান এতক্ষন ড্রইং রুমে বসে ছিল দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় সাড়ে দশটা বাজতে চলল। কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ খবর নেই শিশিরের। নাহিয়ান বেশ বিরক্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে শিশিরের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
এদিকে শিশির পড়েছে মহা ঝামেলায়। আনায়ার সাথে কথা বলতে বলতে সে খেয়ালই করেনি বাসা থেকে সে যে জামাটা নিয়ে এসেছে তার চেইন নিজে নিজে লাগানো যায় না কাউকে দিয়ে লাগিয়ে নিতে হয়। আর এখন তো ইলমা ও চলে গেছে কাকে দিয়ে চেইন লাগাবে সে? চিন্তার মাঝেই সে হঠাৎ টের পায় তার রুমের দিকে কেউ একজন আসছে শিশির ভাবে হয়তো তহুরা আসছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। পেছনে ঘুরে না তাকিয়েই সে বলে,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—”তহু তাড়াতাড়ি আয় তো। ফেসে গেছি একদম এই চেইনটা একটু পারলে লাগাই দে তো। দেখনা একা একা মোটেই লাগানো যায় না”
ব্যক্তিটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে তার দিকে। কিছু একটা অদ্ভুত লাগে শিশিরের। সে কাছাকাছি আসতেই শিশির টের পায় এটা তহুরা না।কাঁধে হালকা বাতাস ছুঁতেই সে চমকে ঘুরে দাঁড়ায় আর এক পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লজ্জার গভীরে,‌পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান।দ্রুত বিছানার পাশ থেকে একটা ওড়না টেনে নিয়ে পিঠ ঢেকে বলে,,

—”আ-আ-আপনি..আপনি এখানে কি করছেন?”
নাহিয়ান:”কি হয়েছে পিছন ঘোরো দেখি!”
শিশির লজ্জায় আরও আড়ষ্ট হয়ে বলে,,
—”ক-ক-কিছু না! আপনি প্লিজ বাইরে যান আর তহুরাকে পাঠান!”
নাহিয়ান বাঁকা হেসে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,,
—”বাআবা আমার লজ্জাবতীর লাজুক লতা বউটা দেখি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু এখনো এত লজ্জা কিসের আপনার ম্যাম?”
নাহিয়ানের এহেন কথাবার্তায় শিশির লজ্জায় আরো দুই কদম পিছিয়ে বলে,,

—”চুপ করবেন আপনি?”
নাহিয়ান এগিয়ে আসতে ‌‌আসতে বলে,,
—”চুপ তো করলাম এখন পিছন ঘুরো!”
শিশির:”না! আপনি নিচে গিয়ে তহুরাকে ডেকে দেন!”
নাহিয়ান এগিয়ে এসে শিশিরের ঠোঁটে নিজের তর্জনী আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,,
—”উসসস.. আর একটাও কথা না যা বলছি তাই করো আর যদি এক্ষুনি পিছনে না ঘুরো তাহলে কিন্তু….”
শিশির চোখ বড় বড় করে তাকায়।
—”তাহলে কী?!”
নাহিয়ান ঠোঁটে সেই রহস্যময় বাঁকা হাসি টেনে বলে,

—”বেশি কিছু না আগের দিন ওয়াশরুমে আর সেদিন রাতে যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে..”
সেই মুহূর্তেই শিশিরের মস্তিষ্কে ফিরে আসে সেই অদ্ভুত সুন্দর,প্রেমময় মুহূর্তগুলোর ঝলক। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল সে । না না নাহিয়ান কে কোনো বিশ্বাস নেই! ও যা বলে সত্যি সত্যি সেটাই করে এখন যদি আর বেশি কথা বলায় নাহিয়ান যা বলছে তাই করে! না না ওর কথা শোনাই শ্রেয়! শিশির আর কিছু না বলে ধীরে পিছন ঘুরে দাঁড়ায়।
নাহিয়ান দেখতে পায় শিশিরের পেছনের চেইন টা খোলা। আর পিঠের ঠিক মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে একটা গাঢ় কালো তিল। তার কেনো যেন মাতাল মাতাল লাগতে শুরু করে কিন্তু বহু কষ্ট নিজেকে সামলিয়ে নিজের ঠোঁটের সাহায্যে চেইনটা লাগিয়ে দেয় সে। অন্যদিকে নাহিয়ানের এহেন কর্মকান্ডে শিশিরের গোলাপি অধরদ্বয় তির তির করে কাঁপতে থাকে এক তীব্র প্রেমময় মুহূর্তের লজ্জায়! তার হৃদস্পন্দন যেন ছন্দ হারায়!

নিঝুম:”আরে আঙ্কেল হোয়াটসঅ্যাপ! সবাই সে কখন চলে আসলো আপনি এত লেটে ঢুকলেন?”
সৌজন্য নিঝুমের দুষ্টুমি ভরা আননের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,,
—”এই মেয়ে তোমাকে কতদিন করে বলেছি আমাকে আংকেল বলবে না!”
নিঝুমের ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি আরো প্রসারিত হলো।
নিঝুম:”আর আংকেল রাগ করেন কেন? কত কষ্ট করে আমি এ রোদের ভিতর গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি!”
সৌজন্য:”কে বলেছিল তোমাকে দাঁড়াতে?”
কথাটা বলেই সৌজন্য গেট পেরিয়ে চৌধুরী আবাসনের অন্দরমহলে প্রবেশ করল। তা দেখে নিঝুম পিছন থেকে বেশি জোরেই বললো,,

—”আপনার নাম না সৌজন্য? আপনার ভেতরে তো একদমই সৌজন্যবোধ নেই! একটা মেয়ে আপনার জন্য এতক্ষণ রোদে দাড়িয়ে থাকলো তাকে না নিয়ে নিজেই ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন অন্তত ধন্যবাদ তো দিতে পারতেন! বোরিং!”
সৌজন্য নিঝুমের কথায় সামান্য পিছন ঘুরে বললো,,
—”আমার ভেতরে সৌজন্যবোধ নেই! তুমি নিজের নাম লক্ষ্য করেছ?গড নোজ তোমার মতো একটা বাচাল মেয়ের নাম কে নিঝুম রেখেছিল!”
কথাটা বলেই নিজের প্যান্টের ফ্রন্ট পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেলে দুলে গুন গুন করতে করতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সৌজন্য। পিছন থেকে নিঝুম কোমরে দুই হাত রেখে বলল,,
—”আমাকে বাঁচাল বলা! দাঁড়ান মজা দেখাচ্ছি আপনাকে!”

