মায়াকুমারী পর্ব ৪৫
মেহেরিন আনজারা
তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সূর্যটা ব্রিজের একদিক থেকে সাগরে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। আকাশে কমলা,সোনালি আর হালকা বেগুনি রঙের খেলা। গোল্ডেন গেট ব্রিজের নিচে সমুদ্র তটে দাঁড়িয়ে রয়েছে জ্যাক,অলিভার এবং অ্যারোন। প্রায়ই ঘুরতে আসে তিন বন্ধু তেমনি আজও। মাঝেমধ্যে ধ্রুবও আসতো কিন্তু এখন ও নেই। হালকা কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরেছে চারপাশকে। সমুদ্রের গায়ে রৌদ্রের শেষ আলো চিকচিক করছে। নীরব হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। হঠাৎ জ্যাক একটা পাথরের উপর বসলো। কেডস খুলে পা ছুঁইয়ে দিলো ঠান্ডা পানিতে।
“দোস্ত জানিস,আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমি ভাবতাম এই ব্রিজের নিচে স্বপ্ন জমা থাকে।”
অলিভার বলল,”স্বপ্ন?”
“হুম। যারা অনেক দূর যেতে চায় কিন্তু যেতে পারে না তাদের স্বপ্নগুলো নাকি এখানকার স্রোতে মিশে যায়।”
“তাহলে আমারও একটা স্বপ্ন এখানে রেখে যাবো আজ।”
অ্যারোন বলল,”কীসের?”
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিলো পানির দিকে। ওরা দু’জন চুপ করে তাকিয়ে রইলো। ঢেউ এসে কাগজটা ভিজিয়ে নিয়ে গেল যেন স্বপ্নটা সাগরের গভীরে টেনে নিচ্ছে। হাওয়া বয়ে যায়,সিল্কি চুলগুলো উড়তে লাগলো আর সেই সন্ধ্যার আলোয় তাদের মুখে ফুটে উঠে এক অপূর্ব প্রশান্তি। হঠাৎই সেই শান্ত মুহূর্তের বুক চিরে ভেসে এলো এক বিভীষিকাময় শব্দ!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ঝুপ!”
চমকে উঠলো ওরা। গোল্ডেন গেট ব্রিজের একদিক থেকে কেউ যেন স্রোতের বুক চিরে নিচে পড়েছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে এক মুহূর্তের স্তব্ধতা,তারপর জল ছুঁয়ে উঠলো সাড়া জাগানো ঢেউয়ের শব্দ।
“কে! কে ছিল ও?”
একসাথে বলে চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করলো ওরা। ব্রিজের ওপরে একটা সাদা ওড়না বাতাসে উড়ছে,ধীরে ধীরে ভেসে ভেসে নিচে নামছে। ওদের ঠিক সামনে সমুদ্রের জলে।
“একটা মেয়ে ছিলো ঝাঁপ দিলো।”
কণ্ঠ কাঁপছিল অ্যারোনের। জ্যাক বলল,”ওহ নো! কিছু একটা করতে হবে!”
দৌড় দিতে শুরু করলো পানির দিকে। কিন্তু পানির মধ্যে এখন শুধু স্রোত,ঢেউ আর কিছু উড়ে আসা কুয়াশা। বুশরার কোনো চিহ্ন নেই। যেন মুহূর্তের মধ্যেই সাগর গিলে ফেলেছে তাকে। আর তখনই ওরা দেখতে পেলো একটা হাত জল থেকে একটু ওপরে উঠেছে তারপর আবার নিখোঁজ। ওরা জানে না সেই মেয়েটি কে,কী তার গল্প,কী ছিলো তার যন্ত্রণা কিন্তু সেই সাদা ওড়না তখনও বাতাসে উড়ছে,যেন রেখে গিয়েছে এক নিঃশব্দ আর্তনাদ। চোখ রাখলো পানির ঢেউয়ের ফাঁকে। অলিভার ৯১১-এ কল করলো কিন্তু তার চোখ দুটো সমুদ্রের দিকে। হঠাৎই দূরে অল্প দূরত্বে মাথা ভেসে ওঠলো বুশরার!
“ওই তো! ও দেখ!”
চিৎকার করে বলল জ্যাক। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে জলে ঝাঁপ দিলো। ঠান্ডা পানিতে শরীরটা কেঁপে উঠলেও লক্ষ্য রাখলো মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে কিনা। অলিভার বলল,”তুই পারবি জ্যাক?”
জ্যাক সাঁতরে গিয়ে বুশরাকে ধরে ফেললো। বুশরা প্রায় নিস্তেজ,ঠোঁট নীল হয়ে আছে কিন্তু তার বুক উঠানামা করছে। সে বাঁচতে চায়,অন্তত শরীরটা তাই বলছে। এক হাতে তাকে ধরে ফিরতে শুরু করলো আরেক হাতে সাঁতরায়। ততক্ষণে ওরা আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা ডাল টেনে বাড়িয়ে দেয় পানির দিকে। দুই হাতে মেয়েটিকে টেনে তোলে তারা। মেয়েটি কাঁপছে,কাশি দিচ্ছে,গলায় জমে থাকা পানি উগড়ে দিচ্ছে। অলিভার তার শরীরের কোট জড়িয়ে দিলো আর জ্যাকের হাত তখনও তার পিঠে। ততক্ষণে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে চলে এলো। বুশরাকে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালে। জ্ঞান ফিরল না। ওরা পিক তুলে স্ক্যান করতে লাগল ওর পরিচয়। হুট করে পিকচারসহ বেরিয়ে এলো নাম-পরিচয় সব। বুঝতে পারল বাঙালি। হুট করে মনে পড়ল ধ্রুবর কথা। ধ্রুব নিশ্চয়ই মেয়েটিকে চিনবে। কল করল তাকে। নিশুকে বুকে নিয়ে ধ্রুব তখন ঘুমাচ্ছিল। বারবার ফোন ভাইব্রেট করতেই পিক করে ঘুমু ঘুমু গলায় বলল,”হ্যালো।”
“ধ্রুব একটা জরুরি সংবাদ আছে।”
“কী?”
ওপাশ থেকে যা বলল তার জন্য প্রস্তুত ছিল না ধ্রুব। ফোন রেখে নিশু যাতে টের না পায় আস্তে করে তার মাথা বালিশে রেখে শোয়া থেকে উঠে বসল ধ্রুব। নড়েচড়ে উঠল নিশু। সর্তক দৃষ্টি ফেলল ধ্রুব। ঘুমুঘুমু গলায় জিজ্ঞেস করল,”কোথায় যাচ্ছ?”
চমকায় ধ্রুব।
“কোথাও না। ঘুমা,তুই।”
পিটপিট করে তাকায় নিশু। বিছানা থেকে উঠে গায়ে শার্ট জড়াল ধ্রুব এবং লাগেজ গুছাতে লাগল। কলিজা কেঁপে উঠল নিশুর।
“কোথায় যাচ্ছ?”
“একটা জরুরি কাজে আমেরিকা ফিরতে হচ্ছে,নিশু।”
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো নিশুর মাথায়।
“কী!”
“হ্যাঁ।”
আকস্মিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নিশু।
“কেন?”
“পরে বলব।”
“না,এখুনি বলো।”
“পাগলামি করিস না।”
“এ্যানির কাছে ফিরছ?”
“না।
“তোমরা সব ছেলে এক। নারীলোভী।”
চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠল নিশু।
“নিশু,শোন!”
“শুনতে হবে না। যাও,চলে যাও। তোমার মতলব তো বহুবছর ধরে খারাপ। ভুল ছিলাম আমি।”
লাগেজ সমেৎ কেবিন থেকে বের করে দিলো ধ্রুবকে। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল ধ্রুব। নিশু বারবার তাকে ভুল বুঝে। শুধু নিশু না,সবাই। কেউই কখনো তাকে বুঝার চেষ্টা করে না। সেও তো রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সময় বিলম্ব না করে দ্রুত লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটল। বিমানবন্দর যেন তার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে।
মায়াকুমারী পর্ব ৪৪
ঘড়ির কাঁটা যেন আরও দ্রুত ঘুরছে। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সময় তার সঙ্গে খেলা করছে। প্রাইভেট জেটের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে সময় লাগল মাত্র অল্প কিছুক্ষণ। বন্ধুরা ইতিমধ্যেই সমস্ত পেপারও প্রস্তুত করেছে ভিসা,মেডিকেল সার্টিফিকেট,টিকেট। ধ্রুব শুধু জেটে চেপে বসল। ইঞ্জিন গর্জন করে জীবনের মতোই শক্তিশালী শব্দে ধ্রুবকে ঘিরে ধরল। আকাশে ধ্রুবের চোখে উঁচু অজানা শহরের আভা।