মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৬

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৬
নওরিন কবির তিশা

চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজের অফিস ভবনের দুই তলার একটা বিশাল কেবিনে বসে আছে নাহিয়ান। সামনে দেশের নামকরা অনেক ব্যবসায়ী।একটা গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিংয়ে এক হয়েছে তারা। প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্রোজেক্ট।
নাহিয়ান সিআইডি টিম থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছে।সে চায় না আর কখনও নিজের প্রাণনাশিনীর থেকে দূরে থাকতে,আর নাতো চায় এমন কোনো কাজের সাথে যুক্ত হতে যা তাকে নিজের প্রাণনাশিনীর থেকে আলাদা করে।
অবশ্য রেজিগনেশন লেটার টা মেইল করার পরই হেডকোয়ার্টার প্রধান গ্রি ডি ফল্ড নিজে নক করেছিলো তাকে।তবে তার একটাই উত্তর,,“Neither I can separate from my wife,nor I want.”সে নাহিয়ান কে বোঝানোর শত চেষ্টা করলেও নাহিয়ানের জবাব একটাই ছিল শেষমেষ তারা নাহিয়ানের এমন যুক্তির কাছে হার মানে।

নাহিয়ান সিদ্ধান্ত নিয়েছে,নিজেদের বিজনেস জয়েন করবে। যেহেতু বিজনেসটা তার বাবার তাই উত্তরাধিকার সূত্রে সেটার মালিক নাহিয়ানই হবে। তাই তার বাবা ইমতিয়াজ চৌধুরী চান ছেলে এখন থেকেই ব্যবসার হাল ধরুক। তাই আজকের এই এত বড় ক্লায়েন্ট মিটিং এর সমস্ত দায়িত্বই নাহিয়ানের উপর ন্যাস্ত হয়েছে।
ঘড়ির কাটায় প্রায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই। মিটিং শুরু হওয়ার আগে নিয়ম অনুসারে সকলের ফোন সাইলেন্ট করে রাখতে হবে। সকলের সাথে নাহিয়ানও নিজের ফোনের লক খুলে সাইলেন্ট মুড অন করতে যাচ্ছিল ঠিক তৎক্ষণাৎ একটা মেসেজে চোখ আটকে গেল তার স্ক্রিনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা নিউজ।রাজধানীর বিখ্যাত বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এক বিরাট সড়ক দুর্ঘটনা। নিহত সংখ্যা ১০ জন ছাড়িয়েছে। আহতদের অনেকেই নিখোঁজ আছেন।
সঙ্গে সঙ্গে নাহিয়ানের মস্তিষ্কের তড়িৎ বেগে স্মরণ হলো শিশিরের কথা। আজকে সকালেই তো শিশির বলছিল শপিংয়ে যাবে। সাজ্জাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। আর শিশির তো সবসময় বসুন্ধরা থেকেই কেনাকাটা করে। তবে কি শিশিরের কিছু….?
নাহিয়ানের মাথা কাজ করে না। এক ঝটকায় সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায় নাহিয়ান। তার এমন আচরণে অবাক হলো উপস্থিত সকলে। তাদের মধ্য থেকে একজন মাঝ বয়সী লোক বলে,,
——“এনি প্রবলেম মাই সন?”
নাহিয়ান তার প্রশ্নের ‌কোনো জবাব দেয় না। দ্রুত বেগে উন্মাদের মত বের হয়ে যায় সেখান থেকে।তবে বের হয়ে নাহিয়ান কি করবে বুঝতে পারে না। মাথা কাজ করছে না তার।নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে! উন্মাদের মতো নিচে এসে গাড়িতে স্টার্ট লাগায় সে।

