মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫২

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫২
নওরিন কবির তিশা

——“ছিঃ ছিঃ! এই যদি গেরামের মাতব্বারের মাইয়ার হাল হয়। তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে মাতব্বরের পারিবারিক শিক্ষা কেমন?এই শিক্ষা নিয়ে কিনা তিনি গেরামের মাতব্বারের ! ছিঃ ছিঃ;এই নাকি মাইয়া মেলা শিক্ষিত হইছে! থাক বাবা, আমাগো মাইয়ারা অশিক্ষিত আছে অশিক্ষিতই ভালা! অন্তত শিক্ষিত মাইয়া লোকের মত নষ্টামি তো করতাছে না!”

তালুকদার বাড়ির বিশাল উঠানে আজ জমায়েত হয়েছে পুরো গ্রামবাসী। তারা যে যার মতো অপরাজিতার উপর কাঁদা ছিঁটাতে ব্যস্ত। নিজের একমাত্র আদরের মেয়ের এমন অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পরেও কিছু করতে পারছেন না মাতব্বর রাজ্জাক তালুকদার। উঠোন ভর্তি মানুষের সামনে মাথার নত করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
তবে এখানেই শেষ হলো না। মানুষজন ইচ্ছা মতো পাথর, পঁচা ডিম টমেটো ছুঁড়তে থাকল অপরাজিতা কে উদ্দেশ্য করে। পাথরের আঘাতে রুধিরক্ত হয়ে উঠল তার ফর্সা, নরম কোমল মুখশ্রী। এলাকাবাসীর সাথে যোগ দিলো পাশের গ্রামের মাতব্বর হোসেন আলীর পুত্র শাহাদাত আলম। অপরাজিতার উপর আগে থেকেই বেশ ক্ষোভ জমে ছিল তার।
কিছুদিন আগে অপরাজিতার সাথে জোরপূর্বক কথা বলার চেষ্টায় জনসম্মুখে অপরাজিতা তাকে ঠাঁটিয়ে চড় মেরেছিল।সেই সাথে রাজ্জাক মাতব্বরের অপমান তো আছেই। প্রতিশোধ প্রবণতা জেঁকে আছে তার মাঝে। অন্যদিকে মেয়ের এমন করুন অবস্থা আর সইতে পারলেন না রাজ্জাক তালুকদার। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

——“থামুন আপনারা। অনেকক্ষণ ধরেই আপনাদের কথা শুনছি। একবার তাকিয়ে দেখুন আমার মেয়েটার কি অবস্থা করেছেন আপনারা। এখনো যদি আপনারা না থামেন তাহলে কিন্তু আমি আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বাধ্য হবো।”
উপস্থিত জনস্রোত থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো,,
——“তা তো করবেনই!ক্ষমতা আপনার হাত; মাইয়ার দোষ কি আর আপনার চোখে পড়বো?”
রাজ্জাক তালুকদার এবার ক্ষেপে গিয়ে বললেন,,
——“আপনারা সেই সময় থেকে বলে চলেছেন আমার মেয়ে দোষ করেছে। কিন্তু কি দোষ করেছে সে?”
শাহাদাত আলম এগিয়ে গিয়ে বলল,,
——“আপনার মাইয়া নষ্টামি করতে গিয়া ধরা পড়ছে। আশা করি বাকিটা আপনাকে বিস্তারিত বলতে হবে না মা-ত-ব্ব-র সা-হে-ব….”

মাতব্বর সাহেব কথাটা বেশ টেনে টেনে বলল শাহাদাত। রাজ্জাক সাহেবের বুঝতে বাকি রইল না তাকে অসম্মানের জন্যই শাহাদাত এমন করছে।সে রাশভারী কন্ঠে শুধালো,,
——“তা কি নষ্টামি করেছে আমার মেয়ে?”
শাহাদাত নরশদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল,,
——“ওই যে দেখতাছেন মজনু! হ্যাতির লাইগা পোড়া বাড়ি থেইকা আপনার মাইয়ারে আমি আজকে ভোর বেলায় বের হইতে দেহেছি, শুধু আমি না আরও অনেকেই ছিলো!”
তারপর সে এলাকাবাসীদের দিকে ফিরে বলল,,

——“আপনারাই কন, সারা রাত্রি জুড়ে পোড়া বাড়িতে কি,কি নষ্টামি হইয়াছে,সে কি কারো বুঝতে বাকি রইছে?”
উপস্থিত সকলের একসাথে থুতু ছিটালো অপরাজিতার দিকে। রাজ্জাক তালুকদার একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। কিন্তু মেয়ে তার আজকে একদম পাথর, অগ্নিকুণ্ডের মতো তেজী মেয়েটা আজ বরফের ন্যায় শীতল হয়ে আছে। রাজ্জাক তালুকদার ভালো করেই জানেন তার মেয়েকে নিয়ে যে অপবাদ রটানো হয়েছে।তার সবটাই মিথ্যা। তবে এটা গ্রাম,আর এখানে কোনো মেয়ের দিকে যদি একবার আঙ্গুল তোলা হয় সেই মেয়ের পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায় ওই মিথ্যা অপবাদ কাঁধে নিয়ে।

