মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫১

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫১
নওরিন কবির তিশা

——“কদ্দিন ধইরা কইতাছি মাইয়াডারে বিয়া দাও। সেয়ানা মাইয়া লোক ঘরে রাহুন ভালা না।”
পুরাতন জমিদার বাড়ির রান্নাঘরে রান্না করছিলেন জমিদার মরহুম আব্দুর রউফের স্ত্রী আঞ্জুমান বিবি আর তার বড় ছেলের স্বহধর্মিনী বনলতা বেগম। আব্দুর রউফ এই গ্রামের আদি জমিদার ছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর। এখন আর তাদের জমিদারি নেই তবে এখনো গ্রামের একমাত্র মাথা আব্দুর রউফ তালুকদারের বড় পুত্র আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার। তিনিই গ্রামের সবকিছুর একমাত্র বিচারপতি, গ্রামের লোকজন এক ডাকে তাকে রাজ্জাক মাতব্বর নামে চেনে।

সময়টা মধ্যাহ্ন। গরমটা ঝাঁকিয়ে পড়েছে, রান্নাঘরের উত্তপ্ত হাওয়া সেই সাথে শাশুড়ির বলা কথাগুলো যেন আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে। প্রত্যেকদিন একই কথা বলেন আঞ্জুমান বিবি। আজকে না পেরে বনলতা বেগম বলেই দিলেন,,
——“আমাকে আর একই কথা কয়দিন ধরে বলবেন আম্মা?আমি তো বলেছি অপরাজিতা পড়াশোনা করতে চায় আর সবচেয়ে বড় কথা ওর আব্বাও এখন মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না।”
আঞ্জুমান বিবি বনলতা বেগমের কথাই মুখ ঝামটে বললেন,,
——“ওরাম কথা কত শুনিছি! মাইয়ারে কোনো বাপে বিয়া দিতে চায় না! আর পড়াশোনা করবে না কি? আর কত পড়াশোনা করবে? মেট্রিক তো দিলো! এই গেরামে ওর বয়সী আর কোনো মাইয়া আছে নি?”
বনলতা বেগম তরকারি কষাতে কষাতে বললেন,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

——“সে কথা আমায় না বলে আপনার ছেলেকে বললেই ভালো করবেন আম্মা। আপনার ছেলেই বলেছে মেয়েকে আরো পড়াশোনা করাবে।”
কষানো তরকারির ঝাঁজে হাচি উঠে গেল আঞ্জুমান বিবির। তিনি মুখ শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে বললেন,,
——“শোনো মাইয়া, আমি বলি। বাবুকে না হয় আমি বোঝাবো। তুমি এক কাজ করো, তুমি অপুরে বোঝানোর চেষ্টা করো। মাইয়ার যে তেজ, আমি কিছু কইতে গেলেই তো ফোস করে ওঠে। পাশের গেরামের হাসন মাতুব্বারের পোলা আছে না? কি যেন নাম?হ্যাঁ হোসেন আলী ব্যাটা টা ভালা। পড়াশোনা নেহাতই খারাপ করেনি শুধু ম্যাট্রিক ফেল। তবে বাপের বহুত টাকা সেই সাথে শুনতাছি বাজারে মুদিখানার দোকানও নিয়েছে।ভালোই ব্যবসা চলতাছে। ওর দাদা আবার তোমার শ্বশুরের ব্যবসা সঙ্গী ছিল তো তাই আগের দিন ওর দাদি আইছিল আমার সাথে কথা কইতে তহন…”
তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বনলতা বেগম বললেন,,

——“আম্মা আমায় বলে লাভ হবেনা।আপনি বরং আপনার ছেলেকে বোঝান। আর সবচেয়ে বড় কথা যোহরের আযান দিয়েছে অনেক সময় হলো।নামাজে যাবেন না?”
আঞ্জুমান বিবি: “কথা কইতে গেলেই তো থামায় দাও। আমি নামাজ পইড়া তবেই আইছি। তোমাগো ভালোর জন্যই বলি।”
বনলতা বেগম পাশের একটা কাপড়ে হাত মুছে উঠতে উঠতে বললেন,,
——“সেটা আমিও জানি আম্মা।কিন্তু আপনার ছেলেকে কে বোঝাবে? আপনি বরং এখানে একটু বসুন আমি ছোটকে পাঠাচ্ছি। আমি এখনো গোসলও করিনি গোসল করে নামাজটা পড়েই আসবো।”
বনলতা বেগম রান্নাঘরের দরজাটা পেরুতে যাবেন ঠিক তখনই পিছন থেকে আঞ্জুমান বিবি ডেকে বললেন,,