কমপ্লেক্সের সামনে হাজারো মানুষের ভিড়। পুলিশ একা সামাল দিতে পারছে না তাদের। চিৎকার, হাহাকারে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে চারিপাশ। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো নাহিয়ান। কোথাও দেখা যাচ্ছে না শিশিরকে। পাগলপ্রায় নাহিয়ান বিক্ষিপ্ত নয়নে খুঁজতে থাকল তার প্রাণনাশিনীকে।
কিন্তু সে কোথায়? এক পর্যায়ে নাহিয়ান নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে রাস্তার উপর বসে পড়ল! কি করবে সে? কোথায় তার প্রাণনাশিনী? কোথায় তার স্বপ্নচারিনী, তার হৃদয়হরনী? নাহিয়ান চিৎকার করে উঠল! তার চিৎকারে চারিপাশ থমকে গেল ক্ষনকাল।
হঠাৎ নাহিয়ান নিজের কাঁধে অনুভব করল কারো উষ্ণ স্পর্শ। নরম কোমল সেই স্পর্শে নিজের নুইয়ে রাখা মাথাটা সামান্য তুললো নাহিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণনাশিনী। নাহিয়ান বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর শিশিরকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরল। পাগলের মত বিলাপ করে সে বলে উঠলো,,,

——“কোথায় ছিলে তুমি? বলো,বলো, কোথায় ছিলে? ফোন অফ কেন ছিল? আমাকে কি এক মুহূর্ত শান্তি দেবে না তুমি? আমাকে না মেরে কি শান্তি হবে না তোমার?”
বিলাপ করতে করতে চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে নাহিয়ানের। তার এমন পাগলামিতে শিশির কি বলবে বুঝতে পারে না। সে অস্পষ্ট স্বরে নাহিয়ান এর বক্ষদেশে মধ্য থেকে বলল,,
——“শান্ত হন! এরকম করছেন কেন? দেখুন আমার তো কিছু হয়নি!”
নাহিয়ান আরও শক্ত করে জাপটে ধরল শিশিরকে।যেন একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলবে।তার লক্ষ্যই হলো না আশেপাশের কতগুলো অবাক দৃষ্টি বিশ্লেষণ করছে তাদের।

নাহিয়ান মঞ্জিলে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগেই…..
সারাটাদিন নাহিয়ান শিশিরের হাত আঁকড়ে তার পাশেই ছিলো।যেন এক ফোঁটা চোখের আড়াল হলেই তার শিশির বিন্দু হারিয়ে যাবে,এমনকি শিশিরের জন্য আজ সব খাবার নিজ হাতে রান্না করে তাকে খাইয়েছে নাহিয়ান,আর পুরো রান্নার সময়টা জুড়ে কিচেনে তার পাশেই সে বসিয়ে রেখেছিলো শিশিরকে।শিশিরের শরীরে জড়ানো ওড়নাটা নিজের হাতের সঙ্গে একপ্রকার বেঁধে রেখেছিল সে।
মাগরিবের নামাজ শেষে নাহিয়ানের রুমে প্রবেশ করলেন নওরিফা খানম, ইমতিয়াজ চৌধুরী,সিকদার শাহ আর রোদেলা জামান। ইমতিয়াজ চৌধুরী একটু রেগে ছিলেন, ছেলের অদ্ভুত আচরণে। অবশ্য রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক এক বা দুই কোটি নয় পুরো ৫০ কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল নাহিয়ানের সামান্য ভুলের কারণে।
তবে বাসায় আসার পর তিনি যখন জানতে পারলেন সবটা শিশিরের জন্য তখন আর তার কি করার? সে নিজেও তো এমন ছিল! দরজার বাইরে থেকে নক করে রোদেলা জামান বললেন,,

——“আসতে পারি নাহিয়ান?”
দরজাটা অবশ্য খোলাই ছিল। তবে হাজার হলেও নিজের মেয়ে,জামাইয়ের ঘর বলে কথা, অনুমতি নেওয়াটাই স্বাভাবিক। নাহিয়ান ভেতর থেকে বলল,,
——“জি আন্টি আসুন!”
একে একে ভেতরে প্রবেশ করলেন সবাই। তার রুমের বিশাল কাউচের উপর ল্যাপটপ হাতে বসেছিল নাহিয়ান। পাশেই শিশির। তাদের সবাইকে দেখে শিশির কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। তবে নাহিয়ান একেবারে স্বাভাবিক। সবার উদ্দেশ্যে সে বলল,,
——“কিছু বলবে তোমরা?”
নওরিফা খানম সহ সবাই নাহিয়ানের রুমের বিশাল কিং সাইজ সোফাটার উপর বসলো। অতঃপর নওরিফা খানম নাহিয়ান আর শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