রাজ্জাক তালুকদার বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি। বলা চলে তার কূটনৈতিক জ্ঞানের কারণেই আজও এই গ্রামসহ আশেপাশের বহু গ্রাম জুড়ে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে আছে। যদিও তিনি অত্যন্ত নীতিবান একজন লোক,এ কারণেই লোকজন তাকে একটু বেশিই পছন্দ করে।
তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার মেয়ে অথবা নরশদ কেউই এমন কোন কাজ করতে পারে না যাতে তার মাথা কাটা যায়। কিন্তু গ্রামবাসীকেও শান্ত করা প্রয়োজন। নয়তো তার মেয়েটির জীবন নষ্ট করে দেবে তারা,এক হাতে করে। তিনি নিরবে পরিকল্পনা করতে লাগলেন কিভাবে এই অপবাদের হাত থেকে অপরাজিতাকে রক্ষা করা যায়।
এদিকে নরশদ এতক্ষণ যাবৎ গ্রামের লোকজনের হাত থেকে অপরাজিতা কে বাঁচানোর নানাবিধ চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন সে ব্যর্থ হল তখন রাজ্জাক তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

——“চাচা!”
রাজ্জাক তালুকদার আনমনে বললেন,,
——“জ্বী!”
নরশদ কোনরকম ভনিতা না করে স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,,
——“আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।আপনি কি রাজি আছেন?”
রাজ্জাক তালুকদার সহ সবাই হচকিত নয়নে তাকালো নরশদের দিকে।নরশদ বিস্মিত গ্রামবাসীদের দিকে ফিরে বলল,,

——“আপনাদের প্রবলেম তো আমাকে আর অপরাজিতা কে নিয়ে,রাইট? যদিও আপনারা যে অ্যালিগেশন আনছেন সেটি সত্যি নয় তবুও তালুকদার চাচা আর অপরাজিতা যদি রাজি থাকে তাহলে আমি নরশদ খানম এক্ষুনি,এই মুহূর্তে অপরাজিতাকে নিজের সহধর্মিনী,জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি।”
রাজ্জাক তালুকদার বোধহয় মনে মনে এটাই ভাবছিলেন। তিনি কোনো রকম আপত্তি না করে বলল,,
——“আমি রাজি আছি বাবা!”
নরশদ এবার অপরাজিতার দিকে ফিরে বলল,,
——“তোমার কি মত অপরাজিতা?”
অপরাজিতা কোনো কথা না বলে তীব্র বিদ্বেষের সহিত মাথা নিচু করে রাখল। তার কাছে এটা জুতো মেরে গরু দান ছাড়া আর কিছুই নয়। কাল রাতে নরশদ যদি তাকে পোড়া বাড়িতে আটকে না দিয়ে অপরাজিতা কুঞ্জে ফিরতে দিতো।তাহলে হয়তো আজ তার অথবা তার পরিবারের কাউকে ‌এই দিনটা দেখতো না। নরশদ বুঝলো।অপরাজিতার রাগের কারণ। সে তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাজ্জাক তালুকদারের দিকে ফিরে বলল,,
——“চাচা আপনি কাজী ডাকুন।বিয়ের আয়োজন শুরু করুন আমি প্রস্তুত আছি।”

এদিকে নিজেদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নাফিসপুরে নিজের দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে রোদেলা।মেট্রিকের ফল টেনেটুনে পাশ হলেও,তা নিয়ে খুশির শেষ নেই রোদেলার। তারউপর সে খবর পেয়েছে নাফিসপুরের হেলাল স্যারের আম বাগানে এবার ব্যাপক ফলন হয়েছে।
স্যারের উপর পুরাতন বিদ্বেষ জমে আছে রোদেলার। একবার বাড়ির কাজ করে নিয়ে গিয়েছিল না বলে সারা ক্লাস তাকে কান ধরে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো হেলাল স্যার। সেজন্যই আজ ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সেই প্রতিশোধ তোলার জন্য নিজের দলবল নিয়ে সে হাজির হয়েছিলো হেলাল স্যারের বিশাল আম বাগানে।
সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর। মাথার উপর সূর্য্যি মামার প্রখর তেজে অতিষ্ঠ জনজীবন।বেশকিছু আম চুরি করেছিল তারা। কিছু নিজেদের জন্য নিয়েছে আর কিছু আশেপাশের গরিব মানুষের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসেছে। রোদেলা হাঁটতে হাঁটতে তার এক সহচরী মেঘলার দিকে ফিরে বলল,,

——“গ্রামের কত মানুষ দামের কারণে আম খেতে পায় না। আর ওই বেডা দেখ কাড়ি কাড়ি আম গাছের পঁচাচ্ছে। বেশ হয়েছে!”
মেঘলা কিছুটা ভীত কন্ঠে বলল,,
——“কিন্তু রোদ! আমার মনে হচ্ছে কাজটা করে একদমই ঠিক হয়নি। যদি স্যার টের পায়, আর যদি বাবার কাছে নালিশ দেয়।”
রোদেলা গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,,
——“নালিশ দিলেও বা আমার তাতে কি? আমি ওই দজ্জালের স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। জীবনে আর ওই স্কুলের ত্রিসীমানায় পা দিবো না!”
আর কথায় একযোগে হেসে উঠলো ৭-৮ জনের একটি বন্ধু দল। তখনই হঠাৎ জিহাদ বলল,,
——“সে তো ঠিক আছে রোদ। যে তুই কি একবারও ভেবেছিস,যদি অপু এ কথা জানতে পারে তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে!”

