মায়াকুমারী পর্ব ২৬
মেহেরিন আনজারা
রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। ধূসরের জন্য অপেক্ষা করতেই আচমকা শুনতে পেলো,”এটা কি আপনার?”
পিছু ফিরে চমকিত নয়নে তাকালো নিশু। তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে তাহমিদ। আমতা আমতা করলো। ঠিক সেদিনের মতো একটি নুপুর ঝুলিয়ে ধরে রেখেছে। আশ্চর্য! তার নুপুর লোকটা কেন বারবার পাচ্ছে?
“জ্বী।”
কম্পিত হাতে নুপুরটি নিলো। তাকে ধরে রেখেছে দ্যুতি।
“আপনি সিক?”
মাথা নাড়ায় নিশু। নিশুর দিকে তাকালো। মিষ্টি রঙের মণিপুরী শাড়ি পরনে। চোখে সবুজ রঙের কাজল আর ঠোঁটে হালকা ম্যাচিং করা লিপস্টিক! সাজ নেই বললেই সারে। কিন্তু চোখ সরাতে পারলো না তাহমিদ। ঠিক সন্দেশের মতো লাগছে নিশুকে। তাহমিদের দিকে তাকায় নিশু। স্যুট-প্যান্ট পরনে। দেখতে মারাত্মক লাগছে! নিসন্দেহে তাহমিদ মারাত্মক সুদর্শন! তাহমিদের শরীর থেকে আসা কড়া তেঁতো কোলনের ঘ্রাণে শ্বাস আঁটকে রইলো। মৃদু হাসলো তাহমিদ।
“লেট হয়ে যাচ্ছে আসছি!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হাতঘড়িতে সময় দেখে কারে উঠে চলে গেল। ভীষণ বিরক্ত হলো ধূসর। এই তাহমিদ কী শুরু করলো! কী পেয়েছে লোকটা?সে একজন পুরুষ,তাহমিদের দৃষ্টি বুঝে! নিশুর প্রতি মারাত্মক আগ্রহ তাহমিদের।
“কীসের নুপুর পরিস তুই বলতো,তোর পা থেকে খুলে যায় আর ওই লোকটা পায়?”
আমতা আমতা করলো নিশু। সেও তো বুঝতে পারছে না কিছু।
“পরতে না পারলে পরার দরকার নেই। আর একবার তাহমিদ যদি তোর নুপুর পায় তোর খবর আছে!”
থমকায় নিশু। সে-তো ইচ্ছে করে হারায় না। গাড়িতে উঠতেই স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। রাগে গজগজ করতে লাগলো ধূসর। উপর থেকে এতক্ষণ দৃশ্যটি দেখলো ধ্রুব। দাঁত-মুখ খিঁচালো। পায়ের মধ্যে নুপুর পড়তে নিতেই দেখলো দুটোই আছে। তাহলে এটা কার? ভালো করে দেখলো নিশু। একই রকম ডিজাইন নয় তবে প্রায় কিছুটা কাছাকাছি! কিন্তু ভীষণ সুন্দর! কার নুপুর তাকে দিলো তাহমিদ?দেখতেই বুঝা যাচ্ছে একেবারেই নতুন! আতঙ্কিত হয় নিশু। তাহমিদের মনের ভিতর কী চলছে! ভীতসন্ত্রস্ত হলো নিশু। ধূসরকে বলা যাবে না। বললে তাহমিদের সঙ্গে মারপিট করবে। তারচেয়ে বরং কাকতালীয় ভাবে ছাঁদে দেখা হলে সে দিয়ে দিবে।
স্বর্ণালংকারগুলো বের করে দেখতে লাগলেন দিলরুবা খাতুন। শপে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন আসাদ সাহেব। স্ত্রীর দিকে লক্ষ্য করলেন একবার। কেমন পুলকিত দেখাচ্ছে! গলা খাঁকারি দিলেন।
“খুশি মনে হচ্ছে তোমাকে?”
হকচকিয়ে উঠলেন।
“কই না তো!”
“গয়নাগুলোর কী হয়েছে আবার?”
“নিশুর জন্য একটা চেইন বানাতে দিব ভাবছি!”
“পুরোন স্বর্ণ ভাঙানোর দরকার নেই। অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিব।”
“তাহলে ছোট্ট ছোট্ট একজোড়া চুড়িও বানাতে দিয়েন। যেন একটু গাঢ় হয়। এক ভরির মধ্যে দেখিয়েন।”
“ছোট্ট চুড়ি কার জন্য।”
“ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি হবে।”
বেরিয়ে গেলেন তিনি। গয়নার বক্সগুলো তুলে রাখলেন। নিশুর জন্য গড়িয়েছেন বিয়ের সময় দিবেন বলে। কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আজ ধ্রুবর পছন্দের খিচুড়ি করবেন। নিশু-দ্যুতি দু’জনে আবার ভর্তা খেতে পছন্দ করে।
হসপিটালে ভর্তি করালো নিশুকে। রক্তশূন্যতা এবং থাইরয়েড ধরা পড়েছে! ধীরাজকে ফোন করে নিয়ে দু’ভাই মিলে রক্ত দিলো নিশুকে। সুগন্ধি লেবুফুলের মতো ঘুমিয়ে রয়েছে নিশু। খবরটি শুনতে পেলো আবির। ঢাকায় ছিল সে। মাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছিল ডক্টর দেখাতে তখন ওদেরও ঢুকতে দেখেছিল। কেবিনে ঢুকতেই চমকায় ওরা। অপ্রস্তুত হয় আবির। তাকে দেখতেই রাগ হয় ধূসরের।
“নিশু কেমন আছে?”
“ভালো।”
“কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি।”
ভালো লাগলো না ধূসরের কথাগুলো। তাকে হাজতে ঢুকানোর পর থেকে সহ্য হয় না আবিরকে।
“কীরে হালা তুই এখানে কী করছ?”
চমকিত নয়নে পিছু ফিরে তাকালো সবাই। মেজাজ খারাপ হলো আবিরের।
“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।”
কলার খাঁড়া করলো অনিক।
“শান্তির ছেলে এখানে কী কাজ তোমার?”
“মুখ সামলে কথা বলো!”
“মাসুদ ভালো হয়ে যাও।”
আবির বুঝতে পারলো আর এক মিনিট এখানে থাকলে মানসম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। তাই মানে মানে এখান থেকে কেটে পড়া ভালো। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল আবির।
“হ্লায় কামডা করলো কী! ম্যারিড মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরে। হ্লা ছ্যাঁছড়া! ঘুষ খাইতে খাইতে পেট বাইর কইরা ফালাইছে! চাচা-মামার মতো লাগতাছে!”
দ্যুতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেজাজ খারাপ হলো। জিন্সের প্যান্ট আর টপস পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় হিজাব বাঁধা। সব বাদ জিন্সের প্যান্ট কেন পড়লো!
“আফা আপনি কোন দেশের ফকিন্নি? ইয়ে মানে কোন দেশের ভিখারি? উগান্ডা নাকি আফ্রিকা? নাকি এন্টার্কটিকার?”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দ্যুতি।
“খবর্দার আমার এরিয়ায় ভিক্ষা করতে আসবেন না আফা। আপনার মতো ফকিন্নির জায়গা আমার এরিয়ায় নাই।”
দাঁতে দাঁত চাপলো।
“এই গাঞ্জাখোর এখানে কী কাজ তোর?”
“হ্লা পোলিও আম্বানি চুপ থাক!”
“গ্যাদারিং করবি না বলে দিচ্ছি বেরিয়ে যা।”
“হ্লা তোর পোলিও রোগের চিকিৎসা করা আগে। আর না হয় কৃমিনাশক ঔষধ খা।”
আচমকা টান দিয়ে দ্যুতিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। হতভম্ব হলো সবাই।
“ওরে কই নেস?”
“চুপ থাক!”
পিছু নিলো ধূসর।
“ছাড়ুন আমাকে! কী শুরু করলেন?”
বাইকে উঠে চলে গেল দ্যুতিকে নিয়ে। মেজাজ খারাপ হলো। থামলো একটি রেস্তোরাঁর সামনে।
“কী সমস্যা আপনার? অভদ্রতামি করছেন কেন?”
“এটা কী পরছো?”
“আপনার সমস্যা কোথায়?”
“ফকিন্নির মতো লাগতেছে! মনে হইতাছে ভিক্ষা করার জন্য বাইর হইছো! ভিক্ষা কইরা কয় টাকা পাইছো?”
“মুখ সামলে কথা বলুন! যা নয় তা বলছেন।”
রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। স্ন্যাকস-কফি অর্ডার করলো।
“এখানে কেন আনলেন?”
“ব্রেকফাস্ট করিনি।”
ধূসর ফোন দিতেই কেঁড়ে নিয়ে পিক করলো অনিক।
“তোর বোন আমার সঙ্গে। টেনশন করিস না হ্লা!”
কিছু বলার পূর্বেই কল কেটে অফ করে দিলো। ফোন নিয়ে বেরিয়ে যেতেই হাত টেনে ধরলো।
“বসো।”
“বাড়াবাড়ি আমার অপছন্দের!”
“বাড়াবাড়ি কই করলাম?”
“আপনি কোন সাহসে কীসের ভিত্তিতে আমার সাথে এমন আচরণ করছেন?”
চমকায় অনিক।
“ফাউল কথাবার্তা বাদ দিয়ে আপনি কি কোনোদিন ঠিক হবেন না?”
“না।”
“জীবনের প্রতি সিরিয়াস হবেন কবে?”
“সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু দেখি না।”
“আসলেই আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। আমি একটা পাগলের সঙ্গে কথা বলছি! রাসকেল!”
উঠে বেরিয়ে যেতে নিতেই আবারও হাত টেনে ধরলো। দাঁতে দাঁত চাপলো দ্যুতি।
“আপনার কোনো রাইট নেই আমার হাত ধরার। আপনার সেই যোগ্যতা নেই আমার হাত ধরার। মাইন্ড ইট! আগে নিজেকে যোগ্য করে আসুন তারপর আমার হাত ধরবেন।”
অপমানিতবোধ করলো অনিক।
“কী বলতে চাও?”
“আমাদের জীবন থেকে সরে যান। দেখতে চাই না আপনাকে।”
“আমি কী করলাম?”
“হুটহাট আমাদের মধ্যে এসে ইন্টারফেয়ার করছেন। কে আপনি হ্যাঁ?”
বেরিয়ে গেল দ্যুতি। কিছুদূর যেতেই ধূসরকে দেখলো। চোখের জল মুছে নিলো গোপনে। দ্যুতির দিকে তাকায় ধূসর। দেখলো তার চোখের লম্বা লম্বা পাপড়িগুলো জবুথবু।
“ও তোর সঙ্গে কী করেছে?”
“কিছু করেনি।”
“সত্য কথা বল!”
“কিছু করেনি চলো।”
হাত টেনে ধরে হাঁটতে লাগলো। মস্তিষ্ক টগবগ করছে!
বিকাল পর্যন্ত হসপিটালে ওরা সবাই। নিশুর জ্বর,ঠান্ডা লেগেছে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। রান্নাবান্না সেরে বসে রইলেন দিলরুবা খাতুন। একটা ছেলেমেয়েও আজ বাসায় নেই। ধ্রুব যে সেই কখন বেরিয়েছে ফোন করলেন পিক করলো না। টেনশনে পড়ে গেলেন। ধূসরকে ফোন করতেই পিক করে বলল,”কী আম্মা?”
“কই তোরা?”
“ঘুরতে এসেছি ঢাকার বাইরে।”
হসপিটালের কথা বললে টেনশন করবে তাই বললো না।
“ওহ। কখন আসবি?”
“একটু পর।”
“তাড়াতাড়ি আয়। আমি বসে আছি টেবিলে।”
“আম্মা আমরা তো লাঞ্চ করেছি। তুমি করে নাও।”
“তোর ভাইয়াও নেই।”
“কোথায় গিয়েছে?”
“জানি না ফোন তোলেনি।”
“আচ্ছা আমি দেখতেছি।”
ধ্রুবকে ফোন দিলো কিন্তু পিক করলো না। কয়েকবার দেওয়ার পরেও একই কান্ড। হতাশ হয় ধূসর। মাকে ফোন করে বলল,”আম্মা টেনশন করো না। ভাইয়া একটা কাজে আছে। তুমি খেয়ে নাও।”
“আচ্ছা।”
মলিন মুখে খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেমেয়ে ছাড়া উনার মুখে খাবার উঠে না।
ডিসচার্জ নিয়ে বাসার পথে রওনা দিলো ওরা। নিশু হসপিটালে থাকবে না কিছুতেই। বমি-টমি করে ভাসিয়ে ফেললো সব।
“রমনা যাবি তোরা?”
নিভু নিভু চোখে তাকায় নিশু।
“ভাইয়া আমি যাবো!”
“তুই তো সবখানে যাস।”
“রমনা চলো ভাইয়া। নিশুর ভালো লাগবে।”
রমনার দিকে চলতে লাগলো গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর রমনায় পৌঁছালো ওরা। গাড়ি থেকে নামলো। উচ্ছ্বসিত প্রকাশ করলো দ্যুতি। পুরো রমনা পার্ক ছেয়ে গিয়েছে মনিমালা ফুলের অপরূপ সৌন্দর্যে! এত্ত সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতেই দু-হাত প্রসারিত করে ঘুরতে লাগলো দ্যুতি। ভালো লাগলো নিশুরও। ঝরে পড়া কিছু মনিমালা ফুলের পাপড়ি কুড়িয়ে নিলো দ্যুতি! হাঁটতে লাগলো ওরা চারজন। ধীরাজ এখন বড় হয়েছে লাজুকও হয়েছে। কথাবার্তা কম বলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কিছুটা হাঁটতেই আকস্মিক চোখ পড়লো দু’জন মানুষের উপর। শ্বাস আঁটকে তাকিয়ে রইলো নিশু। এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। চোখ কচলে নিলো। হ্যাঁ ঠিক দেখেছে সে। নিশুর চিনতে ভুল হয়নি। বিষয়টি নিতে পারলো না। দুঃখ-কষ্টে চোখজোড়া জলে টইটম্বুর হলো ভরা বর্ষার বিলের মতো! নিশুকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো দ্যুতি।
“কীরে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন?”
নীরব রইলো নিশু। নিশুর দৃষ্টি বরাবর তাকাতেই দেখলো ধ্রুব নীলির সঙ্গে। থমকায় দ্যুতি!
“চল বাসায় ফিরি। রমনা দেখা হয়ে গেছে। অনেক সুন্দর রমনাপার্ক!”
পা বাড়ালো গাড়ির দিকে। কিছু ভেবে এদিকে তাকাতেই ওদের দেখে ফেললো ধ্রুব। অপ্রস্তুত হলো সে। নীরবে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো দ্যুতিও। গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। একটু আগে লক্ষ্য করেছিল নিশুর মন ফুরফুরে হঠাৎ কেমন গুমোট হয়ে রয়েছে। নীরব রইলো ধূসর।
“ভাইয়া হোস্টেলের কথা বলেছিলাম কিছু জানাওনি যে?”
“ভুলে গিয়েছি।”
বাসায় এসে পৌঁছালো ওরা। গাড়ি থেকে নামতেই বাসার সামনে থাকা ক্যাটস ক্ল ভাইন গাছটির দিকে দৃষ্টি গেল দ্যুতির। প্রতি বছর এই গাছের ফুল দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে সে। এই বছর মন উজাড় করে অজস্র ফুল ফুটেছে। কয়েকটি ফুল ছিঁড়তেই শুনতে পেলো,”ফুল ছেঁড়া ভালো নয়!”
চমকিত নয়নে পিছু ফিরে তাকালো দ্যুতি। তাহমিদের মতো আরেকটা ছেলেকে দেখতেই চমকায়। তাহমিদ সুঠাহ দেহের হলেও এই ছেলেটা তার চেয়েও কম। কিন্তু দেখতে মন্দ না সুদর্শনই! আমতা আমতা করলো নিশু। কারে উঠে চলে গেল ছেলেটি। বাসায় প্রবেশ করতেই দেখলো বেশ কয়েকজন মহিলা বসে রয়েছেন লিভিং স্পেসে। মৃদু হাসলেন দিলরুবা খাতুন। মিনমিন করে সালাম দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই দিলরুবা খাতুন বললেন,”নিশু এদিকে আয়।”
সেদিকে যেতেই পাশে বসালেন। তাহিয়া বেগম বললেন,”ও নিশু তাই না?”
“জ্বী ভাবী।”
“খুব মিষ্টি!”
নিশু লক্ষ্য করলো সবাই তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে রয়েছেন। আমতা আমতা করলো।
“মেয়েকে পছন্দ হয়েছে আমাদের।”
মলিন হাসলেন দিলরুবা খাতুন। হকচকায় নিশু। নিশু লক্ষ্য করলো ভদ্রমহিলার মুখচ্ছবি তাহমিদের সঙ্গে মিল।
“উনারা কে ফুপি?”
“পাঁচ তলায় এসেছেন উনারা।”
“ওহ। ফুপি আমি রেস্ট নিতে যাচ্ছি। আসলেই ক্লান্ত লাগছে!”
“আচ্ছা যা।”
চলে গেল নিশু।
“ভাবী মেয়ে কিন্তু আমাদের পছন্দ হয়েছে।”
কাঁচুমাঁচু করলেন তিনি।
“আসলেই আমার বড় ছেলের ব..”
হঠাৎ বাসায় ঢুকলো ধ্রুব। একসঙ্গে সবাইকে বাসায় ঢুকতে দেখে ভীষণ খুশি হলেন দিলরুবা খাতুন। ভাবলেন নিশ্চয়ই সবাই ঘুরতে গিয়েছে। আরো ভাবলেন নিশুর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। উনার খুশিটা কাউকে প্রকাশ করতে পারছেন না।
“এই প্রসঙ্গে আমরা অন্যদিন কথা বলি কেমন ভাবী?”
“আচ্ছা।”
উনারা ফিরে গেলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সময় তখন ভোর ছয়টা। হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে! বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো বুশরা। ব্যালকনিতে যেতেই একপশলা হীম হাওয়া এসে ছুঁইয়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠলো শরীরটা। স্নোফল হচ্ছে! হাত বাড়িয়ে স্নো নিলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্নোফলের সৌন্দর্য দেখলো। একটি মগ এনে বরফকুচি নিলো। কিচেনে গিয়ে স্টোভ অন করে সসপ্যানে ঢেলে দিলো। বরফকুচি দিয়ে চা-কফি পান করতে পছন্দ করে বুশরা! একমগ কফি বানিয়ে বেডরুমে গিয়ে বেডের উপর বসলো। কফিতে চুমুক দিয়ে ফোন হাতে নিলো। ধূসর তাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে! অজান্তেই জলে টইটম্বুর হলো চোখজোড়া! বুশরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মেয়েদের চাইতে ছেলেরা বেশি ভালোবাসতে পারে না। অবশ্যই এর যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এই যেমন নিশু ধ্রুবকে এত্ত এত্ত ভালোবাসে কিন্তু মানুষটা তার মুখও দেখতে চায় না। মানুষটাকে ভালোবেসে পাগল পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল।
এদিকে দ্যুতিও অনিককে পছন্দ করে,সম্ভবত ভালোবাসে যদিও প্রকাশ করে না কিন্তু তার ভাই ব্যপারটি বুঝেও ইগনোর করে। তদ্রূপ তার বেলায়ও। সে ধূসরকে পাগলের মতো ভালোবাসে মানুষটা জানে অথচ তাকে সবটা সময় ইগনোর করে। এই যে তাকে প্রতিটি জায়গা থেকে ব্লক দিয়ে রেখেছে। একসঙ্গে বিশটি স্লিপিং মেডিসিন খেয়ে সে সু’ইসাইড এটেম্পও করেছে। কিন্তু তাতে ধূসর নির্বিকার। বুশরার মনে হচ্ছে তার শ্বাস আঁটকে রয়েছে! হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে অথচ সারা রাত তার নির্ঘুম পার হয়েছে। মাথা ঝাপসা হয়ে ভারী হয়ে আছে। যন্ত্রণায় টনটন করছে! ছেলেরা যখন বুঝতে পারে মেয়েরা তাদের প্রতি উইক আর তখন থেকেই শুরু হয় যতশত অবহেলা। নিশু যখন প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন ওর কাজিনরা পাশে থাকায় সে আবারও সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু এটাকে কোনো সুস্থতা বলে! এই যে জীবনে একটা দাগ লেগে গেল। আর এত কষ্ট পেলো,ইভেন পাচ্ছেও অথচ অপর মানুষটি জানেও না কিছু! এখনও নিশুর ভয়াবহ পিটিএসডি-এর সিমটম হচ্ছে। সাইক্রিয়াটিস্ট এর মতে কিছু পিটিএসডি চিকিৎসা করা খুব কঠিন। সারা জীবন এর রেশ থেকে যায়। দুঃস্বপ্ন দেখে,ফ্ল্যাশব্যাক হয়,অনেক সময় মেমোরি ড্যামেজ হয়ে যায়। বুশরার মতে,নিঃসন্দেহে ধ্রুব একজন সাইকোপ্যাথ। তা না হলে এভাবে নিশুকে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এত নৃশংসভাবে জ্যান্ত মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখে হ’ত্যা করতে পারতো না। সত্যি বলতে এত কিছুর পরেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই মানুষটার মধ্যে। এরপরেও মানুষটাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে নিশু। কিন্তু কেন তা বুশরার জানা নেই। দোয়া করলো,আর কারো যেন এরকম কষ্টের মাঝ দিয়ে যেতে না হয় যেমনটা নিশুর হয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সৃষ্টিকর্তাকে ভীষণ করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়,পুরুষ মানুষ এমন কেন?এত পাষাণ এবং শক্ত হৃদয়ের কেন? তারা তিনটা নারীই তিনজন পুরুষের কাছে অবহেলিত হচ্ছে! নিশ্চয়ই এই পৃথিবীতে তাদের মতো আরো অসংখ্য নারী রয়েছে অভাগা,অবহেলিত! জলপ্রপাতের ন্যায় অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দু-গাল বেয়ে।
শাওয়ার নিয়ে বেরুলো দ্যুতি। রুমে ঢুকলো নিশু।
“উনারা কেন এসেছেন?”
“কী জানি!”
“মনে হয় তোকে দেখতে এসেছে।”
“হতে পারে!”
“এজন্যই আমি বাসা থেকে কম বের হই। বাইরে গেলেও মাস্ক ছাড়া বের হই না। যেই দেখবে বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে। বিষয়টি বিরক্তিকর!”
শাওয়ার নিতে গেল নিশু। ভেজা টাওয়াল ব্যালকনিতে মেলে বিছানার উপর বসলো দ্যুতি। ফোন অন করে নিউজফিড স্ক্রোল করতেই দেখলো স্ট্যাটাস দিয়েছে অনিক।
“সিঙ্গেল লাইফ আর ভালো লাগে না। কোনো হৃদয়বান নারী প্রেম করতে চাইলে ইনবক্সে নক করতে পারেন।”
এত নির্লজ্জ আর ছ্যাঁছড়া অনিক হতে পারে তা জানা ছিল না। ভেবেছিল আজকের ইনসাল্টের পর লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হবে কিন্তু যেই লাউ সেই কদু! দ্যুতিকে অনলাইনে এক্টিভ দেখে ট্যাগ দিয়ে পোস্ট করলো,”ভিতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয় ট্রমা! ও ও প্রিয় ট্রমা! প্রিয় ট্রমা!”
মেজাজ খারাপ হলো দ্যুতির। দ্রুত ট্যাগ রিমুভ করে টেক্স করলো,”লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই আপনার?”
“না। কুত্তা খাইয়া ফালাইছে সব!”
“এত কথা তখন কাকে বললাম? কাকে ইনসাল্ট করলাম? গায়ে কি গন্ডারের চামড়া? কথা গায়ে লাগে না? ইনসাল্ট গায়ে লাগে না?”
“এখন আর কারো কথা গায়ে মাখি না নতুন একটা সাবান আর পারফিউম কিনছি ওটাই মাখি!”
“লাস্ট ওয়ার্নিং! আপনি আমাকে আর টেক্স কিংবা ট্যাগ দিবেন না এর পরিণাম ভালো হবে না।”
“ছাইড়া যাবা তো যাও! তোমারে বিয়া করলে বাচ্চাকাচ্চাগুলাও তারছিঁড়া হইবো!”
“দু-একটা লম্পট গেলে আরো হাজারটা ভালো ছেলে আসবে।”
“আল্লাহ তোর ব্যবসা বাড়াইয়া দিক!”
“ননসেন্স!”
সোজা মেসেঞ্জার থেকে ব্লক দিলো। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে দ্রুত টেক্স পাঠালো,”ব্লক দিয়া লাভ নাই হাশরের ময়দানে ঠিকই দেখা হবে।”
দাঁতে দাঁত চেপে এখান থেকেও ব্লক করলো। হঠাৎ কল এলো বুশরার। পিক করলো দ্যুতি।
“কী হয়েছে?”
“তোর ভাই আমাকে ব্লক দিয়েছে। ব্লক খুলছে না।”
“কেন?”
“জানি না।”
“তোর ভাইকেও এখন আমি ব্লক দিয়েছি।”
“কেন?”
“ও পিএইচডি কমপ্লিট করে এসেছে ভালো কথা! চাকরি-বাকরি কিছু করে না উল্টো মাথার পিছন দিয়ে ঝুঁটি একটা করেছে। দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় আর বমি আসে।”
“ওতো এমনই!”
“ওর কি সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই?”
“কিছু বলিসনি?”
“আজ ইনসাল্ট করেছি এখন আমাকে ট্যাগ দিয়ে কী পোস্ট করেছে দেখ!”
সোজা ফেইসবুকে ঢুকে তাই দেখলো।
“আচ্ছা ওয়েট।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন করলো অনিককে। পিক করে বলল,”কীরে গিতা আম্বানি কয়দিন পর কল দিছোস?”
“ফাজলামো বন্ধ করবে কবে?”
“হোয়াট?”
“চাকরি-বাকরি করবে না?”
“আমার মা-বাপের এত্ত টাকা কেডা খাইবো?”
“পারলে নিজের যোগ্যতায় কিছু করো। ফকিরের মতো বাবা-মায়ের টাকার দিকে তাকিয়ে থেকো না।”
“ফিতা আম্বানির মতো কথা বলতাছোস?”
“এইসব বাজে কথা বলা বন্ধ করো!”
“কানের নিচে এমন থাপ্পড় দিমু বিটিভির মতো ঝিরঝির করবি।”
“তুমি আজীবন এমন থাকবে?”
“তো কী করবো?”
“দ্যুতির সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক?”
“কোনো সম্পর্ক নেই?”
“তো ডিস্টার্ব করো কেন?”
“কই করলাম?”
“হয়তো প্রেম করো নয়তো বিয়ে করো।”
“বিয়ের আগে প্রেম করা মানে অযথা অন্যের বউকে ফ্রীতে পাহারা দেওয়া! এইসব আমার দ্বারা ইম্পসিবল! যত যাইহোক আমার একটা পেস্টিজ আছে।”
“তো বিয়ে করো।”
“অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করতে গেলেও ভয় লাগে। পরে দেখা যাবে কার না কার সূর্যের আলো,চাঁদের আলো,তারার আলো নিয়া টান দিচি। তারপর বিয়ের পরে স্ত্রী রাগ করলে সেটা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলেও ইভটিজিং!”
“ফাইজলামি পাইছো?”
“না তো! তবে ভাবছিলাম ধুতিকে নিয়ে ঘর বাঁধবো কিন্তু যা শুরু করছে তাতে বারান্দাও হবে না!”
“মেন্টাল!”
“পাগল!”
“দ্যুতিকে বলবো বিয়ে করে নিতে। লম্পটের জন্য বিয়ে ভেঙ্গে লাভ নেই। ডিজগাস্টিং!”
“আমি নিষেধ করছি তারে বিয়ে করতে না?”
“ও তো এমন কিছু বলেনি!”
“তুই বললি ক্যান?”
“বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা।”
“গীতা!”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো বুশরা। পাগল একটা। মাথা শূন্য করে ফেলবে! ভীষণ বিরক্ত হয়।
“হ্লার অতি শোকে বাপ্পারাজের মতো পাথর হইতে চাইছিলাম অথচ দিলদারের মতোন কমেডিয়ান হয়ে গেছি! আসলেই আমাদের লাইফটাই এমন বাপ্পারাজের মতো! হেনাকে কেউ পায় না। ধূৎ জীবনটা দুঃখে দুঃখে গেল বাপ্পারাজের মতো,ছরি চ্যাকা খাইতে খাইতে গেল।”
ডাক পড়লো অনিকের।
“অনিক ভাত খাবি না?”
“ইচ্ছা নাই।”
“তাড়াতাড়ি আয়।”
দুপুরে ভাত খায়নি অনিক। বেদনাবিধুর হৃদয় নিয়ে রুমের ভিতর ছিল আর সিগারেট পান করেছিল। দলীয় লোকজন আসায় লিভিং স্পেসের দিকে যাচ্ছিলেন অনিকের বাবা।
“সারাদিন কোথায় ছিলে?”
“কেন?”
“যেটা বলেছি উত্তর দাও।”
“যেখানে ইচ্ছে সেখানে।”
“ওয়াক! ওয়াক! কী বিশ্রী গন্ধ! এই দাঁত ব্রাশ করো না?”
“যেখানে চুম্মা খাওয়ার কোনো মানুষ নাই সেখানে ব্রাশ করাটা বিলাসিতা!”
“জুতাটা কই!”
“পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমার শুধু সাপের সাথেই দেখা হয়।”
“কী বললে?”
“সাপ!”
ধূসরের রুমের দিকে পা বাড়ালো দ্যুতি। ধ্রুবকে দেখতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ধ্রুবর মনে হলো দ্যুতি তাকে ইগনোর করছে এবং ওই চোখে ঘৃণা ছিল। চোখে-মুখে ছিল ক্রোধের আভাস। বিছানায় বসে ল্যাপটপ অন করলো। ধূসরের ডোর নক করলো। খুলতেই দেখলো শাওয়ার নিয়েছে। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছছে।
“কী হয়েছে?”
“কথা ছিল?”
“ওই গাধাটার বোনের সাফাই গাইতে আসছিস?”
“তুমি ঠিক কী করতে চাও?”
“কী বললি?”
“ওকে নাকি ব্লক করে রেখেছো?”
“তোকে চামচামি করার জন্য পাঠিয়েছে?”
“তোমরা ছেলেরা এমন কেন?মেয়েদের ইমোশন নিয়ে কেন খেলো?”
“সর সামনে থেকে!”
“ব্লক করে রাখলে কেন?”
“তোকে এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে?”
“ও তোমাকে ভালোবাসে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
“ভাইয়া প্লিজ এতটা নির্দয় হয়ো না।”
“ওর সাথে আমাদের যাবে না।”
“কেন যাবে না?”
“তাদের ফ্যামিলি আমাদের থেকেও উচ্চবিত্ত। তাদের লেভেলের সঙ্গে আমাদের লেভেল যাবে না।”
“তো কী হয়েছে?”
“আমি বেকার মানুষ। তার দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। প্রতিমাসে তার স্কিন কেয়ারের জন্য ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা লাগে। হাতখরচ,শপিং,রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া কিংবা অন্যান্য খরচ বাদ। যেখানে আমার ১টাকাও ইনকাম নেই।”
“আশ্চর্য! আব্বুর টাকাপয়সা কম আছে নাকি! পরিবারে না হয় আরেকজন সদস্য বাড়লো। আর সেটা তো আমাদের মানুষই তাই না!”
“আমি যাকে বিয়ে করবো সে আমার ইনকামই খাবে আমার বাবার না। আমার বাবা তার দায়-দায়িত্ব নিতে বাধ্য না।”
“এটা কেমন কথা?”
“আমার বউকে আমি কারো ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে অবহেলা করবো না। একটাকা ইনকাম হলেও বউকে নিজের বাহুডোরে রাখবো। যাতে কোনো পরপুরুষ তার ছায়া মাড়াতে না পারে। পুরুষ হলে এমনই হবো স্বামী হলে এমনই হবো! বউ আদর-যত্নের জিনিস,ভালোবাসার জিনিস,সোহাগের জিনিস। তাই স্বার্থপরের মতো তাকে একেকবার একেক জনের ঘাড়ের উপর ফেলে যাব না। কারণ আত্মসম্মান আমার যেমন আছে তদ্রূপ আমার বউয়েরও।”
“এটা তো ভালো ডিসিশন।”
“আমার বউকে রানি বানিয়ে আমি হবো রাজা। বিবেকহীন,সেলফিসের মতো বোজা মনে করে,অ্যাটিটিউড দেখিয়ে বউকে চাকরানি বানিয়ে নিজে চাকর হয়ে আত্মসম্মানহীনের মতো আরেকজনের কাঁধে ফেলে যাব না। যারা বউকে সম্মান করতে জানে না তারা হচ্ছে কাপুরুষ! চাকর!রূপগুণস্বাস্থ্য কয়দিনের আসল হচ্ছে মন,বিবেক। টাকা গেলে একসময় টাকা পাওয়া যায় কিন্তু মানুষ হারিয়ে গেলে আর কখনো পাওয়া যায় না।”
কথাগুলো জোরে জোরে এবং শুনিয়ে শুনিয়েই বললো ধূসর। শুনতে পায় ধ্রুব। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো।
“বারো নারীর পিছনে ঘুরা আমার স্বভাবে নেই! কারণ আমি বীরপুরুষ! বারো নারীর পিছনে কাপুরুষেরা চাকরের মতো ঘুরে। সুপুরুষরা দায়িত্ব নিতে শিখে। ধরেই অধিকার নিতে আসে না।”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব।
“বুঝতে পারলাম প্রিয় মানুষের প্রতি তুমি খুব সেন্সেটিভ! এখন ওকে মেনে নাও।”
“আমি বেকার। আমার কোনো টাকাপয়সা নেই বড়লোকের মেয়েকে পালার।”
“বিয়ে করে নাও রিযিকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যার যার রিযিক সে নিয়ে আসে। আর বউদের সঙ্গে সৌভাগ্য আসে। কথায় আছে,বউ ভাগ্যে কপাল ফেরে! বিয়ে করলে দেখিও ভালো কিছু হবে। তোমার ভাগ্যও খুলে যাবে। নারীরা কোমলমতী এবং সৌভাগ্যবতী হয়। তাদেরকে অবহেলা নয় কদর করতে হয়। কিছু গাধা,কাপুরষরা জানে না বউয়ের মর্ম। তারা বউকে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে আগেই টাকার পিছনে দৌড়ায়।”
“অসম্ভব!”
“ইন ফিউচারে হয়তো তুমি জব করবে,অনেক টাকা ইনকাম করবে বাট জীবনে কোথাও ওই মানুষটাকে পাবে যে তোমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে। জীবনে টাকাপয়সা হয়তো একটা সময়ে ঠিকই আসে কিন্তু যে মানুষটাকে তুমি হারাবে তাকে কি আর কোনো কিছুর বিনিময়ে পাবে?এমন ভালোবাসা ক’জন পায় বলো? আর তুমি পেয়েও পায়ে ঠেলে দিচ্ছ! তুমি চাইলে ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে,চেষ্টা থেকেই সবকিছুর পরিবর্তন হয়।”
“চাই না ওকে।”
“কী করতে চাইছো?”
“আমাদের সমাজে বিয়ে শুধু দুইজন মানুষের ব্যপার নয়। এটা দুইটি পরিবারের ব্যপার। এখন ও অনেক ইমম্যাচিওর তাই পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। কাউকে কারো ভালো লাগতেই পারে তার অর্থ এই নয় যে সেটা ছাদনা তলা পর্যন্ত নিতে হবে। এই পরিবারে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। তাই সসম্মানে তার সরে যাওয়া উচিৎ। জীবন অনেক বড়। তাই ওকে বল ওর ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে। তার সাথে আমাদের যাবে না। আমার সাথে থাকতে হলে ৫০০টাকা দামের শাড়ি অথবা থ্রি-পিস,দু’বেলা ভাত আর নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে কোনো কাজের লোক রাখা যাবে না। আগেই বলেছি আমি গরীব ও বেকার এবং তার অযোগ্য।”
“আমি রাজি!”
চমকায় ধূসর। দেখল ভিডিও কলে রয়েছে বুশরা। নাইটি পরনে। চোখ সরিয়ে নিলো। তার মানে সব শুনেছে! চোয়াল শক্ত করলো।
“আপনার সিদ্ধান্তে আমি রাজি। আপনার টাকা লাগবে না আমি আমার বাবার টাকাও নিবো না। দরকার পড়লে আপনার সঙ্গে জব করে এডজাস্ট করে নিবো।”
“আমার বউকে তো আমি কোনো কর্পোরেট অফিসের চাকরানি বানাব না দরকার পড়লে নিজে চাকর হবো। আমার বউ অন্যের অধীনে কাজের লোকের মতো আদেশ-নির্দেশ মেনে কাজ করবে,অফিসে বসের সেবা ও তার কথামত উঠবস করবে,তাদের জন্য খাবার সার্ভ করবে,তাদের সাথে লং ড্রাইভে যাবে আমি তো সেটা আমার শরীরে রক্ত থাকতেও টলারেট করবো না।”
মুগ্ধ হয় বুশরা।
“আমি রাজি!”
“তোমাদের মতো মেয়েরা প্রথম প্রথম এইসব বলে পরে ঠিকই ঝামেলা সৃষ্টি করে।”
“আপনার জন্য আমি সব পারবো। দরকার হলে আপনি আমার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করুন অথবা লিখিত নিন। অমান্য করলে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন না হয়।”
“পসিবল না। তোমার রাস্তা মাপো।”
“ধূসর প্লিজ!”
“ভাইয়া শোনো,টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় কিন্তু সুখী হওয়া যায় না। আমার এ কথার গভীর অর্থ আছে,বুঝতে চেষ্টা করো। সুখী হওয়া অনেক বড় ইবাদত। এ ইবাদত সবাই করতে পারে না। তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয় বরং তোমাকে যে গভীরভাবে ভালোবাসবে তাকে বিয়ে করো। সে সবসময় আগলে রাখবে। ডাল-ভাত খাবে তবুও সুখী হতে পারবে। ভুল করেও সুখ কিনতে যেও না। তাহলে আর সুখী হতে পারবে না। তুমি সুখ কিনতে যাবে অর্থাৎ তোমার বিলাসী জীবনযাপন করতে যাবে তখন আর সুখী হবে না। সুখী হওয়া অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবার কপালে জুটে না।”
“ভালবাসা দিয়ে সংসার চলে না,চাল-ডাল কিনতেও পয়সা লাগে। ইসলামে সমতা রক্ষা করে বিয়ে করতে বলেছে। এমনি এমনি তো আর বলেনি। কুফু মিলিয়ে বিয়ে করা উত্তম। ওকে বল ওর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে তাদের ফ্যামিলির লেভেল অনুযায়ী বিয়ে করে নিতে। এইসব লোক দেখানো আবেগে পড়লে পরে বুঝবে কত ধানে কত চাল। আমাদের পরিবারের সাথে ও কখনো খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। আর বিয়ে করলে ভালোলাগা-ভালোবাসা থাকে অনলি দু-চার মাস। আর বাকি জীবনটা চলে দায়িত্ববোধ,শ্রদ্ধা এবং প্রতিশ্রুতি দ্বারা। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। যখন অভাব আসবে তখন আমার প্রতি তার আর কোনো ভালোলাগা-ভালোবাসা আসবে না আসবে ঘৃণা,ঝগড়া ইত্যাদি। যদি সংসারে সুখ চায় তাহলে কুফু অনুসারে বিয়ে করে নিতে বল তাকে। অর্থাৎ তার লেভেলের কোন ছেলের সাথে বিয়ে করে নিতে বল। আমাদের ফ্যামিলিতে বিয়ে হলে সে এডজাস্ট করতে পারবে না।”
“আমি কথা দিচ্ছি আমি এডজাস্ট করতে পারবো।”
বের করে দিলো দ্যুতিকে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা করে সুখটান দিলো।
গোসল সেরে শুয়ে রইলো নিশু। শরীরটা কেমন ভেঙ্গেচুরে মুষড়ে আসছে।
“নিশু শুনছিস?”
“জ্বী ফুপি।”
“এদিকে আয় তো!”
ব্যালকনিতে টাওয়াল মেলে দিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
“জ্বী ফুপি!”
“একটু পায়েস রান্না করতো!”
“আচ্ছা।”
এক স্টোভে উড়িষ্যার বিখ্যাত নরম তুলতুলে মণ্ডা পিঠা বানাতে লাগলেন তিনি। ধ্রুবর পছন্দের এটা। বাকি স্টোভে পায়েস বসালো নিশু। স্টোভের আগুনে পায়েস হচ্ছে। নতুন গুড়ের গন্ধ ম ম করছে পুরো বাড়িতে। একটা সাদা তরল মিষ্টি গোলা থেকে দিলরুবা খাতুন কী সুন্দর করে পিঠে বানিয়ে ফেলছেন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নিশু। শব্দহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিনি একজন মা। আর মায়েরা অত কম আয় থেকেও ব্যাংকে টাকা রাখতে পারেন। মায়েরা সব পারেন সবার জন্য সন্তানের জন্য। নারকেলের পুরের মতো মানুষের জীবন। নরম চাদরে ঢেকে রাখে সব ক্ষত। সুতির শাড়ি জড়ানো মায়েদের হাত ধরে বাড়িতে আসে সুখ-শান্তি! হঠাৎই নিজের মায়ের কথা মনে পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বর্ষার ভরা বিলের মতো টইটম্বুর হয়ে গেল টানাটানা নয়নজোড়া! ভেজা ঢোক গিলে খুব গোপনে মুছে নিলো অশ্রুটুকু। প্রলম্বিত পাপড়িগুলো ভিজে জবুথবু। দু-তিন রকমের পিঠা বানিয়ে বেরিয়ে গেলেন দিলরুবা খাতুন। ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছেন তিনি। হঠাৎ পায়েসের ঘ্রাণে বেরিয়ে এলো ধূসর। দেখলো বেগুনী রঙের শাড়ি পরে কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করছে নিশু। শাড়িটা এত্ত সুন্দর যে চোখ লেগে গেল। ডুয়েল টোনের বেগুনি কালারের সেমি মসলিন শাড়ি পরনে নিশুর। পুরো শাড়িজুড়ে এমব্রয়ডারি করা ময়ূরের পালক। রংটা এত বেশি সুন্দর যে এক্সট্রা প্রশংসা যুক্ত হয় প্রশংসার ঝুলিতে। শাড়ি সুন্দর না নিশু সুন্দর বুঝতে পারলো না! তবে শাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।
“কিচেনে কী করছিস?”
“একটু পায়েস রান্না করছি!”
“তুই না অসুস্থ?”
“একটুই তো! আস্তে বলো ফুপি শুনবে।”
“দ্রুত বের হয়ে রেস্ট কর।”
“ভাইয়া শোনো না!”
আবদারী-আহ্লাদী স্বর নিশুর। উপেক্ষা করতে পারলো না ধূসর।
“কী?”
“ভাইয়া বাসায় মাল্টা শেষ হয়ে গিয়েছে। এককেজি মাল্টা আর এক প্যাকেট কুলশন ভার্মিছিলি সেমাই নিয়ে আসো তো যাও! আর সঙ্গে ঘি এনো।”
“এত কিছুর দরকার নেই এখন।”
“যাবে!”
“যাচ্ছি! এবার তো তোর জামাইকে খাটাতে পারিস তা না করে সারাক্ষণ আমাকে খাটাস! পেয়েছিস ও তোরা আমাকে বোকাসোকা।”
“ঘ্যানঘ্যান না করে তাড়াতাড়ি যাও।”
বেরিয়ে গেল ধূসর। তিন-চার রকমের বাদাম,কিশমিশ বের করে ভিজিয়ে রাখলো নিশু। ধ্রুবর জন্য পায়েস,ধূসর-ধীরাজ ওরা বাদ যাবে কেন! ওদের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। প্রায়োরিটি দিলে সবাইকে দেওয়া উচিৎ! ধূসর-ধীরাজ,দ্যুতি এদের জন্য বেশি করা উচিৎ! নিঃস্বার্থভাবে ওরা তার জন্য করে। সে-তো কিছু করতে পারে না। বুকটা আদ্র হয়ে চোখজোড়া ফের টইটম্বুর হয়ে গেল। জল মুছে নিলো।
মায়াকুমারী পর্ব ২৫
“খালা চিংড়ি,ব্রকলি,তিনটে ডিম আর কাঁচা ভুট্টাগুলো নিয়ে আসো তো!”
তাই করেন তিনি। ডিমগুলো সিদ্ধ বসিয়ে চিংড়িগুলোর খোসা ছাড়িয়ে,ব্রকলি কেটে,ভুট্টাগুলো ছাড়িয়ে সব মিক্সড করে সাদা তিল ছড়িয়ে রান্না করে নিলো। খুব খিদে পেয়েছে তার। ঘ্রাণ পেতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো দ্যুতি।
“খিদে পেয়েছে নিশু। কী রান্না করছিস?”
“টেবিলে নিয়ে খা।”