মায়াকুমারী পর্ব ৪৩
মেহেরিন আনজারা
মোবাইল বের করে গ্যালারিতে গেল ধ্রুব। একটা পিক বের করে নিশুর হাতে ফোন দিলো। অশ্রুসিক্ত ঝাপসা নয়নে পিকচারটির দিকে তাকালো নিশু। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
“নিশুমনি,
এই চিঠিটা লেখার কোনো অধিকার নেই আমার তবুও লিখছি। প্রায় আটটি বছর একটা চিরন্তন নীরবতার মতো সময়টা কেটেছে আমাদের না বলার মধ্যে,না বোঝার মধ্যে আর সবচেয়ে বেশি না দেখার মধ্যে। হয়তো বা তুই অনেকবার চেয়েছিস আমি একবার ফিরে তাকাই। আর আমি তা না বুঝেই দূরে সরে গিয়েছি। তোর চোখের ভাষা আমি পড়িনি কিংবা সাহস ছিল না পড়ার। কারণ আমরা তো মুখোমুখি হইনি আর চোখাচোখিও হয়নি আমাদের। হয়তো তুই আমায় ভালোবেসেছিলি নিঃশব্দে,নিঃস্বার্থভাবে। তোর মতো করে আর কেউ কখনও ভালোবাসেনি কিংবা আর কেউ ভালোবাসবেও না।
তুই কেমন করে আমায় ভালোবেসেছিলিস নিশু! অবহেলার বালির ভেতরেও তুই একটা নরম ভালোবাসার জলধারা বয়ে নিয়েছিলি। অথচ আমি! আমি তোর সেই চোখের তারাগুলো উপড়ে নিয়েছিলাম একটা ঠান্ডা অজুহাতের লাঠি দিয়ে। তোর চোখে চোখ রাখার মতো সাহস আমার নেই। তবে হ্যাঁ,আমি জানি তুই অনেক কিছু সহ্য করেছিস,চুপ করে থেকেছিস,সয়ে গিয়েছিস,ভালোবেসেছিস। আর আমি! আমি কেবল পালিয়ে বেড়িয়েছি। আজ এত দিন পর দাঁড়িয়ে আছি একটা ফাঁকা বুক নিয়ে। তোর মুখ মনে পড়ে,তোর না বলা কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করে যা আমি কোনোদিন শুনিনি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আজ আমি ভাঙা,অযোগ্য,অচল একজন মানুষ। তোর জন্য আমি হতে পারিনি সেই আশ্রয়,সেই ভরসার শক্ত কাঁধ তাই আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। সে বাদেও চিরকাল তোকে ছোট বোনের মতো দেখে এসেছি আর আমরা যেহেতু একটা নির্দিষ্ট সময় একই বাড়িতে থেকেছি তাই আমি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। অর্থাৎ সেই মানসিক সংকট এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি। আমার সময় লাগবে। আর আমি এখন পরনির্ভরশীল। বাবার টাকায় দিন চলে যায়,অথচ মনের ভেতর কেবলই অনুতাপ জমে। তোর দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। তাই বলছি তুই নিজের দিকে মন দে। মন দিয়ে পড়াশোনা কর,স্বপ্ন আঁক,নিজের মতো করে নিজেকে গড়ে তুল।
তুই নিজের হয়ে উঠ,তোর ক্যারিয়ার এই সবকিছুর মাঝে তুই নিজেকে খুঁজে নিস আর আমার জন্য পবিত্র থাকিস।
জানি,তুই হয়তো এখনও মনে মনে আমার অপেক্ষায় থাকিস কিন্তু আমি আজও তোর দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানুষ হয়ে উঠিনি। তাই আমি চাই,তুই সময় দিস আমাকে নিজেকে তৈরি করতে। আমি ফিরবো আর যখন ফিরবো তখন শুধু প্রেম নয় তোর পাশে দাঁড়ানোর সবরকম যোগ্যতা নিয়ে ফিরবো। তুই ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করিস। আমি চাই না তুই আবার কাঁদিস। চাই না তুই ভাঙ্গিস। আমি শুধু চাই,তুই নিজের শরীর,মন,স্বপ্ন সবকিছুর যত্ন নিস।
তুই এখন নিজের স্বপ্ন আঁক,নিজের স্বপ্নপথে হাঁট,নিজের মতো করে নিজেকে ভালোবাসিস। যেমন করে আমাকে ভালোবেসেছিলি। তুই আমার জন্য অপেক্ষা করিস এই অনুরোধটা করতে আমার লজ্জা হয়। তবুও করবো কারণ তোকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না। জানি,তোর কাছে এই অনুরোধটা লজ্জার। তবু বলছি তুই আমার জন্য অপেক্ষা করিস। তুই ঠিক থাকিস।
ইতি
~ধ্রুব।”
জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো নিশুর দু’গাল বেয়ে।
“সাড়ে এগারো বছর! এতগুলো বসন্ত চলে গেল অথচ একটা দিনও কাটেনি যেদিন তোকে না ভেবে ঘুমিয়েছি।
আমি জানি,তুই হাজারবার ভেবেছিস আমি কি কিছুই ছিলাম না? না তুই ছিলিস,আছিস,থাকবি আমার রক্তে,আমার নিঃশ্বাসে,আমার প্রতিটা অনুতাপে।”
নেমে এলো ঘোর নীরবতা। নিশু কাঁদছে আর তাকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে এখনও ওইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্রুব। মানুষ যত্নে পাখি হয়ে যায়। অভিমানিনী,আহ্লাদী নিশুও পাখির মতো গুটিশুটি হয়ে রইলো ধ্রুবর বুকে তার কথার যত্নে। এই মুহূর্তে সত্যিই তাকে একটি ছোট্ট পুঁচকে টুনটুনির ছানার মতো বড্ড আদুরে লাগছে। তবে সব শুনেও সে তার জেদে অটল। মানতে নারাজ তার কোনো দোষই নেই সব দোষ ধ্রুবর। সে একজন নিষ্পাপ মানুষ। নারীরা আসলেই এমনই। যার উপর তার অধিকার এবং অভিযোগ বেশি তারা তাদের ওপরই নিজের দোষগুলো চাপিয়ে দিয়ে প্রশান্তি পেতে ভীষণ পছন্দ করে। অবশ্য এটা নারীদের একটা জন্মগত সমস্যাও বটেও।
“তাই বলে তুমি আমাকে একবারও দেখতে চাইবে না? তোমার কি মনে পড়ে তুমি আমাকে কখনো দেখতে চাইতে না?”
“হুম পড়ে। এর কারণও রয়েছে। বিয়ের পর যখন ঢাকায় চলে এলাম তখন ফুপির বাসায় উঠেছিলাম। ফুপি আমার ব্রেইনওয়াশ করেছে। অবশ্য তখন টিনএজ ছিলাম তাই যা বলেছিলো সবই আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিলো এবং আমি প্ররোচিত হয়েছিলাম দাদী-ফুপির কথায়। এরপর বাবা আসে বাসা নেয় দু’জনের জন্য। মাঝেমধ্যে ফুপি এসে বাবা আর আমার কান ভারী করতো। তখন বাবাকে ভুল বুঝতাম আর উনার সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঝামেলা হতো। এরপর আব্বা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট নেয় আর আমরা চলে যাই সেখানে। তারপর হঠাৎ শুরু হয় দাদী-ফুপি এবং ফুপাতো বোনদের যাতায়াত। আমাকে নানারকম বুঝিয়ে ব্রেইনওয়াশ করে ফেলতো। তারপর তোর নামে নানারকম নেগেটিভ কথা বলে আমাকে বুঝাতো। আর বলতো তোর বাবা-মায়ের চরিত্র খারাপ।
তুইও তোর বাবা-মায়ের মতো হবি ইত্যাদি। তারপর আরও বলতো তোর শ্বশুরবাড়ি নেই,জামাই আদর পাবি না মানে ইত্যাদি। যদিও এইসবে আমি ভীষণ বিরক্তবোধ করতাম তবুও বলতো। তখন আমিও ভাবতাম নিশ্চয়ই তোর বাবা-মায়ের মতো তুইও ওমন চরিত্রের হবি। মানে তখন তোর প্রতি নেগেটিভ ধারণা এসে গিয়েছিলো তাই তোকে দেখার ইচ্ছে হতো না। এভাবে পেরিয়ে গেল দীর্ঘ আট বছর। বাসায় ফিরলাম প্রথমবারের মতো। তুই আড়ালে রইলি সামনে এলি না। হঠাৎ একদিন রাতে তোকে পেছন থেকে দেখি। কেন জানি অন্যরকম ফিল করলাম। এরপর আবারও আমাদের বিয়ে হয়,বাসর হয়। তোর মুখোমুখি হতে ইতস্ততবোধ করছিলাম আসলেই ওমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ছাঁদে চলে গেলাম। মনের মধ্যে হাজারও কথার জলোচ্ছ্বাস বইলেও সংকট,সংকোচ ছিলো।
ভোর সকালে রুমে ফিরে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। তারপর মা অনেক বুঝালো আমি নীরবই রইলাম। ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে নিতেই দেখলাম ভেজা। বুঝতে পারলাম সাইন করতে গিয়ে তুই কেঁদেছিলি। কেন জানি জীবনে সেদিনই এই প্রথম কোনো সাইন করতে নিয়ে হাত কাঁপছিলো। আমি থামলাম,ভাবলাম একটু সময় নিই। ডিভোর্স যখন-তখন দেওয়া যাবে। ততদিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঘুরে আসি। একটু সময় দরকার। সারা রাত তোকে নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করলাম। বারবার পেপারটা দেখছিলাম। এরপর চিঠি লিখে মায়ের হাতে দিলাম। অপেক্ষা করছিলাম তোর কিংবা প্রতিত্তোরের। ভাবলাম ফেইস-টু-ফেইস হবি। বাট তেমন কিছুই হলো না। তারপর চলে যাই যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে একদিনও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। প্রতি রাতে স্বপ্নে তুই আসতি। আমাকে অভিযোগ করে অভিশাপ দিতি। দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ফের সাইকিয়াট্রিস্ট-এর শরণাপন্ন হলাম। অনেক চড়াই-উৎরাই করে দেশে ফিরলাম। তবুও তুই দূরে রইলি। তোকে দেখার জন্য ছটফট করলাম,ইতি-উতি করলাম কিন্তু তুই আড়াল হয়েই রইলি; বুঝতে পারলাম এটা তোর প্ল্যান। সে যাইহোক,তুই যদি তোর অধিকার দাবী করে আমার সামনে দাঁড়াতি আমি যদি তোকে ফিরিয়ে দিতাম তাহলে বলতে পারতি সব আমার দোষ।”
“এখন সব দোষ আমাকে দিলে?”
নিশু তার জেদে এখনও অটল। সে মানতে নারাজ তার কোনো দোষ নেই।
“যা সত্য তাই।”
“এখানে সব দোষ তোমার।”
নাক টানলো নিশু।
“ঠিক আছে,স্বীকার করলাম সব দোষ আমার। সব আমার কারণে হয়েছে এবার তুই খুশি?”
ফুঁপিয়ে উঠে নিশু। আকস্মিক বেড থেকে নেমে পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল। অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব।
“কী করছিস?”
“ক্ষমা করে দাও। আমার জন্য তুমি অনেক মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছো। বন্দী জীবন কাটিয়েছো। আমি কখনো তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি। তোমার নীরব অভিশাপেই হয়তো আমি আজীবন অসুখী,অসুস্থ। নয়তো এত এত সুখ,আহ্লাদের মধ্যেও কেন আমি অসুখী ছিলাম! কেন আমি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম! কখনো ভাবিনি তোমার মন থেকে আসা নীরব অভিশাপগুলো আমার অশান্তি,অসুস্থতার কারণ। আজ আবারও বুঝতে পারলাম আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেয় না আর সেটা তিলার্ধ পরিমাণ পাপ হলেও। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি কখনও সুখী হইনি। তোমার নীরব অভিশাপগুলো তুলে আমাকে মুক্তি দাও।”
হাত ধরে উঠিয়ে বুকের মধ্যে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুব কখনো ভাবতেই পারেনি নিশু তাকে এত ভালোবাসে। এত ভালোবাসা তার জন্য জমিয়ে রেখেছিল হৃদকুঠিরে। না দেখেও কেউ বুঝি কাউকে এত ভালোবাসতে পারে কিংবা এতটা মায়া জমিয়ে রাখতে পারে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবই শুনলো দ্যুতি। দৃষ্টি তার বাইরের ম্যাগনোলিয়া গাছের দিকে স্থির। জলোচ্ছ্বাস নামছে তার দু-চোখ দিয়ে। চোখে-মুখে আঁধার দেখলো। তারাও তো তার ভাইকে ভুল বুঝেছিলো। ভেবেছিলো তার ভাই সত্যি স্বার্থপর। টুং করে নোটিফিকেশন বেজে উঠতেই স্ক্রীন জ্বলতেই ঝাপসা চোখে তাকায় দ্যুতি। হিতাহিতজ্ঞান ভুলে আকস্মিক কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডোর থেকে নিচে লাফ দিতেই টান পড়লো হাতে। ভীত চোখে তাকাতেই দেখলো শক্ত করে ধরে রেখেছে ধ্রুব।
“ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”
“কী করছিস পাগল হয়েছিস?”
“ছেড়ে দাও বাঁচতে চাই না!”
ততক্ষণে বেশ কিছু মানুষ নিচে জড়ো হয়ে গেল। এগিয়ে এলো কয়েকজনও। উঠাতে নিলেই আরেক হাত দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।
“বোকামি করিস না।”
“ছেড়ে দাও।”
ছুটে এলো কয়েকজন ডক্টর-নার্স। কলরব শুরু হলো চতুর্দিকে। একপ্রকার ছুটে এলো ধূসর। এমন দৃশ্য দেখতেই মেজাজ খারাপ হলেও নীরব রইলো। ঝুলে রইলো দ্যুতি। চিন্তায় ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেল ধ্রুব। চোখ-মুখ উল্টে আতঙ্কিত হয়ে কাঁদতে লাগলো নিশু। এমনটা কেন করলো দ্যুতি? ঘাবড়ে গেল ভীষণ। দ্যুতিকে বাঁচাতে পারবে তো!
“পাগলামি না করে উঠে আয় দ্যুতি,প্লিজ।”
উঠানোর চেষ্টা করলো কয়েকজন মিলে। কিন্তু দ্যুতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ওদের।
“ছেড়ে দাও মরে যাক।”
“কী বলছো তুমি?”
পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো ধূসর। দ্যুতির এই কৃর্তীকলাপ ভালো লাগছে না তার।
“ছেড়ে দাও মরুক!”
শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব। অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বেরুচ্ছে দু-চোখ দিয়ে। নির্বিকার রইলো ধূসর। হোলদোল দেখা গেল না তার মধ্যে। অনেক কষ্টে উপরে তুললো দ্যুতিকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো ধ্রুব। কী হতে নিয়েছিলো সবে! কপাল এবং ঘাড়ের রগগুলো ফুলে নীলবর্ণ ধারণ করলো। রক্তাভ হয়ে গেল চোখজোড়া। চোয়াল শক্ত। মেজাজ খারাপ হলো। আকস্মিক কষিয়ে দুটো থাপ্পড় দিতেই ফ্লোরে আঁচড়ে পড়তেই কপাল এবং ঠোঁট ফেটে গড়গড় করে রক্ত বেরুতে লাগলো। বন্ধ হয়ে গেল কান। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে থমকে রইলো দ্যুতি। বোধশক্তি হারিয়ে ফেললো। রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল। ধ্রুবর ওমন অগ্নিরূপে থরথর করে কাঁপতে লাগলো নিশু। ভীষণ মায়া হচ্ছে দ্যুতির জন্য। কাঁধ চেপে উঠে দাঁড় করালো।
“কী করতে নিয়েছিলি?”
“ভাইয়া!”
আকস্মিক জড়িয়ে ধরলো। থমকায় ধ্রুব। অঝরে কাঁদতে লাগলো দ্যুতি। পিঠের উপর দিয়ে বাম হাত রাখলো। ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো নিজেকে। ডান হাতের আঙ্গুল গুঁজল চুলের ভেতর।
“কী করতে নিয়েছিলি?”
কিছু বলতে পারলো না দ্যুতি। ধ্রুবর বুকের ভেতর কেমন কাঁপছে। মাত্র একটা সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেলতে নিয়েছিলো বোনকে। দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে মস্তিষ্ক। কটন দিয়ে রক্ত মুছে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে মাথার ওপর ওড়না দিয়ে শরীরে জড়িয়ে দিলো। হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ওরা দু’জন। লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে গেল। দ্রুত একটি ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো। চলে গেল বামরূনগ্রাদ হসপিটালে। লিফটে উঠে অনিকের আইসিইউ রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদনীন ফেরদৌসের কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাথা তুলে তাকায় দ্যুতি। সব তার জন্য হয়েছে। তার জন্য অনিক আইসিইউতে,নিশু এবং তার মেজভাই জখম হয়েছে। এরপর তার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শেষমেশ বুশরার গায়ে হাত তুলেছে তার বাবা এবং টেনেহিঁচড়ে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলালো। সবাইকে দেখলেও ইফতেখার মির্জাকে দেখলো না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে ধ্রুব। অনিকের অবস্থা খারাপের দিকে গিয়েছে এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। একটা প্রাণের সঙ্গে কতগুলো মানুষ জড়িত। বেঁচে থাকতে মূল্য দেয়া হয় না এরপর হারালে কদর বাড়ে। অনিকের বেলায়ও হলো তা। বেঁচে থাকাকালীন দু’পয়সার মূল্য কেউ দিলো না। এখন কোটি টাকা খরচা শেষ তবুও ছেলের উন্নতি হলো না। অনিককে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার জন্য রেডি করা হচ্ছে। অঝরে কাঁদে দ্যুতি।
“ওকে দেখবি চল।”
নীরব রইলো সে।
“কাছে গিয়ে একবার ডাক। হয়তো মিরাক্কেল কিছু হতেও পারে।”
“যাব না।”
“কেন?”
নীরব রইলো দ্যুতি।
“আচ্ছা একবার হাতে হাত রাখ। হয়তো কিছু একটা হতেও পারে।”
“যাব না।”
“বাচ্চারা যেমন মায়ের গন্ধ খোঁজে হয়তো ওর হৃদয় তোকে খুঁজছে! যদিও এটা একান্তই আমার মনের কথা।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় দ্যুতি।
“চল।”
হাত ধরে টেনে নিতেই চেঁচিয়ে উঠলো,”না যাব না। আমি দেখতে পারব না।”
“ভয়ের কিছু নেই দেখ আমি আছি।”
ভাইকে জড়িয়ে ধরলো দু-হাতে।
“না।”
হতাশ হয় ধ্রুব। মাথার চুলে আঙ্গুল গুঁজে বুলাতে লাগলো।
“দ্যুতি,শুনবি না ভাইয়ের কথা?”
“ও যদি কখনো জানতে পারে আমি ওকে দেখতে এসেছি তাহলে ওর অহংকার বেড়ে যাবে।”
এমন কথা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি ধ্রুব।
“পাগল হয়েছিস? ওর বাঁচারই তো গ্যারান্টি নেই।”
স্ট্রেচারে করে মুমূর্ষু অনিককে আইসিইউ রুম থেকে বের করতেই ভাইকে খামচে ধরে মুখ গুঁজল বুকে। তাকাবে না সে। অনিককে ওমন অবস্থায় দেখতে পারবে না। কিছুতেই না। লিফটে করে নিচে নিয়ে দ্রুত এম্বুল্যান্সে তুলে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলো। চোখের সামনে মূর্ছা গেল মূহ্যমান আদনীন ফেরদৌস। বুক থেকে মুখ তুলে ভীত চোখে তাকায় দ্যুতি। বিষন্ন মুখে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলো দু’জন। গন্তব্য ঠিক কোথায় জানে না। চোখে ঝাপসা দেখার কারণে ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলো না দ্যুতি। আকস্মিক মুখ থুবড়ে পড়তেই ধরে ফেললো ধ্রুব। তবুও কপালে ব্যথা পেলো।
“ইশ! সাবধানে হাঁটবি তো।”
উঠিয়ে দাঁড় করায়।
“দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?”
পর্যবেক্ষণ করলো। কপালের এক অংশ ফুলে গিয়েছে। ভীষণ খারাপ লাগলো। ফর্সা গাল দুটোয় তার হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পড়ে গিয়েছে। গিল্টি ফিল হলো। আসলেই তখন মাথায় কাজ করছিলো না। হঠাৎই হয়ে গেল সব। হাঁটতে নিতেই পারলো না পা মচকে গিয়েছে। পা ধরে কাতরায়। আচমকা পাঁজাকোলে তুলতেই জড়িয়ে ধরলো ভাইয়ের গলা। আহ্লাদে বুক ফেটে কান্না আসে দ্যুতির। ফুলেফুলে কাঁদে। নীরব রইলো ধ্রুব। কাঁদতে দিলো। কাঁদা উচিৎ! হালকা হয়ে মন শক্ত করা উচিৎ! নিরবচ্ছিন্ন পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। মৃদু মৃদু হাওয়ায় টুপটুপ করে ম্যাগনোলিয়ার বৃষ্টি বয়। যেন রাতটা আজ ওদের ভাইবোনের জন্যই শুধু। আর তাদের স্বাগত জানাচ্ছে অজস্র ম্যাগনোলিয়ারা। কোথায় যাচ্ছে ঠিক নেই শুধু হাঁটছে। হঠাৎ পায়ের উপর নজর পড়লো।
মায়াকুমারী পর্ব ৪২
কি সুন্দর তার বোনের পাজোড়া কিন্তু খালি! মনে পড়ে ছোটবেলার দৃশ্য। তার পিঠে উঠে মাড়াতো এই দু’পা দিয়ে। সুন্দরী হওয়ায় ছোট্টবেলায় দেখতেও বার্বিডলের মতো কিউট ছিল। আধো আধো বুলিতে তাকে মিষ্টি স্বরে ডাকতো! আদ্র হলো হৃদকুঠিরের অভ্যন্তর। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। বুক ভেসে গেল তপ্ত জলে। আহ্লাদী দ্যুতির আরও কান্না পায়। দ্যুতির মনে হলো সে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী! যার কোনো হেটার্স নেই। তার বাবা-মা ভালো,ভাই-ভাবী ভালো,বান্ধবী ভালো,সে যাকে ভালোবাসে সেও ভালো,তার চরিত্রও ভালো,সবাই ভালো সবাই।