রোদেলা: “অপু যদি কখনো এ কথা জানতে পারে তাহলে আগে তোদের খবর করে দেবো আমি। কেননা এই চুরির ব্যাপারটা আমরা কয়জন ছাড়া আর কেউ জানে না। বাকিরা তো টেরই পায়নি।”
আরিস:“কি দস্যির দস্যি মাইয়া! নিজে ধরা পড়লেও আমাদের দোষ।”
রোদেলা: “মরলেও তোদের একসাথে নিয়ে তবেই জাহান্নামে যাব!”
তারা সবাই কথা বলছিল,হাসাহাসি করছিল আর হেঁটে নিজের গ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ রোদেলার চোখ পড়ে একটা বড় পেয়ারা গাছের দিকে। গাছটা বেশ উঁচু আর প্রচুর পেয়ারা ধরেছে তাতে। সে সবার দিকে ফিরে বলে,,

——“পেয়ারা খাবি?”
সবাই অবাক হয়ে বলে,,
——“এই সময় পেয়ারা কই পাবো?”
রোদেলা গাছের দিকে ইশারা করে বলে,,
——“ওই দেখ!”
পাশ থেকে হেমা বাঁধা দিয়ে বলে,,
——“রোদ এটা আক্কাসের মামার গাছ।”
রোদেলা শাড়ির আঁচল টা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বলল,,
——“আক্কাসের মামা হোক আর ঝাক্কাসের মামা পেয়ারা খাব যখন বলেছি তখন খেয়েই ছাড়ব। তোরা শুধু দেখ আশেপাশে কেউ আছে কিনা!”

কথাটা বলেই কিছু বাঁদরের মতো হুরহুর করে গাছে উঠে গেল রোদেলা। সবাই নিচে বসে পাহারা দিচ্ছিল কেউ আসছে কিনা। হঠাৎই কারো পায়ের শব্দে সবগুলো যে, যেদিকে পারলো ছুটে পালালো।রোদেলা গাছে থাকায় খেয়াল করল না যে নিচে কেও নেই।সে নিজ মনে বেশ কিছু পেয়ারা পেরে আঁচল ভর্তি করলো। অতঃপর যখন নামার সময় আসলো তখন পেয়ারাগুলো এক এক করে নিচে ছুড়ে মারল।
এদিকে সবে পেয়ারা গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল সিকদার শাহ। সে মূলত এই গ্রামে এসেছে পথ হারিয়ে। আর যাওয়ার কথা ছিল তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু নরশদের খোঁজে নওগাঁ গ্রামে। কিন্তু ভুল ঠিকানার কবলে পড়ে সে নওগাঁর পরিবর্তে নাফিসপুরে চলে এসেছে। তার উপর তার কপালটা এতটাই খারাপ যে পথিমধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। এখন গাড়িটা ঠেলে ঠেলে গ্যারেজের দিকে যাতে হচ্ছে তার। অবশ্য এই গ্রামে কোথাও এই গাড়ির মেরামত করার জায়গা পাবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে তীব্র সন্দেহ।

তীব্র রৌদ্রতাপে একপ্রকার সিদ্ধ হয়ে আসছিল সে। মাথার ভেতর ঘিলুগুলো যেন টগবগ করে ফুটছিল। হঠাৎ সামনে একটা বড় বৃক্ষের ছায়া দেখে সেখানে এসে দাঁড়ালো সে। হঠাৎই তার উপর শুরু হল পেয়ারার বর্ষণ। দুইটা পেয়ারা পরপর মাথায় পড়লো তার। এর আরেকটা পেয়ারা পড়ার আগেই সেটা ক্যাচ করে নিল সে। বিরক্তিতে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গাছের দিকে তাকাতে দেখতেই সে দেখতে পেল বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ুয়া একটা মেয়ে।বাঁদরের মতো নেমে আসছে গাছ থেকে। তাকে দেখে সিকদার মুখ বিকৃত করে বলল,,
——“হোয়াট দা হেল?”

এদিকে গাছ থেকে নেমে সিকদার কে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল রোদেলার। আশেপাশে তাকিয়ে সে দেখল তার দলবলের কেউ নেই।সবাই উধাও। ভয়ে সিকদারের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠ সে বলল,,
——“আপনি কি আক্কাসের মামা?”
সিকদার অবাক হয়ে বলল,,
——“আর ইউ ম্যাড? ওভাবে পেয়ারাগুলো আমার মাথার উপর ফেলছিলে কেন? আর হু ইস আক্কাসের মামা?”
রোদেলা:“কিছু মনে করবেন না মামা! আসলে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তো,তাই পেয়ারা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি আর কোনদিন চুরি করবো না।মাফ করে দেন!”
সিকদার:“হেই ইউ তোমায় তো একটু আগে সামান্য পাগল মনে করেছিলাম।এখন তো মনে হচ্ছে তোমার পুরোই মাথায় গন্ডগোল আছে। আমায় দেখে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে তোমার মামা মামা মনে হচ্ছে। তাও আবার আক্কাসের মামা। ওয়াট দ্যা ফা**।”

আর কথা বাড়ালো না সে। এমনিতেই এই গরমের মাঝে মেজাজটা বিগড়ে আছে তার উপর এই মেয়ের উল্টাপাল্টা কথায় যেন,বারবার শুদ্ধ ভাষারা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে তার। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করলো সে। রোদেলা বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
——“ওওহ তারমানে আপনি আক্কাসের মামা নন!”
সিকদার কোনো কথা বলল না। তবে এবার বেশ রাগ হলো রোদেলার। এতক্ষণ এই লোকটাকে আক্কাসের মামা ভেবে কি বকাটাই না খেলো সে। সে ঠোঁট কামড়ে বলল,,
——“এত দেমাগ কিসের আপনার হ্যাঁ? আপনার কাছে তো শুধু পরিচয়ই শুনেছিলাম তাই বলে এরকম বোকবেন? বেডা খচ্চর!”
খচ্চর শব্দটা আস্তে উচ্চারণ করল রোদেলা যার দরুন সিকদার কথাটা বুঝতে পারল না।
সিকদার:“কিছু বললে?”
রোদেলা: “না!”
কথাটা বলে এই শাড়ির আঁচল কোমর থেকে খুলে । সোজা পায়ে হাঁটা লাগালো রোদেলা।দুঁ কদম এগোতেই পেছন থেকে সিকদার তাকে ডেকে বলল,,