আকাশে উত্তপ্ত সূর্যের প্রখর কিরণ। বেলা সম্ভবত বারোটার কাছাকাছি। শিশিরদের গাড়ি এসে থামে চৌধুরী আবাসনের গেটের বাইরে। বাড়ির পুরাতন দারোয়ান এসে গেট খুলে দিতেই দৃশ্যমান হলো খুলনার সবচেয়ে বিলাসবহুল পুরাতন বাড়িটি। দুই তলা এক অতি পুরাতন বাড়ি চৌধুরী আবাসন। নাহিয়ান এর দাদা নজরুল চৌধুরী নিজের দাঁড়িয়ে থেকে এই বাড়ি তৈরীর তত্ত্বাবধায়ন করেছিলেন। বাড়িটি দুই তলা পুরাতন তবে বিলাস বহুল। এক প্রাচীনত্ব লেগে আছে বাড়িটির প্রতিটি দেওয়াল। সামনে দেওয়ালে খোদাই করে বড় করে লেখা চৌধুরী আবাসন পাশে ব্রাকেটে ছোট্ট করে (হুরের শান্তি কুঞ্জ) নাহিয়ানের দাদি ‌হুররাম, নজরুল চৌধুরী ভালবেসে তাকে হুর বলে ডাকতেন। নিজের সহধর্মিনীর প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই বাড়ি তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি এই বাড়িতে প্রতিটি কোন হুররাম বেগমের পছন্দ অনুযায়ী তৈরি।

গাড়ি থামতেই শিশির নেমে ভিতরে প্রবেশ করে। আর তার পিছন পিছন নাহিয়ান। গাড়িতে পার্কিং এরিয়ায় নিয়ে যান বাড়ির একজন ড্রাইভার। ভিতরে ঢুকতে দৃশ্যমান হয় বিশাল বড় ড্রয়িং রুম। যার মাঝে সোফার উপর বসে আছেন হুররাম বেগম। ড্রয়িং রুমে চলছে এসি। হুররাম বেগমের বয়স হলেও এখনো যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ্য তিনি। নজরুল চৌধুরী মারা গেছে আরো বিশ বছর আগে। তখন থেকেই এই সংসার একা নিজ হাতে সামলাচ্ছেন হুররাম বেগম। তিনি খুলনাতেই থাকেন নওরিফা খানম, ইমতিয়াজ চৌধুরী তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন হুররাম বেগমের একটাই কথা এটা তার স্বামীর স্মৃতি বহনকারী জায়গা এখান থেকে তিনি মৃত্যুর আগ অব্দি কোথাও যাবেন না।
শিশির ভিতরে ঢুকেই হুররাম বেগমের উদ্দেশ্যে সালাম দেন।হুররাম বেগম শিশিরকে দেখে ‌সালামের উত্তর দিয়ে একগাল হেসে বলে,,

—”আরে আমার ফুল!”
বলে তিনি উঠতে যেতে গেলেই কোমরের ব্যথাটার কারণে বসে পড়েন। শিশির দ্রুত এসে তার পাশে বসে বলে,,
—”উফ আপু তুমি উঠতে গেলে কেন? আমিই তো আসছিলাম!”
হুররাম বেগম হেসে বললেন,,
—”ফুল! কত বড় হয়ে গেছিস তুই?সেই কোন ছোটবেলায় তোকে দেখেছিলাম! ভাগ্যিস আমার বুড়টা বেঁচে নেই নাহলে এই বুড়ো বয়সে আমার সতীনের সংসার করা লাগতো!”
শিশির:”বাবা এই বয়সে এত জেলাসি? যাই হোক তোমার বুড়ো বেঁচে থাকলেও তার হুরকে রেখে কখনোই এই ফুলের দিকে তাকাত না!”

আপনি দুজনেই হেসে উঠল। হুররাম বেগম ছোটবেলা থেকেই শিশিরকে ফুল বলে ডাকে। তিনি টুকরো টুকরো চুমুতে ভরিয়ে দিলেন শিশিরের দুধে আলতা মুখশ্রী। এখনই পিছন থেকে অন্দরমহলে প্রবেশ করল নাহিয়ান। তাকে দেখে হুররাম বেগম হেসে বললেন,,
—”ওই তো চলে এসেছে আমার নায়ক!তা এতদিন পর আমার কথা মনে পড়লো?”
নাহিয়ান এগিয়ে এসে তার কপালে চুমু দিয়ে তার পাশে বসে বলল,,
—”না গো জান তোমার কাছে তোমার সব সময় মনে পড়ে! শুধু সময়ের অভাবে আসতে পারিনি! আর তুমিও তো যাওনি ঢাকায় একবারও!”

হুররাম বেগম:”এই হলো বর্তমান সময়কার ভালোবাসা! আমি নাকি তাকে দেখতে যাইনি,তা আমি কি তোমার মতো ওই কচিটা আর আছি আমার তো বয়স হয়েছে নাকি! ভালোবাসা অজুহাত মানে না!বুঝলে?”
নাহিয়ান:”বুঝলাম! কিন্তু তোমার একটা কথা আমার পছন্দ হলো না তুমি কোথায় বুড়ি হয়ে গেছো? তোমাকে তো এখনো সেই ১৫ বছরের কিশোরীদের মতো লাগে!”
হুররাম বেগম মুচকি হেসে বললেন,,