——“নুয়া,নাহিয়ান আমরা জানি তোমরা এখন একে অপরের জন্য হালাল। অবশ্য সেটা আমাদের অনুমতি সাপেক্ষেই। তবে তোমরা দুজনেই আমাদের দুই পরিবারের অত্যন্ত আদরের। আমরা কখনোই চাইনি তোমাদের বিয়েটা ওভাবে হোক! তবে সে কথা বলে আর লাভ নেই কেননা যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে! তাই এখন আমি যেটা বলতে চাই সেটা হলো…”
কথার মাঝে একবার থামলেন তিনি। অবশ্য তার একটাই কারণ শিশির। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপস্থিত সকলের পানে। তার মনে একটাই দ্বিধা দ্বন্দ্ব সবাই তাদের বিয়ের কথাটা জানলো কিভাবে? নাহিয়ান তো তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল। একপ্রকার ফোর্স করে। এ ব্যাপারে তো কারো জানার কথা নয়। সে যখন এ সকল চিন্তায় নিমগ্ন তখনই নওরিফা খানম আর রোদেলা জামান একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রোদেলা জামান বলে উঠলেন,,,

——“কি ব্যাপার নুয়া? কি ভাবছিস? বাবা-মা আঙ্কেল আন্টি সব কিভাবে জানতে পারলো?”
ফের হাসলেন তিনি। তারপর নওরিফা খানমের দিকে চেয়ে বললেন,,
——“রিফা আপা তুমি বলবা নাকি আমি?”
নওরিফা খানম:“তুইই বল!”
রোদেলা জামান বলতে শুরু করলেন,,
——“সেদিন সুইজারল্যান্ডে তোদের বিয়ের সময় আমরা সবাই গ্রুপ কলে অ্যাড ছিলাম!”
শিশির অবাক দৃষ্টিতে তাদের পানে চেয়ে বলল,,
——“মানে?”

নওরিফা খানম:“মানে আর কি? তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিলি না আর আমার ছেলে! সে তো বাবার সম্মান রক্ষা করবে তাই না?বাবার ছেলে বলে কথা! তাই যা হবার তাই হয়েছিলো!”
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“বাজে কথা বাদ দিয়ে যে কথা বলতে এসেছে, তাই বলো।”
নওরিফা খানম:“শোনো, তোমাদের বিয়ে নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কেননা তোমরা দুজনেই দুইজনকে ভালোবাসো। আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তোমাদের বিয়েটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো।”
শিশির দ্বিতীয় বারের মতো চমকালো। বিয়ে ঠিক করা ছিল মানে? তবে তার বিস্ময় কে পরোয়া না করেই নওরিফা খানম বলেন,,

——“তোমাদের বিয়েটা আমার ছোট ভাই অর্থাৎ নরশদ আর আমি মিলে ঠিক করেছিলাম। সে বহু পুরাতন কথা। সেসব কথা না হয়,আজ না বলি। তবে প্রধানত যে কথাটা বলতে এসেছি তা হচ্ছে, আমার বড় ভাই অর্থাৎ নুরুজ্জামান খানমের খুব ইচ্ছা ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে পুরো জাফলং কে সাজাবে। সাড়ম্বরে আয়োজিত হবে খানম বংশের একমাত্র মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা করা হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা জাফলং আমাদের যাতায়াত বন্ধ হয়েছে প্রায় ১৮ বছর হলো তবে যতটুকু সম্ভব হয়েছে, সেই সাপেক্ষে আমরা চাই যে তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটার আয়োজন জাফলংএ করতে!”
নওরিফা খানমের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে ইমতিয়াজ চৌধুরী বললেন,,

——“আর আমরা চাইছি পরশুদিনের মধ্যেই জাফলং যেতে,এখন তোমাদের কি মতামত? ”
নাহিয়ান আর শিশির একবার একে অপরের দিকে তাকালো অতঃপর নাহিয়ান বলল,,
——“এ বিষয়ে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো মতামত নেই তোমরা যা ভালো মনে করবে সেটাই হবে। কি বলো বউ?”
সবার সামনে নাহিয়ানের এমন সম্বোধনে লজ্জায় পড়ে শিশির। সেই সঙ্গে অপ্রস্তুত হন উপস্থিত সকলে। বিষম লাগে সিকদার শাহর,রোদেলা জামান নওরিফা খানমের দিকে তাকান।নওরিফা খানম ছেলের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,,
——“অসভ্য নির্লজ্জ ছেলে! এখানে তোমার বাবা মা উপস্থিত! ভুলে গিয়েছো?”
নাহিয়ান:“ও মা এতে নির্লজ্জতার কি হলো? বউকে বউ বলবো না তো রাস্তার মানুষকে বউ বলবো নাকি?আজিব!”
অতঃপর নাহিয়ান ইমতিয়াজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ চৌধুরীর দ্রুত নওরিফা খানমকে বলেন,,

