মায়াকুমারী পর্ব ৩৬
মেহেরিন আনজারা
ওদের কান্না শুনতেই বাসার সবাই ছুটে এলো। আঁতকে উঠে দিলরুবা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে তোদের?”
কী বলবে,কিছু বলতে পারলো না ওরা। মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্যুতি।
“আম্মু গো! আমি খুব জঘন্য কাজ করে ফেলেছি!”
থমকান তিনি।
“কীসের জঘন্য কাজ?”
“বলতে পারবো না। বললেও বিশ্বাস হবে না তোমাদের।”
গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন আসাদ সাহেব। বুঝে উঠতে পারলেন না কিছু। সকালে ধ্রুবকে এই রুম থেকে বেরুতে দেখেছেন। আর কাল তো সব ঠিক ছিল। কী প্রতিক্রিয়া করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না!
“আমি মা’র্ডার করেছি আম্মু!”
বুকের ভেতর মোচড় দিলো।
“কী বলছিস?”
“আম্মু! আম্মু গো! ও আম্মু,আমি এখন কী করবো?”
বাকরুদ্ধ হলেন তিনি। আগামাথা তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। ধ্রুব এলো।
“দ্যুতি কী হয়েছে?”
তীরের বেগে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
“ভাইয়া! ও ভাইয়া,অনিক ঠিক নেই। ওকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েছে। ওর অবস্থা ভালো নয়! আমার খুব ভয় হচ্ছে ভাইয়া!”
হতভম্ব হলেন উনারা। বাবা-মাকে ইশারা দিলো বেরিয়ে যেতে। নির্লিপ্তে বেরিয়ে গেলেন উনারা।
“আমি এখন কী করবো? আমিও কি নিশুর মতো পাগল হয়ে যাবো?”
চমকিত নয়নে তাকায় ধ্রুব।
“মানে?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আমি নিশুর মতো পাগল হতে চাই না ভাইয়া! আমি ভালো থাকতে চাই! আমি পাগল হতে চাই না! পাগল হলে আমি সব ভুলে যাবো।”
কেমন অসহায় কণ্ঠস্বর দ্যুতির। ঠিক বুঝতে পারলো না ধ্রুব। নিশু তো পাগল নয়! সব মাথার উপর দিয়ে গেল।
“কী বলছিস?”
অশ্রুসিক্ত এবং অসহায় নয়নে তাকায় দ্যুতি।
“ঠিক বলেছি ভাইয়া।”
কেমন কাতর গলা!
“কী হয়েছিল?”
“তুমি যখন নিশুকে ডিভোর্স দিয়ে গেলে তখন ওর মেমোরিলস হয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিশু ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট ছিল অনেক বছর! আমি নিশুর মতো ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট হতে চাই না!”
চমকিত নয়নে তাকায় ধ্রুব। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনবরত কাঁদতে লাগলো নিশু। দ্যুতির কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না! ধ্রুব,ধূসর,অনিক,দ্যুতি,বুশরা,নিজের মা সবার কথা মনে পড়ছে! কার জন্য কাঁদবে সে? তার তো অনেক দুঃখ!
“অনিকের জন্য আমি পাগল হতে চাই না!”
“কিচ্ছু হবে না বোকা! আমার বিশ্বাস খুব শীঘ্রই সেরে উঠবে দেখিস! আবারও আউল ফাউল বেফাঁস কথাবার্তা বলে তোকে বিরক্ত করবে মিলিয়ে নিস।”
দ্যুতির মন মানে না!
“পাসপোর্ট থাকলে চল আমরাও যাই।”
“না আমি ওকে ওমন অবস্থায় দেখতে পারবো না।”
থমথমে মুখে লিভিং স্পেসে বসে রইলেন আসাদ সাহেব। কোনোকিছুই বুঝতে পারছেন না। দিলরুবা খাতুনের ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেল। অস্থির অস্থির লাগছে উনার। গত কয়েক বছর থেকেই মেয়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখলেন। বিয়ের কথা উঠলেই কেমন জানি আচরণ করে। জিজ্ঞেস করলেও হেসে উড়িয়ে দেয়। বুঝতেই দেয় না কিছু। জীবনে প্রথম মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখেছেন। খারাপ কিছু না হলে মেয়ে কখনো এমন করে কাঁদার কথা নয়! কীভাবে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। চোখে-মুখে ঝাপসা দেখছেন। শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে।
“দিলরুবা কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?”
কেমন ঘামতে লাগলেন তিনি।
“আমার মেয়ের কী হয়েছে,কী বলছে এইসব?”
কেমন মরা কণ্ঠস্বর উনার।
“তুমি টেনশন করছো কেন?”
কিছু বলতে পারলেন না হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। ছেলেদের ডাকাডাকি করতে লাগলেন আসাদ সাহেব।
সব মিলিয়ে প্রায় তিন-চার ঘন্টার মধ্যেই ব্যাংকক নিয়ে আসা হলো অনিককে। চিকিৎসা চলছে! রাত থেকে এই অব্ধি কাঁদতে কাঁদতে আদনীন ফেরদৌসের দু-চোখ ক্ষয় হয়ে গেল যেন। একদিকে পুত্র অন্যদিকে স্ত্রীর ওমন কান্না ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ইফতেখার মির্জার হৃদপিণ্ডকে। শক্ত মনের অধিকারী মানুষটা কেন জানি স্ত্রীর কান্না সহ্য করতে পারছেন না। অবশ্য আগে কখনো স্ত্রীকে কাঁদতে দেখেননি তাও আবার এমন করে। কেমন জানি লাগলো। বুঝতে পারলেন স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির দিকে মন দিতে গিয়ে তেমন একটা স্ত্রীকে স্পেশাল কোনো মোমেন্ট উপহার দিতে পারেননি। স্ত্রীও অবশ্য কখনো অভিযোগ করেননি। তবে সবসময়ই মলিন মুখে থাকতেন। হয়তো বলতে গিয়েও আবার নীরব হয়ে যেতেন। এভাবে জীবনের গোল্ডেন সময়গুলো তিনি কখন যে শেষ করে ফেললেন বুঝে উঠতে পারলেন না। অপরাধবোধে মাথা নুয়ে এলো। ভাগ্যগুণে পরীর মতো সুন্দরী বউ পেয়েছেন তবে কদর করতে জানলেন না রাজনীতি,ক্ষমতার অহংকার এবং মোহে পড়ে। সে যাইহোক,তবে আজ বুঝতে পারলেন বছরের পর বছর স্ত্রীকে তিনি নীরবে কষ্ট দিয়ে এসেছেন।
চোখজোড়া হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে এলো। অহংকারের দাপটে কখনো মাটিতে পা পড়েনি উনার। স্ত্রী তাঁর বাবা-মা,ভাই-বোন সবাইকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে কাঁদলেও একবারও উনাকে অভিযোগ করে কাঁদেননি। মনে হচ্ছিল সবার মাঝে তিনি স্ত্রীর কেউ নন। অবশ্য দেয়ালটা তো তিনি নিজেই অনেক আগে তুলে দিয়েছিলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বুজে তপ্তশ্বাস ফেললেন। পুত্রের কথা মনে পড়তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। এর একটা বিহিত করেই ছাড়বেন তিনি। উনার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে নিশু-দ্যুতির তথ্য নিলেন এবং ফোন করলেন থানায়। দু’জনকে আসামি করে হ’ত্যা চেষ্টার মামলা দায়ের করলেন। রাতে অনিককে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করার ঘটনাটি কিছু লোক দেখেছিল। মামলা শেষে আসামীদেরকে গ্রেফতার করার কড়া নির্দেশ দিলেন এবং এখুনিই! উনার একমাত্র পুত্রকে হ’ত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল আর তিনি কীভাবে ওই আসামীদেরকে ছেড়ে দিবেন তা তো হয় না! তিনিও দেখিয়ে ছাড়বেন কী কী করতে পারেন। সোজা ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবেন নয়তো উনার নামও ইফতেখার মির্জা নয়। ক্ষমতার দম্ভে ফুলেফেঁপে উঠলো উনার বুকের ভেতর। একজন মন্ত্রী হিসেবে সমাজে উনার প্রেস্টিজ রয়েছে। ছেলের বাউণ্ডুলে চালচলনকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি তিনি। কিন্তু অনিক তো শোনার মানুষ নয়। এই নিয়ে ছেলের গায়ে মাঝেমধ্যে হাতও তুলতে দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। তবে কখনো কোনো মেয়েকে ইভটিজিং কিংবা ব্যাড হ্যাবিটের রেকর্ড নেই সেই বিষয়ে তিনি সবসময়ই চোখ-কান খোলা রেখেছেন। কী এমন হলো যে দুটি মেয়ের হাতে মুমূর্ষু অবস্থায় ফিরলো ছেলে!
মন্ত্রী সাহেবের কড়া নির্দেশ পেতেই পুলিশ এসে ভরে গেল স্বপ্নমহল ভবনে। পুলিশকে আশা করেননি কেউই। নিশু-দ্যুতিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝামেলা পাকালো। শোকে মূহ্যমান দ্যুতি পাথর হয়ে রইলেও আতঙ্কিত হয়ে রইলো নিশু। সে কখন অনিককে হ’ত্যার চেষ্টা করেছে! সে-তো বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টো দ্যুতির দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এই তো এখনও ব্যথা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করছে সকল ব্যথা,যন্ত্রণা! আর কত কষ্ট পাবে সে! অশ্রুর জলধারা বইতে লাগলো সফেদ দু-গাল বেয়ে। নাক-মুখ,চোখ এবং পুরো মুখশ্রী কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। দিকবিদিকশুন্য হলেন আসাদ সাহেব। অনিকের বিষয়টি জানতেই তেঁতে উঠলেন। কাল মানহানির মামলা করলে আজ বোধহয় এত ঝামেলায় পোহাতেন না! কালকের ঘটনাটি তিনি ভুলেননি। বিজনেস পার্টনারদের সামনে ইনসাল্ট হয়েছিলেন।
ছেলেটির প্রতি মেয়ের দূর্বলতা আছে বলে কোনো ব্যবস্থা নেননি। পিতা হলেও মেয়ের চোখের ভাষা তো বুঝেন। উনাকে শান্ত থাকতে বলে গম্ভীর হয়ে পুলিশদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো ধ্রুব। কিন্তু ওর কোনো কথা আমলে নিলো না পুলিশ। স্বয়ং মন্ত্রীমশাই কড়া নির্দেশজারি করেছে মানে পালন করতে হবেই এর কোনো হেরফের করা যাবে না। কোনোভাবেই বিষয়টি হ্যাল্ডেল করতে পারলো না ধ্রুব-ধূসর। এটা তো সত্যি যে দ্যুতি অনিককে বাজেভাবে আঘাত করেছে কিন্তু নিশুকে ফাঁসানোটা নিতে পারলো না। বেচারি এমনিতেই রোগী। কাউকে দেখলেই ভয়ে আধমরা হয়ে কাঁপতে থাকে সেখানে আবার হ’ত্যার চেষ্টা করবে এটা হচ্ছে একটা বানোয়াট কনস্পায়ার। অবস্থা সুবিধার নয় দেখে বুশরাকে ফোন করলো ধীরাজ। বুশরা তখন ব্যাংকক যাওয়ার জন্য লাগেজ গুছিয়ে ড্রেস পরে রেডি হলো। পাঁচ মিনিট বাদেই বেরুবে সে। হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করতেই দ্রুত পিক করলো।
“হ্যালো ধীরাজ!”
“সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে আপু!”
“ক..কী হয়েছে?”
শ্বাস আঁটকে রইলো বুশরা। দ্যুতি কী করেছে আবারও?
“পুলিশ এসে ঝামেলা করছে!”
শ্বাস ফেললো।
“কেন?”
“তোমার বাবা ওদের দু’জনের নামে মা’র্ডার কেইসের মামলা করেছে!”
“কখন?”
“আজ।”
“এখন?”
“দু’জনকে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝামেলা করছে পুলিশ। দ্যুতি আপু না হয় আঘাত করেছিল কিন্তু নিশু ভাবী তো নির্দোষ! ভাবীর নামে মামলা করলো কেন?”
“ওয়েট! ডোন্ট ওয়্যারি,আ’ম লুকিং ইনটু দ্যা ম্যাটার।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো বুশরা। ভিডিও কল করলো তার বাবাকে। বিষন্ন মনে পিক করলেন তিনি।
“পাপা তুমি কি পাগল হয়েছো?”
জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
“মামলা করেছো কেন?”
“ভাবলে কী করে আমার ছেলের খু’নিদের আমি ছেড়ে দিবো?”
“নিশুর নামে মামলা করলে কেন?”
“ওই মেয়েকে ভালো ভেবেছিলাম। ভাবখানা এমন যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না!”
তাচ্ছিল্যতা উনার চোখ-মুখ জুড়ে।
“পাপা ভুল হচ্ছে তোমার। ও আঘাত করেনি দ্যুতি করেছে।”
“দু’জনেই করেছে। ছাড়বো না কাউকে।”
“পুলিশদের চলে যেতে বলো পাপা।”
“অসম্ভব! ওদের আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো! জেলের ঘানি টানাবো। ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবো।”
“পাপা তোমার ছেলে ভালো?”
“কী বলতে চাও?”
“তোমার ছেলে কেন মেয়েদের ইভটিজিং করে?”
“হোয়াট?”
“এখন ওরা যদি উল্টো তোমার ছেলের নামে মামলা করে?”
“কী বলতে চাও?”
“ওরা যদি বলে যে তোমার ছেলে তার গ্যাংদের নিয়ে রেপ করার চেষ্টা করেছে আর ওরা আত্মরক্ষার জন্য আঘাত করেছে তখন কী করবে? মুখ থাকবে তোমার?”
চোয়াল শক্ত করলেন।
“ব্ল্যাকমেইল করছো?”
“নয়তো তোমার ছেলে মার খায় কেন? আর কারো ছেলে খায় না কেন?”
“সাট আপ!”
“আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। জেলে নিয়েই ছাড়বেন! উনাকে ব্ল্যাকমেইল করছে এইটুকু আণ্ডাবাচ্চা মেয়ে! সাহস কত! বার কয়েক কল দিলো পিক করলেন না। উনার এসিস্ট্যান্টকে কল দিলো। পিক করতেই বলল,”পাপাকে বলে দাও এই ড্রামা বন্ধ করতে। নয়তো আমি সু’ইসাইড করবো।”
ঘাবড়ে গেল শারাফাত।
“বলে দাও।”
“দিচ্ছি।”
ভয়ার্ত গলায় বলল,”স্যার ছোট ম্যাম ব্ল্যাকমেইল করছে!”
“করুক।”
শুনতে পায় বুশরা। ভিডিও কল দিলো।
“পাপার সামনে ধরো।”
মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
“পাপা! ভাইয়া দ্যুতিকে ভালোবাসে। তুমি তার ভালোবাসাকে এইভাবে কলঙ্কিত করো না। তোমার ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরলে এলোমেলো করে ফেলবে তোমাকে!”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
“আমার দিকে তাকাও পাপা!”
তাকালেন না তিনি।
“আমার ভাইয়ের ভালোবাসার হাতে হাতকড়া উঠবে তো আমার গলা দড়িতে ঝুলবে!”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন তিনি। ফ্যানের সঙ্গে একটি মোটা দড়ি বাঁধলো বুশরা।
“ভালোবাসা যদি বন্দী হয় আমি হবো মুক্তির আগুন!”
“ব্ল্যাকমেইল করছো?”
“হ্যাঁ! আমার ভাইয়ের ভালোবাসার জন্য।”
“ভেবেছো আমি ইমোশনাল হব?”
দড়ির ভেতর গলা ঢুকাতে নিতেই চেঁচিয়ে উঠলেন।
“স্টপ! স্টপ!”
“পুলিশকে চলে যেতে বলো!”
“ইম্পসিবল!”
“তো ঠিক আছে!”
“থামো বলছি!”
“চলে যেতে বলো!”
একমাত্র মেয়ের ব্ল্যাকমেইলের কাছে পরাজিত হয়ে ফোন করলেন পুলিশকে এবং ফিরে যেতে বললেন।
“কিন্তু আমি মামলা তুলবো না। আমার ছেলের জীবনের সঙ্গে ওই মেয়ে দুটোর আয়ু! আমার ছেলে বাঁচবে তো ওরাও বাঁচবে।”
“ওদের সঙ্গে আমার আয়ুও। ওরা বাঁচবে তো আমিও বাঁচবো।”
অগ্নি চোখে তাকিয়ে রইলেন। আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে সমানে! মুষ্টিবদ্ধ করলেন হাত!
“এইটুকুন আণ্ডাবাচ্চা মেয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?”
বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন তিনি।
“ভুলে যেও না আমি তোমার মেয়ে! তোমার রক্ত আমার শরীরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে!”
চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলেন।
“তুমি আমার জন্মদাতা পিতা আর আমি তোমার একমাত্র মেয়ে!”
মন্ত্রী সাহেবের ফোন পেতেই চলে গেল পুলিশ। ঠিক কী হলো বুঝে উঠতে পারলো না দু-ভাই। তপ্তশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালো দু’জন। শপে গেলেন না আসাদ সাহেব। মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। একদিকে স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে তো আরেক দিকে মেয়ে। অন্যদিকে নিরপরাধ দুটো মেয়েকে মা’র্ডার কেইসের আসামি করে বসে আছে। মস্তিষ্ক টগবগ করছে উনার। যতটুকু বুঝতে পারলেন অনিককে আঘাত করেছে দ্যুতি কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হলো না উনার। উনার বিশ্বাস মেয়ে এমনটা করতেই পারে না ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তিনিও এক কাঠি উপরে। মন্ত্রী সাহেব ষড়যন্ত্র করছে আর তিনি আঙ্গুল চুষবেন তাতো হবে না। তিনিও লইয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানহানি,ইভটিজিং এবং রেইপ কেইসের মামলা দিয়ে বসলেন অনিকের নামে। এবার তিনিও দেখবেন নাকউঁচু মন্ত্রীর সাহেবের কত ক্ষমতা! তিনিও টক্কর দিয়ে দেখিয়ে দিবেন কার সঙ্গে প্রতিনিয়ত উঠাবসা উনার। তীরের বেগের ন্যায় নোটিশ পেতেই দাঁতে দাঁত চাপলেন মন্ত্রী সাহেব। এত বড় স্পর্ধা! তিনিও দেখিয়ে ছাড়বেন কত ধানে কত চাল! তিনিও জেলের ঘানি টানিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে ছাড়বেন ওই মেয়ে দুটোকে। ইগোয় লাগায় রাগে-জিদে নাক ফুলে এক হাত হয়ে গেল।
সিগারেট ধরালো ধ্রুব। মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। কী থেকে হঠাৎ কী হলো! এত এত টেনশন নেওয়া যাচ্ছে না। নিরপরাধ নিশুকেও ফাঁসালো ওই নাকউঁচু মন্ত্রী সাহেব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ইচ্ছে তো করছে লোকটার নাক-মুখ ঘুষিয়ে চেহারার রং বদলে ফেলতে কিন্তু অসম্ভব এটা। হুট করে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে উঠলো দ্যুতির বলা কথাগুলো। দ্যুতি বলেছিল নিশু পাগল হয়ে গিয়েছিল এবং ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট অর্থাৎ সে স্বাভাবিক নয়। অস্থিরতা শুরু হলো মনের ভেতর। ওরা দু’জনই আপসেট হয়ে রয়েছে আপাতত বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। বাবা-মায়ের অবস্থাও জটিল হয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে কেউই স্বাভাবিক নয়। ধীরাজ ভার্সিটিতে গিয়েছে। বাসায় রয়েছে শুধু ধূসর। হ্যাঁ ধূসরই নিশুর ব্যপারে সব জানবে। কারণ ধ্রুব লক্ষ্য করেছিল নিশুকে সবসময়ই সেই হসপিটালে নিয়ে যেত। পায়ের তলায় সিগারেটটা পিষে ওদের রুমে এলো। পাথরের মতো বসে রয়েছে দু’জন।
“নিশু তোর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো কই?”
চমকায় নিশু।
“কেন?”
“প্রয়োজন আছে।”
আমতা আমতা করলো।
“কই?”
“আমার কাছে নেই?”
“কার কাছে?”
“মেজ ভাইয়া জানে।”
“ওকে কিছু খাইয়ে দে।”
মাথা নাড়ায় নিশু। বেরিয়ে গেল ধ্রুব। সোজা নক করলো ধূসরের দরজায়। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
“নিশুর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো কই?”
“কেন?”
“প্রয়োজন আছে।”
“জানি না।”
চোয়াল শক্ত করলো।
“ভণ্ডামি না করে রিপোর্টগুলো দে।”
“আমার কাছে কিছু নেই।”
শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।
“নিশু বলেছে তোর কাছে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধূসরের।
“দিবি নাকি আমি নিবো?”
“ওসবের কোনো দরকার নেই। সংসার করার ইচ্ছে থাকলে করো না করলে ডিভোর্সের বিষয়টি ক্লিয়ার করো। ওর জন্য পাত্রের অভাব হবে না।”
শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।
“তোর দেখছি অনেক খচখচানি!”
“সাড়ে এগারো বছর ধরে ভণ্ডামি তো আর কম করোনি! সবার লাইফ হেল করে ঠিকই নিজের ক্যারিয়ার গড়েছো! তোমার মতো সেলফিশ এইসবের কী বুঝবে!”
“মুখ সামলে কথা বলিস!”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আলমারির প্রতিটি তাক চেক করতে লাগলো। একটি তাকে দেখল দুনিয়ার ফাইলপত্র। চমকায় ধ্রুব। এত ফাইল কার চিন্তা করলো! একটা একটা করে নামিয়ে দেখতে লাগলো সবগুলোতেই নিশুর নাম। চমকায় ধ্রুব। ঠিক পনেরো-বিশটা ফাইলেরও বেশি। সবগুলোর ভেতরে অনেকগুলো প্রেসক্রিপশন।
“ঢাকার আর কোনো ডাক্তার বাদ রাখিসনি?”
তাচ্ছিল্যতা ফুটে উঠলো ধূসরের চোখে-মুখে।
“কম ট্রমা তো আর দিয়ে যাওনি।”
মায়াকুমারী পর্ব ৩৫
সবগুলো নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল। এগুলো চেক করতে করতে পুরো একদিন লাগবে। বেশ কতগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষার রিপোর্টও পেলো। সবগুলো নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। কারো থেকে কিছু জানার প্রয়োজন নেই। রিপোর্টগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবে। বিছানার উপর রেখে বয়স অনুযায়ী একটা একটা করে চেক করতে লাগলো। সাড়ে এগারো বছরের ফাইলপত্র কি কম-সম! তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দশ বছর বয়সে। এর পূর্বে পেলো মাইল্ড স্ট্রোকের ফাইলটা। এরপর একে একে সব ঘাটতে লাগলো। যতই ঘাটতে লাগলো ততই বুকের ভেতরটায় কেমন জ্বালাপোড়া অনুভব করলো। অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। এত এত ডিপ্রেশন,আতঙ্ক আর ট্রমার ভেতর দিয়ে গেল মেয়েটা অথচ সে কখনও পিছু ফিরেও তাকালো না। কেন জানি মনে হলো সবকিছু তার জন্যই হয়েছে।