—”এত প্রশংসা করো না দাদুভাই। দেখা গেল তোমার বউয়ের আমাকে সতীন সতীন লাগতে শুরু করলো। তা বিয়ে কবে করছো শুনি? তোমার আগে তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!”
নাহিয়ান শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”বিয়ে তো কবেই করে ফেলেছি! বউটা রাজি থাকলে এতদিন তোমার সাথে দেখা আমার বাচ্চা করতে আসতো!”
নাহিয়ানের এখানে কথায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল শিশির। হুররাম বেগম হয়তো কিছু বুঝলেন না তিনি মুচকি হেসে বললেন,,

—”দুষ্টুটার দুষ্টুমি এখনো শেষ হয়নি। যাইহোক দুষ্টামি পরে করো এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও আর ফুল তুমিও যাও ফ্রেশ হয়ে নাও দুজনকেই অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে”
নাহিয়ান আচ্ছা দাদু বলে উঠে গেল। অন্যদিকে শিশির উঠে যাওয়ার আগেই সেখানে হাজির হলেন শিউলি হক। শিশিরকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,,
—”নুয়া মা! এসেছো?”
শিশির তার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হয়েছে বলল,,
—”জ্বি আন্টি! কেমন আছেন?”
শিউলি হক:”এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি অবস্থা? দেখ না তোমাকে একবার দেখতে যাব ঠিক সেই দিনই ইয়ারলিনা টার মাইগ্রেনের প্রবলেম হতে হল!”
শিশির মুচকি হেসে জবাব দিল,,
—”থাক আন্টি ব্যাপার না!”
শিউলি হক:”আচ্ছা মা চলো তোমাকে রুম দেখিয়ে দেই!”
শিশির:”হুমম”

সারা দুপুর আর বিকাল মিলে শিশির,ইলমা,নিঝুম আর নিঝুমের কিছু কাজিনরা মিলে গল্প করছিল। ঠিক করা হয়েছে কালকে সবাই একসাথে শপিং এ যাবে। সন্ধ্যার পর সবাই যখন একটু রেস্টের জন্য গেল তখন শিশিরের মনে হলো আজকে এখানে এসে ধরে নাহিয়ানের সাথে কোন কথা হয়নি তার।তাই সে‌ নিঝুম এর কাছ থেকে নাহিয়ান এর রুম কোনটা শুনে সেদিকে পা বাড়ালো। নিঝুমও যাচ্ছিল কিন্তু তখনই পিছন থেকে নিঝুমের একটা কাজিন ডেকে বলল,,

—”নিঝু তাড়াতাড়ি আয়, ফুফু তোকে নিচে ডাকছে দ্রুত জরুরী কাজ!”
নিঝুম:’তুই যা আমি আপুকে রুমে দিয়েই আসছি!”
শিশির:”না নিচু তুই যা হয়তো কোন জরুরী কাজ ২ তলার উত্তর সাইটের রুম তাইতো?”
নিঝুম:”হুম! কিন্তু তুমি পারবে?”
শিশির:”কেন পারব না তুই যা!”
নিঝুম:”আচ্ছা”
নিঝুম চলে যেতেই শিশির পা বাড়ানো নাহিয়ানের রুমের উদ্দেশ্যে।

নাহিয়ানের রুমের সামনে এসেই সে থমকে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে ইয়ালিনার কণ্ঠস্বর,,
ইয়ালিনা:”আরে নাহিয়ান ভাইয়া একটু খাও না আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। একবার একটু টেস্ট করো। শুনলাম তুমি নাকি দুপুরে কিছু খাওনি এটা খাও গরমে আরাম পাবে।”
নাহিয়ান:”তোকে কতবার বলতে হবে লীনা, আমি এগুলো খাই না। বেশি বিরক্ত করিস না তো। যা এখন।কাজ করতে দে আমায়”
তবে নাহিয়ানের কোনো কথা কানে গেল না শিশিরের। তার কানে শুধু ইয়ালিনার ঢঙ্গী কথাগুলোই বাজছে। সে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে ইয়ালিনা একটা ব্ল্যাক কালার গাউন পরে চুল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই মেজাজ গরম হয়ে গেল শিশিরের।নাহিয়ানের সামনে কেন অন্য কোনো মেয়ে সেজেগুজে ঘুরঘুর করবে! যদিও নাহিয়ানের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই ,সে ল্যাপটপে কি যেন একটা করছে। একবারও ইয়ারলিনার দিকে তাকাচ্ছেও না।

শিশিরের চিকন নাকের পাটাটা ফুঁলে উঠলো। তীব্র আক্রোশের রুমে ঢুকল সে। ইয়ালিনা,নাহিয়ান দুজনেই তার দিকে তাকালো। ইয়ালিনার চোখে গাঢ় করে আইলাইনার দেওয়া, ঠোঁটে গোলাপী রঞ্জক, মুখে সামান্য ব্লাশার আর এইগুলোই যেন শিশিরের রাগের আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। সে নাহিয়ানের দিকে একবার তাকালো। নাহিয়ান বুঝে গেছেন তার শিশিরবিন্দু এখনো অগ্নিবিন্দুতে পরিণত হয়েছে! কিন্তু ইয়ালিনা শিশিরকে দেখে বিরক্তিতে মুখ ঝামটালো।
তবে মুহূর্তেই নিজের মুখের অভিব্যক্তি বদলে শান্ত কণ্ঠে শিশির বলল,,

—”আরে লিনা আপু তুমি এখানে? তোমাকে তো নিচে ইয়াকুব আঙ্কেল ডাকছে!”
ইয়ালিনা:”ডাকুক! আমার সময় হলে আমি যাব!”
তারপর ফের নাহিয়ানের দিকে ফিরে বলল,,
—”নাহিয়ান ভাইয়া তুমি এটা খাবে না তাহলে অন্য কিছু বানিয়ে আনব লাইক পিজা বার্গার? নাকি অন্য কিছু..”
শিশির:”আরে লিনা আপু তুমি জানো না? উনি তো এসব খায় না খাওয়া বারণ উনার!”
ইয়ালিনা:”তাই নাকি?তা তুমি অনেক জানো দেখছি! তা বলতো ওনার কি কি খাওয়া যাবে,আর কি কি বারণ?”
শিশির নাহিয়ানের দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
—”আপাতত কিছুদিন ওনাকে শুধু থানকুনি পাতার রস খাওয়াতে হবে, সাথে করোলার জুস, উচ্ছের শরবত, আর মাঝে মাঝে একটু নিম পাতার কোরমা! তা তুমি কি এগুলো বানাতে পারবে?”

