মায়াকুমারী পর্ব ৪৭
মেহেরিন আনজারা
আকস্মিক কয়েক কদম এগিয়ে শক্ত করে বুশরার হাত চেপে ধরতেই ধাক্কা দিলো ধ্রুব। পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিলেন ইফতেখার মির্জা। এমনটার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। উনার চোখ লাল হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত,কণ্ঠে গর্জন,”এত বড় সাহস তোমার!”
কয়েক কদম এগিয়ে বুক সোজা টানটান করে উনার মুখোমুখি দাঁড়াল ধ্রুব।
“ও যেতে চাচ্ছে না। জোর করবেন না।”
শান্ত কণ্ঠে বললেও যেন তাতে মিশেছিল হুমকি,ঝড়! ইফতেখার মির্জা এক পা বাড়াতেই ফরহাদ ধ্রুবের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে আগুন,কণ্ঠে হুঙ্কার।
“তোকে শেষ করে ফেলব আজ!”
বলেই ধ্রুবকে ঘুষি দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরহাদ। মুহূর্তেই ধ্রুব পাশ কেটে দাঁড়াল,আরেক পলকে পায়ের জোরে তীব্র এক লাথি মারতেই ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল ফরহাদ।
“কথা কানে যায় না?”
থরথর করে কাঁপছে বুশরা। ইফতেখার মির্জার চোখ জ্বলছে ক্রোধে কিন্তু ধ্রুবর অগ্নিমূর্তি দেখে কিছুটা স্থির থাকলেন। ইফতেখার মির্জা ধ্রুবর দিকে তেঁড়ে গেলেন। মুখে ঘৃণা আর ক্রোধ।
“এত বড় সাহস তোর! তুই জানিস আমি কে? আমি চাইলে..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ধ্রুব বজ্র গতিতে হাত বাড়িয়ে উনার কলার চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল,”হ্যাঁ,আমি জানি আপনি কে। মন্ত্রী! ক্ষমতা দেখান আপনার চেম্বারে গিয়ে,হাসপাতালের ভেতরে নয়। এখানে একজন অসুস্থ মানুষ জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়ছে,আর আপনি জোর করে একটা মেয়েকে টানাটানি করছেন! তাও কিনা তার অমতে বিয়ে দেওয়ার জন্য!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইফতেখার মির্জার শ্বাস আঁটকে এলো। চারপাশের সিকিউরিটিগুলো অস্থির কিন্তু ধ্রুবর আগুনে ভরা চোখ দেখে কেউ এগোতে আর সাহস করল না। ধ্রুব আরও শক্ত করে কলার চেপে ধরল।
“আর একবার ওর গায়ে হাত দিবেন,শপথ করে বলছি এই হাসপাতালের মেঝেতেই আপনাকে হাড়গোড় ভাঙা অবস্থায় ফেলে রেখে যাব।”
বুশরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ। নার্সরা দৌঁড়ে এসেছে,পরিবেশ টানটান উত্তেজনায় জমাট। ইফতেখার মির্জা এবার জোর করে ধ্রুবর হাত সরাতে চাইল কিন্তু তার শক্তি এতটাই অচল যে নড়ানো গেল না। চারপাশের বাতাসে যেন গুমোট শ্বাসরোধী আবহ। এক মুহূর্তের ঝড়,বিস্ফোরণের আগে আগুনের গন্ধ।
“আপনি মন্ত্রী হতে পারেন,ক্ষমতার জোর দেখাতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন,হাসপাতালের ভেতরে আমার সামনে আর কোনোদিন এভাবে ওর গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আজ যদি আমি চাইতাম,আপনার এই গলা এখানেই ভেঙে দিতাম।”
এক ঝটকায় কলার ছেড়ে দিলো। ধপ করে পেছনে দুলে পড়লেন ইফতেখার মির্জা। কণ্ঠে দম আঁটকানো রাগ কিন্তু চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ও জমে গিয়েছে। ফরহাদ কাতর শব্দ করতে করতে মেঝে থেকে উঠতে চাইছে,সিকিউরিটিরা ছুটে গেল তার দিকে কিন্তু ধ্রুব ততক্ষণে বুশরার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিলো পাশে।
“চলো।”
বুশরা হতবাক,চোখ ভিজে গিয়েছে। ভয় আর স্বস্তি মিলে গলায় আঁটকে আছে তার শব্দ। ধ্রুবর হাতের দৃঢ়তায় একটুও প্রতিরোধ করল না। দরজার কাছে পৌঁছে ধ্রুব একবার ঘুরে তাকাল। চোখ সোজা ইফতেখার মির্জার চোখে ঠেকিয়ে দিলো আগুনের মতো দৃষ্টি।
“এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। আবার চেষ্টা করলে,আপনার নাম আর পদবী কোনো কাজে আসবে না।”
কথা শেষ করেই ধ্রুব বুশরাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আইসিইউ করিডোরে ভিড় জমে উঠেছে। সবার মুখে ফিসফাস,উত্তেজনা আর আতঙ্কের ছাপ। বুশরা ধ্রুবর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে না কিন্তু অনুভব করছে আজকের দিনটা হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর,তবুও সবচেয়ে নিরাপদ মুহূর্তও। হাসপাতালের করিডোরে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিল ধ্রুব। বাইরে বের হয়েই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগল। চারপাশে কিছু পলিস,সাংবাদিক,লোকজন। কেউ কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু ধ্রুবর চোখে একটুও দ্বিধা নেই। মুখে শুধু হাড়কাঁপানো কঠিন ভাব। বুশরা থরথর করে কাঁপছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে বলল,”আমার জন্য কেন ঝামেলায় জড়াতে গেলেন? আমার বাবার ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। উনি আপনাকে ছেড়ে দিবেন না আমি শিওর। যেভাবেই হোক উনি রিভেঞ্জ নিবেন।”
ধ্রুব থেমে দাঁড়াল। বুশরার দিকে ফিরে তাকাল,চোখে আগুন,তবুও কণ্ঠে অদ্ভুত শান্ত দৃঢ়তা।
“তোমাকে নিয়ে কেউ জোর করলে,সেটা মন্ত্রী না প্রধানমন্ত্রী আমি থামব না। মনে রেখো,আজকে যদি আমি চুপ করতাম,কালকে তুমি হয়তো আর থাকতেই না।”
বুশরার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো। কাঁদতেও লাগল। এমন মানুষ কি সত্যি হয়? নিশুর কপাল কত ভালো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
“আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমার বাবা ছাড়বে না কাউকে।”
ধ্রুব ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখল। কণ্ঠ ভারী কিন্তু আশ্বাসের মতো দৃঢ়-“ভয় পেও না। কেউ ছুঁতে পারবে না। যতক্ষণ আমি আছি,তুমি নিরাপদ।”
হঠাৎ ধ্রুবর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার। একঝলক তাকিয়ে ফোন কেটে দিলো। আবারও বেজে উঠল।
“শুরু হয়ে গিয়েছে। ওরা পেছনে লেগেই থাকবে কিন্তু আমি ওদের শত্রুতা নিতে ভয় পাই না।”
বুশরা অবাক হয়ে ধ্রুবর মুখের দিকে তাকাল। সেই মানুষটা,যাকে সে ভাবতো শুধু শান্ত,নীরব,গম্ভীর,মুডি আর নিজের জগতে থাকা অথচ আজ তাকে দেখছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে। অগ্নির মতো তেজ,সাগরের মতো গভীরতা আর পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সি থামাল। বুশরাকে ভেতরে বসার ইঙ্গিত দিলো। দরজা বন্ধ করার আগে একবার আকাশের দিকে তাকাল। গাড়ি ধীরে ধীরে হাসপাতাল চত্বর ছাড়ল। পেছনে রইল উত্তেজনায় ভরা ভিড় আর ইফতেখার মির্জার দম আঁটকে আসা চোখ-মুখ। সরাসরি এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলো ওরা। বুশরা বারবার জানালার বাইরে তাকাচ্ছিল। মুখ শুকিয়ে গিয়েছে,ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে হালকা। এক ফোঁটা কথাও বলতে পারছিল না। ট্যাক্সির ভেতর শুধু ইঞ্জিনের শব্দ। ধ্রুব চুপচাপ কিন্তু চোখে ভয়ানক সতর্কতা। মাঝে মাঝেই রিয়ারভিউ মিররে তাকাচ্ছিল। সত্যিই একটা কালো এসইউভি অনেকক্ষণ ধরে ট্যাক্সির পেছনে চলছে।
“আপনি দেখছেন?”
