মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫+৬
নওরিন কবির তিশা
🔹 খুলনায়…
চৌধুরী আবাসনে আজ সকাল থেকেই ব্যস্ততা। একে একে বের হচ্ছে গাড়িগুলো, গন্তব্য—ঢাকা।
এক গাড়িতে ইমরান চৌধুরী, ইয়াকুব চৌধুরী ও তাদের স্ত্রী হাসনা খান ও শিউলি হক। সামনে দুই ভাই পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে কথা বলছে, আর পিছনে দুই জা সংসারের গল্পে ব্যস্ত।
কিন্তু খুব ভোরে বেরিয়ে গেছে তিনজন—নির্ঝর, নিঝুম আর ইয়ালিনা।
তারা জানত নাহিয়ান আজ আসবে, কিন্তু আগের রাতেই সে পৌঁছে গেছে! তাই এক মুহূর্ত দেরি না করেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
নির্ঝর ড্রাইভ করছে, নিঝুম জানালার পাশে মাথা রেখে গান শুনছে, আর ইয়ালিনা… তার মুখ গম্ভীর, ঠোঁট চেপে রেখেছে।
নিঝুম হঠাৎ বলে উঠল, “আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কি জানো, নাহিয়ান ভাইয়া এখন কেমন হয়েছে?”
নির্ঝর নির্লিপ্ত গলায় বলল, “আমার কি মনে হয়?”
“মানে… এত বছর পর দেখা হবে, একটু টেনশন লাগছে না?”
“টেনশন কিসের?”
নিঝুম মুখ ফুলিয়ে বলল, “উফ! ভাইয়া, তোমার কি একদম ইমোশন নাই?”
নির্ঝর এবার তাকাল না, শুধু বলল, “যে লোকটা এত বছর পর দেশে আসছে, সে কি আদৌ আগের মতো থাকবে?”
গাড়ির পেছন থেকে ইয়ালিনা কড়া গলায় বলল, “আর যদি না থাকে, তাহলে খুব ভালো হয়!”
নিঝুম আর নির্ঝর চুপ হয়ে গেল।
গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল ঢাকার পথে…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
🔹 ঢাকা…
কলিংবেল বাজতেই শিশির দৌড়ে দরজা খুলল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর!
“নুয়া আপু!!”
শিশির নিঝুমকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন আছিস নিঝু?”
“আমি ভালো আছি! তুমি কেমন আছো, নুয়া আপু?”
“আমি-ও ভালো।”
“তোরা কী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি, নাকি আমাকে ভিতরে আসতে দিবি?”
পিছন থেকে ক্লান্ত গলায় নির্ঝর বলল, যার কণ্ঠ শুনে নিঝুম আর শিশির হেসে ফেলল।
অন্যদিকে, ইয়ালিনা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। মনে মনে বলল, “আবার শুরু হলো এদের নাটক!”
তার মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল, আর এই ভালোবাসা-দেখানো দৃশ্য যেন তাকে আরও রাগিয়ে তুলল। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা ‘চッ’ শব্দ বের হলো।
ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন নওরিফা খানম আর ইমতিয়াজ চৌধুরী। সবাইকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
“কী ব্যাপার, লিনা? সবাই ভেতরে চলে গেল, তুই এখানেই দাঁড়িয়ে?”
ইয়ালিনা ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “তোমার তো নুয়া আছে, আমাকে দরকার কী?”
নওরিফা খানম হেসে বললেন, “তুই এখনো নুয়াকে হিংসা করিস?”
ইয়ালিনা কিছু বলার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল।
তহুরা দরজা খুলতেই চৌধুরী বাড়ির বাকিরা এসে পৌঁছাল।
🔹 কিছুক্ষণ পর…
সকালে সকলে নাস্তা করে যে যার মতন রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেল। কিন্তু শিশির আর নিঝুম তখনও গল্পে ব্যস্ত।
ঠিক তখনই নির্ঝরের ফোন বেজে উঠল।
কলের আইডি: “Principal – Khulna City College”
নির্ঝর ফোন রিসিভ করল, “সালাম স্যার, সরি, আমি আপনার কল মিস করেছি।”
“ইট’স ওকে, মিস্টার নির্ঝর। আমি শুধু কনফার্ম করতে চেয়েছিলাম যে, আপনি দুদিনের ছুটিতে আছেন, তাই তো?”