ইয়ালিনা:”হোয়াট!”
শিশির:”হুম”
ইয়ালিনা:”ফাইজলামি করছো?”
শিশির:”এমা ছি ছি! তোমার সাথে কি আমার ফাইজলামি করা সম্পর্ক বলোতো? যা সত্যি তাই বললাম বিশ্বাস না হলে ওনার কাছেই শোনো?”
ইয়ালিনা নাহিয়ান এর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল,,
—”এসব কি সত্যি নাহিয়ান ভাইয়া?”
নাহিয়ান নিজেই হতভম্ব কি বলছে শিশির এগুলো! ইয়ালিনার কথায় ধ্যান ভাঙল তার।সে একটু আমতা আমতা করে বলল,,,

নাহিয়ান:”আ..আ.. হবে হয়তো!”
ইয়ালিনা:”কিইই”
শিশির:”জ্বী”
ইয়ালিনা আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিচ থেকে ইয়াকুব চৌধুরী জোরে ডেকে বললেন,,
—”লিনা মামনি একটু তাড়াতাড়ি আয়।কাজ আছে!”‌
ইয়ালিনা;”আসছি পাপা!”
তারপর শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”তোমার সাথে কথা পরে হচ্ছে আগে পাপার কথা শুনে আসি!”
ইয়ালিনা চলে যায়। পিছন থেকে শিশির ভেংচি কেটে বলে,,
—”উমময..পাপা আসছি! যেন কচি খুকি!বুড়ধাম কোথাকার?”

এবার সে নাহিয়ানের দিকে তাকায়। নাহিয়ান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে ‌নাহিয়ানের সাথে কোনো কথা না বলে বেড সাইড টেবিল থেকে ইয়ালিনার আনা ট্রে থেকে লাচ্ছির গ্লাসটা হাতে তুলে সজোরে তা মেঝেতে ছুড়ে মারে। বিকট শব্দ তুলে ভেঙে যায় কাঁচের গ্লাসটা। নাহিয়ান এবারও হতভম্ব! এটাই তার শিশিরবিন্দু এত প্রসেসিভ তার ব্যাপারে! সে তো সারা জীবন এটাই চেয়েছে!
শিশির:”কি হলো কথা বলছেন না কেন? আপনার ফেভরিট লিনা আনা গ্লাসটা ভেঙে দিয়েছি কিছু বলবেন না?”
নাহিয়ান এখনো হতবাক। তা দেখে শিশির বেশ রাগ করে বলে,,
—”কি হল কথা বলেন না কেন?ফেভরিট লিনাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে এমন অবস্থা যে এখন কথায় বের হচ্ছে না!”
নাহিয়ান:”কি তখন থেকে উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছ?”
শিশির:”আমি উল্টোপাল্টা বলছি?”
নাহিয়ান:”আমার কাছে তো তাই মনে হচ্ছে!”
শিশির:”এখন তো আমার কথাবার্তা কাছে উল্টোপাল্টা লাগবেই! আপনার ফেভরিট লিনা আছে না! ওই তো সবকিছু ঠিকঠাক করে তাই না?”

নাহিয়ান বিছানা থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,,
—”উফফস…বেবি রেগে গেলেও তোমাকে মারাত্মক লাগে!পুরাই…”
নাহিয়ান তার কাছাকাছি আসতেই এক ধাক্কা দিয়ে তাকে পিছনে ঠেলে বলল,,
—”সরি যান আমার কাছ থেকে..একদম আসবেন না আমার কাছে!যান না আপনার ফেভারিট লিনার কাছে। আবার যত্ন করে লিনা ডাকা হচ্ছে!”
নাহিয়ান শিশিরের ধাক্কায় এক চুলও নড়লো না। তবে তার কথায় ভেসে অবাক হল,,
নাহিয়ান:”যাহ বাবা আমি কি করলাম?সবাই তো ওকে লিনা বলেই ডাকে!”
শিশির ভেংচি কেটে বলল

—”সবাই তো ওকে লিনা বলেই ডাকে! তাহলে নাম ইয়ালিনা রেখেছে কেন?”
নাহিয়ান দুষ্টু হেসে বলে,,
—”কি ব্যাপার ম্যাম আপনি কি জেলাস? যাই হোক এই কানে ধরেছি আর বলবো না ওকে লিনা। এখন থেকে ইয়ালিনা বলেই ডাকবো হয়েছে!”
শিশির:”যা ইচ্ছা বলুন! আমার কি?”
তীব্র আক্রোশের কন্ঠে কথাটা বলেই ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে যায় শিশির। নাহিয়ান শুধু তাকিয়ে থাকে অপলক তার চাওয়ার পানে। তারপর তার শিশির বিন্দুর হিংসার কথাগুলো মনে করে মাথা নিচু করে মুচকি হাসে!
পরের দিন সকালে….

ঘড়ির কাঁটায় সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা ছুঁই ছুঁই। আজকে সবাই বিয়ের শপিংয়ে যাবে। সকাল থেকেই সেই তোড়জোরই চলছে। তবে এই ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই শিশিরের। কালকে রাত থেকে তার মেজাজটা অনেক বেশি গরম না হলে শপিংয়ের ব্যাপারে সে সবসময় এক পায়ে খাড়া। রুমে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে রিলস দেখছিল সে। হঠাৎ এই দরজার বাইরে থেকে নিঝুম বলে,,
—”নুয়া আপু যাবে না সবাই তো রেডি যে তোমার ওয়েট করছে।”
শিশির মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলে,,
—”না রে নিঝু! সবাইকে চলে যেতে বল আমি যাব না!”
নিঝুম:”কেন আপু? চলো না তোমাকে ডাকছে নিচে দাদিজানও তো ডাকে!”
দাদিজান নামটা শুনে শিশির বিছানা ছেড়ে ওঠে। এই মানুষটা শিশিরকে অনেক বেশি যত্ন করে এখন যদি সে না যায় তাহলে যদি তাতে দাদিজান উপরে চলে আসেন। না না এমনিতেই তিনি অসুস্থ তাকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না। কিন্তু শিশিরও তো ইচ্ছা করছে না। কি আর করা যাবে সে ফ্রেশ হয়ে একটা লেভেন্ডার কালার গাউন এর সাথে সাদা লেগিংস আর সাদা হিজাব বেঁধে বাইরে আসে।
এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল নিঝুম। শিশিরকে দেখে সে মুচকি হেসে বলে,,