——“বড় বউ?”
বনলতা বেগম দ্রুত পিছন ঘুরে বললেন,,
——“কিছু বলবেন আম্মা?”
আঞ্জুমান বিবি:“দেখলাম বৈঠকখানায় দুইডা ছেড়া বসা। একটাকে তো চিনলামই না। মনে হয় বাইরে থেকে আইছে। আরেকটারে মনে হইল কোনহানে দেখছি। ওরা ওইহানে ‌কি করতাসে গো?”
বনলতা বেগম:“আম্মা, ওদেরকে আমিও ভালো করে চিনি না। একজন তো মনে হয় মেম্বারের বাড়িতে কাজ করে, জলিল না কি নাম? আর একজন নতুন করে যে ছেলেটা।ও সম্ভবত গ্রামে নতুন। আপনার ছেলের সাথে কি ব্যাপারে জানি কথা বলতে এসেছে। তাই বললাম ওখানে বসতে।”
আঞ্জুমান বিবি:“দেইখো, গেরামের অবস্থা কিন্তু ভালা না। আগের দিনও হুনতা ছিলাম রমিজ আলীর মাইয়ারে পাইতাছে না। আর সেখানে আমাগো বাড়িত তে তো দুইডা সেয়ানা মাইয়া আছে।”
বনলতা বেগম:“ব্যাপার না আম্মা। ওরা বলেছে কথা বলেই চলে যাবে।”
কথাটা বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো বনলতা বেগম। আঞ্জুমান বিবি তার প্রস্থানের পানে চেয়ে কিছু একটা ভাবলেন অতঃপর বড় হাড়িটাতে রান্নার জন্য চাল ধুতে গেলেন।

পুরাতন লালচে রঙা কিছুটা ভঙ্গুর দোতালা বাড়িটি। গ্রামের সকলে এক নামে অপরাজিতা কুঞ্জ নামে চেনে বাড়িটাকে। অবশ্য এটা আদি জমিদার বাড়ি হিসেবেই পার্শ্ববর্তী বহু গ্রামে পরিচিত। বাড়ির চারপাশটা একটু অন্যরকম।
প্রায় ৮ ফুট উঁচু প্রাচীরে ঘেরা বাড়িটির ভেতর ঢুকলে প্রথমেই দৃশ্যমান হয় পুরাতন লালচে দোতলা ভবনটি,একটু সামনে এগোলেই ভবনের ডানদিকে শান বাঁধানো বিশাল পুকুর-যার উত্তর পাশে ঝাপটানো নীল অপরাজিতা পুষ্প বৃক্ষে মোড়া একটা দুই তলা কাঠের দালান।

দোতলা ভবনটির বাইরের দিকে নিচ তলার বড় বৈঠকখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছিল নরশদ। হঠাৎই তার দৃষ্টিগত হলো শান বাঁধানো পুকুরটির উপরের সিঁড়িতে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে একটি মেয়ে, ভালো করে খেয়াল করে নরশদ বুঝতে পারল সেটা পাঠ্যবই নয় সম্ভবত উপন্যাসের বই।
নরশদ যখন মেয়েটিকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল ঠিক সেই সময়েই কোথা থেকে যেন একটা মেয়ে ছুটে আসলো। অতঃপর অতি সাবধানে সিঁড়িতে বসা মেয়েটির পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি এত মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছিল যে সে খেয়ালই করেনি তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়েছে। পিছনে দাঁড়ানো মেয়েটি হঠাৎ সিঁড়িতে বসা মেয়েটির চুল থেকে চুলকাঁটাটি একটানে খুলে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িতে বসা মেয়েটির একগুচ্ছ স্বর্নালী কেশরাজি বিক্ষিপ্ত তরঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়লো। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে প্রায়, তবুও তার মিইয়ে পড়া রৌদ্র রেখায় মেয়েটির স্বর্ণালী কেশরাজী যেন চিকচিক করে উঠলো। এক মুহূর্তে থেমে গেল নরশদের চারপাশ। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইলো মেয়েটির পানে।
অতিবাহিত হলো মুহূর্ত খানেক। মেয়েটা এতটাই ঘনকেশী যে চুলের আড়ালে তাকে দেখাই গেল না। কিন্তু যখনই মেয়েটা ঘুরে তার চুল খুলে দেওয়া মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ নরশদের পিছন থেকে জলিল বলল,,
——“ভাই সাহেব মাতব্বর চইলা আইছে। আপনারে বাড়ির ভিতরে ডাকতাছে।”
জলিলের কথায় যেন ধ্যান ভাঙল নরশদের। সেই সাথে কিছুটা বিরক্তও হলো সে। ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে জলিলের দিকে ফিরে সে বলল,,