“জি স্যার, আমার কাজিন দেশে ফিরেছে, তাই হুট করেই আমাকে আসতে হয়েছে। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট!”
“নো প্রবলেম। এনজয় ইয়োর টাইম।”
ফোন রেখে নির্ঝর ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো।
🔹 খুলনায়…
সকালবেলা খুলনা সিটি কলেজের করিডোরে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে।
“নির্ঝর স্যার আজ ক্লাস নেবেন না!”
প্রথম বর্ষের ক্লাসরুমে বসে থাকা ফারিন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সারাদিন ওর মাথার ওপর সেই রাগী, গম্ভীর নির্ঝর স্যার থাকবেন না—এটা যেন তার জন্য বিশাল মুক্তির খবর!
🔹 কয়েকদিন আগের ঘটনা…
খুলনা শহরের আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছিল।
ফারিন মুস্তাফার জন্য দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ—কলেজের প্রথম ক্লাস!
কিন্তু দুর্ভাগ্য! সে যে গাড়িতে করে আসছিল, সেটার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল মাঝপথে!
“আল্লাহ! প্রথম দিনেই লেট হয়ে যাবে!”
শহরে সে একেবারেই নতুন, কাউকে চেনে না।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। কিন্তু আশপাশে আর কোনো যানবাহন নেই।
কলেজ পর্যন্ত হাঁটতে গেলে কমপক্ষে ৩০ মিনিট লাগবে, অথচ ক্লাস শুরু হতে বাকি মাত্র ২০ মিনিট!
ঠিক তখনই, দূর থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখল।
একটা কালো রঙের গাড়ি, সামনে একজন পুরুষ নিজেই ড্রাইভ করছে।
ফারিন দ্বিধা করল কিছুক্ষণ, তারপর হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।
গাড়ি ধীরে ধীরে ব্রেক কষল, জানালাটা একটু নামল।
ভিতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল—ঠান্ডা, গভীর, অথচ রহস্যময়,
“কি ব্যাপার? রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
ফারিন তাড়াতাড়ি বলল,
“ভাইয়া, আজ আমার কলেজে প্রথম ক্লাস! কিন্তু আমি যে গাড়িতে আসছিলাম, সেটার ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এখানে নতুন, কাউকে চিনি না… আমাকে কি একটু লিফট দিতে পারবেন?”
গাড়ির ভেতরে থাকা পুরুষটি কপাল কুঁচকে তাকাল, তারপর প্রশ্ন করল,
“কোন কলেজ?”
“খুলনা সিটি কলেজ!”
একটা মুহূর্ত নীরবতা…
তারপর সে ধীর কণ্ঠে বলল,
“উঠুন।”
ফারিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসল।
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! আপনার জন্যই আজকে প্রথম ক্লাস মিস হবে না!”
গাড়ি চলতে লাগল, পুরুষটি সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে, তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই।
ফারিন কৌতূহল সামলাতে পারল না।
“আচ্ছা ভাইয়া, আপনিও তো মনে হচ্ছে কোথাও যাচ্ছিলেন?”
লোকটি একপলক তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমিও খুলনা সিটি কলেজে যাচ্ছি।”
ফারিন এবার উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“ওহ! তাহলে আপনি আমাদের কলেজের সিনিয়র ভাই!”
লোকটি কিছু বলল না।
গাড়ির গতি একটু বাড়ল।
ফারিন মনে মনে হাসল।
“মনে হচ্ছে এই ভাইয়া একটু বেশি সিরিয়াস টাইপের!”
তখনই সে বলল তার পাশে বসা এক সিনিয়র ভাই বলছিল,
“আমাদের কলেজে নির্ঝর স্যার নামে এক ভয়ংকর প্রফেসর আছে! তিনি খুব রাগী! অকারণে বকা দেন, স্টুডেন্টদের অপমান করতে ছাড়েন না!”