—”মাশাআল্লাহ আপু তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে! কারো নজর না লাগুক!”
শিশির মুচকি হেসে বলে,,
—”বাবা এত কথা কোথা থেকে শিখেছিস?”
নিঝুম:”কোথা থেকে শিখবো মানে?আমি বড় হয়ে গেছি! ক্লাস টেনে পড়ি আমি”
শিশির:”ওরে বাবা! মেয়ে তো ভীষণ বড় হয়ে গেছে তা পাত্র খুঁজি!”
নিঝুম সামান্য লজ্জায় মাথা নিচু করে। তা দেখে শিশির মুচকি হেসে বলে,,
—”পাকনি বুড়ি!”

নিচে এসে সে দেখতে পায় পুরো ড্রয়িংরুম‌ জুড়ে লোকজনের সমাগম।বাড়ির আত্নীয় স্বজন থেকে শুরু করে মেডরা পর্যন্ত সবাই আজ শপিং এ যাবে। এদিকে এতো ভীরের মাঝে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে ইলমা।তাই সে আর সাজিদ কোথাও যাবে না।
একে একে সবাই বের হতে শুরু করলো। চৌধুরী আবাসন থেকে বের হলো বড় বড় ৮ টা প্রাইভেট কার।বাকি রইল শুধু শিশির, নাহিয়ান,সৌজন্য, নিঝুম, নির্ঝর,ইয়ালিনা আর নিঝুমের কিছু কাজিনরা অর্থাৎ বাড়ির নবীনরা।নির্ঝর প্রথমে শপিংয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না তবে বাড়ির সবার আর নাহিয়ানের জোরাজুরিতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।তাদের সবাইকে অন্য একটা গাড়িতে তুলে দিল নাহিয়ান।যেইটা যাবে নির্ঝরের তত্ত্বাবধায়নে।তাদের গাড়িটিও কিছুক্ষণের মধ্যে ছাড়িয়ে যায় চৌধুরী আবাসন।
শিশির থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিয়ান সেদিকে তাকিয়ে বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বলল,,

—”কি ব্যাপার ম্যাম? এই গরমের ভিতর এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?”
শিশির:”তা কি করব?”
নাহিয়ান:”আপনি শপিং যাবেন না?”
শিশির:”কিসে করে যাব?সব গাড়ি তো চলে গেল!”
নাহিয়ান নিজের বাইকের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”কেন বাইক পছন্দ হচ্ছে না? গাড়ি বের করতে বলবো?”
নাহিয়ান পাশ ফিরে ড্রাইভারকে ডাকতে যাবে তার আগেই শিশির বলল,,
—”আমি কখন বললাম গাড়িতে?যাব কিন্তু যাবটা কার সাথে?”
নাহিয়ান:”ওহ এই ব্যাপার! তা আমাকে পছন্দ হচ্ছে না!”
শিশির”না!”
নাহিয়ান আফসোসের সুরে বলল,,

—”কি আর করা যাবে? পছন্দ হোক বা না হোক সারা জীবন এই মানুষটার সাথেই তো আপনাকে থাকতে হবে! তাই বেশি কথা না বলে বাইকে উঠলে ভালো করবেন না হলে কিন্তু আমি কোলে করে বাইকে তুলতে বাধ্য হব!”
শিশির:”আমার কোনো ইচ্ছা নেই আপনার মত একটা মানুষের সাথে সারা জীবন থাকার!”
নাহিয়ান:”তাই নাকি?”
শিশির:”হুম! আপনি যান আপনার ফেভরিট লিনাকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরে আসেন!”
নাহিয়ান:”বা..আ..বা এখনো এত রাগ? কিন্তু আমার বউ থাকতে কেনো আমি অন্য মেয়েকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরবো? এখন আপনি উঠবেন নাকি সত্যি সত্যি..”
কথাটা বলে নাহিয়ান বাইক থেকে নেমে শিশিরের দিকে এগিয়ে আসলো। শিশির তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল,,

—”যত দুনিয়ার ঢং!”
নাহিয়ান মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বাইকের উপর বসলো। শিশির ও হেলমেট মাথায় দিয়ে তার পিছনে বসলো। নাহিয়ান তাকে বলল,,
—”ধরে বসেন ম্যাম!”
বলেই বাইক স্টার্ট ছিল সে। শিশিরও নাহিয়ান কে শক্ত করে ধরে বসলো। এমনিতে সে বাইকে চড়াটা ভয় পায়। কিন্তু রাইডার যদি নাহিয়ানের মতো কেউ হয় তাহলে আর কিসের ভয়!

বাইক এসে থামলো খুলনার এক অভিজাত শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। বাইরে পার্কিং এরিয়া নির্ঝরদের গাড়িতে ভর্তি। আজকে পুরো শপিং কমপ্লেক্সটা নির্ঝরদের আওতায়। এখান থেকে সব রকম কেনাকাটা করবে তারা। নাহিয়ান আর শিশির মিলে একটা লেডিস সেকশনে ঢুকলো। পুরো সেকশন জুড়ে নানারকম কাপড়ের বাহার, গাউন ফ্রক থেকে শুরু করে বাংলাদেশী ওয়েস্টার্ন কি নেই সেখানে! নাহিয়ান শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”দেখুন তো ম্যাম কি পছন্দ হয়?”

চোখ ধাঁধানো এক একটা কালেকশন। কোনটা রেখে কোনটা দেখবে সবই তো ভালো লাগছে। সে বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার মনে পড়ে গেল সেই ঘড়ির দোকানের ঘটনা আর সাজিদের বিয়ের শপিং এর সময়কার মুহূর্তগুলো। শিশির যে ড্রেসগুলোই ছুঁয়েছিল প্রত্যেকটা কিনে নিয়েছিল নাহিয়ান। শেষমেষ ড্রেসগুলো রাখারই জায়গা হচ্ছিল না! আর ঘড়ির দোকানের কথা তো বাদই দিল! চুপচাপ সেখান থেকে বের হতে হতে বলল,,
—”চলে আসুন আমার কোনো ড্রেস ভালো লাগেনি!”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,

—”ওকে ম্যাম আপনার যেমন ইচ্ছে!”
শিশির বের হয়ে গেল। কিছু নাহিয়ান বের না হয়ে সেকশনের মালিকের দিকে ইশারা দিতেই তিনি বুঝে গেলেন কি করতে হবে সে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”ওকে স্যার!”
নাহিয়ান বের হয়ে গেল!

শপিংয়ের জিনিসপত্র আর স্বর্ণের জিনিসপত্র কেনার পর। সবাই এসেছে কসমেটিক্স সেকশনে । যে যার মতন পছন্দ অনুযায়ী কসমেটিক্স মেকআপ বক্স বিভিন্ন জিনিস কিনছে। জিনিসগুলো মেয়েদের তাই এর ভিতরে একটু আনইজি ফিল হচ্ছে সৌজন্যের। সেখানে থেকে কি করবে বুঝতে পারছে না। বের হয়ে একটা গেমিং সেকশনের দিকে যাচ্ছিল তখনই তার নজর পড়লো এক জোড়া কানের দুলের ওপর! ব্যস থমকে গেল সে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি দুষ্টুমি ভরা মিষ্টি মেয়ের মুখশ্রী। সে মুচকি হেসে ওইখানে থাকা একটা স্টাফকে বলল দুলটা প্যাক করে দিতে।

মাথার উপর মধ্যদুপুরের সূর্যের প্রখর ‌বেগুনি-হলুদ রশ্মি। ব্যস্ততম খুলনা শহর।রাস্তাগুলো যেন জীবন্ত নদী
যার বুকে গাড়ির হর্ন, মানুষের হাঁটার শব্দ, আর অদ্ভুত এক কোলাহল প্রতিধ্বনি তোলে। তাদের বাইক এসে থামে ‌খুলনার হৃদস্পন্দন KDA অ্যাভিনিউয়ে।শহরের প্রধান প্রশাসনিক এলাকা, রাস্তা সোজা চলে গেছে শিববাড়ি মোড় ছুঁয়ে রয়্যাল মোড়ের দিকে।ঠিক মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে এক আধুনিক কাচঘেরা স্থাপনা—Shimla Plaza।
আর তার নিচতলায়, এক উজ্জ্বল সাইনবোর্ডে রোদ পড়ে চকচক করছে সেই নাম—PizzaBurg। শিশির নাহিয়ানের দিকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে নাহিয়ান বলে,,

—”চলুন আমার শহরের নব্য বিখ্যাত হওয়া রেস্তোরাঁ থেকে আমার নব্যবধূকে তার একটি প্রিয় জিনিস খাইয়ে আনি! এমনিতেই তো সে আবার আমার উপর রাগ করে কাল রাত থেকে কিছু খায়নি!”
শিশির আর কিছু বলে না। সে বুঝে যায় সে যে কালকে রাত থেকে কিছু খায়নি সেটা নাহিয়ান খুব ভালো করেই জানে। নাহিয়ানের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে।ভেতরে ঢুকতেই ঠাণ্ডা বাতাসের এক মৃদু ঝাপটা এসে গায়ে লেগে যায়।ডান দিকে রিসিপশন কাউন্টার, যেখানে একজন ক্যাশিয়ার হাসিমুখে বসে থাকে।ছাদের কাছ ঘেঁষে ঝুলছে ছিমছাম হলুদ আলো, আর চারপাশে অর্ধেক কাচ ঘেরা দেয়ালে রোদের লুকোচুরি খেলা।সামনের দিকে আধা-বৃত্তাকার একটি ওয়েটিং কাউচ,বাম পাশে সাজানো বইয়ের তাক, যেন এই কফি-পিজ্জা গন্ধময় জায়গাটাকে একটা অস্থির শহরের মাঝে খানিকটা শান্তির লাইব্রেরি বানিয়ে রেখেছে।

দেয়ালে কিছু দেয়ালচিত্র, যেন শিল্পীর রঙে ফুটে উঠেছে আধুনিক আর প্রাচ্যর মিশেল।দূরে, কাচঘেরা এক কোণা সেখান থেকে দেখা যায় খুলনার রাস্তায় ছুটে চলা গাড়িগুলো। শিশিররা এসে ঠিক সেইখানে বসে। একটা ওয়েটার ছুটে এসে অর্ডার নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর একটা ট্রে তে তাদের স্পেশাল পিৎজা সেই সাথে দুটি গ্লাসে মিন্ট মজিতো নিয়ে আসে।

খাওয়া শেষে নাহিয়ান শিশিরকে বলে,,
—”এবার আপনার হাতটা একটু বাড়ান তো ম্যাম!”
শিশির বেশ অবাক হয়ে বলে,,
—”কেন?”
নাহিয়ান:”বলছি তাই!”শিশির আর কথা না বাড়িয়ে তার ডান হাতটা নাহিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তা দেখে নাহিয়ান আপত্তি করে বলে,,
—”এইটা না বাম হাত!”
শিশির অবাক হয়। বাম হাত দিয়ে কি হবে? এ প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগেই নাহিয়ান বলে,,
—”কি হলো বাম হাতটা দিন আর চোখ বন্ধ করুন।”
শিশির:”আবার চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?”
নাহিয়ান'”আমি বলেছি তাই!”
শিশির:”আপনার যখন যা ইচ্ছা হবে আমাকে বলবেন আর সবটা আমাকে মানতে হবে?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,

—”জ্বী!”
শিশির আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে তার বাম হাত এগিয়ে দিল নাহিয়ানের দিকে। নাহিয়ান তার হাতে কিছু একটা পরালো তারপর বলল,,
—”নিন ম্যাম এবার চোখটা খুলুন!”
শিশির আস্তে আস্তে চোখ খুলল। হাতের দিকে তাকাতেই তার চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। এটা কি! তার হাতে চুড়ি তবে যে সে চুড়ি নয়!হোয়াইট গোল্ডের একটা চিকন চুড়ি।যার উপর ছোট ছোট ডায়মন্ড বসানো। শিশির অবাক কণ্ঠে নাহিয়ান কে প্রশ্ন করলো,,
—”এসব কি!”
নাহিয়ান:”বেঙ্গাল কেন পছন্দ হয়নি?”