——“কে আসছে?”
জলিল:“মাতব্বর রাজ্জাক তালুকদার।”
নরশদ এক ঝলক বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“ও আই সি! আচ্ছা চলো!”
সে আর জলিল রওনা দেয় রাজ্জাক তালুকদারের কক্ষের দিকে।
এদিকে…..
অপরাজিতা এক মনে বসে বসে শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ উপন্যাসটি পড়ছিল। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ তার চুল খুলে দেওয়ায় বড় বিরক্ত হলো সে। সুদীর্ঘ কেশরাজী এক হাতে সরিয়ে সামনে এনে পিছনে ঘুরতেই সে দেখতে পেল। তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তার সবচেয়ে প্রিয় বাল্য সহচরী রোদেলা। অপরাজিতা অবশ্য আন্দাজ করতে পেরেছিল যে কাজটা রোদেলারই।

কারণ একমাত্র রোদেলাই এই কাজটা করার দুঃসাহস দেখায়। যখনই অপরাজিতা সিঁড়ির ঘাটে এসে বসে তখনই কোথা থেকে জানি হাজির হয় সে। আর এসেই তার একমাত্র কাজ অপরাজিতার চুলগুলো খুলে দেওয়া। অপরাজিতা ঠোঁট কামড়ে তার দিকে তাকাতেই রোদেলা হেসে বলে,,
——“তোর এত সুন্দর চুল সবসময় বেঁধে রাখিস কেন রে? আমার যদি এরকম চুল থাকতো না আমি সারাক্ষণ ছেড়ে দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম।”
অপরাজিতা ফের হাত খোঁপায় চুল গুলো বাঁধতে বাঁধতে বলল,,
——“বিরক্ত লাগে আমার। এই গরমে, মাঝে মাঝে তো মনে হয় চুলগুলো গোড়া থেকে কেটে ফেলি শুধু আম্মার জন্য কাটতে পারি না।”
রোদেলা মুখ বিকৃত করে বলল,,

——“সত্যি বলি অপু, তোর মতো খাইস্টা আমি আমার জীবনে দেখিনি। দেখ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে আমরা সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছি।আর তুই? বসে বসে উপন্যাস পড়ছিস।তাও কি উপন্যাস? এত এত উপন্যাস রেখে চন্দ্রনাথ! কিরে তুই অপু? বুঝলাম তুই শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পছন্দ করিস। তো পরিণীতা পড়!দেবদাস পড়! তা না কি এক বিদঘুটে উপন্যাস পড়ে যাচ্ছে!”
অপরাজিতা: “আমার তো ওসব উপন্যাসকে উদ্ভট লাগে! আমার জন্য চন্দ্রনাথ, পথের দাবি, পল্লীসমাজ এগুলোই শ্রেয়!”
রোদেলা মুখ বাঁকিয়ে অপরাজিতার পাশের স্থানটি পরিষ্কার করে সেখানে বসতে বসতে বলল,,
——“হ্যাঁ হ্যাঁ এই সবই পড়! বদ দোয়া দিলাম তোর বর হবে মারাত্মক পাগলাটে প্রেমিক, যার প্রেম তোকে মাতাল করে তুলবে। ফলে তখন তুই আর এরকম খাইস্টা থাকতে পারবি না!”
অপরাজিতা:“বাজে কথা বাদ দিয়ে বল কেন এসেছিস?”
রোদেলা:“তোর চিন্তা হচ্ছে না?”
অপরাজিতা ফের বইটির মেলতে মেলতে বলল,,