গাড়ির স্পিড আরও একটু বেড়ে গেল…
ফারিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া, শুনলাম আমাদের কলেজে একটা গণিতের প্রফেসর আছেন, নির্ঝর চৌধুরী। উনি নাকি প্রচণ্ড রগচটা!”
গাড়ির গতি এবার আরও একটু বাড়ল…
ফারিন আরও বলল,
“আমার পাশে যে ভাইয়া ছিল, সে বলল, উনি কারণে-অকারণে স্টুডেন্টদের অপদস্ত করেন! আসলেই কি সেরকম?”
গাড়ির গতি আরও বেড়ে গেল, পুরুষটি এবার শক্তভাবে স্টিয়ারিং ধরল।
ফারিন একটু ভ্রু কুঁচকাল, “কেন যেন মনে হচ্ছে এই ভাইয়া এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না!”
সে নির্লিপ্তভাবে বলল,
“আমি কিন্তু অন্যায় সহ্য করি না! যদি উনি আমার সঙ্গে এরকম কিছু করেন, তাহলে পুরো খবর নিয়ে ছাড়ব!”
ঠিক তখনই, গাড়ি সজোরে ব্রেক করল!
ফারিন হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ে যেতে লাগল, তখনই লোকটি ঠান্ডা স্বরে বলল,
“চলে এসেছি খুলনা সিটি কলেজ।”
গাড়ি থেকে নামতেই ফারিন এক গভীর শ্বাস নিল।
প্রথম দিন!
তার সামনে বিশাল খুলনা সিটি কলেজের ক্যাম্পাস।
চারপাশে ছড়ানো সবুজ গাছপালা, পুরনো অথচ রাজকীয় বিল্ডিং। ব্রিটিশ আমলের লালচে ইটের স্থাপত্যশৈলী মিশ্রিত এই কলেজ যেন একদম অন্যরকম। বিশাল গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই রাস্তার দুই পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া, বকুল আর রাধাচূড়া গাছ।
তারপরও আজকের সকালটা তার জন্য এত সুন্দর নয়।
আজ তার প্রথম ক্লাস!
nervousness কাজ করছে তার ভিতর
নতুন শহর, নতুন কলেজ, নতুন মানুষ…
কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই!
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে, ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!
তার মানে আজ আর পুরো কলেজ ঘুরে দেখা হবে না!
সে দ্রুত পা বাড়াল প্রথম বর্ষের ক্লাসরুমের দিকে।
ক্লাসরুমে ঢুকতেই সে দেখল, বেশিরভাগ সিট ভরে গেছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে এক কোণে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে দ্রুত গিয়ে বসল।
তারপরই শুরু হলো প্রথম ক্লাস—গণিত!
সবার চোখ দরজার দিকে।
হাঁটার ভারী শব্দে কেঁপে উঠল কাঁচের জানালাগুলো।
ক্লাসরুমের দরজা খুলে গেল…
ভেতরে ঢুকল সেই মানুষটা—
যার গাড়িতে চড়ে ফারিন আজ কলেজে এসেছে!
তার রক্ত হিম হয়ে গেল!
তারপর আসল ধাক্কাটা লাগল, যখন লোকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“Good morning, students. I am Professor Nirjhor Chowdhury.”
“এই লোক…!”
ফারিনের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল!
তার পাশে বসা এক মেয়ে ফারিনের দিক তাকিয়ে হাসল।
“তুমি কি নতুন?”
ফারিন মাথা ঝাঁকালো, “হ্যাঁ…”
মেয়েটি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল, “তাহলে নির্ঝর স্যার সম্পর্কে কিছু জানো না, তাই না? দেখছো না, স্যার কত হ্যান্ডসাম? আমি প্রথম দিন দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলাম!”
তারপর একটু ফিসফিসিয়ে বলল,
“কিন্তু পরে বুঝেছি, উনি একেবারে পাষাণ! প্রচণ্ড রাগী! ছাত্রদের সামনে ধুয়ে দিতেও দুইবার ভাবেন না!”
ফারিনের তখনই মনে পড়ল, রাস্তার সেই কথা…!
“নির্ঝর স্যার নাকি কারণে-অকারণে স্টুডেন্টদের অপদস্ত করেন!”
ফারিনের বুক ধক করে উঠল!
সারা রাস্তা যার নামে বাজে কথা বলল, সে লোকটা আসলে তারই প্রফেসর!
🔹 নির্ঝরের রহস্যময় কণ্ঠ…
ঠিক তখনই নির্ঝর চৌধুরীর কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল।সে হাতের কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“আমি শুনলাম, আমি নাকি খুব কঠোর একজন অধ্যাপক। কেউ কেউ ভাবে আমি অপ্রয়োজনীয়ভাবে রূঢ়। আরও মজার ব্যাপার হলো, কেউ কেউ তো মনে করে তার মাত্র একটা তুড়িতেই আমায় শায়েস্তা করা যায়”
ক্লাসে মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এল!
ক্লাসের সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস শুরু করল।
“কি হইছে?” “তুই কিছু জানিস?”
🔹চোখাচোখি!
সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে একে অপরকে দেখছে।
কিন্তু ফারিন স্পষ্ট বুঝতে পারল—এই কথাগুলো তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে!
ঠিক তখনই, নির্ঝর চোখ সরু করে তাকাল ক্লাসের এক কোণের দিকে।
সেই দিকে এক পলক তাকিয়েই বলল,
“The last seat, left corner. You!”
ফারিনের হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেল!
“এবার বুঝি সবার সামনে অপমান করবে?”
তারপরও গলা শক্ত করে বলল,
“Yes, sir?”
নির্ঝর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল,
“Are you new?”
ফারিন শুকনো ঢোঁক গিলে মাথা নেড়ে বলল,
“Yes, sir.”
নির্ঝর ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“Introduce yourself.”
ফারিন গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে বলল,
“I am Farin Mustafa, from Dumuria.”
নির্ঝর চোখের ভ্রু একটু উঁচু করল। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“Okay. Sit down.”
ফারিন থতমত খেয়ে গেল! এতটুকুই? আর কিছু বলবে না?
সারা ক্লাসে এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। নির্ঝর নিজের মতো লেকচার দিয়ে চলে গেল।
কিন্তু এরপর থেকে ক্লাসে যখনই নির্ঝর আসে, ফারিন তাকে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু নির্ঝর?
ছোটখাটো কথা দিয়েই তাকে জ্বালিয়ে মারে!
বিরতির সময় ফারিন ক্লাসে বসে ছিল, তখন পাশে বসা নেহা একধাক্কা দিল।
“কি রে, এখনো তোর নির্ঝর স্যারকে নিয়ে ভাবছিস?”
ফারিন বিরক্ত মুখে বলল,
“হুহ! ভাবার কিছু আছে নাকি? ওই হিটলার তো আমাকে দেখলেই জ্বলে ওঠে!প্রশ্ন করবে এমন জায়গা থেকে যে আমি কোনদিন শুনিই নি। এমনিতেই আমার গণিত ভালো লাগে না । তারপরে যদি স্যার হয় এরকম। ধ্যাত কেন যে মরতে প্রথম দিন ওনার গাড়ির সামনেই আমার পড়তে হলো। ”
নেহা আরেকটু খোঁচা দিয়ে বলল,
“মনে হয় তোর জন্যই স্যার ক্লাসে থাকেন! তুই না থাকলে কি আর ভালো লাগে?”
ইমন যোগ দিল,
“This is called love at first sight!”
ফারিন এবার একদম চটে গেল!
“তোদের ফাও কথা শুনতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই! ওই বজ্জাত স্যারকে দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়!”
এই বলে ফারিন ব্যাগ গুছিয়ে উঠে চলে গেল।
নেহা আর ইমন পেছন থেকে হাসতে লাগল…
অন্যদিকে……
ঢাকা – ইউনাইটেড হাসপাতালে
ঢাকার সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক হাসপাতালের একটি বিশেষ কেবিনে চেতনাহীন অবস্থায় শুয়ে আছে ফুয়াদ আহমেদ।
আজ চতুর্থ দিন।
তবুও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
অক্সিজেন মাস্ক পরানো মুখটা এতটাই নিস্তব্ধ, যেন সে ঘুমিয়ে নেই—একটা গভীর শূন্যতায় ডুবে গেছে।
ডাক্তারেরা উদ্বিগ্ন।
“তার জ্ঞান এখনো ফিরেনি। আজকের মধ্যে যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে বিদেশে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।”
ফিরে যাওয়া সেদিনের ঘটনায়…
শিশির তখনো রাগে গজগজ করতে করতে আনায়াকে টেনে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসছিল।
পেছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিল ফুয়াদ আহমেদ।
এই মেয়েটা একেবারে অন্যরকম।
তার খেলা তো এখনো শুরুই হয়নি!
কিন্তু আজ দেরি করা যাবে না।
তাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
তাই নিজের গ্রুপকে বিদায় জানিয়ে ফুয়াদ গাড়ির দরজা খুলে স্টিয়ারিংয়ে বসল।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল।
গাড়ি চলতে লাগল ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক দিয়ে।
হালকা সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
ফুয়াদ নিজের মুড ঠিক রাখতে গান গুনগুন করছিল,
“তোকে দেখে মনে মনে
বাজল যে গিটার 🎸 🎸
প্রেমে জলে ভেসে গেল
মনটা যে আমার 🎶
আয় তুই আমার হবি
আয় আয় আয় 🎶”
তবে গানের সুর মুখে থাকলেও, আজ তার ভেতরটা একদম ফুরফুরে লাগছে না।
মনে হচ্ছে… কিছু একটা ঠিক নেই!
কিন্তু কী?
ঠিক তখনই!
হঠাৎ সামনে মালবোঝাই একটা ট্রাক চলে এলো!
ফুয়াদ তৎক্ষণাৎ ব্রেক চাপল।
কিন্তু…
গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না!
তার হাত-পা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেল!
“কী হচ্ছে এটা?”
ফুয়াদ দ্রুত গিয়ার পরিবর্তন করতে গেল।
না!
কিছুই হচ্ছে না!
তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেল!
ট্রাকটা আরও কাছে আসতে লাগল….
শুধু কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান!
বিস্ফোরণের মতো এক বিকট শব্দ হলো!
চারপাশ কেঁপে উঠল!
পাশের গাড়িগুলো একসঙ্গে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল!
পথচারীরা হতভম্ব হয়ে ছুটে এলো!
রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাড়ির ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলোতে হেডলাইটের আলো পড়ে চিকচিক করছে!
কেউ একজন চিৎকার করে উঠল—
“এক্সিডেন্ট! এক্সিডেন্ট!”
লোকজন ছুটে এসে দেখল, গাড়িটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে!
ড্রাইভিং সিটে বসা ছেলেটার পুরো শরীর রক্তে ভিজে গেছে…
এরপর লোকজন তাকে ঐখানকার একটি পাবলিক হাসপাতালে এডমিট করা এবং তার বাবাকে খবর দেয় পরে তার বাবা এসে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে এডমিট করায় ।
বর্তমান – ইউনাইটেড হাসপাতাল
ফুয়াদের বাবা, ফরিদ আহমেদ, জানালার কাচের ওপার থেকে ছেলের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তার কপাল কুঁচকে আছে।
তার মাথার ভেতরে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—
“এটা কি সত্যিই দুর্ঘটনা?”
তার মন বলছে, “না, এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটা পরিকল্পিত!”
কিন্তু কে?
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩+৪
কে তার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাইবে?
তার মন তার ১৯ বছর আগের এক ঘটনা মনে করিয়ে দিল। তিনি মনে মনে বলেন,
তাদের কারো বেঁচে থাকা সম্ভব না। আর যদি থাকেও তাহলে তো আমাকে চেনা সম্ভব না…..