শিশির:”বেঙ্গাল সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি! কিন্তু এসব কি?হোয়াইট গোল্ড! ডায়মন্ড!”
নাহিয়ান:”হ্যাঁ তো! আমি শুনেছি বিয়ের পরে মুসলমান মেয়েদের চুড়ি আর নাকের নোলক পড়তে হয়। বাট নোলক তোমায় এখন পড়া লাগবে না আপাতত চুড়িই পড়ো।”
শিশির:”আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
নাহিয়ান:”কেন?”
শিশির:”এটা কি পরিমান এক্সপেন্সিভ জানেন? তারপর আপনি বলছেন এটা সবসময় পড়ে থাকতে!”
নাহিয়ান:”এক্সপেন্সিভ বলে আমি তোমাকে চিকন বেঙ্গাল দিয়েছি না হলে মোটা টা দিতে পারতাম আর কোনো বাহানা নয় আমি যখন বলছি তখন সারাক্ষণই পড়ে থাকবে?”
শিশির:”কিন্তু এর ওপরের ডায়মন্ডগুলো!”

নাহিয়ান:”এগুলো খেয়াল না করে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না!”
শিশির আর কোনো কথা বলল না। বেশি কথা বললে যদি নাহিয়ান বাড়ির সকলকে তাদের বিয়ের ব্যাপারে জানিয়ে দেয়। তাহলে তো সবার চোখে শিশির খারাপ হয়ে যাবে। আর আসলেও চুড়িটাতে যে ডায়মন্ড আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।শিশির খেয়াল করেছে দেখেছে বলেই না বুঝেছে আর এখানে সচরাচর কেউ হোয়াইট গোল্ড পড়ে না তাই সহজে কেউ বুঝবে না।
রাত দশটা……

ছাদে স্ট্রিং লাইটের লাল-নীল আলোর মাঝে বসে আছে নিঝুম। মনোযোগ তার মোবাইলের স্ক্রিনে। হঠাইৎ সে টের পায় তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ একজন। ফিসফিস কন্ঠে কথা বলছে। ভয়ের চমকে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় লম্বা করে সাদা শার্ট পরিধানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। ভয়ে সে চেঁচিয়ে উঠতেই সামনের ব্যক্তিটি নিজের হাত দিয়ে নিঝুমের মুখ চেপে ধরে। নিঝুম ভয়ে আর্তনাদের মতো শব্দ করতে থাকে। ব্যক্তিটি তার মুখ চেপে ধরেই বলে,,

—”এই মেয়ে আস্তে! এত জোরে চেঁচাচ্ছ কেন?”
নিঝুমের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই সে চেঁচিয়ে উঠল,,
—”ক-ক-কে আপনি?
—”ভুত!”
সৌজন্যের কণ্ঠ এবার চিনতে পারল নিঝুম তবুও শিওর হওয়ার জন্য বললো,,
—”সৌজন্য ভাই?”
সৌজন্য থমকে গেল। এই প্রথম নিঝুম তাকে ভাই বলেছে। এতদিন তো আঙ্কেল বলে এসেছে আচ্ছা নিঝুমের মুখে সৌজন্য ভাই এত শ্রুতিমধুর কেন শোনাচ্ছে? কেন বারবার শুনতে ইচ্ছা করছে? নিঝুম আবারও ডাকলো,,
—”সৌজন্য ভাই? এটা কি আপনি?”
সৌজন্য:”হুমম..”
নিঝুম:”এতক্ষন কোন দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলেন? কতবার প্রশ্ন করলাম!”
সৌজন্য নিশ্চুপ। নিঝুম এবার দুষ্টু হেসে বলল,,

—”গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলেন নাকি কল্পনায়!”
সৌজন্য:”মানে..”
নিঝুম:”মানে আপনার প্রিয়সীর সাথে রোমান্স করছিলেন নাকি?”
সৌজন্য:”কি সব বলছো উল্টোপাল্টা? পিচ্চি কোথাকার! তুমি এসবের কি বোঝো?”
‌নিঝুম:”ফাস্ট অফ অল আমি পিচ্চি না আমি ক্লাস টেনে পড়ি! আর সেকেন্ডলি কেন বুঝবোনা? এখন তো ক্লাসে
থ্রি-তে পড়া বাচ্চা মেয়েরাও এগুলো বোঝে!”
সৌজন্য:”ও তাই নাকি?”
নিঝুম:”হুম”
সৌজন্য:”তবে তুমি একটু বেশিই পাকা দেখছি!”
নিঝুম:”আপনি কিন্তু কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন বলেন কল্পনা করতে ছিলেন না?”
সৌজন্য:”একদমই না। ঐসব ফালতু জিনিস আমি কল্পনা করিনা!”
নিঝুম বাঁকিয়ে বলল,,

—”আইছে আমার শুদ্ধ পুরুষ রে! ফালতু জিনিস নাকি ওইগুলা? তা আপনি দুল গুলো কার জন্য কিনছিলেন নিজের জন্য? কই আমি তো আপনার কে কখনো কানের দুল পরতে দেখিনি!”
সৌজন্য:”আমি কখন দুল কিনলাম?”
নিঝুম:”এইতো গেচ্ছেন না ধরা খেয়ে! আমি নিজের চোখে আপনাকে কানের দুল কিনতে দেখেছি ওই স্টাফ ভাইয়াটা আপনার হাতে যখন প্যাকটা দিচ্ছিল তখনও দেখেছি!”
সৌজন্য:”আমার তোমার সাথে এখন এসব ফালতু কথা বলার সময় নেই! নিচে যাও নিচে তোমাকে সবাই ডাকছে।”
কথাটা বলেই সোজা না নিচেই চলে গেল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পিছন থেকে নিঝুম দুষ্টু হেসে বলল,,
—”যাহ!বেচারা লজ্জা পেয়েছে!”