——“কিসের চিন্তা?”
রোদেলা: “কালকে তো মেট্রিকের ফল দেবে। আমার যা ভয় করছে না বাবা বলছে কালকে সকাল সকাল গঞ্জে যাবে, আর যদি ফল খারাপ হয় তাহলে বলছে আমাকে ওই পাশের গ্রামের আব্বাসের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে!”
অপরাজিতা রোদেলার কথায় হেসে বলল,,
——“তা তো ভালো, তুইতো বলিস যে পড়াশোনা তোর ভালো লাগেনা, বিয়ে করে সংসার করতে চাস।তাহলে কি সমস্যা?”
রোদেলা: “তাই বলে ওই আব্বাসকে? ব্যাডা কালা, ভুটকা, ওর ভুড়ির নিচে একদিন চাপা পড়লেই তো‌ আমি শেষ।জায়গায় পটল তুলবো!”
অপরাজিতা:“তাহলে পরীক্ষা কেন ভালো দিস নি?”
রোদেলা: “পরীক্ষা ভালই দিয়েছি! কিন্তু শুনিস নি যে ব্যাডা পরীক্ষার রুমে ছিল সে কি বলেছিল,, বলেছিল যে আমি পাশ করলেও নাকি ফেল করিয়ে দিবে!”
অপরাজিতা হেসে বলল,,

——“আরে পাগলি! উনি তো তোর সাথে মজা করে বলেছিল।সত্যি সত্যি কি আর পাশ করলে কেউ ফেল করিয়ে দেয়?”
রোদেলা: “তাহলে পাশ করব বলছিস?”
অপরাজিতা: “ভালো পরীক্ষা দিলে ইনশাল্লাহ পাশ করবি!”
রোদেলা বেশ জোরে বললো,,
——“আলহামদুলিল্লাহ!”
রোদেলার এমন কথায় তার দিকে ফিরে ফের হাসলো অপরাজিতা। হাসির কারনে অপরাজিতার বাঁ চোয়ালের টোলখানা গভীর ‌গর্তের মতো ফর্সা ত্বকে নিমগ্ন হলো। ফলে অপরাজিতার সুস্নিগ্ধ মুখশ্রী যেন এক অপার্থিব মাধুর্যে ভরে গেল, ঠিক যেন শরতের সকালে ফোঁটা শিউলি ফুলের মতো অনবদ্য সুন্দর দেখালো।

টগর আর চাঁপা দুটো হারিকেন হাতে দোতলার বারান্দা পেরিয়ে দক্ষিণ দিকের রুমটার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে এক মনে কিছু একটা পড়ছিল নবাগত আগন্তুক লোকটি। যেখানে নিজের তের বছরের জীবদ্দশায় অপরিচিত কাউকেই এই বাড়িতে রাত্রি যাপন করতে দেখেনি টগর। সেখানে চেনা নেই জানা নেই, কোথাকার কোন একটা লোককে দিব্যি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন বড় চাচা রাজ্জাক তালুকদার।
সেই সাথে আবার টগর,চাঁপাকে বলেছে যেন তাকে দেখে রাখা হয়।সাত বছর বয়সী ছোট্ট চাঁপা বিষয়টা গভীরভাবে না নিলেও,টগর ব্যাপারটা এত হালকাভাবে নিতে পারছে না। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে লোকটা কে? কি তার পরিচয়?সে মনে মনে ভাবলো লোকটার কোন প্রয়োজন আছে কিনা একবার দেখে তারপর সোজা অপরাজিতা কক্ষে গিয়ে তার কাছে শুধাবে, লোকটাকে সে চেনে কিনা?
সে ফিসফিসিয়ে চাঁপা কে বলল,,

——“ চাঁপা, তুই গিয়ে শোন ওনার কিছু লাগবে কিনা? লাগে তাহলে আমাকে এসে জানাবি!”
চাঁপা:“তুমি যাবে না আপু?”
টগর:“না!শুনিস নি দাদি আমাকে কি বলেছে, বলেছে যেনো অপরিচিত লোকের সাথে বেশি কথা না বলি।”
চাঁপা:“কিন্তু আপু…”
সে আর কিছু বলার আগেই টগর তাকে থামিয়ে এক ধমক দিয়ে বলল,,
——“তোকে যা বললাম তাই কর।এত বেশি বুঝিস কেন?”
অন্যদিকে হারিকেনের হলদেটে আলোয় এক মনে একটা আর্টিকেল পড়ছিল নরশদ। নিস্তব্ধ রজনীতে শুনশান চারিপাশ,কিন্তু হঠাৎই কারো কথার গুঞ্জন কানে আসতেই এলিয়ে দেওয়া শরীরটা বিছানা থেকে সামান্য তুলে দরজায় উঁকি দিতেই দেখতে পেল সেখানে হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে ‌দুইজন। একটা ১২-১৩ বছর বয়সী কিশোরী, সাথে খুব সম্ভবত ছয় থেকে সাত বছর বয়সী একটা ছোট্ট মেয়ে। তারা সম্ভবত ভেতরে আসা নিয়ে ইতঃস্থ বোধ করছিল। তাদের দেখে নরশদ মুচকি হেসে ডেকে বলল,,