——“এই যে মেয়ে শুনছো?”
রোদেলা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল,,
——“আমি এই যে মেয়ে নই আমার একটা সুন্দর নাম আছে রোদেলা, রোদেলা জামান।”
সিকদার ফিসফিসিয়ে বলল,,
——“নামটা সুন্দরই কিন্তু তোমার সাথে যাচ্ছে না!”
রোদেলা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
——“কি বললেন?”
সিকদার:“বললাম একটু হেল্প করো তো! আসলে এই গ্রামের কিছুই আমি চিনি না তার উপর গাড়িটাও খারাপ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোনো গ্যারেজ পাবো কি?”
রোদেলা:“হ্যাঁ পাবেন! কিন্তু এই গ্রামে তো প্রায় শেষ সীমানায় আপনি। আর গ্যারেজ পেতে,আমাদের এলাকায় যেতে হবে আপনাকে!”
সিকদার:“তোমাদের এলাকা মানে? কতদূর?”
রোদেলা:“আমার গ্রাম মানে নওগাঁ,এইতো আর প্রায় মিনিট দশেকের পথ।”
সিকদার অবাক কন্ঠে বলল,,

——“তোমার বাসা নওগাঁ?”
রোদেলা:“হুম!”
সিকদার:“থ্যাংকস গড! আচ্ছা গাড়িটা পুশ করো তো!”
রোদেলা:“কি?”
‌সিকদার:“পুশ করো মানে পিছন থেকে ধাক্কা দাও।”
রোদেলা: “এইজন্যই মানুষের উপকার করতে হয় না, খেতে দিলে শুতে চায়! কেনরে ভাই আপনি আমার কাছে শুনছেন গ্যারেজ কোথায় পাবেন?আমি তো আপনাকে জায়গার নাম বলেই দিলাম।এখন যাওয়ার দায়িত্ব আপনার। আমি কেন খামোখা আপনার গাড়ি ঠেলতে যাব?”
সিকদার:“কারন কিছুক্ষণ আগেই তুমি আমার মাথায় ওই বড় বড় সাইজের পেয়ারা ফেলে আলু গজিয়ে দিয়েছো। এখন প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে আমার।সেই অপরাধের শাস্তি অনুযায়ী এখন এই গাড়িটা তুমি ঠেলে সামনের গ্যারেজ অব্দি নিয়ে যাবে। আর আমি যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ বলেই তোমাকে একা ধাক্কাতে বলছি না। আমি নিজেও হেল্প করছি তোমায়।”

রোদেলা: “আইছে আমার মানবতার ফেরিওয়ালা রে! প্রথমত আপনি হেল্প করবেন কি করবেন না তাতে আমার বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না।কারণ আমি আপনার গাড়ি ধাক্কাতে পারবো না! আর দ্বিতীয়ত আপনি কেন হনুমানের মতো গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন হ্যাঁ? না দাঁড়ালে তো আর আপনার মাথায় পড়তো না!”
কথাটা বলে রোদেলা সামনের দিকে এগোতে গেলেই সিকদার বাঁকা হেসে বলল,,
——“এই যে মিস গোবরঠাসা। তোমাকে আমি ভালো মুখে বললাম কথা শুনলে না। এখন যদি কথা না শোনো তাহলে ওই যে কি নাম বললে আক্কাস না ঝাক্কাস তার মামাকে কে গিয়ে আমি বলে দেবো তুমি তাদের গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করেছো।”
রোদেলা: “যা ইচ্ছা করুন!”
সিকদার: “ওকে!”
কথাটা বলে সিকদার চেঁচাতে গেলেই রোদেলা দৌড়ে এসে পায়ের দুই আঙুলের উপর ভর করে কিছুটা উঁচু হয়ে মুখ বন্ধ করে দিল সিকদারের। তারপর বলল,

——“বজ্জাত বেডা! চলুন ঠেলে দিচ্ছি আমি আপনার গাড়ি।”
কথাটা বলে মুখ ছাড়লো সে। সিকদার ফের দুষ্টু হাসি মুখে নিয়ে বলল,,
——“এবার আইছে লাইনে! চলুন মিস এগোই তাহলে!”
রোদেলা আর কোন কথা না বলে সিকদারের সাথে গাড়ির পিছন থেকে ঠেলতে লাগলো। তার ইচ্ছা করছিল পাশ থেকে রাস্তায় ফেলা একটা ইট নিয়ে সিকদারের মাথা ফাঁটিয়ে দিতে। তবে সে কিছু বলতে পারল না শুধু দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণের চেষ্টা করল। এদিকে তার এমন অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো সিকদার।

