মায়াকুমারী পর্ব ৩৭

মায়াকুমারী পর্ব ৩৭
মেহেরিন আনজারা

চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে দ্যুতি। হাত-পা ছেড়ে দিলো। চোখের সামনে বারবার ভাসছে কাল রাতের দৃশ্যটি। মানুষটা বুঝি আর বেফাঁস কথাবার্তা বলে তাকে নাস্তানাবুদ করবে না,তাকে রাগাবে না,তাকে বলবে না আমাকে কেন মর্নিং উইশ করলে না,আউল ফাউল কথা বলে তাকে লজ্জা দিবে না। দ্যুতি জানে না অনিক তাকে আদোও ভালোবাসে কিনা! ভালোবাসলে কি কেউ এত বেখেয়ালি হয়! দ্যুতির মনে হচ্ছে এটা ওয়ান সাইড লাভ। হয়তো তার বুঝার ভুল। অনিককে ওভাবে আঘাত করা উচিত হয়নি। হয়তো অনিক তার দূর্বলতা জেনে ফ্লার্ট করে মজা নিতো আর সে সিরিয়াস ভাবতো! শ্বাস আঁটকে এলো। ডুকরে কান্না পায়।

বিষন্ন মুখে অশ্রুসিক্ত নয়নে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো নিশু। শহরের কোলাহলের মাঝেও শুভ্র ম্যারিকা ফুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিন্তু তাকে মুগ্ধ করতে পারলো না। আর দিন হলে এই একঝাঁক ম্যারিকায় খুশিতে আপ্লূত হয়ে যেত নিশু। মা’র্ডার কেইসের মামলা খেয়ে ছক্কার মতো ধাক্কা খেলো মস্তিষ্কে। সেও এক মা’র্ডার কেইসের আসামি! শেষমেশ কিনা এত বড় অপবাদ! নিতে পারলো না নিশু। কেঁদেকেটে নাক-মুখ ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে ফেললো। জলপ্রপাতের ন্যায় অনর্গল তপ্তজল গড়িয়ে পড়ছে সফেদ দু-গাল বেয়ে। তাকেও হাতকড়া পরিয়ে আসামির গাড়িতে করে নিতে এসেছিল পুলিশ। আর এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে এই বাড়ির সবাই জেনে গিয়েছে। ছিঃ! ছিঃ! ভাবতেই দুঃখে-কষ্টে,রাগে-জিদে,লজ্জায়-অনুতাপে ভীষণ কান্না পেলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সে এত খারাপ নাকি! কিন্তু মনের দুঃখ কাউকে বুঝাতে পারলো না। কাল রাত থেকে অতিরিক্ত চিন্তায় এবং কেইস খেয়ে আত্মহ’ত্যার প্রবণতা জাগলো নিশুর মনের মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলো ঝাঁপ দিয়ে আত্মহ’ত্যা করবে কিন্তু এখন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া ছাঁদে উঠলে সবাই সন্দেহ করতে পারে। সে যাইহোক,আত্মহ’ত্যা করার আগে নিশু একটা ভালো কাজ করতে চায়। শাড়ি দুটিতে অনিকের রক্ত লেগেছিল তাই ওগুলো পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলো। সে মরে গেলে তার শাড়িটা জড়িয়ে ধরে না হয় সবাই স্মৃতিচারণ করবে। নাক টেনে শাড়ির কোণ দিয়ে চোখ মুছে নিলো। শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিলো শাড়ি দুটো। ওরা দু’জন আবার সবসময়ই একজন আরেকজনেরটা ধুয়ে দেয়। এই নিয়ে ওদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। পানি ঝরিয়ে বাম হাতের ভাঁজে নিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। চারতলার সিঁড়ি ঘরে আসতেই আকস্মিক মুখোমুখি হলো তাহমিদের।

অপ্রস্তুত হলো নিশু। লজ্জায় ফর্সা গাল দুটোয় গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়লো। আমতা আমতা করে চোখ নামিয়ে ফেললো। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। তাদরেকে জেলে নেওয়ার জন্য পুলিশ এসেছিল এটা নিশ্চয়ই তাহমিদও শুনেছিল! নিশুর দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো হাতের ভাঁজে রাখা শাড়ি দুটির উপর। চিনতে ভুল হয়নি। টকটকে লাল এবং গোলাপি রঙের শাড়ি দুটো কাল ওরা পরেছিল। দু’জনকেই মারাত্মক লেগেছিল অবশ্য। শ্বাস আঁটকে সাইড দিতেই গম্ভীর হয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালো তাহমিদ। শ্বাস ফেলে উপরের দিকে পা বাড়ালো নিশু। কিছু একটা মনে করে হঠাৎ পিছু ঘুরে দাঁড়ালো তাহমিদ। নিশু ছাঁদে যেতেই শিওর হয়ে তড়িৎ উপরে উঠে বাসায় ঢুকলো। টান টান করে শাড়িগুলো মেলে দিলো নিশু। আত্মহ’ত্যার কথা মনে পড়তেই কাঁপতে লাগলো বুকের ভেতর। সুখ ধরা দিতেই এখন তার উপর গ্রহণ লেগেছে! তার কপালে বোধহয় সুখ নেই! জলপ্রপাতের ন্যায় টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। দূর্বল পায়ে ছাঁদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে তানজিল। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে দ্রুত নেমে গেল। সিগারেট ধরালো তানজিল। গোলাপি শাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই তাকিয়ে রইলো। আকস্মিক অক্ষিপটে ভেসে উঠলো দ্যুতির হাস্যজ্জ্বল চেহারা। সিগারেটে লম্বা করে টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো ওড়িয়ে দিলো আকাশে।

বেশ কিছু শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তাহমিদ। লক্ষ্য করলো টান টান করে শাড়ি দুটো ছায়ার মধ্যে মেলে দিয়ে গিয়েছে নিশু। টকটকে লাল শাড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের শার্টগুলো হাঙ্গারে ঝুলিয়ে প্যান্টগুলো দড়িতে মেলে বাসায় ফিরে গেল
“তাহমিদ তোর হঠাৎ কী হয়েছে বল তো?”
“কই?”
“তাহলে অফিসে যাসনি কেন মাঝপথ থেকে ফিরে এলি যে?”
বিরক্ত হলো তাহমিদ। প্রতিত্তোর করলো না।
“কীরে কিছু বলছিস না যে অফিসে যাসনি কেন?”
“ভাইয়ার ডায়রিয়া হয়েছে আম্মু। শার্ট-প্যান্ট সব নষ্ট করে ধুয়ে ছাঁদে শুকাতে দিয়েছে!”
“কী বললি?”
“তোমার ছেলে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছে।”
বিষম খায় তাহমিদ। গাট্টা মা’রলো তাসফিয়ার মাথায়।
“তোর মাথা!”
“ওহ! মাথায় মারো কেন!”

ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের কিছু ড্রেস ধুয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তানজিল। তাহিয়া বেগম লক্ষ্য করলেন আজ হসপিটালে যায়নি তানজিল। চিন্তিত হলেন তিনি।
“এই তোদের আজ হয়েছেটা কী! একজনের না হয় ডায়রিয়া কিন্তু তোর কী হলো তানজিল?”
“ওর কলোরা হয়েছে আম্মু!”
দাঁতে দাঁত চাপলো তানজিল। মুখ টিপে হাসতে লাগলো তাসফিয়া।
“হায় আল্লাহ কী বলিস!”
“সত্যি বলছি আম্মু। দু’জনের ডায়রিয়া,কলেরা দেখা দিয়েছে।”
“এই তোরা ডাক্তারের কাছে যাস না কেন?”
“ডাক্তারেরই তো কলেরা! সে আর কী যাবে ডাক্তারের কাছে।”
চোয়াল শক্ত করে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তানজিল। হায় হায় করে উঠে দু’জনের জন্য ডিমওয়ালা ইলিশ দিয়ে কাচ কলার ঝোল রান্নার আয়োজন করতে লাগলেন।

বিমর্ষ মুখে রিনা খালা আর জোছনাকে নিয়ে রান্নাবান্না করে গোসল সেরে নিলো নিশু। কোনোমতে লাঞ্চ করে ব্যাংকক যাওয়ার জন্য রেডি হলো ধ্রুব। বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে দ্যুতিকে জিজ্ঞেস করলো,”ব্যাংকক যাবি তুই?”
মাথা নাড়ালো যাবে না।
“আমি যাব।”
“দ্যুতি গেলে তোকে নিতাম। ওর দিকে খেয়াল রাখিস কিছু একটা করে বসবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নিশু। হাত ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে গেল। আচমকা কোমর পেঁচিয়ে ধরে মুখ গুঁজল ঘাড়ে। শ্বাস আঁটকে থমকে রইলো নিশু। বাম হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ডান হাত দিয়ে চিবুক তুলে বলল,”তোর সঙ্গে অনেক কথা বলা বাকি নিশু!”
নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। বাম গালে চুমু খেয়ে মুখ গুঁজল ভেজা চুলে। ঘ্রাণ টেনে নিতে লাগলো।
“তোর চুলগুলো ভীষণ সুন্দর নিশু,যত্ন নিস রুক্ষ যেন না হয়ে যায় কখনও। তোর চোখ দুটো অপূর্ব নির্মল জলের মতো,দেখিস বিষন্নতা এসে ছায়া না ফেলে। তোর মুখ,ঠোঁট,দাঁত,চিবুক,হাসি সবটাই অনন্য ঠিক যেন কোনো নিপুণ শিল্পকর্ম। তবু যত্ন নিস শুধু আমার জন্য। আর সবচেয়ে বেশি,নিজেকে আগলে রাখিস কারণ তুই আর তোর এইসব আমার সমস্ত পৃথিবী।”

মুহূর্তেই শিরদাঁড়া বেড়ে সর্পিল গতিতে হীম স্রোত বয়ে গেল।
“তুই আমার চোখের শীতলতা মায়াকুমারী! তুই জানিস,তোর চোখে তাকালেই যেন সমস্ত জ্বালা নিভে যায়। তোর চোখের দিকে তাকালেই আমার ভেতরের সমস্ত ঝড় যেন থেমে যায়। তোর চোখ দুটোই আমার শীতলতা,আমার আশ্রয়। তুই আমার মায়ার মতো ধরা যায় না,ছোঁয়া যায় না তবু তোকে ঘিরেই আমি বাঁচি। আর একটু অপেক্ষা কর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই খুব শীঘ্রই চিরদিনের জন্য তোকে তুলে আনবো আমার ঘরে। তোকে নিয়ে একটুকরো শীতল সংসার গড়বো যেখানে কেবল শান্তি থাকবে,তোকে ভালোবাসার অবিরাম চিত্ররেখা থাকবে। তুই হবি আমার চিরন্তন,আমার মায়াকুমারী।”

আইসের ন্যায় জমে গেল নিশু। কিছু বলতে পারলো না। কপালে এবং চিবুকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। ধ্রুব যেতেই যেন ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো একরাশ নিঃশব্দতা। নিশু দাঁড়িয়ে রইলো ঠিক আগের জায়গায়,যেন কেউ তাকে ছুঁয়ে দিয়ে ঠাঁই করে দিয়েছে শূন্যতার ভেতর। হাওয়া একটুখানি চুল উড়িয়ে দিলো গাল বরাবর। সে হাত বাড়িয়ে চুল সরাতে গিয়েও থেমে গেল। ধ্রুবর গলার সেই উষ্ণ স্পর্শ যেন এখনও লেগে আছে ঘাড়ে। নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করে সে শুঁকে নিতে চাইলো সেই ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণেও মিশে থাকে প্রতিশ্রুতির কুয়াশা। তার বুকের গভীরে এক অজানা হাহাকার জমে উঠলো। ভয় আর আশা মিলেমিশে এক অদ্ভুত গাঢ় অনুভব। ধ্রুবর বলা প্রতিটা কথা এখনও তার কানে বাজছে বারবার।
“তুই আমার চোখের শীতলতা মায়াকুমারী!”
নিশু জানে না এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তব কিংবা কতটা অলীক। কিন্তু এতটুকু সে জানে এই কথাগুলো তার হৃদয়ে নরম কুয়াশার মতো জড়িয়ে থাকবে যতদিন সে বাঁচে। চোখের কোণে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তেই সে ফিসফিস করে বলল,”তুমি আবার ফিরবে তো ধ্রুবতারা?”
সেই প্রশ্ন শুনতে পায় না ধ্রুব। ধীরাজকে নিয়ে রওনা দিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ব্যালকনিতে থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো নিশু। গাড়িটা মিলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

বিকেল বেলা প্রায়। পুরো বাসার অবস্থা গুমোট। ভালো লাগছে না নিশুর। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। কিছু খাওয়াতে পারেনি দ্যুতিকে। এদিকে ব্যাংকক যায়নি ধূসর। কারণ বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। অন্যদিকে আসাদ সাহেবও চেঁচামেচি করছেন এদিক-সেদিক ফোন করে। হার্টের রোগী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে ভেবে দুশ্চিন্তায় রইলো। দিলরুবা খাতুনকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। তাই সবার কথা বিবেচনা করে ধূসর থেকে গেল। নিশুর মুখোমুখি হলো না ধূসর। নিশুও একপ্রকার নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“দ্যুতি ছাঁদে যাবি?”
নীরব রইলো সে।
“চল একটু ছাঁদে বসি। কিছুক্ষণ সময় কাটালে ভালো লাগবে।”
প্রতিত্তোর করলো না।
“চল না। আর কতক্ষণ এমন থাকবি। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে এখন কান্নাকাটি করে কী হবে।”
হাত ধরে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদে পা ফেলতেই আকস্মিক দুধপালংগুলো খসে বাতাসে উড়ে এসে পড়তে লাগলো তাদের গায়ে। কি সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং মুহূর্ত। ভীষণ ভালোলাগা কাজ করলো নিশুর। মেঘমুখে ছাঁদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেল দ্যুতি। নিচের দিকে তাকালো। ট্যাবেবুইয়া ফুলে ফুলে ভরে গেছে তাদের বাড়িটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরে ছাঁদের চতুর্দিকে তাকায়। ছাঁদের চতুর্দিকে থাকা তারকাঁটাগুলোয় ঝুমকোলতার ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। আনমনা হয়ে টবগুলোর দিকে তাকায়। কয়েন প্ল্যান্টের ফুল ফুটেছে! ইশ! কি সুন্দর! কয়েন ধরবে কি তাতে! আনমনা হয়ে এক থোকা বৃদ্ধাবেলী ছিঁড়ে তাকিয়ে রইলো ছুটন্ত যানবাহনগুলোর দিকে। নিশু হঠাৎ লক্ষ্য করলো শাড়ি দুটো নেই। আঁতকে উঠলো সে।

“খালা শাড়িগুলো কই?”
“জানি না।”
“কাউকে নিতে দেখেছো?”
“না।”
“আজ ছাঁদে এসেছিল কে দেখেছো?”
“হ,পাঁচতলার ভাড়াটিয়ার ছেলেগুলারে আইতে দেখছি।”
“আর কেউ এসেছিল?”
“হেরা ছাড়া তো আর কারো ছাঁদে উঠার অনুমতি নাই।”
এটা ঠিক যে ওরা দু’জন ছাঁদে এসে সময় কাটায় এবং পায়রা পুষে বলে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাসা ভাড়া দেয়ার সময় এটাও উল্লেখ থাকে। তাই ছাঁদে কেবল নিশুরাই আসে। ইদানীং পাঁচতলার ভাড়াটিয়ারাও আসে। সে যাইহোক,এখন শাড়ি দুটো কে নিতে পারে ভেবে চিন্তিত হলো নিশু।
“খালা কে নিতে পারে বলো তো?”
“বুঝতাছি না। পাঁচ তলার ভাড়াটিয়ার পোলারা ছাড়া আর কারো উঠার দুঃসাহস নাই।”
এটা ঠিক কিন্তু কী করবে এখন ভীষণ চিন্তিত হলো নিশু। ধূসর পছন্দ করে কিনেছিল তাদের জন্য। লাল শাড়িটার জন্য দ্যুতির মন ভীষণ খারাপ হয়েছিল সেদিন। দু-ভাইবোন অনেক তর্কবিতর্ক এবং রাগারাগিও করেছিল। খাবার টেবিলে মায়ের কাছে অভিযোগও করেছিল। একটা স্মৃতি ছিল শাড়ি দুটি। কিন্তু কে নিলো? ধূসর জানতে পারলে চেঁচামেচি করবে। কারণ সত্যিই সুন্দর শাড়িগুলো। প্রিয় একটা জিনিস ওভাবে হারিয়ে গেল। কেমন জানি লাগছে! পাঁচতলায় রিনা খালাকে পাঠালে আউল-ফাউল কথা বলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এতে তাঁরা অপমানিতবোধও করতে পারে। রিনা খালার হুঁশজ্ঞান কম। নিশু সিদ্ধান্ত নিলো সে ভদ্রতার সহিত জিজ্ঞেস করবে তারা ভুলে নিয়েছে কিনা! অবশ্য ধূসর আজ ছাঁদে আসেনি আর এলেও তাদের জামাকাপড় ধরার মতো ওতোটাও বিবেকহীন নয়।
“দ্যুতি চল।”

আনমনা হয়ে বৃদ্ধাবেলীর থোকা গুঁজে দিলো নিশুর চুলে। অবশ্য চিন্তায় থাকায় লক্ষ্য করলো না নিশু। দ্যুতির হাত ধরে আড়ষ্ট হয়ে পাঁচতলার বাসায় কলিংবেল চাপতেই ডোর খুললো তাসফিয়া। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রইলো নিশু। দ্যুতি গম্ভীর হয়ে রয়েছে।
“কে তোমরা?”
“তিনতলা থেকে এসেছি।”
“ও আচ্ছা। ভেতরে আসো।”
“না। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম।”
“হ্যাঁ বলো।”
আমতা আমতা করলো নিশু। তাসফিয়া তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধ লাগছে নিশুকে। মলিন হাসলো নিশু।
“কে এসেছে তাসফিয়া?”
“তিন তলার আংকেলের মেয়ে।”
চমকে উঠলেন। তিন তলার আংকেলের মেয়ে কেন আসবে। একপ্রকার ছুটে এলেন। কথাটি শুনতেই দ্রুত ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় এসে বসলো তানজিল। পূর্ব থেকে বসা ছিল তাহমিদ।
“আরে তুমি!”
মলিন হাসলো নিশু এবং সালাম দিলো। সালাম নিলেন তিনি।

“দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে আসো।”
চোখ পড়লো দ্যুতির দিকে।
“ওর কী হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“ও অসুস্থ।”
“ও ভেতরে আসো।”
“না আন্টি। একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম কিছু মনে না করলে।”
“হ্যাঁ বলো।”

হাত ধরে ভেতরে ঢুকতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল ওরা দু’জন। তাহমিদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই লজ্জায় আড়ষ্ট হলো নিশু। অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। নিশুর পরনের পেস্ট কালারের সেমি মসলিন শাড়িটা যেন এক টুকরো নরম আলো স্নিগ্ধ অর্কিডের মতো। পুরো শাড়িজুড়ে বেগুনি রঙের অর্কিড ফুলের সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারির কাজ,সঙ্গে খাঁজকাটা কাটওয়ার্ক আর নিখুঁত ম্যাচিং ব্লাউজ। শাড়ির রঙটায় এমন এক শান্ত সৌন্দর্য ছিল যেটা চোখে পড়তেই তাহমিদের মনে এক অজানা আনন্দের ঢেউ ছুঁয়ে গেল। শাড়িটা এতটাই সুন্দর যে মুহূর্তেই মন,দিল,চোখ সব আঁটকে গেল। নিশুর লম্বা ভেজা চুলগুলো খোলা,একপাশে গুঁজে রাখা ফুটন্ত বৃদ্ধাবেলীর থোকা যেন গন্ধে ছড়িয়ে দিচ্ছিল স্নিগ্ধতা। কানে পরা ছোট্ট সোনার ঝুমকোগুলো এতটাই মানানসই যে তাহমিদের মনে হলো এগুলো বুঝি নিশুর জন্যই তৈরী ভালোবাসায় গড়া,নিখুঁত কোনো কারিগরের হাতে। ফর্সা গলায় লাভ শেইপের সোনার লকেট।

হঠাৎ যেন বাতাসে চন্দনের এক কোমল সুবাস ভেসে উঠলো। ঠিক তখনই নিশুর হাত ধরে টেনে আনতেই পায়ের সোনার নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ যেন ভেঙে দিল চারপাশের নিস্তব্ধতা। চোখ নামাতে পারলো না তাহমিদ। মনে মনে ভাবলো,কে বেশি সুন্দর নিশু নাকি তার শাড়ি?এই মেয়েটা এত অসাধারণ শাড়িগুলো কোথায় পায়? কে দেয় এসব? কোথ থেকে শপিং করে? নিশু ছাড়া এমন শাড়ি অন্য কারো পরনে সে কোনোদিন দেখেনি। হৃদয়ের গভীর থেকে একটা স্বগতোক্তি যেন বেরিয়ে এলো,”আপনাকে যতবার শাড়িতে দেখি,ততবার আমি খু’ন হয়ে যাই সুগন্ধি লেবুফুল!”

ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো নিশু। কিন্তু সেই চোখের কোণেই কি এক বিন্দু সুখের ঝিলিক ছিল নাকি বিরক্তি বুঝা গেল না। আঁড়চোখে দ্যুতির দিকে তাকালো তানজিল। দ্যুতির পরনে অফ হোয়াইট রঙের ক্রেপ কয়নের লং শার্ট। হাতায় ফোল্ডিং এবং বুক থেকে নিচ অব্ধি বাটন রয়েছে। শার্টটি জুড়ে ল্যাভেন্ডার ফুলের নকশা। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে মিষ্টিমুখী দ্যুতিকে। কিন্তু মেয়েটা কেমন গম্ভীর হয়ে রয়েছে। যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে তার উপর দিয়ে।
“বসো।”
“না আন্টি প্লিজ।”
আঁড়চোখে দ্যুতির দিকে তাকালো তানজিল। কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
“আরে বসো। বসে বসে কথা বলি।”
“আন্টি প্লিজ শুনুন সময় নেই। বাসায় ফিরতে হবে। আসলেই আমরা এসেছিলাম একটা কথা জিজ্ঞেস করতে।”
“হ্যাঁ বলো।”

“ইয়ে মানে আন্টি,সকালে আমি দুটি শাড়ি ধুয়ে ছাঁদে দিয়ে এলাম কিন্তু এখন নেই। কিছু মনে না করলে বলছিলাম আরকি আপনারা ভুলে আপনাদের জামাকাপড়ের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কিনা বেয়াদবি নিবেন না আন্টি।”
“আরে না না কী মনে করবো! বেয়াদবির কী আছে! আমি তো ছাঁদে যাই না৷ আমার ছেলেরা মাঝেমধ্যে শুকাতে দেয়। ওরা ছেলেমানুষ শাড়ি দিয়ে কী করবে!”
দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো দু’জন। হুট করে একজন তাকিয়ে রইলো আরেকজনের দিকে।
“ও আচ্ছা তাহলে আমরা আসি।”
“চা-কফি খেয়ে যাও।”
“না আন্টি।”

বিষন্ন মুখে বেরুতে নিতেই হঠাৎ পায়ের তলায় কিছু একটা ফুঁড়তেই একটু ব্যথা পায় নিশু। পা তুলতেই দেখলো একটা স্টোন। চমকায় নিশু। এই স্টোনগুলো তাদের শাড়ির। ধোয়ার সময়ও কয়েকটা পড়ে গিয়েছিল তাহলে এখানে এলো কী করে! মাথা ঘুরিয়ে একপলক পর্যবেক্ষণ করলো দু’ভাইকে। কেমন জানি লাগলো নিশুর। পরক্ষণেই ভাবলো,সত্যি এরা আনবে কেন আর এরা তো ছেলেমানুষ। সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল দু’জন কিন্তু নিশুর মনের খচখচানিটা গেল না। শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করায় দু’ভাইকে কেমন জানি দেখাচ্ছিল। ওরা যেতেই ডোর আঁটকে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন,”ওদের শাড়ি কে নিয়েছে দেখেছিস তোরা?”
গম্ভীর স্বরে তাহমিদ বলল,”আমরা কী জানি!”
“তাহলে শাড়িগুলো নিলো কে?”
“জানি না।”
“তোরাই তো ছাঁদে গেলি।”
খেঁকিয়ে উঠলো তানজিল।

“বলতে চাচ্ছেন আমরা চুরি করেছি?”
“তা বলবো কেন?”
“হাজারটা শাড়ি কেনার ক্ষমতা আছে আমাদের।”
ছেলেদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বিরক্ত হলো তাহমিদ।
“কী হয়েছে আম্মা?”
“কিছু না।”
“বলতে চাচ্ছেন আমরা চুরি করেছি?”
“কখন বললাম?”
তানজিল বলল,”চুরির অপবাদ নিয়ে এই বাড়িতে আর থাকবো না।”
“পাগল হয়েছিস তোরা! কখন বললাম চুরি করেছিস!”

মায়াকুমারী পর্ব ৩৬

রুমে ফিরে গেল তানজিল। ডায়েরি খুলে আনমনা হয়ে তাতে লিখতে লাগলো,”এই মেয়েটাকে আমার এত্ত ভালো লাগে কী বলবো! দেখলেই আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। অনেক সুন্দর সে! ওকে দেখলেই মনে হয় পৃথিবীর সব আলো এসে চোখে ধরা দেয়। ওকে দেখলেই আমার ভেতরটা কেমন আলোয় ভরে যায়। কীভাবে বোঝাই,মেয়েটার প্রতি টানটা ঠিক কতটা গভীর! ওর হাসিটা যেন সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। ওর হাসিটা চোখে লেগে থাকে সারাদিন। ওর দৃষ্টিটা যেন ঝিলমিল করে উঠে। ওর কথা ভাবলেই বুকটা কেমন করে উঠে যেন এক অনন্ত অপেক্ষা শুরু হয় প্রতিবার। খুব গোপনে ওর একটা নাম দিলাম,ঝিলিক!”

মায়াকুমারী পর্ব ৩৮