——“তোমরা কি কিছু বলবে?”
টগর বাইরে থেকে চাঁপাকে বলল,,
——“চাঁপা গিয়ে শোন ওনার কিছু লাগবে কিনা?”
চাঁপা:“তুমি শোনো না?”
টগর:“আমি এখন অপু আপুর কাছে যাব; আপুকে গরম দুধ দিতে বলেছিলো বড়মা একেবারে ভুলে গেছি। তুই যা; আমি গেলাম।”
কথাটা বলে সেখান থেকে দ্রুত স্থান করল টগর। উপায়ান্তু না পেয়ে ছোট্ট চাঁপা গুটি গুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। তাকে দেখে নরশদ হাতে থাকা জিনিসপত্রগুলো স্টাডি টেবিলের উপর রেখে বিছানা থেকে নেমে এসে বলল,,
——“কিছু বলবে?”
চাঁপার ভীষণ ভয় লাগল লোকটাকে দেখে। লোকটাকে পাহাড়সম লম্বা ঠেকলো তার কাছে। এত লম্বা মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি। দেখবেই বা কি করে বাড়ির বাইরে তো কখনো যাওয়াই হয়নি তার। কিছুটা ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,

——“তোমার কি কিছু লাগবে ?”
নরশদ মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
——“তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছো?”
চাঁপা:“সত্যি কথা বলবো না মিথ্যা কথা?”
নরশদ:“মিথ্যা কথা কি বলতে হয়?”
চাঁপা না সূচক মাথা নাড়লো। তা দেখে নরশদ বলল,,
——“তাহলে বলবে কেন?”
চাঁপা:“আসলে তুমি না অনেক লম্বা? ঠিক ওই আমাদের বাড়ির সামনের লম্বা গাছটার মতো!”
চাঁপার দেওয়া এমন অদ্ভুত উপমায় হাসলো নরশদ। তারপর তার কাছে শুধালো,,
——“তোমার নাম কি?”
চাঁপা:“চন্দ্রিমা তালুকদার চাঁপা!”
নরশদ:“বাবা কি কঠিন নাম!”

চাঁপা প্রতিত্তুরে মুচকি হাসলো। নরশদ একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“তোমার সঙ্গে আরেকজন যে এসেছিলো না? সে কোথায়?”
চাঁপা:“ও টগর আপু ওতো অপু আপুর কাছে গেছে!”
নরশদ চিনলো না অপু কে? কিন্তু চাঁপার সাথে ভাব জমানোর জন্য বলল,,
——“চকলেট খাবে?”
বলেই সে প্যাকেট থেকে একটা চকলেট বের করে চাঁপার হাতে দিতে গেলেই চাঁপা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে তীব্র গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,,

——“না না!”
নরশদ:“কেন?”
চাঁপা:“অপু আপু বলেছে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নিয়ে খেতে নেই।”
নরশদ এবার কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। কে এই অপু?যার কথা কথায় কথায়, চাঁপা বলেই যাচ্ছে। অপু,অপু, হঠাৎই তার মনে পড়ল বাড়িটার নাম অপরাজিতা কুঞ্জ, ঠিক তখনই তার স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠলো সকালে বলা জলিলের কথাগুলো,,
——“ভাই সাহেব! আপনারে আগুনের মইধ্যা ফেলাইতে যাইতাছি!”
নরশদ অবাক হয়ে তখন জিজ্ঞাসা করেছিলো,,
——“কেন? হঠাৎ এ কথার মানে?”
জলিল তখন এক গাল হেসে বলেছিলো,,

——“আপনারে যে বাড়িতে নিইয়া যাইতেছি ওইহানে একটা মাইয়া আছে। মাইয়া নয় যেন সাক্ষাৎ আসমানের পরি। যেতিই ওই মাইয়ারে দেখিছে হেতিই পাগল হয়ে গেছে।”
তার কথায় প্রথমে অবাক হলেও পরে যখন সে শুনেছিলো মেয়েটি সবেমাত্র এসএসসি দিয়েছে তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলো নরশদ। শহরের কতো মেয়ে তার জন্য পাগল আর এখানে সে কিনা এমন পিচ্চি একটা মেয়ের প্রেমে পড়বে সে?তার নিজের ছোট বোনও তো মেয়েটির থেকে বয়সে অনেক বড়।