বহু কষ্টে প্রায় এক ঘন্টা ধরে গাড়ি ঠেলার পর গ্যারেজের দেখা পেয়েছিলো সিকদার। যদিও এটা রোদেলার পরিচিত ছিলো। তার এক কাকাতো ভাইয়ের গ্যারেজ। তাই লোকটি সিকদারের গাড়ি অতি দ্রুত সারাই করে দিয়েছিল। বর্তমানে সিকদার আর রোদেলা মিলে যাচ্ছে তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিকদার খবর পেয়েছে তালুকদার বাড়িতে আগমন ঘটেছে এক নব আগন্তুকের। রোদেলার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আগন্তুকটিই সম্ভবত তার প্রিয় বন্ধু যার খোঁজে এই গ্রামে আসা তার।
এদিকে রোদেলার বুক আনচান করছে। পাশের এক কাকীর কাছে সবকিছু শুনেছে সে। অপরাজিতার ভারী বিপদ। কথাগুলো শোনার সাথে সাথে আর কোনো কিছু না ভেবেই সে ছুট লাগিয়েছে তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর তার পিছু নিয়েছে সিকদার।

তালুকদার বাড়ির উঠান দেখে একে একে বিদায় নিচ্ছে সবাই। কিছুক্ষণ আগেই সবার সামনে বিয়ের কার্য সম্পন্ন হয়েছে অপরাজিতা আর নরশদের। বাড়ি এখন প্রায় ফাঁকা তবুও আশেপাশে ভিড় করে আছে এলাকার কিছু মহিলারা। আঞ্জুমান বিবি এক মনে বকে চলেছেন বনলতা বেগমকে। মহিলারা কেউ থামাচ্ছে তো নাই, বরং আঞ্জুমান বিবিকে আরো উস্কাচ্ছে বনলতা বেগমের বিরুদ্ধে। মানুষের ভিড় এড়িয়ে এক প্রকার ঠেলাঠেলি করে অপরাজিতা কুঞ্জে প্রবেশ করলো রোদেলা।

কোনো মতে সিঁড়ি দিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করল সে। এদিকে সিকদার দাঁড়িয়ে আছে ভবনের বাইরে। ভিতরে এত মহিলাদের ভিড়ে সে আর ভিতরে ঢোকার সুযোগ পায়নি। রোদেলা এক ছুটে অপরাজিতার কক্ষের সামনে এসে থামল। সেখানে এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে অপরাজিতা। রোদেলা থেমে গেল এক মুহূর্ত এযেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের বিষয় ঘটছে তার চোখের সামনে।
অপরাজিতা কাঁদছে? হ্যাঁ অপরাজিতাই! কিন্তু অপরাজিতা কাঁদতে পারে? সে তো অপরাজিতা সে তো অপরাযেও,সে তো অর্ণিমা সে তো আলো, জীবনে এই প্রথমবার হয়তো অপরাজিতা কে কাঁদতে দেখলো রোদেলা। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় অপরাজিতার পাশে বসলো। তাকে দেখে মুখ তুলল অপরাজিতা। শক্ত করে জাপটে ধরে বলল,,

——“তুই কোথায় ছিলি রোদ? বলনা কোথায় ছিলি?”
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো অপরাজিতা। তা দেখে স্তম্ভিত হলো রোদেলা। কিছু বলতে পারল না সে শুধু আস্তে আস্তে আওড়ালো,,
——“কাঁদিস না অপু!”

সিকদার কে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো নরশদ। এগিয়ে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
——“সিকদার?”
সিকদার শাহ পিছনে ঘুরে নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে এক গাল হেসে বলল,,
——“আরে নরশদ! ভাই তুই জানিস তোর খোঁজে সেই জাফলং থেকে কবে রওনা দিয়েছি আমি। বড় ভাই অনেক অসুস্থ। ভাবি বলেছে যেন তোকে নিয়েই বাড়ি ফিরি।”
এতদিন পর নিজের বন্ধুকে দেখে যেন ভরসা পেলো নরশদ। সে তো মনে মনে এমনই কাউকে খুঁজছিল। নতুবা অপরাজিতা কে নিয়ে আরো একটি রাত এই জাহান্নামে কাটাতে হতো তাকে। সে একদমই চায় না আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে।
নরশদ:“তুই গাড়ি এনেছিস না?”
সিকদার অবাক কণ্ঠে বললো,,

——“কতদিন পর তোর সাথে দেখা।কোথায় একটু হাই হ্যালো করবি তা না? বাই দ্যা ওয়ে এখানে হচ্ছেটা কি রে? এত লোকজন?”
নরশদ:“সে কথা না হয় তোকে পরে বলব! আগে বল গাড়ি এনেছিস কিনা?”
সিকদার:“হ্যাঁ।এনেছি তো। বাড়ির বাইরে আছে।”
নরশদ:“গুড! তাহলে তুই গাড়ির কাছে যা, আমি তোর ভাবীকে নিয়ে আসি। আজ রাতেই আমি জাফলং ব্যাক করছি।”
সিকদার চোখ বড় বড় করে বলল,,
——“ভাবি মানে? তুই বিয়ে করেছিস?”
নরশদ:“সে অনেক কথা।এখন তোকে এত বিস্তারিত বলার সময় নেই। বাড়ি চল পথে যেতে যেতে বলব।”
আর এক মুহূর্তে দাঁড়ালো না নরশদ। দ্রুত পায়ে অন্দরমহলের ভেতর প্রবেশ করল সে। এদিকে তার যাওয়ার পানে বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ‌সিকদার।নরশদ বিয়ে করেছে? কিন্তু কাকে? আর বিয়ে করলেও তাদেরকে একবারও জানালো না? তাকে না জানাক অন্তত ভাইয়া ভাবিকে? এমনই হাজারটা প্রশ্ন মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল সিকদারের। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে সে পা বাড়ালো প্রধান ফটকের দিকে।
পরের দিন সকালে……

গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। সকালের সুস্নিগ্ধ রৌদ্র কিরণ গাড়ির জালনার কাঁচ ভেদ করে চোখের উপরে সে লাগতেই পিটপিট করে চোখ খুলল অপরাজিতা। তখনই সে অনুভব করল কোনো শক্তপোক্ত পুরুষের হাতের বাঁধনে আবদ্ধ সে। তখনই তড়িৎ বেগে চোখ মেলে তাকালো সে। পাশ ফিরতেই সে দেখতে পেল নরশদ অতি সাবধানে নিজের শক্ত বাহু দ্বারা আবদ্ধ করে রেখেছে তাকে।
অপরাজিতা এক ঝটকায় নরশদের হাত ছাড়িয়ে দিতে গেল কিন্তু তার ক্ষীণ শরীরের সবটুকু বল দিয়েও যেন সুঠাম দেহী নরশদকে এক ইঞ্চিও সরাতে পারল না সে বরং নরশদ ঘুমের মধ্যে আরো শক্ত করে ধরল তাকে। বেশ কয়েকবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর অপরাজিতা নিজ থেকেই হাল ছেড়ে দিল।
সে মনে করতে লাগলো কালকে তার সাথে কি কি হয়েছে। তার বিদায় বেলাটা কতটা নিষ্ঠুর ছিল।তার মা একবারও তার দিকে ফিরেও তাকায়নি,আর দাদি তো ব্যস্ত ছিল কথা শোনাতে। শুধুমাত্র রাজ্জাক তালুকদার তাকে নিজের বুকের মাঝে রেখে বলেছিল,, আজ নাকি সে শান্তি পেল। সে নাকি অপরাজিতা কে যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিতে পেরেছে!

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল অপরাজিতার ঠোঁটের কোনে। তার সামনের এই মানুষটা নাকি তার জন্য যোগ্য পাত্র!হাহ! সে যখন এসব চিন্তায় মগ্ন ছিল তখনই হুট করে গাড়ির ব্রেক কষে কেউ। হঠাৎ এমন ব্রেকে সামনের দিকে হেলে পড়তে গেল নরশদ অপরাজিতা দুজনেই। ঘুম ভাঙলো নরশদের। তখনই সিকদার বলল,,
——“চলে এসেছি নরশদ, ভাবিকে সাবধানে নামা।”
সিকদার বাড়ি থেকে নেমে চলে গেল। মূলত অপরাজিতা আর নরশদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় না সে। সে বেরিয়ে যেতেই গাড়ি থেকে নামলো নরশদ। নেমে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়ালো অপরাজিতার দিকে। অপরাজিতা ধরল না নরশদের হাত একা একাই নেমে গেল গাড়ি থেকে। নরশদ গাড়ির দরজা লাগিয়ে, সামনের দিকে এগোলো।
এদিকে অপরাজিতা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের বিশাল আলিশান বাড়ির দিকে। এ যেন কোনো পুরাতন রাজমহল। বিশাল এক বাড়ি, প্রধান গেট খুলে দিতেই তার সামনে উন্মুক্ত হলো বিশাল তিন তলা বাড়িটি। যার সামনে খোদাই করে লেখা খানম কুঞ্জ। তার মানে নরশদরা খানম? বাড়ির সামনে বিশাল বাগান,প্রধান গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত যেতেই অন্তত ১০ মিনিট সময় লাগবে তাদের।
নরশদ বিস্মিত অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে বলল,,

——“আমার সাম্রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম মহারানী! যদিও আমি জানি আমাকে এখনো আপনি মেনে নিতে পারেননি। তবে আল্লাহ যদি চায় ইনশাআল্লাহ আমার পরিবারের মানুষকে মেনে নিতে আপনার অসুবিধা হবে না।”
অপরাজিতা এক ঝলক তাকালো নরশদের দিকে।নরশদ আর কোন কথা না বলে অপরাজিতার হাত শক্ত করে ধরল। অতঃপর দুজন মিলে হাঁটা লাগালো খানম কুঞ্জের দিকে।
বাড়ির ভেতরটা আরো বেশি সুন্দর। বড় বড় স্তম্ভে ঘেরা বিশাল এলাকা বাড়ির মাঝে। তিনতলা ভবনের সম্পূর্ণটাই ঘিরে আছে মাঝের উঠানটাকে। বাড়ির দ্বিতীয় গেট পার হয়ে নরশদ আর অপরাজিতা প্রবেশ করল বাড়ির ভেতর।
বাড়ির মাঝের বিশাল আসনে বসে আছেন এ বাড়ীর মাথা নরশদের বড় ভাই নুরুজ্জামান খানম।পাশে তার সহধর্মিনী মাহেজাবিন মায়া।

নরশদ এ বাড়ির ছোট ছেলে।তার বয়স যখন মাত্র দশ তখনই একটা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তার বাবা মা।তখন থেকেই নুরুজ্জামান খানম তাকে আর তাদের ছোট বোনকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে।আজ পর্যন্ত কখনো সে বড় ভাইয়ের কথার অবাধ্য হয় নি তবে আজ এক দুঃসাহসিক কাজ করে সে দাঁড়িয়েছে ভাইয়ের সামনে।সে কি বলে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
এদিকে মাহেজাবিন অপরাজিতাকে দেখে এগিয়ে আসলেন। নরশদের দিকে ফিরে বললেন,,