——“চলো,চলো রিফা। আমার সুগারের ঔষধটা দিবা।এখানে থাকলে নিশ্চিত,আমার সুগার লেভেল হাই হয়ে আমি মারা যাবো!দ্রুত চলো!”
কথাটা বলেই ‌নওরিফা খানমকে এক প্রকার টেনে হিচড়ে রুম থেকে বাইরে নিয়ে গেলেন ইমতিয়াজ চৌধুরী। সাথে বেরিয়ে গেলেন রোদেলা জামান আর এই সিকদার শাহ। তারা বেরিয়ে যেতেই শিশির নাহিয়ানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
——“আপনার ভেতরে কি লাজ-লজ্জা বলে কোনো পদার্থ আছে?নাকি ছোটবেলায় সেরেলাক্সের সাথে সেটাও গুলিয়ে খেয়েছেন?”
নাহিয়ান:“বউকে বউ বললে যদি নির্লজ্জের খেতাব পেতে হয়। তাহলে সেই খেতাব আমি বারংবার পেতে রাজি আছি বউ!”
শিশির বুঝলো না সে রাগ করবে,নাকি নাহিয়ানের এমন কাণ্ডে অবাক হবে? এই লোকটাকে যে সারা জীবন সে কিভাবে সামলাবে? আল্লাহই ভালো জানে!

খুলনায় চৌধুরী আবাসনে…..
ঘড়ির কাঁটায় প্রায় রাত ৮ টা ছুঁই ছুঁই। নির্ঝর নিজের রুমের সোফার উপর বসে ল্যাপটপে কাজ করছে, আর ক্ষণে ক্ষণে ফারিনকে দেখছে। ফারিন‌ সেই তখন থেকে স্টাডি টেবিলে বসে একমনে কলম দিয়ে বিভিন্ন সাদা পাতায় কিসব হিজিবিজি অঙ্কন করে চলেছে।
সেই সাথে মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গান করে উঠছে। নির্ঝর শেষমেষ ল্যাপটপটা বন্ধ করে, এগিয়ে গিয়ে ফারিনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফারিন নিজের কল্পলোকে এতটাই ব্যস্ত যে খেয়ালই করলো না তার পিছনে নির্ঝরে দাঁড়িয়ে। তবে নির্ঝর ভালো করেই বুঝতে পারলো ফারিন খাতায় হিজিবিজি অঙ্কনের পাশাপাশি গুনগুনিয়ে গান গাইছে,,
“Darling aankhon se aankhen char Karne do….
Ruko Na ruko na mujhko pyar Karne do….
Beqaif hein bahara, bechaan jaane yaara….”
তার এমন গানে নির্ঝর ঠোঁট টিপে হাসলো। অতঃপর সামান্য কেশে উঠতেই, ফারিন বিষ্ময়ে পিছনে ঘুরে তাকালো। তা দেখে নির্ঝর বলল,,

——“না পড়ে গান গাইছো?”
ফারিন অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললো,,
——“আ-আরে স্যার আপনি?”
নির্ঝর: “কি বললাম শুনতে পাওনি?না পড়ে গান গাইছো কেন?”
ফারিন মুখ ভোতা করে বলল,,
——“এই ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে কার পড়তে ইচ্ছা করে বলুন?স্যার? কি সুন্দর রোমান্টিক ওয়েদার!”
নির্ঝর: “তো না পড়ে তাহলে গান গাইতে হবে?”
ফারিন: “না.. ঠিক তা না..”
নির্ঝর:“তবে ঠিকটা কি?”
ফারিন: “আপনি চাইলে আমরা কোনো একটা রোমান্টিক মুভি ও দেখতে পারি!লাইক আশিকি, কুচ কুচ হোতা হে, ভার-জারা, অথবা রিসেন্ট ভাইরাল হওয়া কিছু যেমন সাইয়ারা,”
নির্ঝর:“হোয়াট?”
ফারিন: “না না স্যার। আমি তো শুধু নাম বললাম, কখন বললাম যে দেখতেই হবে।”
অতঃপর ফারিন মনে মনে বলল,,“বেডা আনরোমান্টিক!”
এরপর নির্ঝরের দিকে ফিরে বলল,,

——“কিছু বলবেন?”
নির্ঝর:“হুম! আমার ফোনটা পাচ্ছি না।কোথায় জানো?”
ফারিন:“সেটা তো ঠিক জানিনা।”
নির্ঝর:“তোমার ফোনটা কই?”
ফারিন আশেপাশে একবার নজর বুলায় নিজের ফোনটা খোঁজার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোথায় যে রেখেছে আল্লাহই ভালো জানে! কখনো তো নিজের কোনো জিনিসের যত্ন নেয় না সে।চেয়ার থেকে উঠে বিছানার উপর থেকে নিজের ফোনটা এনে নির্ঝরের হাতে দিয়ে সে বলল,,
——“এই যে নিন!”
নির্ঝর ফারিন এর হাত থেকে দ্রুত তার ফোনটা নিয়ে, নিজের নাম্বারে ডায়াল করল। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সেভ করা নামখানা “হি*ট*লা*র” পাশে ব্রাকেটে আবার লেখা “আমার আনরোমান্টিক জামাই!” নির্ঝর এক অন্যরকম ভঙ্গিমায় ফারিন এর দিকে তাকালো।ফারিন তখন নির্ঝরের দিকেই তাকিয়ে ছিল। নির্ঝরকে এমন ভাবে তাকাতে দেখে,অবাক হয়ে সে বলল,,

——“কি হয়েছে?”
নির্ঝর কোনো কথা না বলে ফোনের স্কিনটা তার দিকে ঘোরালো। সঙ্গে সঙ্গে ফারিনের চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো সেভ করা নিক নেম টা,ভয়ে শুকনা একটা ঢোক গিললো সে। হি*ট*লা*র নামটা সেই দিয়েছিল, যদিও বিয়ের আগে তবে বিয়ের পরে আর চেঞ্জ করা হয়নি। আর ব্রাকেটের নামটা তো ফ্রেন্ডরা মিলে ডেয়ার হিসেবে জোর করে দিয়েছিল। সে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল,,
——“আ-আসলে..”
নির্ঝর এক কদম এগিয়ে আসলো তার দিকে,,
——“আসলে কি?”
ফারিন এক কদম পিছালো,,
——“আসলে মানে লি..”
নির্ঝর আরো এগোতে লাগল তার দিকে,,
——“আমি আনরোমান্টিক?”
নির্ঝরের এমন অদ্ভুত ভাবে এগিয়ে আসায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে ফারিন। ভয়ার্ত ঢোক গিলে সে বলল,,
——“না আসলে..ইয়ে মানে..”
নির্ঝর ফারিনের বেশ কাছাকাছি এসে বলল,,

——“কি তখন থেকে ইয়ে,মানে,আসলে করছো?Give me the answer আমি আনরোমান্টিক? লাইক সিরিয়াসলি? সেদিন রাতের পর টানা এক সপ্তাহ জ্বর ছিল তোমার! তারপরও বলবে আমি আনরোমান্টিক?”
নির্ঝরের এমন ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতেই আটকে আসলো ফারিনের। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সে বলল,,
——“আমি কখন বললাম আপনি আনরোমান্টিক? ওটাতো লিসারা ডেয়ার হিসেবে দিয়েছিল!”
নির্ঝর এবার ফারিনের একেবারে কাছাকাছি চলে এলো। নেশাক্ত কন্ঠে সে বলল,,
——“ওরা বলল আর তুমি মেনে নিলে? ওকে ফাইন, আজকে তোমাকে আমি রোমান্টিকতার ঠিক সেই পর্যায় গুলো দেখাবো, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো আমাকে আনরোমান্টিক বলতে তোমার অন্তত দশ বার ভাবা লাগে!”
ফারিনের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। তার এখনো ভালোভাবেই মনে আছে সেই রাতের কথা! যখন ফারিন জীবনে প্রথম নির্ঝরকে তীব্র পাগলাটে প্রেমিক হিসেবে আবিষ্কার করেছিল! সে কি করবে বুঝতে পারছে না! ইতিমধ্যে নির্ঝর ঝুঁকতে শুরু করেছে।আর কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান তারপরেই… ফারিন বেশ জোরে বলে উঠলো,,

——“জ্বী আম্মু…”
নির্ঝর অপ্রস্তুত হয়ে উঠল।
নির্ঝর:“আম্মু কই?”
নির্ঝরের এমন অবাক হওয়ার সুযোগটাকেই কাজে লাগালো ফারিন। নির্ঝরের হাতের নিচ দিয়ে আলগাছে বের হয়ে দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল,,
——“আম্মু তো ছিলোই না!”
নির্ঝর:“তবে যে বললে আম্মু!”
ফারিন: “ওটা তো আপনার থেকে বাঁচার একটা ট্রাপ ছিল!”
নির্ঝর:“তবে রে..”
কথাটা বলেই নির্ঝর সামান্য দৌড়ে ফারিনের দিকে এগিয়ে যেতেই ফারিন এক ছুটে করিডোরের প্রায় শেষ প্রান্তে গিয়ে বলল,,

——“পারলে এখন ধরে দেখান!”
নির্ঝর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অতঃপর ফারিনের দিকে চেয়ে বলল,,
——“কতক্ষণ আর বাইরে থাকবে মিসেস? কিছুক্ষণ পর তো তোমাকে এই নির্ঝরের বুকেই ফিরতে হবে। তখন না হয় সেই সময়টা,আর এই সময়টা সুদ সহ ‌আসল কড়ায়-গন্ডায় নিব। মনে রেখো আমি কিন্তু ম্যাথের টিচার, ক্যালকুলেশন বেশ ভালোই পারি!”
ফারিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
——“উমম.. তখনেরটা তখন দেখা যাবে।”
বলেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল ফারিন।নির্ঝর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

দূর অন্তরীক্ষে দৃশ্যমান একফালি রুপালি চন্দ্র। মেঘের আড়ালে-অন্তরালে লুকিয়ে যেন খেলা করছে সে। মাঝে মাঝে ছড়াচ্ছে তার রুপালি কিরণ। তবে তা অত্যন্ত ক্ষীন, নিজেদের বিশাল দুতলা ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান আর শিশির।
নাহিয়ান একদৃষ্টে চেয়ে আছে শিশিরের পানে। শিশির আকাশের নক্ষত্ররাজীর দিকে চেয়ে নাহিয়ানকে একের পর এক বিভিন্ন কথা বলেই চলেছে তবে তার জবাবে নাহিয়ান প্রতিবারই হু হা উত্তর দিচ্ছে। শিশির এবার বিরক্ত হয়ে নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো নাহিয়ান অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার পানে। শিশির রাগ করে কিছু বলতে যেতে গিয়েও পারলো না;লজ্জায় কন্ঠ খাদে নামিয়ে সে বলল,,
——“সারাদিন এতো কি দেখেন?”
নাহিয়ান ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,,

——“আমার বউকে!”
শিশির: “এভাবে সারাদিন তাকিয়ে থাকতে বিরক্ত লাগে না?”
নাহিয়ান এক অন্য ভনিমায় হাসলো। তা দেখে শিশির বলল,,
——“কি হলো?”
নাহিয়ান:“একটু আগে কি বললা তুমি?বিরক্তি?”
শিশির: “তা নয় তো কি? এভাবে সারাদিন একটা মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকলে;বিরক্ত লাগাটাই তো স্বাভাবিক।”
নাহিয়ান:“তবে শোনো…”
শিশির:“কি?”
নাহিয়ান:“নয়ন ভরে দেখি তোমায়…
তবু বুঝি দেখার শেষ নাই…”
শিশির কিছুটা লজ্জায় মাথা নোয়ালো। অতঃপর কি জানি কি ভেবে সে হঠাৎই নাহিয়ান কে বলল,,

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫ (২)

——“এটা তো ক্ষণিকের জন্য মাত্র মিস্টার এআর! যখন আপনি আবার আমাকে রেখে আমেরিকায় চলে যাবেন তখন?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে ফের গেয়ে উঠলো,,
——“তোমায় ছেড়ে বহুদুরে…
যাব কোথায়…?
এক জীবনে এত প্রেম পাব কোথায়…?”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৭