সকালটা অদ্ভুতভাবে কেটে গেল নরশদের। কাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় সকালে গ্রামের পরিবেশটা ভিজে আছে অন্যরকম বৃষ্টি মাখা আবহে। তবে আজ তালুকদার বাড়ি পরিবেশটা অন্যরকম। আজ বাড়ির বড় মেয়ে অর্ণিমা তালুকদার অপরাজিতার মেট্রিকের ফলাফল ঘোষণার দিন।তাই সকাল থেকেই বাড়িতে রয়েছেন বাড়ির বড় কর্তা রাজ্জাক তালুকদার।
আজ অপরাহ্নে চাঁপার সাথে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল নরশদ। পিচ্চি মেয়েটার সাথে ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। হঠাৎই তার লক্ষ্যগত হলো শান বাঁধানো পুকুরটায় ভাসমান দুইটি শ্বেতরংগা রাজহংসী। হাস দুটো অন্যরকম সুন্দর।সে হাসগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,,

——“এগুলো কার হাঁস?”
চাঁপা:“ওদের একদম হাঁস বলো না, ভাইয়া, ওগুলো অপু আপুর শুভ্রা আর শ্বেতা!”
নরশদ:“হাসেরও আবার নাম হয় নাকি?”
চাঁপা তাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পিছন থেকে টগর তাকে ডেকে বলল,,
——“চাঁপা দ্রুত আয়। রহমান কাকা গঞ্জ থেকে ফিরেছে, সাথে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছে। সম্ভবত অপু আপুর ফল অনেক ভালো এসেছে দ্রুত আয়। বড়আব্বু ডাকছে তোকে।”
চাঁপা বোনের কথা অনুযায়ী এক ছুটে দৌড়ে গেলো। অপু আপুর ফলাফল বরাবরই খুব ভালো হয়। আর প্রত্যেকবারই ফলাফল দেওয়ার পর বড়আব্বু সারা এলাকা জুড়ে মিষ্টি বিলায় সেই সাথে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া তো আছেই।

আজকে শুক্লা দ্বাদশীর রাত। নিজের কাঠের দালানটির দোতলার বারান্দায় অপরাজিতা গাছটির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণিমা তালুকদার অপরাজিতা। এই দালানটি বিশেষভাবে তার জন্য তৈরি। সারাদিন মূল ভবনে লোকজন গিজগিজ করে। কেউবা তার বাবার সাথে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা করতে আসে, কেউবা আসে দাদি-চাচীর সাথে পারিবারিক বিষয় নিয়ে গল্প করতে।
নানা কারণে পড়াশোনার বিঘ্ন ঘটতো অপরাজিতার। সে কারণে রাজ্জাক তালুকদার নিজেই মেয়ের জন্য পুকুর পাড়ের নির্জন জায়গাটিতে একটা কাঠের ছোট্ট দোতলা দালান তৈরি করে দিয়েছিলো। সেখানেই অপরাজিতা ফুলের চারা লাগিয়ে দালানটাকে আরো বেশি শোভিত করেছে অপরাজিতা।

হারিকেনের নিভু নিভু হলদেটে আলোয় বারান্দায় বসে শরৎচন্দ্রের পথের দাবি উপন্যাসটির দশম পাতাটা খুব মনোযোগের সাথে পড়ছিল অপরাজিতা। হঠাৎই তার দৃষ্টিগত হল বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে কেউ। খুব খেয়াল করে অপরাজিতা বুঝলো এটা বাড়ির কেউ নয়। কেননা এত রাতে বাড়ি থেকে কেউ বের হয় না।
অপরাজিতা বেশ খেয়াল করে দেখলো লোকটার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। তীক্ষ্ণ শৈল্পিক তার দেহ, লোকটা পিছনে কেউ আছে কিনা দেখার জন্য যেই না পিছন ঘুরলো তৎক্ষণাৎ অপরাজিতা বুঝলো এটা তাদের বাড়ির কেউ নয়। এটা সেই নবাগত আগন্তুক। কাল রাতে টগর বেশ অনেকক্ষণ ধরেই তার সাথে বসে বসে লোকটার গল্প দিচ্ছিলো। টগর এর ভাষ্যমতে অপরাজিতা যা বুঝলো লোকটাকে ভালোই খাতির করছে তার আব্বা।