——“এটা কে নরশদ? মিশনে গিয়ে কি এবার তবে আমার বোন নিয়ে ফিরলি?”
নরশদ কিছু বলার আগে নুরুজ্জামান খানম বললেন,,
——“কি ব্যাপার নরশদ কথা বলছিস না কেন? মেয়েটি কে?”
নরশদ অপরাজিতার হাত শক্ত করে ধরে কোনোরকম ভনিতা ছাড়া স্পষ্ট কন্ঠে বলল,,
——“আজ পর্যন্ত আমি তোমার কোনো কথার অবাধ্য হই নি ভাইজান। তবে আজ তোমাকে না জানিয়ে আমি জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। যদিও সেটা বাধ্য হয়ে তবে তুমি পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
তারপর অপরাজিতা দিকে ফিরে সে বলল,,
——“ও আমার সহধর্মিনী। অর্নিমা তালুকদার অপরাজিতা।”
নুরুজ্জামান খানম ভাইয়ের এমন দৃঢ়তায় খুশি হয়ে বললেন,,

——“প্রাউড অফ ইউ নরশদ। আই রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ। এই না হলে আমার ভাই! বেশ করেছিস। আর আমাকে জানাস নি এ নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই!”
নরশদ আমার দৃষ্টিতে তাকালেন নুরুজ্জামান খানমের দিকে। কেন অবাক হবে না সে সহ পুরো পরিবার জানে নুরুজ্জামান খানম পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করার কি পরিমান বিরোধী। তবে আজ হঠাৎ তার হলো কি। সবাই যখন তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখন নুরুজ্জামান খানম একগাল হেসে বলল,,
——“কি তোমরা অবাক হচ্ছ? তোমাদের জানামতে আমি পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করার বিরোধী তাই তো? হ্যাঁ আমি বিরোধী তবে সবার ক্ষেত্রে নয়। শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রে যারা নিজে থেকে বিয়ে করে কিন্তু পরে নিজের সহধর্মিনীর মর্যাদা অন্যদের সামনে দিতে ভয় পায়। কিন্তু আমার ভাই তাকে দেখো দৃঢ় চিত্তে আমার সামনে তার সহধর্মনীকে এনে দাঁড়ি করিয়েছে।”
অতঃপর তিনি মহেজাবিনের দিকে ফিরে বললেন,,

——“সব রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা মায়া! আমাদের পারিবারিক যত রিচুয়ালস আছে সব কমপ্লিট হওয়া চাই!”
মাহেজাবিন মুচকি হেসে অপরাজিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন বলল,,
——“ওরে বাবা, আমার দেবদাস ভাই বিয়ে করে আনছে? হায় আল্লাহ কি দেখতেছি! ও যা শুরু করছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল যেখানে বিয়েই করবে না! দেখি দেখি ভাবি সরো তো দেখি কাকে বিয়ে করেছে আমার ভাই?”
মাহেজাবিন মায়া পিছন ঘুরে দেখলেন। নরশদ নিজের ছোট বোনকে দেখে অবাক হয়ে বলল,,
——“ রিফা তুই? কবে আসলি? নাহিয়ান কোথায়?”
তারপর আশেপাশে তাকিয়ে সে বলতে লাগল,,

——“নাহিয়ান, নাহিয়ান!”
নওরিফা খানম এগিয়ে এসে বললেন,,
——“নাহিয়ান তোমার কথাই বলছিল ভাইয়া। এখন ঘুমিয়ে আছে। তার আগে দেখি আমার চাঁদ বরন ভাবী টা কই?”
সে এগিয়ে এসে অপরাজিতার দিকে তাকালো। অপরাজিতা ডাবল ডাগর মধুরঙা চোখ,আর লাবণ্যময়ী মুখশ্রী পানে তাকিয়ে নওরিফা বলল,,
——“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ! আমার ভাইয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে!”
মাহেজাবিন:“আসিলেও রে রিফা নরশদের পছন্দ আছে। কি মিষ্টি দেখতে?”
অপরাজিতা নরশদের পরিবারের সবার এমন আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। নওরিফা খানম তার লাবণ্যময়ী মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলল,,

——“শুনলাম তোমার নাম নাকি অপরাজিতা? আমি তোমাকে নাম ধরেই ডাকলাম। মনে তো হয়না তুমি আমার থেকে বয়সে বড় হবে। বরং আমিই বড়!”
তারা যখন কথা বলছিল ঠিক তখনই কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলো ছোট্ট নাহিয়ান। নরশদকে দেখে সোজা দৌড়ে এসে তার কলে চড়ে বলল,,
——“তুমি কোথায় ছিলে মামু? জানো আমি কত খুঁজেছি তোমায়?”
নরশদ নাহিয়ানের মুখশ্রী স্নেহের চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে বললো,,
——“আমি কাজে গিয়েছিলাম বাবা!”
সাত বছর বয়সী ছোট্ট নাহিয়ান ছোটমামু বলতে পাগল। নরশদও নিজের প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসে নাহিয়ানকে।ইমতিয়াজ চৌধুরীর খাতিরে নাহিয়ানরা কানাডায় থাকে, ফলে হয়তো বছরে এক থেকে দুইবার দেশে আসে তারা। আর যখনই দেশে আসে তখনই নাহিয়ান নাওয়া খাওয়া ভুলে সার্বক্ষণ নরশদের কাছে পড়ে থাকে।
তাদের কথা শেষে মাহেজাবিন মায়া আর নওরিফা খানম অপরাজিতাকে নরশদের রুমের দিকে নিয়ে গেলেন।

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। প্রখর রৌদ্রতাপ যেন নিস্তব্ধ শীতলতায় রূপ নিবে কিছুক্ষণ বাদেও। বিশাল রুমের জানলার পর্দা সরিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অপরাজিতা। বাইরে থেকে দেশে আসছে বিভিন্ন লেকের জলরাশির কল কল শব্দ, মাঝে মাঝে জাফলং এর দূর পাহাড় থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ যেন মন কেড়ে নিচ্ছে।
অপরাজিতা খানম পরিবারের সবার আচরণে মুগ্ধ। সবাই তাকে এতটা আপন করে নিয়েছে যেন অপরাজিতা তাদের বহুদিনের চেনা। সবার আচরণে মুগ্ধ হলেও অপরাজিতা ক্ষিপ্ত নরশদে প্রতি। কেন তার জীবনটা এরকম করলো নরশদ। আর কি বা তার পেশা? কোন কারণে সেদিন এতগুলো মানুষকে হত্যার আদেশ দিচ্ছিল সে? এরকম নানা চিন্তা যখন তার মনের মাঝে হানা দিচ্ছিল ঠিক তখনই সে আবিষ্কার করল তার পিছনে দাঁড়িয়েছে কেউ।
এক মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালো সে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে নরশদ।নরশদকে দেখে অপরাজিতা সরে যেতে গেলেই নরশদ তাকে ডেকে বলে,,

——“অপরাজিতা?”
অপরাজিতা পিছন ঘুরে ক্ষিপ্র কন্ঠে বলল,,
——“দেখুন আপনাকে আমি কিছু বলিনি তার মানে এই নয় যে আপনাকে আমি কিছু বলবো না। নিঃসন্দেহে আপনার পরিবারে মানুষগুলো অনেক ভালো। তারমানে এই নয় যে আমি আমার সাথে হওয়া আচরণ গুলো ভুলে যাবো। দয়া করে আমার উপর স্বামীর কর্তৃত্ব ফলাতে আসবেন না।লাভ হবে না, কারণ যে কলঙ্কের অধিকারী নিয়ে আপনি আমায় করেছেন, তারপর হয়তো জীবনের কোনো পর্যায়ে আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না।”
তার কথা বলা শেষে নরশদ বলল,,

——“তোমার কথা বলা শেষ হয়েছে?”
অপরাজিতা:“জ্বী!”
নরশদ:“তাহলে এবার আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। ফার্স্ট অফ অল তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা আমার একদমই ছিল না। ঐদিন তুমি যদি আমার পিছু না নিতে তাহলে হয়তো তুমি এক প্রান্তে থাকতে আমি অন্য প্রান্তে। সেকেন্ডলি তখন যদি আমি তোমায় বিয়ে করে না বাঁচাতাম তাহলে তুমি এতক্ষণে হয়তো এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আমার সাথে তর্ক করতে পারতে না। অ্যান্ড লাস্ট এন্ড মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি আমার উপর ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকবে আর আমিও সেটা থাকতে দেবো। তাহলে সে চিন্তা ভুলে যাও,কেন না বিয়ে যখন করেছি তখন অবশ্যই স্বামীর কর্তৃত্ব ফলাবো। বিকজ এটা আমার অধিকার। চার কালিমার মাধ্যমে তোমাকে আপন করেছি আমি সো আমার অধিকার আমি ফলাতে পারবো কি পারবো না । সেটা নিশ্চয়ই তোমার কাছ থেকে শুনবো না?”

অপরাজিতা:“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? ঐদিন আপনার পিছনে আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি? আপনার ঐ মানুষরূপী জানোয়ারটা আমার সামনে প্রকাশ ঘটে গিয়েছে তাই? আপনার মতো মানুষরূপী জানোয়ারকে আমি ভয় পাই না! এটা আমি খুব ভালো করেই জানি আপনার মতো মানুষ মেয়েদেরকে কতটুকু সম্মান করতে পারে! তাই আপনার থেকে আমি সম্মান এক্সপেক্টও করি না!”
নরশদ:“হোয়াট ইউ মিন বাই ঐ ধরনের মানুষ?তুমি আমাকে কি মনে কর হে?”
অপরাজিতা:“আপনি যা আপনাকে ঠিক তাই মনে করি আমি!”
নরশদ:“হোল্ড অন হোল্ড অন! তুমি আমাকে কে ঐসব…ওহ শিট!সেটা তুমি আমাকে আগে বলবে না!”
নরশদ আর কোন কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল আলমারির দিকে।অপরাজিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার থেকে। হুট করে এই লোকটার হলো টা কি? অপরাজিতা কিছু বলার আগেই নরশদ একটা আইডেন্টিটি কার্ড এনে তার সামনে ধরে বলল,,

——“আমি সিআইডি অফিসার নরশদ খানম। অফিসার এন কে! আই থিঙ্ক তুমি নাম শুনেছো? আর আমি একটা মিশনের কাছে তোমাদের এলাকায় গিয়েছিলাম! মিশন টা সিক্রেট ছিল এজন্য আত্মগোপন করে রেখেছিলাম।যদিও আমি তাতে সাকসেস হয়েছি আর ঐদিন আমি অপরাধীদের মার্ডার দেখছিলাম আর হয়তো তুমি ভেবেছ..”
অপরাজিতা অবাক কণ্ঠে বললো,,

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫১

——“আপনি অফিসার এন কে?”
নরশদ:“জ্বী ম্যাম! আমিই অফিসার এনকে। আর বর্তমানে আপনি মিসেস এন কে!”
অপরাজিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মানে ঐদিন নরশদ অপরাধীদের মা*রা*র অর্ডার দিচ্ছিল আর অপরাজিতা কি ভাবলো? নিজের বোকামির জন্য নিজের উপর নিজেরই রাগ হলে অপরাজিতার।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৩