হুররাম বেগমের সাথে গল্প শেষে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল শিশির। তখন এই সে একবার উঁকি মেরে দেখলো নাহিয়ানের রুমের দিকে। ভেতরে মোবাইলটা একাধারে বেজেই চলেছে। শিশির ভেতরে ঢুকলো। নাহিয়ান রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে শোনা যাচ্ছে পানি পড়ার শব্দ। শিশির বুঝলো নাহিয়ান হয়তো ওয়াশরুমে।
সে বের হয়ে যাচ্ছিল তখনই আবারো বেজে উঠল ফোনটি। শিশির ওয়াশরুমের দিকে তাকালো। না এখনো বের হচ্ছেনা নাহিয়ান! তাই বাধ্য হয়ে এসে নিজেই ফোনটি তুললো। সাথে সাথে ওই পাশ থেকে ভেসে আসলো এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর,,

—”হোয়াটস আপ এআর? তোমার তো কোন খোঁজ খবরই নেই? কেমন আছো তোমরা আর..”
তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে শিশির বলল,,
—”সরি কিন্তু আমি নাহিয়ান না!”
ওই পাশের মেয়েটি এবার দ্রুত বলল,,
—”তুমি নিশ্চয়ই শিশির? এম আই রাইট?”
শিশির বেশ অবাক হয়ে বলল,,
—”জ্বী কিন্তু আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?
ওই পাশে থাকা মেয়েটি বলল,,
—’আমাকে তোমার চেনার কথা ও না! আমি তনয়া! তনয়া ইসরাত। নাহিয়ানের কলিগ। আমরা দুজনেই CIA-এ আছি । যদিও ও অনেক বেশি সিনিয়র বাট আমরা একসাথে জয়েন করছিলাম এজন্য আমি ওকে এ আর বলেই ডাকি!”

শিশির:”ওওহ!”
তনয়া:”তোমার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন হচ্ছে আমি কি করে তোমাকে চিনি তাই না?”
শিশির:”জ্বী তাতো একটু হচ্ছে!”
তনয়া মুচকি হেসে বলতে শুরু করলো,,
—”তোমাকে দেখার আমার ভীষণ শখ, শুধু আমার না আমাদের টিমের সবার যদিও এ আর কখনো তোমার ছবি আমাদের দেখায় নি! শুধুমাত্র একটাই কারণে তোমাকে দেখতে চাই আমরা তা হচ্ছে নাহিয়ানের মত একটা কঠোর মানুষও কি করে একটা মেয়েকে এতটা ভালবাসতে পারে কি এমন আছে সেই মেয়ের মাঝে! ও সার্বক্ষণিক প্রশান্তি তুমি! ও যখন কোন জটিল কেস হ্যান্ডেল করতে পারত না তখন তোমার কথা মনে করতো তোমার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে বড় বড় জটিল কেসও সলভ করে ফেলতে পারতো!তুমি একবার কিডন্যাপ হয়ে ছিলে না এইতো কিছুদিন আগে, তুমি কি জানো এআর শুধুমাত্র তোমার কারনে সিআইডি টিম ছেড়ে দিয়েছে?

অবশ্য তোমার জানার কথা নয়! তুমি হয়তো দেখনি ওর মত কঠোর মানব তোমার জন্য কি বদ্ধ উন্মাদের মতো কেঁদেছে, ওর জন্য ঐদিন দুই ঘন্টার জন্য তোমাদের বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ক্রাইম সেক্টর অফ হয়ে গিয়েছিল! শুধু বাংলাদেশ না আমেরিকারও ক্রাইম সেক্টর গুলো স্থগিত ছিল প্রায় ছয় ঘন্টার জন্য! তুমি বুঝতে পারছ আমেরিকার মতো একটা দেশের ক্রাইম সেক্টর অফ করে দিয়েছিল ও! বাংলাদেশের প্রত্যেকটা গ্রামের পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নিয়ে এসেছিল! পর্যবেক্ষণ করেছিল দেশের প্রত্যেকটা স্থানের ট্রাফিক সিগন্যাল পর্যন্ত অফ হয়ে গেছিল! ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছিল! পাগলামি শুরু করে দিয়েছিল তুমি জানো না!
যাই হোক বোন অনেক ভালো থাকো দোয়া করি তোমার জন্য। আর আমাদের এআরের একটু খেয়াল কইরো বেচারা তোমাকে অনেক ভালোবাসে!”

শিশির:”জ্বি আপু চেষ্টা করব দোয়া করবেন!”
তনয়া:”অফকোর্স!গড ব্লেস ইউ মাই ডেয়ার লিটল সিস!”
তনয়া ফোন কেটে দিল। তখনই ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো নাহিয়ান। কপালের ওপর পড়া ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে জল বিন্দুরা। পুরো শরীর উন্মুক্ত শুধু কোমরে একখানা সাদা টাওয়াল। শিশিরকে দেখে চিরাচরিত মুচকি হেসে সে বলল,,

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৬

—”হোয়াসট আপ! ম্যাম! এত রাতে আমার রুমে?”
শিশির কোন জবাব দিল না শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে, নাহিয়ানের সৌন্দর্য, বা তার বলা কথাগুলোই শুধু তাকে আকৃষ্ট করছে না নাহিয়ানের ভালবাসাও তাকে এখন আকৃষ্ট করছে। তার মনে শুধু একটাই কথা, একটাই সুর বেজে যাচ্ছে,,
—”বিচ্ছেদের এই যুগেও একটা পুরুষ এতটা ভালবাসতে পারে!”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৮