কিন্তু উনি কোথায় যাচ্ছে? এত রাতে তো গ্রামের কেউ জেগে থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা জমিদার বাড়ির মূল ফটক এতক্ষণে আটকা পড়ে যায়। দারোয়ান আমির আলী এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে লোকটা যাচ্ছে কোথায়?
অপরাজিতা আর আগ পাছ না ভেবে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে পিছু করে লোকটির। লোকটি প্রধান ফটক পেরিয়ে এগিয়ে চলল গ্রামের নির্জন রাস্তাটির দিকে। অপরাজিতা বেশ অবাক হলো। এই রাস্তাটি সোজা যায় একটা পোড়া বাড়ির দিকে। বাড়িটা ভঙ্গুর,পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বহু কাল ধরে। গ্রামের মানুষের ভাষ্যমতে সেখানে জিন-ভূতের বাস। যদিও অপরাজিতার কাছে এই সবই কুসংস্কার তবুও লোকটা সেদিকে কেন যাচ্ছে তা নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই তার মাঝে।

যে মেয়েটি দিনের বেলাতেও একবার বাড়ি থেকে বের হয় না সেই মেয়েটিই মধ্যরাতে পিছু নিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের। কথাটা গ্রামে জানাজানি হলে তার নামে বদনাম রটাতে গ্রামবাসীরা এক মুহূর্তও সময় নেবে না। তবুও এই লোকটির পরিচয় জানার জন্য আর লোক টি এত রাতে কোথায় যাচ্ছে তা জানার জন্যই অপরাজিতা তার পিছু করেছে।
লোকটি সোজা পোড়া বাড়ির সামনে এসে থামল। কিছুটা ঘুরে আশপাশ দেখতেই অপরাজিতা দ্রুত লুকালো পোড়া বাড়িটির পিছনে। লোকটি অর্থাৎ নরশদ দ্রুত কদম ফেলে প্রবেশ করল পোড়া বাড়িটির ভেতর। অপরাজিতা ভাবলো এখন তার চলে যাওয়া উচিত কাল সকালে না হয় আব্বাকে দিয়ে শুনবে লোকটার কাছে,সে কেন এখানে এসেছিল। কিন্তু সে যখন চলে উদ্ধুত হচ্ছিল তখনই ভেতর থেকে ভেসে আসলো সেই আগন্তুকের গভীর কন্ঠ,,
——“যদি স্বীকার না করে তাহলে মে*রে ফেল। কোনো কথা ছাড়াই এমনভাবে মা*রবি যাতে ওর সাথে থাকা লোকগুলো মৃ*ত্যুকে নয় তোদেরকে ভয় পায়।”

মুহূর্তেই থেমে গেল অপরাজিতার পদচারণা। গ্রামে ইদানিং হত্যা,‌নারী ধ*র্ষ*ণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছে। মানুষগুলো যেন পাগল কুকুরের মতো খেপেছে। তাহলে কি এই লোকটা সেই দলেরই কেউ? এক মুহূর্তে শ্বাস আসলো অপরাজিতার। সেই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে সামান্য উঁকি দিলো বাড়িটির ভিতর। যেখানে নিভু নিভু হারিকেনের হলদেটে আলোয় দৃশ্যমান কতগুলো মুখ।
অপরাজিতা সেখান থেকে দ্রুত পিছন ঘুরে যখনই বের হয়ে আসতে যাবে ঠিক তখনই তার হাত ধরে টান মারে কেউ। হেঁচকাটানে ভারসাম্য হারিয়ে অপরাজিতা পড়ে কোনো সুঠামদেহি যুবকের প্রশস্ত বক্ষ দেশে। মুহূর্তের চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হয় তার। সে চিৎকার করে কিছু বলতে যেতেই যুবকটি শক্ত হাতে তার মুখ চেপে ধরে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫০

অপরাজিতা নিজের মধুরঙ্গা ডাগর ডাগর চক্ষু মেলে তাকায় লোকটির দিকে। মুহূর্তেই চিনে ফেলে তাকে সে। এটাই তো সেই আগন্তুক। হারিকেনের হলদেটে আলোয় অপরাজিতা স্পষ্ট বুঝলো অপরপাশের আগন্তুক লোকটি বিমোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার পানে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫২