মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৪
নওরিন কবির তিশা
দুইটি বসন্ত পার হয়ে গেল, তার হিসাব কে রাখে! কত শত ঋতুর আনাগোনা, কত অগণিত শতকের পদধ্বনি। কত হাসি, কত কৌতুকে মুখর হয়েছে দিন। আবার কত বিষাদ আর বিরহের অশ্রুধারা মিশে গেছে কালের সমুদ্রে। সব যেন এক বৃহৎ ছবি, যার প্রত্যেকটি রেখা সময়ের হাতের স্পর্শে একেকটি গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই ছবি কখনো উজ্জ্বল রোদ্দুরের মতো ঝলমল করে, আবার কখনো মেঘলা দিনের বিষণ্ণতাকে মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি সুর, যা জীবনের মহাগানে মিশে গিয়ে এক অনন্ত ঐক্যতান রচনা করে চলেছে।
কক্ষের পাশের লাইব্রেরী টাতে বসে স্বভাবসুলভ সারা দিনের কর্মকাণ্ড,ডায়েরিটাতে নোট করছিলো অপরাজিতা। তার বহু পুরাতন অভ্যাস এটি। ডায়েরি খানা ভারী সুন্দর একেবারে নীল অপরাজিতা রঙ্গা, তার ওপর স্বর্ণালী অক্ষরে খোদাই করে লেখা আমার অপরাজিতার জন্য। ডায়েরিটা যতটা না সুন্দর তার থেকেও বেশি এর বিশেষত্ব,ডায়েরিসহ গোটা এই লাইব্রেরীটা অপরাজিতা কে নিজেদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে উপহারস্বরূপ দিয়েছিল নরশদ।
তখন থেকেই একটা বাজে অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে তার। প্রতিদিন রাতে অন্তত একটা উপন্যাসের বই তাকে পড়তেই হবে অতঃপর দিনের কর্মকাণ্ডগুলো ডায়েরিটাতে নোট করে তবেই দিনের সকল কাজের সমাপ্তি ঘোষনা করে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুইটা বছর। অপরাজিতা আর নরশদের কোল আলো করে প্রায় মাস পাঁচেক আগে এসেছে এক ছোট্ট রাজকন্যা, নরশদ ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে নওয়ার। পুরো নাম নওয়ার খানম হলেও নরশদ সহ বাড়ির পথ থেকে তাকে ভালোবেসে নুয়া বলে ডাকে। এদিকে বিয়ের চার মাস পরেই রোদেলা জানতে পেরেছিল সে অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভাবস্থার তিন মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই এক নির্মম ভুলের তাড়নায় জীবন-কুঁড়িটি অসময়ে ঝরে গেল।
তারপর থেকেই বহু চেষ্টা করেও কোন ফল পাইনি রোদেলারা। অবশেষে এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে,নিয়তির এই নির্মম পরিহাস কে হেসে মেনে নিয়েছে তারা। তবে অপরাজিতা কখনোই রোদেলা কে মাতৃশূন্যতা অনুভব করতে দেয়নি। নওয়ার যতক্ষণ না তাদের কাছে থাকে তার থেকে বেশি সময় রোদেলার কাছেই থাকে সে,রোদেলাও প্রায় সার্বক্ষণই খানম কুঞ্জেই থাকে।
অতীতের।স্মৃতির পাতার থেকে বের হয়ে কলমটা ডায়রির ভিতরে রেখেই দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে গেল অপরাজিতা। কাল থেকে শুরু হবে নতুন তোড়জোর;আর মাত্র এক সপ্তাহ বাদে নিহিলের বিয়ে।
মেয়ে অবশ্য নিহিলের নিজেরই পছন্দ করা। অস্ট্রেলিয়ায় একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো তারা। এখন দুইজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেদেরকে আপন করে নেওয়ার। তাই তাতে আর বাঁধা হননি নুরুজ্জামান খানম। নিঃশব্দে তিনি মেনে নিয়েছেন সবটা। অবশ্যই এর পেছনে নরশদ আর অপরাজিতার অবদানও কম নয়! বলতে গেলে একপ্রকার অপরাজিতার কথাতেই রাজি হয়েছেন নুরুজ্জামান খানম!
রুমে প্রবেশ করেই অপরাজিতা দেখতে পায় নরশদের হাত নিয়ে খেলছে ছোট্ট নওয়ার।বাবা প্রেমী মেয়েটার বাবাকে হলে আর কাউকে লাগেনা।নরশদও সারাক্ষণ মেয়ের চিন্তায় মশগুল। সিআইডি ব্যুরোতে থাকাকালীনও প্রায় ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর ফোন দিয়ে মেয়ের খবর নেয় সে।
নরশদ মেয়ের সাথে কথা বলছে,খেলছে মাঝে মাঝে চুমুতে ভরিয়ে তুলছে ছোট্ট নুয়ার মুখশ্রী। নুয়াও হেসে কুটি কুটি। দরজা খুলে এমন মনমুগ্ধকর দৃশ্যে মুচকি হাসলো অপরাজিতা। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটা মেয়ের জীবনে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য হয়তো আর হতে পারে না!
কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছে নুয়া। অপরাজিতাও প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমানোর। কালকে সকাল থেকেই শুরু হবে ব্যাপক কাজের চাপ। কালকে নিহিলের হলুদের ডেকোরেশনের জন্য কিছু লোকজন আসবে। হলুদের আয়োজন করা হয়েছে আরো ২ দিন বাদে। কারণ যার হলুদ সেই তো দেশে নেই। একেবারে বউ নিয়ে তবে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবে নিহিল।আর তারপরের দিনই কানাডা থেকে ফিরবে নওরিফারা। যদিও তার আসার কথা কাল সকাল দশটায় তবে একটা সমস্যার দরুন ফ্লাইট মিস হয়ে গেছে তাদের।
অতঃপর বাংলাদেশে বড় করে বিবাহ আয়োজিত হবে তাদের। সময়টা ধরা বাধা। দুইদিন আগেই ঈদুল ফিতর থাকায় বাড়ির জনসংখ্যা প্রায় শূন্য। সবাই ঈদের ছুটিতে যে যার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।
অপরাজিতা ঘুমানোর জন্য রুমের আলো নেভানোর আগে নরশদের দিকে একবার তাকালো।তার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট। অপরাজিতা খুব ভালো করে জানে এই দুশ্চিন্তার কারণ। সে নরশদের হাতের উপর হাত রেখে বলে,,
——“চিন্তা করিয়েন না,নরশদ! ইনশাআল্লাহ যা হবে ভালোই হবে। আর আপনি যে কাজটা করছেন সেটা তো খারাপ নয়। আল্লাহ সব সময় তার ভালো বান্দার সকল ভালো কাজে সাহায্য করে।”
নরশদ অপরাজিতার হাতটার উপর নিজের আরেক হাত রেখে বলল,,
——“এটা আমি খুব ভালো করেই জানি তিলোত্তমা। তবে আমার চিন্তা তোমাকে আর আমার রাজকন্যাকে নিয়ে। ওরা যদি কোন রকমে জেনে ফেলে যে রেকর্ডিংটা আমার কাছে আছে। তাহলে জানিনা ওরা আমার সাথে ঠিক কি কি করবে? যতক্ষণ না আমি ফুটেজটা ব্যুরোতে জমা দিতে পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই!”
অপরাজিতা তার থেকে ফিরে বিশ্বাসের হাসি হেসে বলল,,
——“আমার আপনার উপর বিশ্বাস আছে নরশদ। আপনি থাকতে আমার আর নুয়ার কখনো কোনো ক্ষতি হবে না।”
নরশদ যেন অপরাজিতার এমন কথায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো। অপরাজিতার ললাটে দীর্ঘ এক প্রেম পরশ এঁকে দিয়ে বলল,,
——“ইনশাআল্লাহ!”
দীর্ঘ প্রেম পরশ শেষে কিছুক্ষণ পর অপরাজিতা মিহি কন্ঠের নরশদের দিকে ফিরে বলল,,
——“ভাবছি, কালকে সকাল সকাল রোদকে একবার আসতে বলব। নুয়াকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে বলব।”
নরশদ:“কেন?”
অপরাজিতা: “আপনি তো জানেনই নুয়া কি পরিমাণ সেন্সিটিভ। এত লোকজনের ভিতরে আমি ওকে টাইম দিতে পারব না। আপনিও তো কালকে ব্যস্ত থাকবেন। আর ভাইয়া ভাবিও ভীষণ ব্যস্ত। ওতো আবার অপরিচিত কারো কাছে থাকে না কান্নাকাটি করে। তার ওপর ওর প্রচুর স্কিন এলার্জী;এই গরমে ভীষণ কষ্ট হবে ওর। তাই ভাবছি কালকে ওকে রোদের বাসায় রেখে এসে,সন্ধ্যায় গিয়ে নিয়ে আসবো। এমনিতেও ওতো এখন বাইরের খাবার কিছুটা খেতে পারে। সকালে কে ফিডিং করিয়ে দিয়ে আসবো তারপর বিকালে ডেকোরেশন এর লোকজন চলে গেলে নিয়ে আসবো।”
নরশদ প্রথমে রাজি না হলেও। পরে নিজের মেয়ের কথা চিন্তা করে, সম্মত হলো।
সকাল গড়িয়ে দুপুর,ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে বারোটা। বাড়ি চলে ডেকোরেশন এর লোকজনে ভর্তি।নরশদ আর নুরুজ্জামান খানম তদারকি করছেন সকল সাজসজ্জার। বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। কোনো খামতি চান না তারা।
এদিকে মাহেজাবিন মায়া, অপরাজিতা সহ বাড়ির কিছু আত্মীয়-স্বজন ব্যস্ত বিয়ের তত্ত্ব নিয়ে। যদিও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এগুলো তত একটা প্রচলিত নয়। তবে কনে পক্ষ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হওয়ায় এগুলোতের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললেও খাবারের দিকে বেশি একটা নজর নেই কারো। যেহেতু বিয়ে বাড়ির আয়োজন তাই আত্মীয়-স্বজন নেহাতই কম নয়। এত লোকজনের জন্য রান্নাবান্না সেই সাথে বিয়ে বাড়ির কাজ করা বেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠতো মায়া আর অপরাজিতার পক্ষে। তাই নুরুজ্জামান খানম একটা বাবুর্চি দল ঠিক করেছে সমস্ত রান্নাবান্নার জন্য।
আজানের কিছু পরে গোসল আর নামাজ-কালাম শেষে। সবাই আয়েশ করে খেতে বসেছে খানম বাড়ির বিশাল রান্না ঘরের সামনের বড় খাবার টেবিলে।আয়োজন করা হয়েছে বাহারি রকম খাবারের। সকলকে একসঙ্গে খাবার পরিবেশন করল মাহেজাবিন মায়া। পরিবেশনার কাজ সব দিন মাহেজাবিন মায়া নিজ হাতে সামলান।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই একটু বিশ্রামের জন্য বড় কক্ষের দিকে গেল। কেন জানি খাওয়ার পর থেকেই মাথা ঝিমঝিম করছে সবার। ঝিমুনি একসময় তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নিতে শুরু করে, তন্দ্রাচ্ছন্নতা ঘিরে বসল সবাইকে। একে একে ঘুমিয়ে পড়ে বাড়ির সব কয়টা লোকজন।
অপরাজিতা নিহিলের স্টাডি রুমে বসে টেলিফোনে রোদেলা সাথে কথা নুয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন খোঁজখবর নেওয়া শেষে,ফোন রেখে সে রুমের বাইরে আসলো। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে ড্রয়িং রুমে সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে নরশদ। এমন তো কখনো করেনা সে। তবে কি ক্লান্তি টা আজকে একটু বেশিই?
অপরাজিতা নিচে পড়ে থাকা কুশন দুটির একটি নরশদের মাথার নিচে, আর একটা ডানপাশে ভালো করে রেখে দিল যাতে কিছুটা আরাম করে ঘুমাতে পারে সে। কাজ শেষে অপরাজিতা একবার নরশদের দিকে তাকালো ঘুমন্ত নিষ্পাপ চেহারা তার। অপরাজিতা মুচকি হেসে সেখান থেকে যাওয়ার জন্য দুই পা বাড়াতেই বিকট শব্দ তুলে বাড়ির মেইন গেটটা খুলে দিল কেউ।
হঠাৎ এমন শব্দে কিছুটা কেঁপে উঠল অপরাজিতা। পিছন ঘুরে সে তাকানোর আগেই বাড়ির প্রধান গেট পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করে কিছু দুস্কৃতিকারী। প্রত্যেকের হাতেই বন্দুক, ছু*রি সহ প্রা*ণ*ঘা*তী অস্ত্র। অপরাজিতা কি করবে বুঝতে পারল না নরশদকে দুই তিনবার ঝাঁকুনি দিলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার।
অপরাজিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই। উপায়ান্তু না পেয়ে সে সোফার নিচে নিজেকে আড়াল করে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকাতে এসে দেখতে পেল পুরো অন্দরমহলটাকে ঘিরে রেখেছে পাঁচ-দশ জন দুষ্কৃতিকারীর এক দল। তাদের মধ্যিখানে দাঁড়ানো এক সুঠামদেহি বিশাল আকার পুরুষ।
দেখতে বড় ভয়ানক লাগে তাকে, চোখগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে, যেন কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে, মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফে,যেন বহুকাল ধরে পরিষ্কার না করা এক বৃহৎ জঙ্গল, পুরু ঠোঁটের অধিকারী পুরুষটি আশেপাশে তাকিয়ে বিক্ষিপ্ত নয়নে কি যেনো খুঁজছে। তার পাশে দাঁড়ানো লোকের ভাষ্যমতে উনিই দলীয় প্রধান।
তাদের মধ্যে থেকে একটা লোক হঠাৎই নিজের পিছন থেকে তীক্ষ্ণ ধার যুক্ত একটা ছু*রি বের করে,এগিয়ে আসে নরশদের দিকে। অপরাজিতার হৃদ যন্ত্র টা বেগতিক হারে কাঁপছে। এই বুঝি কোনো বড় সর্বনাশ ঘটে যায়! তবে লোকটা নরশদের বুকের মাঝে ছু*রি বসানোর আগে প্রধান লোকটি নির্দেশের স্বরে বলে,,
——“অহনই মারিস না। ওরে বাঁচায় রাখন লাগবো। ওর মুখে পানির ঝাপটা দে।”
অপরাজিতা অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। পাশ থেকে হাতরে কিছু একটা তুলে যখনই উঠতে যাবে সে।তৎক্ষণাৎ তার ওড়না চেপে ধরে কেউ। ভীত নয়নে পিছনে তাকাতেই সে দেখতে পায় তার পিছনে বসে আছে দলীয় প্রধান নামে খ্যাত সেই ব্যক্তিটি। ভয় কেঁপে ওঠে অপরাজিতা। তা দেখে লোকটি বাঁকা হেসে বলে,,
——“কি ভেবেছিলে সুন্দরী? এই ছোট্ট ছোট্ট নরম হাত দিয়ে আমাকে মা*র*বে?”
কথাটা বলেই লোকটি অপরাজিতার হাত ধরতেই, তীব্র বিদ্বেষেরসহীত হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো অপরাজিতা। লাভ হলো না তাতে বরং দানব আকৃতির সেই মানবটি আরো শক্ত করে চেপে ধরল অপরাজিতার হাত। অতঃপর তাকে টান দিয়ে উঠিয়ে এনে নরশদের সামনে দাঁড়ালো।
এদিকে দলীয় লোকটি প্রধানের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়া মাত্র রান্নাঘর থেকে বিশাল এক পানির জগ এনে ঢেলে দিল নরশদের মুখে।কিছুক্ষণ পর চোখ পিটপিট করে খুলল নরশদ।তা দেখে দলীয় প্রধান ব্যক্তিটি বলল,,
——“কি ব্যাপার অফিসার এন কে? বিয়ে করে নিয়েছেন, তারপরও আমার পিছন ছারলেন না! কি দরকার ছিল? বিয়ে করেছেন একটা সুখী পরিবার গড়তে পারতেন! তা না! সেই আমার পিছনে লাগলেন।ছ্যা!”