“হ্যাঁ,চিন্তা করো না। এরা চাইলে এখনই নামবে কিন্তু আমি নামতে দিবো না।”
এয়ারপোর্টে পৌঁছাতেই আরও স্পষ্ট হলো চাপ। লাগেজ চেক-ইনের সময় দু’জন অচেনা লোক খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তাদের চোখে সন্দেহ,ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। ধ্রুব বুঝল ওরা ইফতেখার মির্জার লোক। পাসপোর্ট দেখাতে গিয়ে বুশরার হাত থরথর করে কাঁপছিল। কাউন্টার অফিসার ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ধ্রুব হালকা হাসি দিয়ে বিষয়টা ঢাকল।
“ও অসুস্থ,মেডিকেল কেস। দয়া করে তাড়াতাড়ি ক্লিয়ার করে দিন।”
বোর্ডিং পাস হাতে পেয়ে একটু নিঃশ্বাস ফেলল বুশরা কিন্তু ধ্রুবর চোখে সেই স্বস্তি নেই। গেটের দিকে এগোতে এগোতে ফোনটা বন্ধ করল।
“এখন থেকে কেউ আমাকে ট্রেস করতে পারবে না।”
প্লেনে ওঠার পরও উত্তেজনা কাটল না। জানালার পাশে বসে বুশরা গা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল কিন্তু ঘুম এলো না।বারবার কানে বাজছিল ইফতেখার মির্জার সেই ঠান্ডা কণ্ঠ,”আমাকে হয়রানি করার পরিণাম খারাপ হবে তোমার।”
ধ্রুব হেডরেস্টে হেলান দিয়ে বসেছিল কিন্তু চোখ একটুও বন্ধ করল না। যেন চারপাশে অদৃশ্য হুমকি খুঁজছে। তার মুঠোয় বুশরার হাত শক্ত হয়ে আছে।
“ভয় পেয়ো না। আমরা সরাসরি সিঙ্গাপুরে যাব তারপর মাউন্ট এলিজাবেথে। সেখানে ওরা কিছুই করতে পারবে না।”
ফ্লাইট কাঁপল হালকা টার্বুলেন্সে। বুশরা ধড়মড় করে ধ্রুবর হাত আঁকড়ে ধরল।
“দেখো,আমরা নিরাপদ আছি। যতক্ষণ না আমি আছি।”
প্রায় দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা ভ্রমণ শেষে অবশেষে প্লেন নামল সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্টে। টানা ক্লান্তিকর যাত্রায় শরীর ভেঙে পড়েছে দু’জনের,তবুও নামার মুহূর্তে যেন স্বস্তির শ্বাস নিতে পারল বুশরা। কেবিনের ভেতরের আলো নিভে আসতেই জানালার বাইরে তাকাল। রানওয়ের ঝলমলে আলো চোখে ধাক্কা দিলেও মনে হচ্ছিল কেবল অচেনা অন্ধকারে নেমে এসেছে। নিঃশ্বাস ফেলল বুশরা,তবে চোখের কোণে জমে থাকা ভয়ের রেখা মুছে গেল না। ধ্রুব লক্ষ্য করল,তার ভিতরের অস্থিরতা বাইরে আড়াল করার চেষ্টা করলেও শরীরের প্রতিটি ভঙ্গিতে অস্বস্তি স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক যাত্রার ক্লান্তি স্পষ্ট। এয়ারপোর্টের ভিড় আর উষ্ণ আর্দ্র বাতাস পেরিয়ে ধ্রুব দ্রুত হোটেলের দিকে এগোল। রিসেপশন থেকে রুম বুক করল,দু’জনের জন্য আলাদা আলাদা। রুমে ঢুকতেই চিলতে বেডের উপর শরীর ঢেলে দিলো বুশরা। ধ্রুবও নিজেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আরামদায়ক বেডে। দীর্ঘ পথচলার ক্লান্তি মুছে নিতে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস থামিয়ে রইল। চোখ বন্ধ করেই দুইজন অনুভব করল যাত্রার চাপ আর অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমে এসেছে কিন্তু মনেই ভয়ের ছাপ থেকে যায়,যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের আকাশে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলো। মেরিনা বে’র ধারে রূপালি আলোয় ঝিকিমিকি করছে সুপারট্রি গ্রোভের দানবীয় গাছেরা। দূরে সমুদ্রের ঢেউ হালকা শব্দে আছড়ে পড়ছে পাথরের বাঁধে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অর্কিডের মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু হাসপাতালের কেবিনের ভেতর এই অনন্ত সৌন্দর্যের এক বিপরীত জগৎ ঘন হয়ে আছে বিষণ্নতা,বেদনা আর হিংস্র এক বিস্ফোরণ। গরম গরম চিকেন কর্ন স্যুপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠে আসছে কাঁচের বাটির ওপর দিয়ে। নিশু ধীরে ধীরে একেক চামচ করে তুলে দিচ্ছে আসাদ সাহেবের মুখে। তিনি চোখ বন্ধ করে স্যুপের স্বাদ নিচ্ছেন যেন বহুদিন পর জীবনটা কিছুটা শান্তি পেয়েছে। নিশু আবোলতাবোল বকবক করছে। সেই কখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করে বকা দিচ্ছে উনাকে।
“একটু ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। খালি টেনশন আর টেনশন করেন। এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
তপ্ত শ্বাস ফেলল নিশু।
“টেনশন করে কী লাভ হয় আপনার বলুন তো! বয়স হয়েছে। এখন খাবেন-দাবেন আর রেস্ট নিবেন। তা না,উনি খালি টেনশন করেন। এখন কষ্টটা কে পাচ্ছে শুনি!”
নিশুর আদুরে বকাগুলো স্যুপের সাথে হজম করতে মন্দ লাগছে না আসাদ সাহেবের বরং বেশ লাগছে। পুত্রবধূর আদুরে বকা খেতেও সৌভাগ্য লাগে। পাশে বসে থাকা দিলরুবা খাতুন ঠোঁট নেড়ে নীরবে জিকির করছেন। উনার কণ্ঠে উদ্বেগের ছায়া,চোখে এক চাপা আতঙ্ক। কিছু না বলেই ধ্রুব হঠাৎ আমেরিকা ফিরে গিয়েছে। একটা ফোনও করেনি এই অব্ধি। নিশু এখনও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কাঁদলে চোখ-মুখ কেমন ফুলে লাল হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলেও স্বীকার হয় না উল্টো বলে মাথাব্যথা। নিশুর কষ্ট বুঝে সবাই কিন্তু কিছু করার নেই। কী আর করবে। ভাগ্যে নেই। ভাগ্য থাকলে সেই জিনিস হামাগুড়ি দিয়ে আসে।
সোফার এক কোণে চুপচাপ বসে রয়েছে দ্যুতি। কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে অজস্রবার। পাশে বসে ধূসর নীরবে ফোন স্ক্রল করছে। তবে তার চোখ যেন অন্য কোথাও,তার ভিতরের অস্থিরতা ফুটে উঠছে পাতলা কপালের রেখায়। ঠিক সেই মুহূর্তে কেবিনের কাচের দরজা খুলে গেল। রোদে পোড়া কাচের ফ্রেম ভেদ করে ঢুকে পড়ল এক অনাহূত রোশনি। ধ্রুবর হাতে হাত রেখে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল বুশরা। পরনে লাল কাতান শাড়ি,কানে ইয়া বড় সোনার ঝুমকা,ঠোঁটে লাল টুকটুকে গাঢ় লিপস্টিক,চোখে তৃপ্তির দীপ্তি আর মুখে অদ্ভুত এক বিজয়ের তীর্যক হাসি।
চারদিক স্তব্ধ। কেবিনের বাতাসটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল যেন বৃষ্টি আসার আগে পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা এক অব্যক্ত অশনি সংকেত। আরেক চামচ স্যুপ তুলতে নিতেই হঠাৎ নিশুর হাত থেমে গেল মাঝপথে। পিছু ফিরতেই চোখ আঁটকে গেল ধ্রুবর হাতে। যে হাতে একদিন ছিল তার ভালোবাসার অধিকার আজ সেই হাত জড়িয়ে আছে বুশরার আঙুলে। টুপ করে পড়ে গেল স্যুপের বাটি। গরম তরল ছিঁটকে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল চকচকে টাইলস এবং ধূসর,দ্যুতির পায়ের ওপর। ধোঁয়া উঠছে। বিস্ফোরিত হয়ে উঠে দাঁড়াল নিশু। শ্বাস আঁটকে রইল,চোখে দাবানল। গলার শিরা ফুলে উঠেছে। আকস্মিক ছুটে গেল বুশরার দিকে। সবাইকে হতভম্ব করে বুশরাকে ধাক্কা দিতেই সে গিয়ে পড়ল সোফার কোণে। ব্যথা পেতেই জোরে আর্তনাদ করে উঠল। রণচণ্ডী রূপ ধারণ করেছে নিশু।
“তুই আমার স্বামীর হাত ধরেছিস কেন? বল! কেন ধরলি তুই ওর হাত?”