নরশদ হালকা চোখ মেলে তাকাতেই চারিপাশটা ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা আবিষ্কার করল। কিছুক্ষণ পর চারিপাশ কিছুটা পরিষ্কার হতেই সে দেখতে পেল তার অপরাজিতার হাত বন্দী বিশ্রী দেখতে সেই লোকটির হাতে। তৎক্ষণাৎ সোফা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু এই চেষ্টা যেন নেহাতই বৃথা। শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না সে। তবুও গলার জোর তুঙ্গে তুলে সে বলল,,
——“ওকে ছেড়ে দে এরশাদ! এর ফল কিন্তু ভালো হবে না!”
লোকটি অর্থাৎ এরশাদ বাঁকা হেসে বলল,,
——“ভালো কি খারাপ হবে তা তো পরে দেখা যাবে! আপাতত আপনার বউকে আমার মিনিট ত্রিশের জন্য হলেও লাগবে! এরকম হুরপরি তো আর চোখের সামনে পেয়ে ছুঁড়ে ফেলা যায় না!”
নরশদ নিজের প্রিয়তমাকে নিয়ে এমন বাজে ইঙ্গিতে সামলাতে পারল না নিজেকে। সর্বশক্তি দিয়ে সোফা থেকে উঠে লোকটাকে এক ধাক্কা মারলো সে। কিন্তু তার সর্ব শক্তি প্রয়োগকৃত ধাক্কাতেও যেন এক চুলও নড়লো না এরশাদ। বরং বাঁকা হেসে বলল,,
——“আপাতত আপনার শরীরে বে*ন*জো*ডি*য়া*জে*পি*ন*স প্রয়োগ করা হয়েছে অফিসার এনকে! তাই আপনি সারাদিন ধরে লাফালাফি করলেও আমাকে এক চুলও সরাতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা আমাকে আপনিই ক্ষেপিয়েছেন। কি দরকার ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে আমার পিছনে লোক লাগানো। আপনি আপনার মত ভালো ছিলেন আমি আমার মত। তাও! এই বেশি বেশি খেতে চাওয়াই কাল হলো তো?”
শরীরের সায় না পেলেও তখন অনড় নরশদ। কন্ঠে ঝরে পড়ছে আগুনের ফুলকি। বাজ পাখির ন্যায় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সে বলল,,
——“তুই বাঁচতে পারবি না এরশাদ? ছেড়ে দে ওকে! ছেড়ে দে বলছি!”
এরশাদ:“তোকে তো আগেই বললাম তোর বউকে ৩০ মিনিটের জন্য হলেও আমার লাগবে। ৩০ মিনিট না হয়তো একটু বিশ্রাম কর।”
কথাটা বলেই এরশাদ দলীয় লোকজনকে আদেশ দিল নরশদকে বেঁধে রাখার জন্য। নরশদ নিজেকে তাদের হাত থেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু ক্রমেই তার শরীর ভেঙে আসছিল। এমন স্বাস্থ্যবান সমর্থক একাধিক পুরুষের সাথে নিজের ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না সে। মিইয়ে পড়লো শীতের গোধূলির ক্ষীণ আলোর ন্যায়।
সেদিন খানম বাড়ির আঙিনায় যেন নেমে এসেছিল এক টুকরা জাহান্নাম। নরশদের সামনেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক মানুষরূপী দানবীয় পশু। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছি*ড়ে খেয়েছিল তার তিলোত্তমাকে।নরশদ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি হিসেবে আবিষ্কার করেছিল সেদিন। যার চোখের সামনে তার প্রিয়তমাকে খু*ব*লে খাচ্ছেন ন*র*প*শু*রা।
অপরাজিতার চিৎকারে সেদিন কেঁপে উঠেছিল খানম বাড়ির প্রতিটা ভীত। জড় বস্তুগুলো যেন নিঃশব্দ হৃদয়ভারে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। ধীরে ধীরে একসময় অপরাজিতা লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে;তখনও থামেনি ন*র*প*শু*টি। তবে ততক্ষণে তীক্ষ্ণ ছুরিকাঘাতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে বিদায় নিয়েছে নরশদ খানম।
প্রায় ৪০ মিনিট পর থামে সে। ততক্ষণে তার দলীয় লোকজন নরশদের লোকের ধারনকৃত ভিডিও ফুটেজ, আর অন্যান্য সকল রেকর্ডিং নিয়ে হাজির হয়েছে। এরশাদ মেঝের উপর থেকে বস্ত্র নিয়ে নিজের শরীরে জড়ায়। অতঃপর একবার তাকায় সামনে। যেখানে শায়িত আছে এক জোড়া কপতো-কপতি। এরশাদ পাশের একজনের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে ফের দুইবার আঘাত করে নরশদের বক্ষ পিঞ্জিরার মাঝ বরাবর।
র*ক্ত ছি*ট*কে এসে মুখে লাগে তার। এক প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।সে দলীয় লোকজনের দিকে ফিরে বলে,,
——“বাকি কয়টারে মারছোস নি?”
দলীয় জা*নো*য়া*র*রা সম্মতি মূলক মাথা নাড়ায়। যার অর্থ বেঁচে নেই খানম পরিবারের আর কেউ। জাফলং এর বুক থেকে মুছে গেছে খানম পরিবারের অস্তিত্ব!অতঃপর এক প্রসন্নচেতা ফুরফুরে মন নিয়ে এরশাদ স্বদলবলে বেরিয়ে যায় খানম কুঞ্জ ছাড়িয়ে।
তবে সৌভাগ্যবশত তখনো বেঁচে ছিলো অপরাজিতা। কোনমতে নিজের ছি*ন্ন*ভি*ন্ন শরীরটাকে টেনে স্টাডি রুমের কাছে এসে একটা ছেঁড়া কাগজে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর কাছে অপটু হাতে খাপছাড়া এক চিঠি লিখে সে। অতঃপর ফিরে আসে নিজের প্রাণ প্রিয় স্বামীর কাছে, অশ্রুসিক্ত নয়ন নিয়ে হাত বুলায় নরশদের ছুরির আঘাতে ছি*ন্ন*ভি*ন্ন বক্ষদেশ। অতঃপর সেখানে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অপরাজিতা।
থেমে যায় তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের পদচারনা, প্রাণবন্ত খানম কুঞ্জে নেমে আসে এক ভয়াল স্থবিরতা।
পুলিশ আসে আরও ঘন্টা খানেক বাদে। খানম কুঞ্জ থেকে একে একে বের হয় দশখানা লা*শ। তারাই রোদেলাকে দেয় তার প্রাণ সখীর ছিন্নভিন্ন হাতে লেখা চিঠিখানা। সেদিন থেকেই বদলে যায় তাদের জীবন ব্যবস্থা। নওয়ার খানম হয়ে উঠে শিশির শাহ। রোদেলা আর সিকদার দুহাতে আগলে রাখে। তাদের প্রিয় বন্ধুর শেষ চিহ্নটাকে।
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৩
এরপরের ঘটনা শিশিরের জানা। এতদিন ধরে নওরিফার মুখে গল্প শুনছিল সে। সেদিন ঐ চিঠি দেখার পর থেকেই ভয়ংকর রকম প্যানিক অ্যাটাক হয় তার। তারপর তার থেকে আর কিছু লুকায়নি নওরিফা। সবটা খুলে বলেছে। এতদিন ধরে গল্পের মাঝে কখনো শিশির হেসেছে, কখনো মন খারাপ করেছে।তবে আজকের ঘটনাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নিজের বাবা-মার এমন পরিণতি শোনার পর স্থির থাকতে পারে না কোঊন মেয়ে। তবে সে শান্ত। এক ফোঁটা পানিও গড়িয়ে পড়েনি তার চোখ বেয়ে। অন্যদিকে নিজের প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের, পরিবারের এমন পরিণতি বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার নওরিফার নয়ন সিক্ত হচ্ছে অশ্রুজলে।