বুশরা সামলে উঠতে না উঠতেই চুলের মুঠি চেপে ধরল।
“নিশু,কী করছিস? পাগল হয়েছিস?”
কিন্তু নিশু কিছু শুনছে না। চোখে ঘন অন্ধকার। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো গর্জন,”শাঁকচুন্নি! ডাইনি কোথাকার! তুই মেয়ে না,তুই অভিশাপ! তুই আমার বিশ্বাস নষ্ট করলি! তুই আমার বিশ্বাসের কবর দিলি!”
“এই সব কী হচ্ছে নিশু?”
ধ্রুবকে ধাক্কা দিতেই পড়ে গেল পেছনে,চেয়ারের গায়ে ঠোক্কর খেল। চারপাশ নিঃশব্দ। দিলরুবা খাতুন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসে পড়লেন। দ্যুতি দু’হাত মুখে চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁপছে। নিশুর গলা ফেটে এলো,”তার মানে এই তোমার গার্লফ্রেন্ড তাই না?এজন্যই তুমি আমাকে ফেলে চলে গিয়েছ?”
কোমর চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় বুশরা।
“এই,বিয়ে করেছিস তোরা?এই বল! চুপ থাকবি না!”
শব্দগুলো যেন বিদ্যুৎ। গলা ফাটিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল নিশু।
“কীভাবে! কীভাবে! কীভাবে পারলি তুই? কীভাবে পারলি আমার স্বামীকে কাঁড়তে? কীভাবে পারলি বল? বুক কাঁপল না তোর?”
অবস্থা বেগতিক দেখে উৎকণ্ঠা হলো ধূসর।
“আশ্চর্য ব্যাপার! দাঁড়িয়ে আছো কেন,সার্কাস দেখছ নাকি! থামাও ওকে! ওর তলপেটে সেলাই,রক্তপাত হবে!”
কিন্তু নিশু শুনছে না কিছুই,সে রূপ নিয়েছে এক উন্মত্ত আগ্নেয়গিরির। এবার দু’হাতে বুশরার গলা চেপে ধরল। বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। নিশুকে টেনে সরাতে চাইল ধ্রুব,ধূসরও হাত বাড়াচ্ছে কিন্তু সে বুশরাকে জড়িয়ে ধরেছে পিশাচীর মতো।
“আমার স্বপ্ন! আমার ভালোবাসা! কীভাবে,কেমন করে পারলি তুই ছিনিয়ে নিতে? বুক কাঁপল না তোর?তোকে ওর নাম্বার দেওয়াই ভুল হয়েছিল। ওর নাম্বার নিয়ে আমাদের সবার অজান্তে লাইন লাগিয়েছিস তাই না? আমাদের বোকা বানিয়েছিস তুই! ছাড়ব না তোকে! বান্ধবী নামের কলঙ্ক তুই।”
মায়াকুমারী পর্ব ৪৬
নিশুর চুল এলোমেলো। চোখে রক্ত। ঠোঁটে পিচ্ছিল কান্নার রেখা। বাইরে তখন হঠাৎ শুরু হয়েছে এক হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সুপারট্রিগুলো আলোয় ভিজছে। আর কেবিনের ভেতরে অরণ্যের মতো এক নিশুর গর্জন,বিশ্বাসঘাতকতার চিৎকার আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আসাদ সাহেব থমকে রইলেন। শ্বাস নিতে ভুলে গেলেন। মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগলেন দিলরুবা খাতুন। কীভাবে পারল ধ্রুব এমনটা করতে?সে কি জানতো না নিশু তাকে কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে!